আফগানিস্তানে তালেবান বাহিনী একের পর এক জেলায় হামলা চালিয়ে সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে

জারি করছে কঠোর শরিয়াহ আইন

ফ্র্যাংক গার্ডনার    বিবিসির নিরাপত্তা বিষয়ক সংবাদদাতা

জুলাই ৭, 2021

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ঘোষণা অনুযায়ী আফগানিস্তান থেকে পশ্চিমা দেশগুলোর অবশিষ্ট সেনা তাড়াহুড়ো করে এমাসেই প্রত্যাহারের যে সিদ্ধান্ত, সেটি তালেবান বিদ্রোহীদের আরও সাহসী করে তুলেছে।

সাম্প্রতিক দিনগুলোতে আফগানিস্তানে তালেবান বাহিনী একের পর এক জেলায় হামলা চালিয়ে সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। মনোবল হারানো সরকারি সেনারা তাদের ঘাঁটি ছেড়ে হয় পালাচ্ছে, নয়তো আত্মসমর্পণ করছে। এসব ঘাঁটি এখন তালেবান বাহিনীর দখলে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আফগানিস্তানে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদে প্রত্যাবর্তনের অপচ্ছায়া দেখা যাচ্ছে।

নিরাপত্তা এবং সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক একজন বিশ্লেষক ডক্টর সাজান গোহেল বিবিসিকে বলেন, “বাইডেন প্রশাসন আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা সেখানে তালেবানদের প্রত্যাবর্তনকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে। আল কায়েদাকে নতুন করে তাদের নেটওয়ার্ক পুনর্গঠন এর সুযোগ করে দিয়েছে । এর ফলে তারা আবারও বিশ্বজুড়ে হামলার ষড়যন্ত্র করতে সক্ষম হবে।”

তালেবানের কঠোর শরিয়াহ আইন জারিকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে অস্ত্র হাতে রাস্তায় নেমেছেন আফগানিস্তানের নারীরা । ছবি : ফেসবুক

জঙ্গি অভিযানের ব্যাপকতা বাড়ছে

আফগানিস্তান নিয়ে যত ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী করা হচ্ছে, এটি হয়তো তার মধ্যে একেবারে সবচাইতে নেতিবাচক দিকে পড়বে। কিন্তু দুটি জিনিস নিশ্চিতভাবেই ঘটতে চলেছে।

প্রথমত, ১৯৯৬ সাল হতে ২০০১ সাল পর্যন্ত কঠোরভাবে যারা আফগানিস্তান শাসন করেছে, সেই তালেবান কোন না কোন চেহারায় ফিরে আসতে যাচ্ছে।

তালেবান এখনো পর্যন্ত বলে চলেছে যে জোর করে কাবুল দখল করার কোনো ইচ্ছে তাদের নেই। কিন্তু আফগানিস্তানের একটা বিরাট অংশজুড়ে তালেবান এরই মধ্যে নিজেদের এক প্রবল শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আর তাদের কঠোর ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী তারা যে আফগানিস্তানে একটি ইসলামিক আমিরাত প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সেই দাবি কিন্তু কখনোই বাদ দেয়নি।

দ্বিতীয়ত, আল-কায়েদা এবং এর প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামিক স্টেট ইন খোরাসান প্রভিন্স (আইএস-কেপি) কিন্তু সুযোগের অপেক্ষায় আছে, পশ্চিমা সৈন্যরা আফগানিস্তান ছাড়ার পর সেই নতুন পরিস্থিতিকে কিভাবে কাজে লাগানো যায়।

আল-কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেট আফগানিস্তানে আগে থেকেই আছে।

আফগানিস্তান খুবই পর্বতময় এবং বন্ধুর একটি দেশ। সেখানে এমন অনেক দুর্গম এলাকা আছে যেখানে সহজেই আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ গোষ্ঠীগুলো লুকিয়ে থাকতে পারে।

তবে এপর্যন্ত আফগানিস্তানের নিরাপত্তা সংস্থা এনডিএস যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশের বিশেষ বাহিনীর সহযোগিতায় এরকম হুমকির মোকাবেলা করতে পেরেছে।

