Tina Turner – কুইন অফ রকেন এন রোল

একজন নির্যাতিত রমনীর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

মোয়াজ্জেম খান মনসুর

বাবা মা নাম রেখেছিল আনা মে বুলক (Anna Mae Bullock) একটি খুব  সাধারণ পরিবারে ১৯৩৯ সালে ব্রাউন্সভিল, টেনেসিতে জন্ম। তার বয়স যখন এগার, তার মা জেলমা  হটাৎ করে একদিন তাদের পরিবার ছেড়ে চলে যায়। বুলকের বাবা ফ্লয়েডের অত্যাচরে অতিষ্ঠ হয়ে জেলমা তিন কন্যা রেখে গৃহ ত্যাগ করেন। দু বছরের মাথায় বাবা ফ্লয়েড আবার বিয়ে  করে ডেট্রয়েটে চলে যান। তখন তারা তিন বোন  নানির কাছে চলে যায়। এগারো বছর বয়স থেকেই  বুলক চার্চে গান করতে শুরু করেন। ছোট বেলায় গৃহ পরিচারিকার কাজ করেন। হাসপাতালে নার্সদের সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করেন।

আমি বলছি একজন  কৃষ্ণকালো  নির্যাতিত রমনীর ঘুরে দাড়াঁনোর গল্প। আমি যার কথা, বলছি তিনি পৃথিবী বিখ্যাত Queen of Rock ‘n’ Roll কিংবদন্তি Tina Turner. হ্যাঁ এই নামেই বুলক পৃথিবী জয় করেছেন। কন্ঠ শিল্পী গীতিকার এবং অভিনয় শিল্পী ছিলেন টিনা টার্নার। ১৯৫৭ সালে গানের জগতে আসেন  আইক টার্নের হাত ধরে। Ike Turner এর ব্যন্ড কিংস অফ রিদম। তার যাত্রা শুরু হয় Little Ann নামে।  সে তখন দুইজন ভোকালিস্টের সাথে ব্যাক স্ট্রেজে গান গাইতেন। একদিন কণ্ঠশিল্পী Lassiter ‘A Fool in Love’ এলবামটির  রেকর্ডিংয়ে আসতে পারলেন না। স্টুডিও ভাড়া করা হয়ে গেছে। উপান্তর না দেখে আইক  টিনাকে দিয়ে গান গাওয়ালেন। সে রাতে  বাজিমাত করলেন টিনা। তারপর আর পিছনে তাকানোর প্রয়োজন হয়নি। লিড সিংগার হিসেবে নামটা স্থায়ী করে ফেলেন Ike & Tina Turner Reuve. এরপর Tina Turner নামে ডুয়েট সিংগেল Hit হয়  A Fool in Love.

টিনা টার্নার আর আইক টার্নার উপহার দেয় অনেক হিট এলবাম। It Gona Work Out Fine, River Deep- Mountain High ” Proud Mary এবং Nutbush City Limits এগুলো ছিল সব ১৯৭৬ সালের আগে। যদিও ডিপ রিভার – মাউন্টেন হাই এলবামটি আমেরিকাতে খুব হিট করতে পারেনি কিন্তু ইউরোপে ছিল সুপার হিট। পরবর্তী জীবনে এই এলবামের পথ ধরেই টিনা টার্নার ইউরোপে  গানের সম্রাজ্ঞী হতে পেরছিলেন।

