শুচিতা

(কানাডার দৈনন্দিন বাস্তবতার দিকে লক্ষ্য রেখে কাল্পনিক এই উপন্যাস ‘শুচিতা’। লিখেছেন কানাডা প্রবাসী নজরুল ইসলাম। )

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আর কী বলব, সে অনেক কাহিনি। আজকালকার বউরা কারও সঙ্গে থাকতে চায় না। আমরা শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ-দেবর নিয়ে সেকালে থেকেছি, কারও সঙ্গে টুঁ শব্দটিও করিনি। কমলকে দেবতার মতো মান্য করে সব সময় চলেছি।

তা করবেন না কেন, স্বামী তো দেবতার অবতার। তা ছাড়া আপনার স্বামীর মতো এমন দেবতুল্য স্বামী পাওয়া তো অনেক ভাগ্যের ব্যাপার। কমল এ কথা শুনে মিচকি মিচকি হাসে।

শুচিতা সুমিতের সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করে আঙুল দেখিয়ে ঘর থেকে চলে গেছে। শুচিতার বাসায় দেশ থেকে তার আগের জানাশোনা এক বদমাইশ এসেছে এবং তাকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করে।

ওমা, এ কী কথা গো?

হ্যাঁ, বোন দেখেন আমার ছেলে কত অসুস্থ, অ্যাকসিডেন্টের পর থেকে সে ঘরে বসা, শুচিতা একটু খোঁজখবরও নেয় না, এই বলে আরতি দুই চোখের জল হাত দিয়ে মোছে।

অধরা বলে, বউদি, আর কাঁদবেন না।

কোন লোক দেশ থেকে এসেছে?

প্রদীপ নামে এক ছেলে যার সঙ্গে শুচিতার আগে থেকে জানাশোনা ছিল।

রাম রাম এ কী বলছেন গো!

কী আর বলব, সবই আমাদের কপাল।

এ তো কুলক্ষণ, কুলক্ষণ।

আচ্ছা, আমরা উঠি, একটু তাড়া আছে।

আপনি বসেন এবং চা খেয়ে যান।

না বউদি, সারা দিন কাজ করে এসেছি, আজ না আর একদিন।

আজ তো চা খাওয়াতে পারলাম না, আর একদিন এসে খেয়ে যাবেন অবশ্যই।

আচ্ছা, আজ উঠি এই বলে অধরা চলে যায়।

অধরা চলে যাওয়ার পর থেকেই সুমিত অসুস্থ বোধ করে, সে ঘাড় ও বুকে ব্যথা, শরীরে ঘাম, প্রচণ্ড বমি ও নিশ্বাসে কষ্ট পাচ্ছে। বাসার সবাই অস্থির হয়ে বলে, তোমার কী হয়েছে?

সুমিত বলে, বুঝতে পারছি না শরীরে কেবল ঘাম দিচ্ছে এবং বুকে ব্যথা অনুভব করছি। কমল কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে অবস্থা খারাপ দেখে ৯১১ কল দিলে কয়েক মিনিটের মধ্যে এম্বুলেন্স এসে ওকে দেখে হাসপাতালে নিয়ে ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করিয়ে দেয়। ডাক্তার ও নার্স সঙ্গে সঙ্গে ট্রিটমেন্ট শুরু করে। ওরা বিভিন্ন ধরনের টেস্ট করিয়ে নিশ্চিত হয় যে সুমিতের সিভিয়ার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, ওর কয়েকটা ব্লকেড রয়েছে এবং এখনই ওপেন হার্ট সার্জারি লাগবে। সুমিতের বাবা কমল অনুমতি দিলে ওকে সবকিছু রেডি করে পোস্ট অপারেশন রুমে নিয়ে ডাক্তার ও নার্স তৈরি হয়ে ওই রাতেই অপারেশন করিয়ে নেয়।

পরদিন খবর পেয়ে সুমিতের বন্ধু আজিজ ও মনিকা হাসপাতালে দেখতে আসে এবং শুচিতাকে জানায় যে তোমার স্বামী সুমিতের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে এবং সে হাসপাতালে আছে। খবর পেয়ে শুচিতা, প্রিতম ও আভা ইমার্জেন্সিতে এসে খবর পায় যে সুমিতের অপারেশন হয়েছে এবং আইসিইউতে আছে।

