নব্য কানাডীয়রা অন্য সব মানুষের চেয়ে বেশি আশাবাদী

সরকার সঠিক কাজই করবে এমন আস্থা কানাডায় নবাগতদের মধ্যেই বেশি এবং তারা দুর্নীতি নিয়ে খুব একটা ভাবিত নন

নভেম্বর ৯, ২০১৯

হ্যালিফ্যাক্সে নিজের রেস্টুরেন্টে কাউন্টারের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ক্রেতাদের স্বাগত জানাতে জানাতে মুনতাজর নাজি জোর দিয়ে বললেন, তিনি এর চেয়ে বেশি সুখি হতে পারতেন না। তিনি তার কানাডিয়ান স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন।

মূলত ইরাকের বাসিন্দা নাজি একজন উদ্বাস্তু হিসাবে ১০ বছর আগে কানাডায় আসেন। তিনি এখানে এসে একটি নাপিতের সেলুনে কাজ করার সুযোগ পান। পরে তিনি দোকানটি কিনে নেন। এখন তিনি তিনটি ব্যবসার মালিক। এখানে আসার পর তিনি নিজের স্ত্রীকেও স্পন্সর করে এদেশে নিয়ে এসেছেন এবং তাদের কানাডায় জন্মানো দুটি সন্তান আছে।

নাজি বলেন, “এখানে আমাদের প্রয়োজনীয় সব কিছুই আছে, বিদ্যুৎ আছে, এটি একটি নিরাপদ দেশ, এদেশের মানুষ…সেই সব সুযোগ, আমি এমনটাই ভাবি।”

সিবিসি নিউজের পক্ষে সম্পাদিত এক নতুন জরিপে দেখা গেছে, গত ১০ বছর বা তার কম সময় ধরে যারা এদেশে আছেন তারাই সাধারণ মানুষের চেয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক বেশি আশাবাদী। সিবিসি নিউজে প্রকাশিত ঐ জরিপে বলা হয়, অন্য কানাডীয়দের চেয়ে নতুন কানাডীয়রা রাজনীতির ব্যাপারেও একটু বেশি আগ্রহী। আর দেশটি ঠিক পথেই এগুচ্ছে এমন কথা বলার ক্ষেত্রে, সরকার সঠিক কাজটিই করবে এমন আস্থাশীল হওয়ার ক্ষেত্রেও অন্যদের চেয়ে নব্য কানাডীয়দেরই এগিয়ে থাকার সম্ভাবনা বেশি। আর তারা বলেন যে, কানাডার রাজনীতিতে দুর্নীতিকে তারা কোন সমস্যা বলে মনে করেন না।

১০ বছর বা তার কম সময় ধরে যারা এদেশে আছেন তারা অন্যদের তুলনায় ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক বেশি আশাবাদী। ছবি: সিটিভি

এরও যেটা দেখা গেছে সেটা হলো, নতুন কানাডীয়রা বলছেন, কনজারভেটিভ দলের নেতা এন্ড্রু শিয়ার এবং এনডিপি নেতা জগমিত সিং সম্পর্কে তারা তেমন বেশি কিছু জানেন না, তারা মনে করেন, গ্রিন পার্টি তাদের কাছে “খুব বেশি কট্টর”। আর লিবারেল দলের নেতা জাস্টিন ট্রুডোর প্রতি তাদের বিরাট শ্রদ্ধা রয়েছে।

এই শেষ বিষয়টি একধরনের আবেগ যা নাজির পরিবারেও ধ্বনিত। হ্যালিফ্যাক্সে নিজেদের অ্যাপার্টমেন্টে নাজির পাশে বসে তার স্ত্রী সাবরিন ট্রুডো সম্পর্কে বলেন, “আমরা তাকে ভালবাসি। তাকে সমর্থন করি।”

নাজি যোগ করেন, “তিনি (ট্রুডো) অসংখ্য উদ্বাস্তুকে সাহায্য করেছেন।”

প্রধান প্রধান ইস্যু: চাকরি খুঁজে পাওয়া এবং যোগ্যতার সনদের স্বীকৃতি পাওয়া

জরিপের তথ্য অনুযায়ী, নতুন কানাডীয়রা যে তিনটি বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন সেগুলি হলো: চাকরি খুঁজে পাওয়া, আগের যোগ্যতার সনদের স্বীকৃতি পাওয়া এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াকরণের সময় অভিবাসন ত্বরান্বিত করা।

২০১৬ সালে সিরিয়া থেকে একজন উদ্বাস্তু হিসাবে কানাডায় আসা দাঁতের চিকিৎসক ঈসা আল হারিরী জরিপের ওই তথ্যের সঙ্গে সর্বান্তকরণে একমত পোষণ করেন। তবে তিনি এই সব বিষয়েই সুফল পাওয়ার ব্যাপারে অতো বেশি আশাবাদী নন।

আল হারিরী এবং তার স্ত্রীর ছয়টি সন্তান যাদের মধ্যে কানাডায় জন্মানো যমজ মেয়েও আছে। তিনি বলেন, তার ডেন্টিস্টের সনদের স্বীকৃতি পাবার জন্য তিনি অনেক চেষ্টা করেছেন যাতে তিনি পরিবারের জন্য উপার্জনের সুযোগ পান। কিন্তু গোটা প্রক্রিয়াটিই অনেক বেশি দীর্ঘ।

