মুসলিম অভিবাসীদের প্রতি নিত্যদিনের বৈষম্য যেভাবে ফ্রান্সের সহিংসতায় ইন্ধন জুগিয়েছে

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক, ৮ জুলাই ২০২৩: গত ২৭ জুন ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের শহরতলির একটি তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে কিশোর নাহেল নিহত হওয়ার জেরে সহিংস বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল গোটা শহর। পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, নির্দেশনা না মেনে পালিয়ে যাওয়ার সময় উত্তর আফ্রিকান বংশোদ্ভূত নাহেল নামের ১৭ বছর বয়সী ঐ কিশোরকে গুলি করা হয়।

বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, স্যোসাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, পুলিশের দুই কর্মকর্তা গাড়িটি থামানোর চেষ্টা করছেন। তাঁদের একজন গাড়ির জানালা দিয়ে চালকের দিকে অস্ত্র তাক করেন। চালক গাড়ি চালানো শুরু করলে খুব কাছ থেকে গুলি করেন পুলিশের ওই কর্মকর্তা। কয়েক মিটার দূরে গিয়ে গাড়িটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। বুকে গুলিবিদ্ধ নাহেলকে জরুরি চিকিৎসা দেয়া হলেও বাঁচানো যায়নি। গুলিবর্ষণকারী অফিসারটিকে হত্যার অভিযোগে আটকও করা হয়। তার বিরুদ্ধে ‘ইচ্ছেকৃতভাবে খুনের’ অভিযোগ আনা হয়েছে।

পুলিশ কৃর্তক নেহাল হত্যার প্রতিবাদে ২৭ জুন রাত থেকেই প্যারিস ও অন্য আরো কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ ও সহিংসতা শুরু হয়। ছবি : গ্লোবাল নিউজ

এ ঘটনার প্রতিবাদে ২৭ জুন রাত থেকেই প্যারিস ও অন্য আরো কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ ও সহিংসতা শুরু হয়। গাড়ি ও বাসস্টপে আগুন দেয়া হয়, কিছু রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়া হয়, আক্রান্ত হয় পুলিশ স্টেশনও।

অভিযুক্ত পুলিশ অফিসার অবশ্য নাহেলের পরিবারের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।

ধারণা করা হয় নাহেলের মৃত্যু ফ্রান্সে বর্ণবাদ এবং সংখ্যালঘু জাতি-গোষ্ঠীর মানুষদের প্রতি পুলিশের বৈষম্যমূলক আচরণের ব্যাপারে ক্ষোভ উস্কে দিয়েছিল এবং পুরো ফ্রান্স সহিংস বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছিল।

কে এই নাহেল?

বিবিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্যারিসের নানতেরে শহরেই বেড়ে ওঠেন ১৭ বছর বয়সী নাহেল এম। তিনি খাবার ডেলিভারির কাজ করতেন এবং রাগবি লিগে খেলতেন। একমাত্র সন্তান নাহেলকে বড় করেছেন তার মা। ইলেকট্রিশিয়ান হতে চেয়েছিল নাহেল। আর সেজন্যে যে এলাকায় তার বসবাস ছিল, তার কাছেই সুরেসনেসের একটি কলেজে ভর্তি হয়েছিল সে। যারা নাহেলকে চেনেন, তাদের ভাষ্য অনুযায়ী নাহেল ভালো ছেলে ছিল এবং সবাই তাকে ভালোবাসতো।

নাহেল ও তার মা মোনিয়া আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত, তবে তার বাবা সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। আগের কোন সমস্যায় জড়িয়ে পড়ার কারণে পুলিশের কাছে সে পরিচিত ছিলো। তবে নাহেলের পরিবারের আইনজীবী জোর দিয়ে বলছে, তার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে কোনো অপরাধের রেকর্ড নেই।