আরতি শুচিতাকে দেখে হাউমাউ করে কান্নাজড়িত হয়ে রাগান্বিত সুরে বলে, আমার ছেলের অসুখের জন্য তুমি দায়ী। তোমার জন্য আমার ছেলে অ্যাকসিডেন্ট করেছে, আজ অসুস্থ এবং যদি কিছু হয়, আমি তোমাকে তার জন্য দায়ী করব।

আভা বলে, শুচিতা, তুমি কোনো জবাব দেবে না, চুপ করে থাকো। শুচিতা আরতিকে বলে, মা, তুমি অযথা আমাকে দোষী সাব্যস্ত করো?

আরতি শুচিতাকে বলে, তুমি পুরা পরিবারকে অসুস্থ করে তুলছ, ঘর ছেড়ে দিয়েছ, এমনকি তোমার ছেলেকে আমাদের কাছে আসতেও দাও না।

শুচিতার মা আভা বলে, চলো, আমরা এখান থেকে চলে যাই, তা না হলে এখানে অনেক ধরনের কথাবার্তা হবে।

শুচিতা একবার সুমিতের দিকে তাকিয়ে বলে, ভালো থেকো। এই বলে শুচিতা আভা ও প্রিতমকে নিয়ে বাসায় চলে যায়।

শুচিতা তার মাকে বলে, তুমি খেয়াল করে দেখছ, সুমিতের মা কী ধরনের আচরণ করে?

আভা বলে, এটা তোমার এবং আমাদের জন্য অনেক যন্ত্রণাদায়ক। ওরা আমাদের সহ্য করতে পারে না এবং সব সময় শত্রু ভাবে। শুচিতা বলে, মা, আমার শাশুড়ি মানসিক রোগী এবং ওর আগে ট্রিটমেন্ট হওয়া দরকার।

কিন্তু কে ওকে এ কথা বলবে?

মা, এদের পুরা পরিবারের কাউন্সেলিং দরকার। এরা এখনো বড়-ছোট, জাত-বংশ নিয়ে আছে। এরা এ দেশে এসে কোনো দিন দুই পয়সারও কাজ করেনি; সরকার থেকে অনুদান নিয়ে বেঁচে আছে আর বড় বড় কথা বলে এবং মানুষের সমালোচনা করে। এদের কে এসব বোঝাতে যাবে?

এদের মুখের ভাষা এবং কথাবার্তার জন্য আমি আলাদা হয়েছি।

প্রিতম শুচিতার ছেলে ধ্রুবকে নিয়ে হাসপাতালের পার্কিং লটে গাড়িতে বসেছিল, সে জিজ্ঞেস করে সুমিতকে কী দেখেছ?

আভা বলে, ওকে একনজর দেখেছি। ও শুচিতার সঙ্গে কথা বলছে, কী বলেছে জানি না।

শুচিতা বলে, ও পুরোপুরি অ্যানেস্থেসিয়া কেটে উঠতে পারেনি। এখনো ঘুমে আছে, মাঝেমধ্যে চোখ খুলে এদিক-সেদিক তাকায়। আমাকে দেখে বলছে, তুমি কেমন আছ?

আমি বলছি, আমরা ভালো, তবে তোমার কী অবস্থা?

চোখ বন্ধ করে রেখেছে, কিছুই বলেনি। আমি সুমিতের মা’র কথা শোনার কোনো দরকার মনে করি না। উনি যা খুশি তাই বলুক, এতে আমার কিছু যায়-আসে না।

আভা বলে সুলতা, সুব্রত এবং সুমিতের বাবা কমল আমার সঙ্গে কথা বলেছে। আর আরতি যে ধরনের মানুষ হয়তো বলে বসত ধ্রুব আমাদের নিকট থেকে যাক।  এটা কী মগের মুল্লুক যে সে বললেই এই ছোট বাচ্চা ধ্রুবকে দিয়ে দেব?

ধ্রুব বাচ্চা ছেলে, সে মাকে ছাড়া কীভাবে থাকবে?

