নজিরবিহীন বিক্ষোভে উত্তাল শ্রীলঙ্কা

মহা বিপর্যয়ের মধ্যে দেশটির অর্থনীতি

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : সম্প্রতি শ্রীলংকা সরকারের মন্ত্রিসভার ২৬ জন মন্ত্রীর সকলেই পদত্যাগপত্র জমা দিলেও ক্ষমতা ছাড়েননি প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসা এবং তার বড় ভাই প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসা।

জ্বালানি, খাদ্য এবং ওষুধ সরবরাহে অব্যাহত সংকটের মুখে দেশজুড়ে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। সরকারি দলের নেতাদের বাড়ির বাইরে অনেক বিক্ষোভ হচ্ছে। ক্ষুব্ধ বিক্ষোভকারীরা রাজাপাকসা পরিবারের পদত্যাগ দাবি করে বলছেন রাজাপাকসা পরিবার ক্ষমতা না ছাড়লে মন্ত্রিসভার পদত্যাগের এই সিদ্ধান্ত অর্থহীন। খবর বিবিসি নিউজের।

এদিকে চরম অর্থনৈতিক সংকটে গণঅসন্তোষের মধ্যে শ্রীলংকার ক্ষমতাসীন জোটেও ভাঙন দেখা দিয়েছে। ফলে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের নেতৃত্বাধীন জোট। শ্রীলংকা ফ্রিডম পার্টি (এসএলএফপি), শ্রীলংকা পদুজানা পেরামুনা (এসএলপিপি), সিলোন ওয়ার্কার্স কংগ্রেসের (সিডব্লিউসি) ৪২ জন আইনপ্রণেতা ক্ষমতাসীন জোট থেকে বেরিয়ে গিয়ে স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের ঘোষণা দেন।

নজিরবিহীন বিক্ষোভে উত্তাল শ্রীলঙ্কা । বাঁয়ে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসা এবং ডানে তার বড় ভাই প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসা।ছবি: অনলাইন

বিক্ষোভের মধ্যে মন্ত্রিসভার সদস্যদের পদত্যাগের পর প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে সর্বদলীয় সরকার গঠনের যে আহ্বান জানিয়েছে, তাও প্রত্যাখ্যান করেছে বিরোধী দলগুলো। তারা খোদ প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছে। গত ৫ এপ্রিল শ্রীলংকার পত্রিকা আদাদেরনা আরো জানিয়েছে, দেশে জ্বালানির হাহাকার চলেছেই। পরিবহণ প্রায় বন্ধ। খরচ বাঁচাতে ১০-১৩ ঘণ্টা লোডশেডিংও করা হচ্ছে দেশজুড়ে। এরই প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন কলম্বোর জনতা।

কিন্তু গোতাবায়া পদত্যাগ করবেন না বলে জানিয়েছেন তাঁর সরকারের সড়কমন্ত্রী জনস্টন ফার্নান্দো। এদিকে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতির প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ শুরু করেছেন চিকিৎসকেরা। তবে গত ৫ এপ্রিল ইতিপূর্বে জারিকৃত জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। খবর রয়টার্সের

রয়টার্স আরো জানায়, একসময়ের প্রতাপশালী ক্ষমতাসীন জোট আইনপ্রণেতাদের একের পর এক পদত্যাগে অস্বস্তিতে পড়েছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র এক দিনের মাথায় গত ৫ এপ্রিল মঙ্গলবার নতুন অর্থমন্ত্রীও পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। এতে আরও অস্বস্তি বেড়েছে প্রেসিডেন্টের। প্রেসিডেন্টের ভাই বাসিল রাজাপক্ষেকে সরিয়ে গত সোমবার সাবেক বিচারমন্ত্রী আলী সাবরিকে নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল। এদিকে শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টের স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেবর্ধন আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশে বলেন, সামনে আরও কঠিন দিন আসছে। তিনি আরো বলেন, দেশের অর্থনৈতিক সংকটে ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের অনাহারে থাকার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

জনতার এই বিপ্লব নজিরবিহীন

ক্রোধ আর হতাশা জর্জরিত এই দ্বীপরাষ্ট্রের মানুষের বিক্ষোভ এখন শুধু এক ব্যক্তি বা এক পরিবারতন্ত্রকে লক্ষ্য করে। প্ল্যাকার্ডে, ব্যানারে আর মুখরিত স্লোগানধ্বনিতে তাদের একটাই দাবি – “গো গোটা গো”, “গোটা গো হোম” – “গোটা বিদায় নাও”, “গোটা ঘরে ফিরে যাও”। গোটা হলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট।