গত সাড়ে তিন বছর ধরে কানাডায় বসবাস করার পরও তিনি কোনও চাকরি খুঁজে পাননি। এটা স্বীকার করতেও হারিরী বিব্রত বোধ করেন।

তিনি বলেন, “একজন ডেন্টিস্ট হিসাবে আমি অত্যন্ত সফল হতে পারতাম। আমি সিরিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছি, অন্যদের সাহায্য করেছি। কিন্তু এখন মনে হয় আমিই সাহায্যপ্রার্থী, আমিই অন্যের সাহায্য নিয়ে টিকে আছি।”

কানাডায় তার নতুন জীবনের জন্য তিনি কৃতজ্ঞতা জানান, কিন্তু এটাও স্বীকার করেন যে, তিনি মনে করেন, এখানে একজন ডেন্টিস্ট হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে তাকে আরও বেশি সাহায্য করার ছিলো।

উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে হারিরী বলেন, “আপনি যদি এদের সাহায্য করেন তাহলে সেই সুযোগ নিয়ে তারা সামাজিক সেবার বাইরে গিয়েও অর্থনীতিতে এবং নিজেদের কমিউনিটির জন্য অবদান রাখতে পারবে।”

চাকরি না পাওয়ার হতাশা সত্তে¡ও আল হারিরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর প্রতি তার রয়েছে গভীর শ্রদ্ধা, লিবারেল দলের সরকার তার সন্তানদের একটি “নতুন জীবন” দিয়েছে এই সত্য তিনি উপেক্ষা করতে পারেন না এবং কানাডার দুর্নীতি নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন নন।

তিনি বলেন, “আপনি যদি এখানকার দুর্নীতির সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর দুর্নীতির তুলনা করেন তাহলে দেখা যাবে উভয়ের মধ্যে কোনও তুলনা হতেই পারে না।”

উদ্বাস্তু ও অভিবাসীদের মনোভাবে পার্থক্য আছে

অভিবাসন আইন নিয়ে ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হ্যালিফ্যাক্স-এর আইনজীবী লি কোহেন বলেন, সিবিসির জরিপে যে তথ্য পাওয়া গেছে তা তার মক্কেলদের সঙ্গে যেসব কথোপকথন হয় তার সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল। তিনি বলেন, অনেক নবাগত কানাডীয়র কাছে কানাডা হলো “বেহেশতের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণের” মতো। সুতরাং বোঝাই যায় যে তারা সাধারণ কানাডীয়দের চেয়ে বেশি আশাবাদী হবেন।

তিনি উদ্বাস্ত ও অভিবাসীদের মধ্যে মনোভাবের তফাৎ আছে বলে উল্লেখ করেন। উদ্বাস্তদের অনেকেই মৃত্যুর হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে এখানে এসেছেন। কিন্তু অভিবাসীরা এসেছেন ভাগ্যান্বেষণে, শিক্ষাদীক্ষা কিংবা পরিবারের সঙ্গে পুনর্মিলনের জন্য। কোহেন বলেন, অভিবাসীরা সরকারের ব্যাপারে বেশি সমালোচনামুখর হবেন এটাই স্বাভাবিক।

এছাড়াও কোহেন বলেন, কানাডায় অভিবাসীদের সংখ্যা এখন এতটাই বেড়েছে যে, নির্বাচনের বিষয় এলে তারা একটা পার্থক্য গড়ে দিতে এবং তাদের ব্যাপারে আরও বেশি মনোযোগ দিতে রাজনীতিকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

ভোট দেওয়া কর্তব্য

সিবিসির জরিপে দেখা গেছে, নতুন কানাডীয়দের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মনে করেন, ভোট দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য, কিন্তু ৩৬ শতাংশ নবাগত বলেছেন, ভোট দেওয়ার প্রক্রিয় সম্পর্কে তারা খুব কমই জানেন।

নতুন কানাডীয় হিসাবে নাজি এবারের শরতের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ভোট দিয়েছেন। তার স্ত্রী লিবারেল দলকে ভোট দিয়েছেন এটা স্পষ্ট, তবে নাজি বলছেন, অন্যান্য দলের পরিকল্পনা সম্পর্কে তাকে আরও তথ্য জানতে হবে।

নতুন কানাডীয়দের মধ্যে পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, ৩৫ শতাংশ বিশ্বাস করেন ট্রুডোরই প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিৎ। সেই তুলনায় শিয়ার্সকে পছন্দ করেন ১৯ শতাংশ। আর সিং ও এলিজাবেথকে পছন্দের তালিকায় রেখেছেন যথাক্রমে ১১ ও ৯ শতাংশ নতুন কানাডীয়।

জরিপে এটাও দেখা গেছে যে, বাদবাকি কানাডীয়দের চেয়ে নতুন কানাডীয়রা সব প্রশ্নেই ট্রুডোর কর্মকাÐকে অধিকতর ইতিবাচকভাবে দেখেন শুধু গাঁজা বৈধ করার বিষয়টি ছাড়া। এই প্রশ্নে সাধারণ কানাডীয়দের ৫৮ শতাংশ যেখানে ট্রুডোর কাজকে ভালো বলেছেন সেখানে নতুন কানাডীয়দের ৪৯ শতাংশ কাজটিকে ভালো বলেছেন।