মা, আমার শাশুড়ি অনেক ঝামেলার মানুষ, ওনাকে কোনো কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না।

প্রদীপ কাজ থেকে বাসায় এসেছে। সে সুমিতের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে শুনে দুঃখ প্রকাশ করেছে। সে বলে, সুমিতের অ্যাকসিডেন্ট, হার্ট অ্যাটাক এসবই দুর্ঘটনা মনে হচ্ছে। লোকটা অনেক ভেঙে পড়েছে মন থেকে এবং সোজা হয়ে দাঁড়াতে অনেক সময় লাগবে।

প্রদীপ বলে, শুচিতা, এই অবস্থাতে তোমাকে ভেবেচিন্তে ওদের সঙ্গে কথা বলতে হবে?

শুচিতা বলে, আমার কী করার আছে, ওরা আমাকে কেউ সহ্য করতে পারে না। সুমিতের মা আমাকে দেখলে অমনি ঝগড়া শুরু করে এবং বলে, আমার জন্য সুমিত এই অসুবিধায় পড়েছে এবং যদি ওর ভালোমন্দ কিছু হয় তারা আমাকে দোষী সাব্যস্ত করবে।

প্রদীপ বলে, শুচিতা, তুমি ভেবেচিন্তে বিয়ে করেছ এবং সুমিতের লোকজন এসে সব ঝামেলা লাগিয়েছে।

অধরা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওর স্বামী সুশীলকে বলেছে, সুমিত ভালো পরিবার দেখে বিয়ে করেনি। সে অতিনিম্ন বংশে বিয়ে করেছে, যে জন্য মিল হচ্ছে না। সুশীল বলে, কার দোষ কে বলবে, এরা এক রকম বলে, বাইরের লোক অন্য রকম বলে। অধরা বলে, তুমি কী শুনছ?

সুশীল বলে, আমি যতটা শুনেছি, শুচিতা এবং ওর মা-বাবা খুবই ভালো মানুষ। কিন্তু সুমিতের মা শুচিতাকে পছন্দ করে না। তা ছাড়া এতগুলো লোক দুই কামরা বাসায় থাকে, সুমিতের কোনো রোজগার ছিল না বা আজও নেই। শুচিতা সবকিছু সংসারের খরচ এবং বাসার কাজ করে, ওরা শুচিতাকে চাকরবাকরের মতো খাটায়। এসব নিয়ে ঘরে মনোমালিন্য হচ্ছে, সুমিতের মা ইন্ডিয়া থেকে এসেছে এবং এ দেশের নিয়মকানুন জানে না। শুচিতা মেয়ে হিসেবে ভালো এবং বাইরে কাজ করে আবার ঘরেও সব কাজ ওর জন্য রেখে দিয়ে চাকরের মতো কাজ করিয়ে বিবাদের সৃষ্টি করেছে।

অধরা বলে, আমি শুনছি শুচিতা প্রদীপ নামে কোনো ছেলেকে আগে থেকেই পছন্দ করে।

সুশীল বলে, তুমি এসব বিশ্বাস করবে না, ওই ছেলে আমার দোকানে কয়েকবার খেতে এসেছে এবং আমি শুনছি ওকে সুমিত এবং তার পরিবারের লোকজন অযথা সন্দেহ করে।

পরদিন প্রদীপ কাজ থেকে সরাসরি হাসপাতালে আইসিইউতে গিয়ে সুমিতকে দেখে বলে, তুমি কেমন আছ?

সুমিত বলে, এই আরকি, অ্যানেস্থেসিয়া কেটে উঠেছি, প্রচণ্ড ব্যথা।

ডাক্তার কী বলে?

চারটা ব্লকেড পাওয়া গেছে এবং পায়ের থেকে শিরা (ভেইন) কেটে নিয়ে জোড়া লাগিয়েছে। সারা শরীরেই ব্যথা অনুভব করছি। কবে নাগাদ ভালো হব এবং ছেড়ে দেবে বলতে পারছি না। হাসপাতালে ডাক্তারের কেয়ারে থাকলেই ভালো হবে।

প্রদীপ অনেকটা সময় ওর কাছে বসে থেকে বলে, তুমি ভালো হয়ে উঠবে, এই আশা করি।

প্রদীপ এর মধ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে একটা পুরোনো টয়োটা গাড়ি কিনে নিয়েছে। আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে বাসায় এসে বলে, আংকেল, আমি সুমিতকে দেখে এসেছি। প্রিতম বলে, সুমিত কেমন আছে?