আফগানিস্তানে হামলা বা বোমা বিস্ফোরণের মতো ঘটনা এখনো ঘটছে। তবে বহুবার এমন ঘটনা ঘটেছে, কোন অনুচরের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অথবা আড়ি পেতে শোনা কোন মোবাইল ফোনের আলাপ থেকে হামলার আঁচ পেয়ে আফগান এবং পশ্চিমা বিশেষ বাহিনী দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পেরেছে। এরকম ব্যর্থ করে দেয়া হামলার ঘটনা আমরা প্রকাশ্যে কমই জানতে পারি।

আফগানিস্তানের ভেতরেই বিভিন্ন ঘাঁটি থেকে পশ্চিমা বাহিনী এরকম পরিস্থিতিতে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ব্যবস্থা নিতে পারতো, অনেক সময় হেলিকপ্টারে করে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে যেতে পারতো। রাতের গভীরে আচমকা তারা শত্রুকে ধরে ফেলতে পারতো।

কিন্তু এসব অভিযানও এখন শেষ হতে চলেছে।

‘ব্রিটেনের জন্য হুমকি বাড়ছে’

তালেবান এ সপ্তাহে এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, ১১ই সেপ্টেম্বরের পর যদি কোন পশ্চিমা সেনা আফগানিস্তানে থেকে যায়, এমনকি কাবুল বিমানবন্দর বা মার্কিন দূতাবাসের পাহারায় থাকা কোন সেনা, সেটিকে তারা দোহা চুক্তির লঙ্ঘন বলে ধরে নেবে। এই চুক্তির অধীনে সব পশ্চিমা সেনার ১১ ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে আফগানিস্তান ছাড়ার কথা।

তালেবান হুমকি দিয়েছে, এরকম থেকে যাওয়া বিদেশি বাহিনীর ওপর তারা হামলা চালাবে।

এ সপ্তাহে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সরকারের অতি গোপনীয় ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল’ বা এনএসসি’র একটি সভায় সভাপতিত্ব করার কথা। আফগানিস্তান ছেড়ে চলে আসার পর সেখানে নিরাপত্তার জন্য কী কী সহায়তার ব্যবস্থা রাখা হবে, সেটা নিয়েই কথা হবে এই বৈঠকে।

সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের সাবেক প্রধান স্যার অ্যালেক্স ইয়াংগার স্কাই নিউজকে বলেছেন, “পশ্চিমারা যদি আফগানিস্তানকে পরিত্যাগ করে, তাহলে ব্রিটেনের জন্য সন্ত্রাসবাদের হুমকি বাড়বে।”

কিন্তু ব্রিটেনের জন্য এটি উভয় সংকট।

যদি ব্রিটেন কয়েক ডজন এসএএস বা অন্য কোন স্পেশ্যাল ফোর্সের সদস্যকে আফগানিস্তানে রেখে আসে, তারা এখন আর কোন সুরক্ষিত মার্কিন ঘাঁটির নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে থাকবে না, তাদের কাছাকাছি সাহায্য করার মতো কোন সামরিক বিমানও থাকবে না। এ অবস্থায় নতুন করে মাথাচাড়া দেয়া তালেবান বাহিনীর সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবে এই ব্রিটিশ সৈন্যরা।

আর যদি তালেবানের দাবি মেনে সব সৈন্যকে ফিরিয়ে আনা হয়, তাহলে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার ব্যাপারে কোন আগাম আভাস গোয়েন্দা তথ্য থেকে পাওয়া গেলে, তার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের কোন উপায় পশ্চিমা দেশগুলোর থাকবে না।

তালেবান-আল কায়েদা আঁতাত

তাহলে তালেবান এবং আল-কায়েদার মধ্যে আসলে ঠিক কী ধরণের সম্পর্ক?

যদি তালেবান কোনভাবে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফিরে আসে, তার মানে কি সেখানে আল-কায়েদার প্রত্যাবর্তন অবশ্যম্ভাবী? আবারও কি সেখানে আল-কায়েদার ঘাঁটি, সন্ত্রাসবাদীদের প্রশিক্ষণ শিবির, কুকুরের ওপর বিষাক্ত গ্যাসের পরীক্ষা- এগুলো দেখা যাবে? যেগুলো বন্ধ করার কথা বলেই ২০০১ সালে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়েছিল?

পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আসলে গত কবছর ধরে এসব প্রশ্ন নিয়েই মাথা ঘামিয়ে চলেছে।

আল-কায়েদার সঙ্গে তালেবানের সম্পর্ক নিয়ে ব্রিটিশ সরকার যে কতটা উদ্বিগ্ন, তা সরকারের ফাঁস হওয়া কিছু দলিলে বেশ স্পষ্ট। এরকম কিছু গোপন দলিল সম্প্রতি প্রকাশ্য ব্রিটেনের রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, এর আগে ২০০৮ সালেও একই ঘটনা ঘটেছিল। এসব দলিল যারাই পড়েছেন, তারাই বুঝতে পারবেন ব্রিটিশ সরকার কতটা উদ্বিগ্ন।

এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের ডঃ গোহেল আফগানিস্তানে চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলোর ব্যাপারে গবেষণা করছেন বহু বছর ধরে। তালেবানের সঙ্গে আল-কায়েদার সম্পর্কটা কী, সে সম্পর্কে তার কোন সন্দেহ নেই।

“তালেবান থেকে আল-কায়েদাকে আলাদা করা যাবে না। এদের মধ্যে মধ্যে অনেক অভিন্ন সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সম্পর্ক আছে, যেটি নেতারা চাইলেও পুরোপুরি ছাড়তে পারবেন না”, বলছেন ডঃ গোহেল।

আগাম লক্ষণ

আল-কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেন যখন ১৯৯৬ সালে তার ঘাঁটি সুদান হতে আফগানিস্তানে নিয়ে যান, তারপর ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে তালেবান তাদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছে।

সেসময় আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে মাত্র যে তিনটি দেশ স্বীকৃতি দিয়েছিল, তার একটি ছিল সৌদি আরব। তখন সৌদি সরকার তাদের নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান প্রিন্স তুরকি আল-ফয়সালকে আফগানিস্তানে পাঠিয়েছিলেন বিন লাদেনকে তাদের হাতে তুলে দিতে তালেবান সরকারকে রাজী করাতে।

তালেবান এতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। আফগানিস্তানে আল-কায়েদার এই ঘাঁটি থেকেই নাইন ইলেভেনের বিধ্বংসী সন্ত্রাসবাদী হামলার পরিকল্পনা এবং তা পরিচালনা করা হয়েছিল।

তবে ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান জেনারেল স্যার নিক কার্টার, যিনি আফগানিস্তানে কয়েকটি অভিযানের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পালন করেন, তিনি বলছেন, তালেবান নেতৃত্ব হয়তো তাদের অতীতের ভুল হতে শিক্ষা নিয়েছে।

তার মতে, যদি তালেবান এবার ক্ষমতার ভাগ চায়, বা ক্ষমতা দখল করতে চায়, তাহলে তারা এবার আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হয়ে থাকতে চাইবে না।

আর সমস্যাটা সেখানেই। তালেবান নেতাদের মধ্যে যারা বিচক্ষণ, বিশেষ করে যারা দোহায় শান্তি আলোচনা চলার সময় সেখানকার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শপিং মলে ভালো জীবনের স্বাদ পেয়েছেন, তারা হয়তো আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার জন্য আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কে পুরোপুরি ছেদ ঘটাতে চাইবেন।

কিন্তু আফগানিস্তানের মতো একটা বিশাল, বিস্তৃত দেশে, যেখানে শাসনব্যবস্থা প্রায় নেই বললেই চলে, সেখানে ভবিষ্যতের কোন তালেবান সরকারও যে আল-কায়েদাকে দমিয়ে রাখতে পারবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। প্রত্যন্ত উপত্যকা আর গ্রামগুলোতে আল-কায়েদা সহজেই নিজেদের শেকড় গাড়তে পারে।

কারণ আল-কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেট গ্রুপ- এদের উভয়েই আসলে একটি বিশৃঙ্খল, অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে আরও ভালোভাবে সংগঠিত হয়। আর আফগানিস্তান থেকে যতরকমের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তাতে বোঝাই যায়, সেরকম একটি পরিবেশই তারা পেতে যাচ্ছে।