টিনা টার্নার। ছবি : ইউরোনিউজ.কম

টিনা টার্নার তার মায়ের মতন স্বামী সুখ পাননি। বাইরে নামী শিল্পী হিসেবে  নন্দিত হলেও  স্বামী আইক টার্নারের অত্যচার মুখ বুজে সহ্য করে নিতেন। কারণ টিনা চাইতেন না যার হাত ধরে তিনি গানের জগতে প্রবেশ করেছেন, বিখ্যাত নন্দিত হয়েছেন, নতুন একটি উজ্জ্বল ঝলমলে আনন্দমুখর জীবন পেয়েছেন, তাকে ছুড়ে ফেলে দিতে। স্টেজে তার দুর্দান্ত গানের সাথে অনবদ্য নাচ তাকে দর্শক নন্দিত করে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। হাজার হাজার সংগীত প্রেমী দর্শক সুরের উদ্দাম স্রোতে ভেসে ভেসে হারিয়ে যেতেন অন্য ভূবনে। টিনা টার্নারের অপূর্ব কন্ঠের উত্তাল ঊর্মীর জোয়ারে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকতেন দর্শক ঘন্টার পর ঘন্টা। স্বামী আইকের ঋণে আবদ্ধ থাকতে চেয়েছিলেন সারা জীবন। মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচার ছিল নিত্যসঙ্গী।

আইক টার্নারের স্টুডিওতে অনেক মহিলা শিল্পীর থাকার ব্যবস্থা  ছিল এবং তাদের সকলের সাথে বহুগামী আইকের ছিল যৌন সম্পর্ক। সেকথা টিনার অজানা ছিল না।

১৯৭৬ সালে জুলাই মাসে টিনা এবং আইক মিউজিক্যাল টুরে ছিল। রাস্তায় যেতে যেতে টিনাকে ভীষণ মারধর করেছিল আইক। টিনার জীবন ছিল চরম হতাশাপুর্ণ। টিনা ছিল আইকের জীবনে সম্পূর্ণ অস্তিত্বহীন, অবহেলিত ও নির্যাতিত। স্বামী আইকের সাথে বিবাহিত অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি পাবার জন্য ভয়ংকর এক ঝুঁকি নিয়ে সেই রাতে পকেটে ৩১ সেন্টস আর একটি মোবাইল ক্রেডিট কার্ড নিয়ে ডালাসের এক হোটেল থেকে পালিয়ে যান টিনা। সে রাতেই  তার স্টেজে পার্ফমেন্স  করার কথা ছিল। অন্য এক হোটেলে গিয়ে বলে, আমি তোমাদের  ম্যনেজারের সাথে কথা বলব। ম্যনেজার এলে সে বলে আমি Tina Turner. আমার স্বামী  আমাকে খুব মেরেছে। টিনার সাদা  জ্যাকেটে ফোটা ফোটা লাল রক্তের দাগ।  মারের আঘাতে তার এক চোখ ফুলে গিয়ে  প্রায় বন্ধ।

টিনা বলল আমার কাছে এখন  কোন টাকা নেই, তুমি আমাকে এখানে দয়া করে থাকতে দাও আমি পরে তোমাকে বিল মিটিয়ে দেব। 

তার এক বন্ধু লস এঞ্জেলেসের একটা টিকেট কিনে দেয়। টিনা টার্নারের শুরু হয় জীবনের আরেক অধ্যায়। ভয়, হতাশা আর অর্থ সংকটে নিমজ্জিত টিনা ছিল একজন অসহায় রমনী। তারপর সময়ের সাথে সাথে ধীরে-ধীরে ঘুরে দাড়ানোর গল্প। জীবন জয়ের গল্প। ১৯৬২ সালের বিয়ে ১৯৭৮ সালে টিনা ভেংগে দেয়। টিনা আইককে ডিভোর্স দেন। টিনা টার্নার তার প্রাক্তন স্বামী আইক টার্নারের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ঋণের প্রতিদান হিসেবে তার নামের পিছনে  Turner নামটা রেখে দেন সারা জীবন। বিবাহিত জীবনের অভিশপ্ত সময়ের কাছ থেকে পালিয়ে মুক্তি হবার পর  দীর্ঘ কয়েক বছর মানসিক এবং অর্থনৈতিক টানাপোড়েন কাটিয়ে উঠে আবার ঝলসে উঠলেন টিনা।