ও কথা বলেছে এবং অপারেশন থেকে সেরে উঠতে অনেক সময় লাগবে, এটুকু বলতে পারি। ধ্রুব প্রদীপকে দেখে দৌড়ে এসে বলে, আংকেল আসছে, খাবার দাও, হাত ধরে টেবিলে নিয়ে বলে বসো, আংকেলকে খাবার দাও।

প্রদীপ বলে, ধ্রুব, তুমি আমাদের নক্ষত্র যাকে ছাড়া আমি একমুহূর্তও থাকতে পারি না এবং বারবার ফিরে আসি। প্রিতম বলে, সে সবারই প্রিয় এবং ওকে দেখলে আমরা সবকিছু ভুলে যাই। আমরা বাসায় না হেসে থাকতে পারি না। বিকেল হলে

ওকে নিয়ে বাইরে বাগানে বসে গল্প করতে হবে, সে আজকাল বাগানে কাজ করে এবং গার্ডেনে আমার সঙ্গে গাছে পানি দেয়, আগাছা পরিষ্কার করে।

আভা বলে, ও বাসার সবাইকে ব্যস্ত রাখে এবং কেউ বিনা কাজে বসে থাকতে পারে না। টেলিভিশনে ভালো প্রোগ্রাম হলে, সে এসে বলবে, মা, তোমরা এসো, বিশেষ করে খেলার প্রোগ্রাম হলে সবার আগে হইচই শুরু করবে।

সে মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং ভালোমন্দ সবকিছু বোঝে। কী বলছি ধ্রুব, ঠিক না? ওই দেখো সে হাসে, যাও আংকেলকে একটু আদর করে এসো। তার পরে খেতে এসো। ধ্রুব দৌড়ে গিয়ে প্রদীপকে আদর করে বলে, আংকেল, খেতে এসো।

প্রদীপ বলে, সুমিত আস্তে আস্তে সুস্থ হলে শুচিতা তুমি কী ওকে নিয়ে আলাদা বাসা করবে?

শুচিতা বলে, আমি ওকে নিয়ে কীভাবে বাসা করব, ও তো ওর মা-বাবা, ভাইবোন ব্যতীত থাকবে না।

আভা বলে, ওর মা-বাবা, ভাইবোন আছে যারা ওকে দেখাশোনা করবে। সুমিতের মা শুচিতাকে পছন্দ করে না, ওখানে গেলে শুচিতা অসুস্থ হয়।

শুচিতা বলে, সুমিতকে আমি হ্যান্ডেল করতে পারি, কিন্তু ওর মাকে আমি পছন্দ করি না। এই মহিলা ঝগড়া ব্যতীত আর কিছু ভালো শেখেনি। তা ছাড়া সে আমার সামনে অন্য লোককে বলে, সুমিত কী দেখে বিয়ে করেছে? তুমি বলো, এরকম কথা শুনলে কেমন লাগে আমার?

প্রদীপ বলে, মানুষ কী সব সময় ঝগড়া করে?

যেসব লোক কারণে-অকারণে মানুষের সঙ্গে ঝগড়া করে এরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে মানুষকে দাবিয়ে রাখার জন্য এসব করে। এরা লুকানো স্বার্থের জন্য মানুষের সঙ্গে ঝগড়া করে, যাতে তাকে তার কৃত অপরাধ সম্পর্কে কিছু না বলতে পারে। সুমিতের মা-ও সেই ধরনের লোক, সে মনে করে শুচিতা সরল-সহজ লোক। লুটেপুটে তার রোজগার এবং তাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেব। তাকে এমনভাবে দাবিয়ে রাখব, যাতে কিছুই বলতে পারে না, এগুলো গ্রাম্য মানুষের নোংরা বুদ্ধি।

পরদিন কাজের পর শুচিতা হাসপাতালে রেস্টুরেন্ট থেকে সুমিতের পছন্দের কিছু খাবার নিয়ে দেখা করতে যায়। সুমিত বেডে এবং ওয়ার্ডে ডাক্তার এসেছে, ডাক্তার সবকিছু রিপোর্ট এবং তার অপারেশন দেখে বলে, আরও এক সপ্তাহ তোমাকে হাসপাতালে থাকতে হবে। শুচিতা পরিচয় দিয়ে বলে, আমি সুমিতের স্ত্রী শুচিতা এবং জানতে এসেছি ওর কী অবস্থা?