বিবিসি জানায়, শ্রীলঙ্কায় বৈদেশিক মুদ্রার চরম ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে জ্বালানির মত অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানি দেশটির জন্য দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। মহামারির কারণে পর্যটন শিল্পও বড়ধরনের ধাক্কা খেয়েছে, যা এই সঙ্কটের পেছনে অন্যতম বড় একটা কারণ। তবে দেশটির বহু মানুষ সঙ্কটের সময় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ব্যথর্তার জন্য অভিযোগের আঙুল তুলছে প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসার দিকে।

বিশ্লেষকরাও বলছেন ২০১৯ সালে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা গ্রহণের পর মি. রাজাপাকসা বড়ধরনের কর হ্রাস ও আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মত যেসব নীতি প্রণয়ন করেছেন, সেগুলো এই সঙ্কটকে আরও গভীর করেছে। এমনকী আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ-এর কাছ থেকে সাহায্যও তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন।

বিবিসির মতে একাধিক কারণে শ্রীলংকার বর্তমান অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। মূলত ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে কখনো এতোটা দুরাবস্থায় পড়েনি দেশটি। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সংকট বেসামাল করে তুলেছে দ্বীপরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে। বৈদেশিক ঋণের ভারে জর্জরিত শ্রীংলকা। পরিস্থিতি এমন অবস্থায় ঠেকেছে যে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারছে না। জিনিসপত্রের দাম এখন আকাশছোঁয়া। কাগজের অভাবে দেশটির স্কুল পর্যায়ের পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। কারণ, কাগজ আমদানি করার মতো বৈদেশিক মুদ্রা তাদের কাছে নেই।

বিবিসির মতে যে সকল কারণে অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো:

অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প

গত ১৫ বছরে শ্রীলংকা বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, রাস্তা এবং আরো নানা ধরণের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।

রাজধানী কলম্বোর কাছেই সমুদ্র থেকে ভূমি উদ্ধার করে কলম্বো পোর্ট সিটি নামে আরেকটি শহর তৈরি করা হচ্ছে।

এর কাজ শেষ হতে সময় লাগবে ২৫ বছর এবং বাজেট ধরা হয়েছে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার।

বলা হয়, হংকং, দুবাই এবং সিঙ্গাপুরকে টেক্কা দেবে নতুন এই শহর। চীনের সাথে একত্রিত হয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে শ্রীলংকা।

দেশটির বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন উৎস থেকে শ্রীলংকা ঋণ নিয়েছে। বিপুল অর্থ খরচ করা হলেও অনেক প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হয়নি।

ঋণের ভারে জর্জরিত

গত ১৫ বছরে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে দেদারছে ঋণ নিয়েছে শ্রীলংকার বিভিন্ন সরকার।

এর মধ্যে অন্যতম উৎস্য হচ্ছে সার্বভৌম বন্ড। ২০০৭ সাল থেকে দেশটির সরকার অর্থ জোগাড়ের জন্য সার্বভৌম বন্ড ইস্যু করেছে।

অর্থনীতিবিদরা বলেন, একটি দেশের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে এ ধরণের সার্বভৈৗম বন্ড বিক্রি করা হয়। আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে এ ধরণের বন্ড বিক্রি করে অর্থের জোগান দেয়া হয়। শ্রীলংকা সেটাই করেছে।

কিন্তু এই অর্থ কিভাবে পরিশোধ করা হবে সে ব্যাপারে খুব একটা চিন্তা-ভাবনা করেনি।

ঋণ পরিশোধে বেহাল অবস্থা

আন্তর্জাতিক সার্বভৈৗম বন্ড বাবদ শ্রীলংকার ঋন রয়েছে এখন সাড়ে বারো বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

এছাড়া দেশীয় উৎস থেকেও সরকার ঋণ করেছে।

সব মিলিয়ে চলতি বছর শ্রীলংকাকে প্রায় সাত বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

এ সাত বিলিয়ন ডলার ঋণের মধ্যে বৈদেশিক ঋণ (আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ড) দেড় বিলিয়ন ডলার।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, চলতি বছর এসব ঋণ শোধ করতে পারবে না দেশটি।