কানাডায় বৃদ্ধ দম্পতিদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ক্রমাগত বাড়ছে

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : কানাডার দম্পতিরা জীবনের শেষদিকে এসে বিয়ে বিচ্ছেদ চাওয়ার ক্ষেত্রে বেশি খোলামেলা। গবেষণা বলছে, এ ধরণের বিয়ে বিচ্ছেদ পুরুষের চেয়ে নারীর ওপর বেশি প্রভাব রাখে। খবর সাবা আজিজ- গ্লোবাল নিউজ।

কানাডায় বছরের পর বছর ধরে বিয়ে বিচ্ছেদের গড় বয়স ক্রমাগত বাড়ছে। এর কারণ অংশত লোকেদের একটু বেশি বয়সে বিয়ে করা। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার সর্ব সাম্প্রতিক উপাত্ত অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিয়ে বিচ্ছেদের গড় বয়স ছিল ৪৮ বছর।

স্ট্যাটক্যান-এর তথ্যমতে, গত তিন দশক ধরে দেশে গ্রে ডিভোর্সের সংখ্যা বেড়েছে, যখন ৫০ বছর বা তারও বেশি বয়সের দম্পতিরা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। যদিও এই বয়স গ্রুপের লোকেদের বিয়ে বিচ্ছেদের হার সম্প্রতি কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে এবং কোভিড-১৯ মহামারির প্রথম বছর ২০২০ সালে কমেছে। বিয়ে বিচ্ছেদ কখনও খুব সহজ নয়, তবে, বিশেষজ্ঞরা বলেন, ৫০ বছরের বেশি বয়সী কাউকে ছেড়ে দেয়ার কিছু অভিনব চ্যালেঞ্জ আছে।

গত তিন দশক ধরে কানাডায় বৃদ্ধ দম্পতিদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। ছবি : আইস্টক

অন্টারিওর ভগানভিত্তিক পারিবারিক আইনজ্ঞ এবং ক্যাসপারস শেগিনি এলএলপির ম্যানেজিং পার্টনার কেভিন ক্যাসপারস বলেন, বিয়ে বিচ্ছেদ ঘিরে কলঙ্কের মত কিছু বিষয় জড়িয়ে থাকলেও অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ব্যক্তিরা বিবাহিত জীবনে সুখি না হলে তা থেকে বেরিয়ে আসার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী হন।

ক্যাসপারস গ্লোবাল নিউজকে বলেন,  গত ১০ বছরে তিনি গ্রে ডিভোর্স বাড়তে দেখেছেন, বিশেষ করে ৬৫ বছর বা তারও বেশি বয়সের লোকেদের ক্ষেত্রে।

তিনি বলেন, “কয়েক বছরের মধ্যে এই বিষয়টি নিশ্চিতভাবেই বেশি প্রচলিত হয়েছে। তারা (জ্যেষ্ঠ দম্পতিরা) দাম্পত্য জীবনের দিকে তাকান, যদি তারা দাম্পত্য সম্পর্ক নিয়ে সুখি না হন, বাচ্চারা বাড়ি ছেড়ে গিয়ে থাকে এবং যেহেতু জীবন উপভোগের জন্য তাদের এখনও অনেক সময় আছে। বাড়িটা এক শুন্য নীড় হয়ে পড়লে তারা আর বিবাহিত জীবন টেনে নেয়ার কোনও কারণ খুঁজে পান না।”

গ্রে ডিভোর্স কেন ঘটছে

ওয়েস্টার্ন অন্টারিও ইউনিভার্সিটির সোশিওলজি বিভাগের প্রফেসার র‌্যাচেল মারগোলিস বলেন, “গ্রে ডিভোর্সের” পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে।

এর একটি কারণ হলো বেবি বুমারস, (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৪ সালের মধ্যে জন্ম গ্রহণকারী) যাদের বয়স ৬০ বছর থেকে ৭৮ বছর এবং যারা জীবনে নানা ধরণের সামাজিক পরিবর্তনের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছেন।

মারগোলিস বলেন, “কানাডার বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে বহু সংখ্যকই তরুণ বয়সে বিয়ে করেছেন, (হয়ত) বয়স ২০-এর ঘরে থাকতেই তালাক পেয়েছেন, আর আমরা জানি একবার তালাক পাওয়া ব্যক্তিদের আবারও তালাকের পথে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।”