ডাক্তার বলে, ওর অবস্থা উন্নতির দিকে এবং আরও এক সপ্তাহ রেখে ছেড়ে দিতে পারি, বাসায় গেলে নিয়মিত ও ওষুধ এবং দেখাশোনা করতে হবে।

শুচিতাকে দেখে সুমিতের দুই চোখ আবেগে সিক্ত হয়ে ওঠে। বলে, এত দিন পর তুমি আমাকে দেখতে এলে। শুচিতা বলে, আমি আরও কয়েক দিন এসেছি, তুমি ঘুমাচ্ছিলে বা তোমার মা’র সঙ্গে কথা বলতেছিলে, সে জন্য চলে গেছি। আজই তোমাকে একলা পেয়েছি। আমি ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পেরেছি যে তুমি এক সপ্তাহ পর বাসায় যাবে।

সুমিত বলে, ডাক্তার তাই বলে এবং দুই সপ্তাহ বাসায় নার্স এসে আমার অপারেশনের ঘা দেখে পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ পাল্টিয়ে দিয়ে রিপোর্ট দেবে।

তুমি ঠিক হয়ে যাবে এই ভেবে আমি খুবই আস্বস্ত হয়েছি। তোমার জন্য কিছু খাবার রেস্টুরেন্ট থেকে এনেছি, খেয়ে নাও। সুমিতকে খাবার খাইয়ে দিয়ে বলে, আমি এখন যাই।

সুমিত বলে, ধ্রুবকে কী একবার নিয়ে আসতে পারবে?

উইকেন্ডে নিয়ে আসব, ও নিজেও সারাক্ষণ বাপ্পি বাপ্পি করে এবং তোমার দেওয়া খেলনা নিয়ে খেলা করে। আচ্ছা, আমি অফিস থেকে এসেছি, এখন যাই। সুমিত আবেগে বলে, তুমি এলে আমি একটু ভালো অনুভব করি।

বাসায় আসার পর শুচিতা বলে, আমি সুমিতকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম।

আভা বলে, ওর অবস্থা কী রকম?

ওর অবস্থা ভালোর দিকে এবং ডাক্তার মনে হয় আগামী সপ্তাহে হাসপাতাল থেকে বাসায় যেতে দেবে।

প্রিতম বলে, ও কোথায় উঠবে?

ও নিজের বাসায় উঠবে এবং সবাই আছে ওকে দেখার অসুবিধা হবে না।

শুচিতা হাসপাতাল থেকে চলে যাওয়ার পর সুমিত আস্তে আস্তে বেড থেকে উঠে বাথরুমে গিয়ে আয়নায় নিজের চেহারার মুখোমুখি হয়। সে অনেক দিন এভাবে নিজেকে দেখেনি। সে ভাবে তার চেহারায় এককালে ছিল সুদর্শন ভাব, যে-ই দেখত আর একবার ফিরে তাকাত। আজ তার নিজের চেহারা দেখে নিজেরই কান্না পায়, ঘৃণা লাগে। বুকে অপারেশনের কাটা ঘা এখনো শুকায়নি। পা থেকে অপারেশন করে শিরা (ভেইন) কেটে নিয়ে বুকে জোড়া লাগানো হয়েছে, তা-ও শুকায়নি। মুখে খোঁচা খোঁচা আধা কালো আধা পাকা দাড়ি, নিজেকে চিনতে পারছে না। সে কান্না বন্ধ করতে চেষ্টা করছে।

পর্ব: ৬

সুমিত রাতে হাসপাতালের বেড থেকে উঠে টয়লেটে গিয়ে ফ্লোরে পড়ে যায়। এ অবস্থায় নার্স দৌড়ে এসে তাকে ধরে বেডে নিয়ে শুইয়ে দিলেও কিছু সময়ের জন্য তার জ্ঞান ফিরে আসেনি। ইমার্জেন্সি ডাক্তার অনেক ধরনের টেস্ট করে কারণ খুঁজে বের করতে চেষ্টা করছেন। জ্ঞান ফিরে এলে সে আস্তে আস্তে বেড থেকে উঠতে চেষ্টা করে, কিন্তু উঠতে পারে না। তাকে ডাক্তার জিজ্ঞেস করেন, তোমার কী হয়েছিল?