ফ্রান্সের অনেকেই মুসলিম অভিবাসনকে সমস্যা হিসাবে দেখে

বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশের গুলিতে নাহেলের মৃত্যুর আগে কয়েক সপ্তাহে ধরে ফ্রান্সের প্রথম সারির কিছু মিডিয়ায় এবং বেশ কজন রাজনীতিকের মুখ থেকে  মুসলিম এবং আলজেরীয় অভিবাসীদের সম্পর্কে খুবই উস্কানিমূলক বক্তব্য বা বিবৃতি শোনা গেছে। উদাহরণ হিসাবে ফ্রান্সের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডুওয়ার্ড ফেলিপে’র এক সাক্ষাৎকারের কথা বলা যায়। জুনের প্রথম দিকে মিডিয়াতে দেয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে অভিবাসন আইনে ব্যাপক সংস্কারের আহ্বান জানান তিনি। তার মতে অনেক ফরাসী বিশ্বাস করে যে  দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রজন্মের অনেক অভিবাসীও ফ্রান্সের সত্যিকারের নাগরিক হতে পারেনি। তারা মনে করে এসব অভিবাসী শিক্ষা বিমুখ, সমাজে তাদের কোনো অংশগ্রহণ নেই এবং ফ্রান্সের নাগরিক রীতিনীতির তারা ধার ধারেনা। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী  স্পষ্ট গলায় বলেন, ফ্রান্সের অনেক নাগরিক মুসলিম অভিবাসনকে সমস্যা হিসাবে দেখেন। তিনি বলেন মানুষের এসব উদ্বেগকে অবজ্ঞা করা উচিৎ নয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, অস্বস্তিকর বিষয় এবং ভীতিকর বিষয়।

বিবিসি’র ঐ প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয় যে, কিছুদিন আগে ফ্রান্সের সবচেয়ে জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল , বিএফএম টিভি, লিওঁ শহরের একটি স্কুলের গেটের মুখের ভিডিও ফুটেজ তুলে দেখায় যে কতজন ছাত্রী ইসলামী ড্রেস পরে স্কুলে ঢুকছে।

ঐ রিপোর্ট প্রকাশের মূল উদ্দেশ্যই ছিল মানুষকে দেখানো যে জনসমক্ষে ধর্মনিরপেক্ষতার যে রীতি ফ্রান্সে প্রচলিত তা ভেঙ্গে কীভাবে স্কুলে ধর্মীয় আচরণের প্রদর্শন ঢুকে পড়ছে।

স্কুলে ধর্মীয় পোষাক পরে যাওয়া নিয়ে টিভিতে এই বিতর্ক সৃষ্টির আগে নিস শহর থেকে একটি খবর আসে যে সেখানকার একটি স্কুলে ৯ থেকে ১১ বছরের কিছু মুসলিম ছাত্র-ছাত্রী স্কুলের চত্বরে নামাজ পড়েছে।

ঐ ঘটনার পর নিসের মেয়র ক্রিস্টিন এসট্রোসি, যিনি ফ্রান্সের দক্ষিণ-পন্থী একটি রাজনৈতিক দলের নেতা, প্রকাশ্যে ঐ শিশুদের সমালোচনা করেন। সমালোচনা করেন ফ্রান্সের শিক্ষামন্ত্রী পাপ এনদিয়ায়ে-ও।

এদিকে পুলিশের গুলিতে কিশোর নাহেল নিহত হওয়ার পর কিন্তু কিছু দক্ষিণ-পন্থী চিন্তাভাবনায় বিশ্বাসী লোক অভিযুক্ত পুলিশকে আইন সহায়তা দিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্যাম্পেইন শুরু করে মাত্র ক’দিনেই মানুষের কাছ থেকে ১৬ লাখ ইউরো চাঁদা তুলেছে। সেই প্রচারণা অবশ্য সরকার পরে বন্ধ করে দিয়েছে।

বামপন্থী রাজনীতিকরা অবশ্য এই ক্যাম্পেইনের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু দক্ষিণ-পন্থী অনেক রাজনীতিক একে সমর্থন করে বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছেন যে তারা পুলিশের পক্ষে। বিবিসি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব ঘটনা ফ্রান্সের অনেক মুসলিম, এবং বিশেষ করে উত্তর আফ্রিকা থেকে আসা অভিবাসী মুসলিমদের মনে বদ্ধমূল ধারনা তৈরি করেছে যে ফরাসী রাষ্ট্র এবং সমাজে তাদের স্থান নেই, এবং বুঝতে অসুবিধা হয়না যে কেন তারা নাহলের মৃত্যুতে এভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।