১৯৮৪ সালে টিনার Solo Album ‘Private Dancer’ পৃথিবীব্যাপী বিশ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়। টিনা এবার আবারো পৃথিবী জয় করে নেয়। ‘ What’s Love Got to Do With It ‘  ৪৪ বছর বয়সী ফিমেল শিল্পী Hot 100  টপ শিল্পী। তার গানের দ্যুতি ছড়িয়ে পরে। ‘Better Be Good To Me’, Private Dancer’, ‘We Don’t Need Another Hero’, ‘Typical Male’, ‘The Best’ Dont Wanna Fight’’ ও ‘Golden Eye’ গিনিস বুকে নাম লিখিয়েছেন।১৮০,০০০  দর্শক শ্রোতার উপস্থিতিতে স্টেজ কাঁপিয়েছেন এই শিল্পী।

বছরের শ্রেষ্ঠ গান সহ তিনটি Grammy Awards জিতে নেয়। বছরের শ্রেষ্ঠ ফিমেল ফোকাল পারফর্মার হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ২০১৮ সালে গ্র্যামী এওয়ার্ড লাইফ টাইম এচিভমেন্ট দিয়ে তাকে সন্মানিত করে।

১৯৭৫ সালে অভিনয় করেন Tommy ছবিতে এবং ১৯৮৫ সালে Mad Max Beyond Thunderdome.  ১৯৮৬ সালে  অটোবায়োগ্রাফী লেখেন Tina: My Life Story. পরে সেটা নিয়ে ছবি করা হয় ১৯৯৩ সালে What’s Love Got to Do with it.

Tina Turner ১০০ মিলয়ন রেকর্ড বিক্রি করেছেন। The Best Selling – Recording Artists All Time. মোট ১২ Grammy Awards পেয়েছেন, পেয়েছেন  Grammy Life Time Achievment Award , পেয়েছেন কেনেডি সেন্টার সন্মাননা।

টিনা টার্নারই প্রথম  কৃষ্ণবর্ণ শিল্পী এবং প্রথম মহিলা শিল্পী যাকে নিয়ে Rolling Stone ম্যাগাজিন কভার স্টোরি করেছে। টিনা টার্নারকে 100 Greatest Artist All Time  হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। টিনার নাম তারকা চিহ্ন দিয়ে সন্মানিত করেছে Hollywood Walk of Fame.

টিনা টার্নার ১৯৯০ সাল থেকে সুইজারল্যান্ডে তার চেয়ে ১৬ বছরের কম বয়সী ভালবাসার মানুষ Erwin Bach সাথে বসবাস করতে শুরু করেন। দীর্ঘ ২৭ বছর একত্রে বসবাস করে আবার বিয়ে করেন টিনা ২০১৩। ২০১৩ সালে দীর্ঘ দুই যুগের পর সুইজারল্যান্ডের নাগরিকত্ব পাবার পর জন্মভূমি আমেরিকার নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। জুরিখে ২০২১ সালে ৭৬ মিলিয়ন ডলার দিয়ে একটি ম্যানসন ক্রয় করেন। টিনা টার্নারের মোট সম্পদের পরিমান ২৫০ মিলিয়ন ডলার। ২৪ মে,২০২৩

দীর্ঘ দিন ধরে বিভিন্ন রোগে (ক্যান্সার- কিডনি) ভুগে ৮৩ বছর বয়সে  আমেরিকান বর্ন সুইস কিংবদন্তি শিল্পী টিনা টার্নার এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান সীমানার উপারে।

ইংরেজী গানের জগতে, ইতিহাসে কিংবদন্তি Queen of Rock ‘n’ Roll  টিনা টার্নার  বেঁচে থাকবেন তার গানের মূর্ছনায় What’s Love Got to Do with it  শত শত বছর  আমাদের হৃদয়ের গভীরে অন্তরে – অন্তরে।

আগস্ট ২৭/২০২৩

টরন্টো, কানাডা