সে কিছুই মনে করতে পারে না।

আজ কী বার?

সে তাকিয়ে আছে, কিছুই বলতে পারে না।

তুমি কোথায় আছ এবং তোমার কী হয়েছিল?

কিছুই বলতে পারছে না। ডাক্তার তার ব্লাড প্রেশার চেক করে দেখে উচ্চচাপ। ডাক্তার বলে, শারীরিক দুর্বলতাই এর কারণ। তুমি নার্সের সাহায্য ছাড়া বাথরুমে যাবে না।

কয়েক দিন হলো সুমিতের ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে, এখনো দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সে মানসিকভাবে অনেক ভেঙে পড়েছে এবং স্বাভাবিক কথা বলতে গিয়ে মুখে জড়িয়ে আসে, কথাবার্তায় অসংযত। তার এ অবস্থায় হাসপাতালে আরও কয়েক সপ্তাহ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ডাক্তার। সে কিছুই মনে রাখতে পারে না। নিজে নিজে বিড় বিড় করে আপন মনে কী যেন বলতে থাকে।

ডাক্তার তাকে মানসিক ডিপার্টমেন্টে রেফার করেছেন তার অন্য কোনো ধরনের অসুবিধা আছে কি না, দেখার জন্য। মানসিক বিভাগের ডাক্তার বলেছেন যে তার অপারেশন সম্পূর্ণ ভালো না হওয়া পর্যন্ত তাকে অন্য কিছু চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব না।

প্রায় এক মাস পার হওয়ার পর সুমিতকে হাসপাতাল থেকে বাসায় পাঠানো হয়েছে এবং প্রতি সপ্তাহে নার্স এসে দেখে যায়। সে এতই দুর্বল যে ভালোভাবে ওঠাবসা ও নড়াচড়া করতে পারে না। সে প্রায়ই কান্নাকাটি করে এবং বলে, আমি মরে যাব, তোমরা আমাকে কেউ দেখবে না।

শুচিতা ও তার মা আভা এবং প্রিতম ধ্রুবকে নিয়ে এসে দেখে গেছে। আভা ঘর থেকে কিছু খাবারদাবার নিয়ে এসেছে। কমল, তার ছেলেমেয়েরা এসে কথাবার্তা বলেছে, কিন্তু আরতি তার ঘর থেকে বের হয়নি। ওরা কিছু সময় থেকে চলে গিয়েছে এবং শুচিতা বলেছে যে সে উইকেন্ডে ছুটিছাটার দিনে এসে ধ্রুবকে নিয়ে থাকবে।

শুচিতা সুমিতকে দেখে যাওয়ার পর বাসায় পৌঁছে বলে, মা, তুমি কি খেয়াল করেছ আমার শাশুড়ি একবারও আমাদের দেখতে রুম থেকে বের হয়নি?

তা তো দেখলাম। আমরা এতগুলো লোক এতক্ষণ বসে ছিলাম, আরতি একবার এসে সৌজন্যমূলক কেমন আছেন বলতে পারত। আমি জানি না কেন সে এমনটি করে, হয়তো সে এখনো ভাবে যে আমরা ছোটলোক এবং সে বড়লোক। প্রিতম হাসে। বলে, তোমরা ওকে গুরুত্ব দেবে না, সে থাকগে তার মেজাজ নিয়ে। তোমরা তোমাদের দায়িত্ব পালন করেছ।

বাবা, তুমি বলো ওকে গুরুত্ব দেবে না। আমি হয়তো যাব, কিন্তু দেখা যাবে শাশুড়ি আমার সঙ্গে কথা-কাটাকাটি করছে, আমি কী সব সময় মুখ বন্ধ করে থাকব?