তিনি আরও যোগ করেন, বেবি বুমারদের রয়েছে অন্য সব প্রজন্মের মানুষের চেয়ে বেশি সম্পদ, তাই তারা আলাদা থাকার ব্যয় নির্বাহ করতে সক্ষম।

এ ছাড়া, মারগোলিস বলেন, আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে এই মুহূর্তে অবিবাহিত বয়স্ক মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি, এর অর্থ হলো, তালাক পাবার পর নতুন সঙ্গী নেবার মত অনেক বেশি মানুষ আছে।

তার ভাষায়, “বেবি বুমাররা জানেন, তালাকের সাথে যে কলঙ্ক জড়িত ছিল সময়ের সাথে সাথে তা সত্যিই মুছে গেছে। সুতরাং, আগে দম্পতিরা এক সঙ্গে থাকারই সিদ্ধান্ত নিতেন কিন্তু এখন সেসব দূর হয়ে যাওয়ায় তালাক চাওয়া অনেক সহজ হয়েছে।”

আর্থিক সংশ্লিষ্টতা

বেশি বয়সে উদ্বিগ্ন হবার মত অভিভাবকের দায়িত্ব কমে যায়, কারণ সন্তানরা বড় হয়ে যায় এবং তাদের আলাদা থাকার সম্ভাবনাই বেশি, তার পরও বেশি বয়সে বিয়ে বিচ্ছেদ হলে তা উভয়ের জন্যই আর্থিক দিক থেকে বোঝা হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, উদ্বেগের বিষয় হলো, “গ্রে ডিভোর্সের” দম্পতিদের কাজ করার জন্য বেশি সময় অবশিষ্ট থাকে না যেমনটা তরুণ বয়সে থাকে এবং তারা হারানো সম্পদ ফের অর্জনের জন্য কম সময় পান। এদিকে, জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয় এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা কানাডাজুড়েই মানুষের ওপর বাড়তি ভার চাপিয়ে দিয়েছে, যা অনেকেরই অবসরকালীন পরিকল্পনার ওপর প্রভাব ফেলছে।

গত সপ্তাহে প্রকাশিত টরন্টো মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর এজিং-এর এক রিপোর্টে দেখা গেছে, ৫০ বছর বা তারও বেশি বয়সের প্রতি চারজন কানাডীয়র মধ্যে একজন বলেছেন, তার আয় যথেষ্ট নয়। রিপোর্টে বলা হয়, এই বয়স গ্রুপের মাত্র এক-তৃতীয়াংশের মত (৩৫ শতাংশ) মানুষ বলেছেন, তারা যখন চাইবেন তখনই অবসর নেয়ার মত অবস্থা তার আছে। 

গত ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত টিডি ব্যাংক গ্রুপের আরেক সমীক্ষা অনুযায়ী, বয়স্ক কানাডীয়দের প্রতি ১০ জনের মধ্যে চারজন (৪৩ শতাংশ) বলেন, তারা যে সময় অবসর নেবেন বলে প্রাথমিক পর্যায়ে পরিকল্পনা করেছিলেন সেই সময়েই অবসরে যেতে পারবেন কিনা সে বিষয়ে তারা “আত্মবিশ্বাসী নন।”

এর এক সপ্তাহ আগে প্রকাশিত ডেলোইত্তি কানাডার এক বিশ্লেষণেও দেখা যায়, ৫৫ ও ৬৪ বছরের মধ্যে বয়স এমন বয়স্ক কানাডীয়দের ৫৫ শতাংশই বলেছেন, সঞ্চয় ফুরিয়ে যাওয়া এড়াতে তাদেরকে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে হচ্ছে।

ক্যাসপারজ বলেন, “কোনও ধরণের আর্থিক অস্থিতির মুখে যদি তাদেরকে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয় অথবা এভাবে বলতে পারি, কোনও ধরণের সহায়তার দায়িত্বের কারণে,  তাহলে সেটি সত্যিই উদ্বেগজনক।”

তথ্য উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, গ্রে ডিভোর্সের আর্থিক প্রভাব পুরুষের চেয়ে নারীর ওপর অনেক বড় হয়ে দেখা দিতে পারে।

গত বছর প্রকাশিত স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৫৪ থেকে ৫৬ বছর বয়সী তালাকপ্রাপ্ত নারীর আয়ের হ্রাসপ্রাপ্তি নিঃসঙ্গ, বিবাহিত অথবা বিধবা নারীদের চেয়ে বেশি। এই সমীক্ষায় ১৯৮২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে প্রদত্ত ট্যাক্সের পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হয়।