চেষ্টা করবে সব সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে, হয়তো সে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।

সুমিত তার মা-বাবা ও ভাইবোনকে নিয়ে যে বিল্ডিংয়ে থাকে ওটা ৩৪তলা বিল্ডিং এবং প্রতিটি ফ্লোরে ১০টি করে পরিবার থাকে। বহু লোক একত্রে থাকে। এই বিল্ডিংয়ে নানা ধরনের সুবিধা যেমন ৪টি এলিভেটর, কমিউনিটি সেন্টার, ব্যায়ামাগার, সুইমিং পুল, ডে কেয়ার।

ডে কেয়ারে ছোট ছেলেমেয়েদের রেখে ভোরে মা-বাবা কাজে যায় এবং বিকেলে নিয়ে ঘরে ফেরে। এই ডে কেয়ার সরকারি ফান্ডে পরিচালনা করে, যেখানে মা-বাবাকে মাসিক ইনকাম অনুসারে কিছু পয়সা দিতে হয় এবং কারও কারও ক্ষেত্রে যদি মাসিক আয় কম হয়, কিছুই দিতে হয় না। তা ছাড়া এ দেশে প্রতিটি ছেলেমেয়ে সরকার থেকে চাইল্ড সাপোর্ট পেয়ে থাকে।

ডে কেয়ার থেকে বাচ্চাদের সকালে ব্রেকফাস্ট, দুপুরে লাঞ্চের পর ঘুমানো (এক ঘণ্টা) এবং বিকেলে স্নাক্স দিয়ে থাকে।

ডে কেয়ার ওয়ার্কার অন্তত দুইবার শিশুদের বাইরে হাঁটতে নিয়ে যায়। শিশুরা এখানে খেলাধুলার সঙ্গে সঙ্গে পড়াশোনার পরিবেশও পেয়ে থাকে।

যারা ডে কেয়ার ওয়ার্কার হিসেবে কাজ করে, কমিউনিটি কলেজ থেকে দুই থেকে তিন বছরের চাইল্ড কেয়ার ট্রেনিং ডিপ্লোমা নিয়ে চাকরিতে আসে। এরা ছেলেমেয়েদের সাময়িক ট্রিটমেন্ট ও ফার্স্ট এইড দিয়ে থাকে। মা-বাবা যারা ছেলেমেয়েদের এই সেন্টারে রেখে কাজে বা পড়াশোনা করতে যায়, কোনো উদ্বিগ্নতা থাকে না। যদি শিশুরা অসুস্থ হয়, ওরা সঙ্গে সঙ্গে ফার্স্ট এইড দিয়ে থাকে, প্রয়োজনে অ্যাম্বুলেন্স কল করে বাচ্চা হাসপাতালে পাঠায় এবং মা-বাবাকে অবহিত করে।

এখানে রয়েছে কমিউনিটি রিক্রিয়েশন সেন্টার, যেখানে বিয়েশাদি ও ধর্মীয় আলাপ-আলোচনা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। তা ছাড়া তৎসংলগ্ন ব্যায়ামাগার ও সুইমিং পুল যেখানে ২৪ ঘণ্টা পুরুষ-মহিলা সুবিধামতো ব্যায়াম করতে পারে।

এই বিল্ডিংয়ে বেশ কয়েকটি ভারতীয় পরিবার রয়েছে। সুমিতের একই ফ্লোরে ললিত নামে এক লোক প্রায় ১৫-১৬ বছর থেকে পরিবার নিয়ে থাকে। দশ বছর হয় স্ত্রীর অকালমৃত্যুতে ললিত সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। এক ছেলে প্রিয়ব্রত ও এক মেয়ে নিমিকে নিয়ে সংসার তার। প্রিয়ব্রত দুই বছর হয় ইউনিভার্সিটি থেকে সোশ্যাল সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করে একই শহরে কাজ করে এবং বিয়ে করে তার স্ত্রী অদিতি ও ছেলে নিলয়কে নিয়ে আলাদা থাকে।

নিমি কমিউনিটি কলেজ থেকে আর্লি চাইল্ডের ওপর ডিপ্লোমা করে ডে কেয়ারে কাজ করে এবং বাবার সঙ্গে থাকে। বাবা ললিত অবসর জীবন এবং সব সময় বাসায় থাকে।

কমল অধিকাংশ সময় প্রতিবেশী ললিতের সঙ্গে গল্প করে এবং যেহেতু কমল একজন ব্রাহ্মণ উচ্চ বংশের লোক, ললিত ওকে সব সময় সম্মান করে। (চলবে)

ললিতের মেয়ে নিমি দিনে বাসায় থাকে না, ওরা সময় কাটানোর জন্য দুজন বসে গল্প করে। এ সুযোগ নিয়ে সুমিত ও হুইল চেয়ার ঠেলে ঠেলে গিয়ে বাসায় নক করে বসে ললিতের সঙ্গে গল্প করে এবং অনেক সময় তর্কে জড়িয়ে পড়ে। ডাক্তার সুমিতের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে উত্তেজিত হওয়া থেকে বিরত থাকতে নিষেধ করেছেন। সুমিতের এক দিকে হার্টের এবং অপর দিকে মানসিক সমস্যা, সে অল্পতেই নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ললিত যখন যা পারে আপ্যায়ন করায় এবং দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি নিয়ে আলাপ করতে করতে একপর্যায়ে তর্কে মেতে ওঠে।

নিমি সময়-অসময় কাজ থেকে ঘরে এসে বাবাকে হয় কমল বা সুমিতকে নিয়ে উচ্চ স্বরে চিৎকার করতে শোনে। সে দু-একবার বলেছে, বাবা, তুমি বাইরের লোক কেন ঘরে নিয়ে এসো?

আমি কাজ করে ঘরে এসে অস্বস্তি বোধ করি। কিন্তু ললিত নিমির কথায় কর্ণপাত না করে তর্ক করে যে এতে তোমার কী অসুবিধা হচ্ছে?

নিমি বলে, বাবা, তুমি আমার অসুবিধা বুঝতে পারছ না, এতে ঘরের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। আমি রোজ রোজ বাসায় এসে দেখি তুমি ওদের নিয়ে চিৎকার ব্যতীত স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছ না। এতে আমার অনেক কষ্ট হয়। ওরা আমাকে দেখেও বাসায় যায় না এবং আমার সঙ্গেও অসংগতভাবে কথা বলে, যা আমি একদম সহ্য করতে পারছি না। ললিত বলে, কমল একজন ব্রাহ্মণ উচ্চ বংশের লোক, ওকে আমি শ্রদ্ধা করি।

সে যা-ই হোক বাবা, তুমি বাইরের মানুষ সব সময় ঘরে নিয়ে এসো এটা আমি পছন্দ করি না।

ললিত রাগান্বিত স্বরে বলে, ওরা আমাদের প্রতিবেশী। বাইরের লোক কোথায়?

বাবা, আমি তোমার ভালোর জন্য বলছি, এদের সঙ্গে এত মাখামাখি করবে না।

টেবিলে থালাবাসন, খাবারদাবার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এবং কিচেন নোংরা করে রাখে যা রোজ রোজ নিমিকে পরিষ্কার করতে হয়। কিচেন নোংরা করে রাখে যা দেখে বলে, বাবা, তুমি নিশ্চয় অসুস্থ হয়ে গেছ, তোমার চিকিৎসা দরকার।

অনেক সময় নিমি রাতে ঘুমিয়ে পড়ে, ললিত কমলকে নিয়ে রাত একটা-দুইটা পর্যন্ত বসে আড্ডা এবং চিৎকার করে বাসায় যায়। ললিত বলে, নিমি, তুমি এই উইকেন্ডে বাসায় থাকবে না, বাসায় আমরা চার-পাঁচজন মিলে ছোটখাটো একটা পার্টি করব, তোমার সহ্য হবে না, তুমি বরং প্রিয়ব্রতের বাসায় চলে যাও।

বাবা, তুমি বাইরের লোক ডেকে বাসায় কিসের পার্টি করবে, তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?

আমাকে ঘর থেকে বের করে তুমি এখানে আড্ডা জমাবে আর অযথা চিৎকার করবে। ললিত বলে, একটু-আধটু বন্ধুবান্ধব মিলে গল্প গুজব করি তোমার অসুবিধা কোথায়?

কমল ও সুমিত উঁচু বংশের লোক, একজন ব্রাহ্মণ এবং ভালো সম্পর্ক রাখলে ভালো।

বাবা, তুমি গল্প গুজব করো, নিজেদের কন্ট্রোল করতে পারো না, একপর্যায়ে তোমরা চিৎকার শুরু করো। বাবা, মা মরার পর তোমাকে অনেক সময় দিয়েছি এবং এই তোমার শেষ পরিণতি। তুমি কোত্থেকে এসব যুগিয়েছ, ভাইয়া চলে গেছে এবং আমিও তোমাকে ছেড়ে চলে যাব।

যা তুই যেখানে খুশি, আমি একাই থাকব। (চলবে)