স্ট্যাটক্যান-এর সমীক্ষায় বলা হয়, “পুরুষের ওপরও তালাকের নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে, তবে তাদের আয় ৭০ থেকে ৮০ বছর বয়সী নারীদের তুলনায় বেশি হবার সম্ভাবনাও বেশি।

মারগোলিস বলেন, বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটনোর ব্যাপারে নারীদেরই উদ্যোগী হবার সম্ভাবনা বেশি, তবুও বিচ্ছেদের পর সাধারণত পুরুষের সম্পদ ও আয় গড় হিসাবে নারীর চেয়ে বেশি থাকে।

বর্তমান আবাসন বাজারে বাড়ির দর ছাদ স্পর্শী এবং উচ্চ সুদের হারের কারণে বিচ্ছেদের পর নতুন একটি আবাসন খুঁজে পাওয়াও তাদের জন্য বড় রকমের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

তিনি বলেন, “কানাডায় বাড়ির দাম খুব বেশি বেড়ে যাওয়ায় এখন যারা তালাক নিচ্ছেন তাদের জন্য যথেষ্ট পরিসরের বাড়ি খুঁজে পাওয়া অতীতে তালাক নেয়া ব্যক্তিদের চেয়ে কঠিনতর।” “সে কারণেই আমরা অনেক সময় দেখি যে, লোকেরা, বিশেষত নারীরা তাদের জিনিসপত্র নিয়ে হয়ত কোনও বন্ধুর সঙ্গে অথবা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বাস করছেন।”

ক্যাসপারজ বলেন, বিয়ের আগের কোনও চুক্তি অথবা বিয়ের চুক্তিনামা সংশ্লিষ্ট দম্পতির দীর্ঘদিন ধরে অর্জিত সম্পদ ভাগ করার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।

‘গ্রে ডিভোর্সের’ মানসিক যন্ত্রণা

কিছু গবেষক বলেন, দীর্ঘদিনের বিয়ে বিচ্ছেদের আবেগগত যন্ত্রণাও নারীর ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কঠিন হতে পারে।

জার্নাল অব এপিডেমিওলোজি অ্যান্ড কমিউনিটি হেলথ-এ মঙ্গলবার প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় ফিনল্যান্ডের পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ৫০ থেকে ৭০ বছর বয়সী পুরুষ ও নারী উভয়েরই বিয়ে বিচ্ছেদের আগে আগে বিষন্নতা নিবারণের ওষুধ সেবনের হার দ্রুত বেড়ে যায়, তবে সেটি নারীদের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত বেশি বাড়ে। সমীক্ষায় বলা হয়, নতুন সঙ্গী জোটার পরের সময়ে বিষন্নতা নিবারণের ওষুধ সেবন কমলেও তার পরিমাণ কম এবং এটি স্বল্পকাল স্থায়ী হয়। তবে এই প্রবণতা নারীদের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।

সমীক্ষার লেখকরা এমন উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, নতুন সঙ্গী বেছে নেয়ার পর পুরুষের চেয়ে নারীদের ক্ষেত্রে বিষণ্নতা নিবারকের ব্যবহার সামান্য হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি এমন ব্যাখ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে যে, বিয়ে জিনিসটা নারীর চেয়ে পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে অনেক বড় উপকার বয়ে আনে, আর অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সের পুরুষদের নতুন সঙ্গী খুঁজে নেয়ার সম্ভাবনা নারীদের চেয়ে বেশি।

“এছাড়া, নারীরা (মিশ্র) পরিবারের সদস্যদের, যেমন নতুন সঙ্গীর সন্তানদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক রক্ষায় বৃহত্তর দায়িত্ব নিতে পারে, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্য দুর্বল করতে পারে।”

বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রাপ্তবয়স্ক শিশু ও নাতি-নাতনিরা এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে এবং ডিভোর্সি দম্পতিকে তাদের নতুন জীবনে খাপ খাইয়ে নিতে সহায়ক হতে পারে।

মারগোলিস বলেন, “আমার মনে হয়, সব শিশুই তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে জীবন মিলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে এবং বুঝে নিতে পারে যে, তাদের বাবা-মা নিজেদের জন্য যা চান সেটাই বেছে নিয়েছেন এবং এটি যদি জীবন আরও জটিলও করে তোলে তারা বিষয়টি সমর্থন করতে ও মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে পারে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *