চৌরাস্তার মোড়

শুজা রশীদ

                ব্যস্ত চৌরাস্তার পাশে বসবাস করার অনেক ফ্যাসাদ আছে কিন্তু কেউ যদি একটু দার্শণিক গোছের হয়, ব্যস্ততা একবারেই না থাকে, এবং চৌরাস্তার মোড়ের বাজারে অবস্থিত মুদির দোকানের মালিক যদি হয় তার জিকিরে দোস্ত তাহলে শুধু যে স্থানটা ভালো লাগতে শুরু করবে তাই নয়, এমনকি সেই ভালো লাগা রীতিমত ভালোবাসায় পরিণত হয়ে যেতে পারে। কাজ থেকে অবসর নেবার পর এই চৌরাস্তাই হয়ে উঠেছে আমার নতুন শখ। আমার চার তলার কন্ডো থেকে সারা দিন বসে বসে চৌরাস্তার শত ভীড় ভাট্টা দেখাটা এখন সময় কাটানোর চেয়েও বেশী কিছু হয়ে উঠেছে। আগে কখনও উপধাবন করিনি যে খুব আপাত দৃষ্টিতে গুরুত্বহীণ মানুষের সাথেও জড়িয়ে থাকতে পারে চমৎকার কোন কাহিনী। হুইল চেয়ারে করে প্রতি সপ্তাহে মাঝ বয়েসী যে লোকটা পঙ্গুদের জন্য তৈরি বিশেষ ধরনের গাড়ী চালিয়ে এসে বাজারের পার্কিং লটে রেখে ফুটপথের উপর চুপচাপ দীর্ঘক্ষণ বসে থাকে ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে মোড়ের দিকে তাকিয়ে তার কথাই ধরা যাক।

                আমার আফগানী বন্ধু রোলা হচ্ছে বাজারের একমাত্র মুদির দোকানের মালিক। তার গল্পের ভাণ্ডার কখন শেষ হয় না। তার সারাদিন কাটে ছোট দোকানটার মধ্যেই, খদ্দেরদের সাথে আলাপে। মনযোগ দিয়ে তাদের কথা শোনে সে, মাঝে মাঝে দু চারটা প্রশ্ন করে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যাবতীয় খুটিনাটি তথ্য বের করে নেয়। এইভাবে তার ভান্ডারে সঞ্চিত হয়েছে রকমারি সব গল্প, অধিকাংশই এই চৌরাস্তাকে ঘিরেই। সৌভাগ্যবশত আমরা কিছু মানুষ যারা তার একাধারে খদ্দের এবং বন্ধু, মাঝে মাঝে তার মুখ থেকে সেই সব কাহিনীর কিছু কিছু শুনতে পাই।

                এক বিকালে রোলার দোকানে আমরা কয়েকজন স্থানীয় যখন আমাদের প্রাত্যাহিক আড্ডায় বসেছি সেই সময় হুইলচেয়ারের লোকটা এলো, বরাবরের মতই গাড়ী পার্ক করে ফুটপথে গিয়ে বসল। এই সময়টাতে দোকানে ভীড় থাকে কম। রোলা একঘেঁয়ে কাজের মধ্যে ফাঁক খুঁজে এক জগ ভর্তি তার বিখ্যাত কলম্বিয়ান কফি বানিয়ে এনে দোকানের এক কোণে রাখা খুব সম্ভবত রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা পুরানো একটা টেবিল আর খান কতক চেয়ার ঘেরা স্থানে যেখানে আমরা গ্যাঁট মেরে বসে থাকি সেখানে এসে আমাদের সাথে যোগ দেয়। যেখান থেকেই আসুক, চেয়ারগুলো গদি আঁটা, বসে আনন্দ আছে।

                পাশের পাকিস্তানী হালাল মাংসের দোকানের কসাই মাহমুদ ভারতীয় মুসলিম, এই সময়টাতে তার কাজ থেকে কিছুক্ষণের বিরতি নিয়ে আমাদের সাথে এসে যোগ দেয় সে। মাঝে মাঝে শ্রীলংকান রেস্টুরেন্টের শেফ এবং মালিক চান্দুরানও আসে। ডানে খান দুই দোকান পরে পিজার দোকানের মালিক দুই চেক ভাই- কায়েল এবং কেলান। সুযোগ পেলে তারাও এসে হাজির হয়। মাঝ বয়েসী চৈনিক বংশোদ্ভূত লিন চিং এই সারিতে অবস্থিত একমাত্র চুল কাটার সেলুনের মালিক। সে কখন হাজিরা দিতে ভুল করে না। আরোও অনেকেই আসে, যার যখন সুযোগ হয়। অধিকাংশই এই বাজারে কাজ করে। এমন কত দিন হয়েছে রোলার দোকানে হয়ত কেউ এসেছে সিগ্রেট কিংবা দুধ জাতীয় কিছু একটা কিনতে, দেখে কোনার টেবিল ঘিরে দুনিয়ার মানুষ ভীড় করে বসে আছে আর তাদের মাঝে খুব গম্ভীর মুখে বসে তার গল্পের ঝাঁপি থেকে কোন একটা গল্প শোনাচ্ছে রোলা। কি কিনতে এসেছে ভুলে গিয়ে সবার সাথে গিয়ে জমায়েত হয়েছে খদ্দের, গল্প শোনার জন্য।    

                “ঐ যে লোকটা হুইলচেয়ারে বসে আছে বাস স্ট্যাণ্ডের পাশে,” রোলা আঙ্গুল তুলে বিশাল শেলফে প্রায় ঢেকে থাকা দোকানের একমাত্র জানালাটার দিকে নির্দেশ করে। একটু ভালো করে তাকালে জানালার সেই সামান্য ফাঁক দিয়েও হুইল চেয়ারে বসে থাকা লোকটাকে ঝাপসা ঝাপসা দেখা যায়। তাকে আমরা গত কয়েক বছর ধরেই দেখে আসছি। সে মাঝ বয়েসী বাদামী লোক, মাথায় চুলের ঘনত্ব দ্রুত কমে আসছে, মুখে ছোট ছোট দাঁড়ি, বেশ কিছুদিন ধরে ওজন বাড়ছে, পরনে ঢিলা ঢালা হাফ হাতা জামা আর ফুল প্যন্ট – দুটোই ধুসর।

                আমরা শ্রোতারা প্রায় সবাই একই সাথে আমাদের কফির কাপ উঁচিয়ে কফিতে চুমুক দেই, রোলা উপরে নীচে মাথা দোলায় – তার একটা মুদ্রা দোষ। “জানো কেন ও এখানে এসে ঐভাবে ফুটপথে বসে মোড়টার দিকে তাকিয়ে থাকে? বন্ধুরা, সব কিছুর পেছনেই একটা কাহিনী আছে। আজকে আমি এই লোকটার কাহিনী তোমাদেরকে শোনাব। কিন্তু আগে ওর একটা নাম দেয়া দরকার। কি নাম দেয়া যায়?” 

                আমরা সবাই পরস্পরের মুখের দিকে তাকাই। গল্পটা যেহেতু রোলা বলছে লোকটার নাম জানাটা কি রোলার দায়িত্ব নয়? 

                “তোমরা তো জানই আমি কারো আসল নাম ব্যবহার করি না,” রোলা আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলে। “গল্পতো মানুষের নাম নিয়ে নয়, মানুষকে নিয়ে। আমরা ওকে একটা নাম ঠিক করে দেই। বেলাল কেমন শোনায়?”

                রোলা বরাবরই একটু নাটুকে কিন্তু আমরা আবার সেটা পছন্দ করি। আমরা সবাই একযোগে মাথা দোলাই। বেলাল হোক কিংবা জন হোক, আমাদের কাছে দুটোই সমান।  

                “আরে গল্পটা শুরু কর না রে বাবা,” লিন অধৈর্য হয়ে বলে। হেয়ারড্রেসার হলেও মহিলার ধৈর্য খুবই কম।

                আমি তার পিঠে আলতো করে চাপড় দেই। রোলা আবার তাড়াহুড়া করতে পছন্দ করে না।

                “আচ্ছা! আচ্ছা!,” রোলা খনিকটা বিরক্তি নিয়ে বাতাসে হাত ঝেড়ে বলে। “শুরু করছি। এখন থেকে দশ বারো বছর আগে কোন একটা দক্ষীণ এশিয় দেশ থেকে এসেছিল সে, দেশের নামটা ভুলে গেছি। কিন্তু দেশের নামে কিইবা এসে যায়? সারা দুনিয়া থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ আসছে এই দেশে। সবারই জীবনে কোন না কোন গল্প আছে, যে কারণে মাতৃভূমি, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধব ছেড়ে তারা পাড়ি জমিয়েছে এই দূর দেশে। আমরা সবাই তো সেই একই নৌকার যাত্রী। বেলালের সরকারী চাকরী ছিল, অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালোই ছিল, চারদিকে দূর্ণীতির ছড়াছড়ি থাকলেও সে মোটামুটিভাবে সব কুল মানিয়ে চলছিল – বেঁচে থাকার জন্য, ঝুট ঝামেলা থেকে দূরে থাকার জন্য যা করতে হয় করছিল।”

                আমরা সবাই মাথা দোলাই। আমাদের সবারই পরিস্থিতি কম বেশী সেই রকমই তো ছিল, তাই না? আমরা সবাই বোধহয় একযোগে বলে উঠতে চাইছিলাম আমদের অতীতের অভিজ্ঞতা, কিন্তু নিজেদেরকে আমরা সম্বরণ করি। রোলার গল্প বলায় বিঘ্ন ঘটালে রোলা  খুবই বিরক্ত হয়। হঠাৎ রাগ করে বলে বসতে পারে, “তাহলে আজকের মত আমার গল্প এখানেই শেষ হল।” হ্যাঁ, তেমনটা হয়েছে আগে। তার আবার খুব তাড়াতাড়ি গোস্বা হয়ে যায়।

                “বেলালের দেখা হল এক অতি সুন্দরী মেয়ের সাথে – সব মেয়েই সুন্দরী, কম আর বেশী”

                “মেয়ে নয় বল ভদ্রমহিলা,” লিন তাকে শুধরে দেয়।

                রোলা একটু ভড়কে যায়। আমি দ্রুত বলি, “পরিণত বয়স্ক মেয়েরা হচ্ছে ভদ্রমহিলা, আমরা সবাই জানি। তো, বেলাল সেই ভদ্রমহিলার প্রেমে পড়ল, তাই তো? তারা কি একসাথে কাজ করত?”

                “তুমি তাদের কাহিনী কি করে জানলে,” মাহমুদ সেই নিষিদ্ধ প্রশ্নটাই করে বসে।

                রোলা তাকে বরফ শীতল একটা চাহনি দিল। “এতো অধৈর্য কেন তুমি, ভাই সাব? তোমার সব প্রশ্নের উত্তর যথা সময়েই পেয়ে যাবে। ঠিক আছে?”

                মাহমুদ হাসে। তাদের দুজনার বন্ধুত্ব গভীর। রোলাকে উত্যক্ত করবার সাহস তার আছে। চান্দুরান গল্পে বিঘ্ন ঘটানোর জন্য মাহমুদের উপর খুবই বিরক্ত হয়, তাকে একটা নোংরা চাহনি দেয়।

                দুই চেক ভাই চোখাচোখি করে, হাসে। তারা জানে রোলা কেমন খামখেয়ালি। আফগানীরা সবাই একটু ঐরকম, তাদের ধারনা। ঘাড় ত্যাড়া। রোলাকে সেই কথা তারা বহুবার বলেছে। রোলা প্রতিবারই চেকদের সম্বন্ধে নোংরা কিছু বলে তার প্রতিদান দিয়েছে। 

                “মেয়েটি বেলালের সহকর্মীই ছিল,” রোলা খুব গাম্ভীর্য নিয়ে আবার গল্পে ফিরে যায়। এটা ভালো লক্ষণ।  এর অর্থ হচ্ছে রোলা এবার এই গল্প শেষ না করে থামবে না। “মেয়েটি ছিল ধর্মভীরু, প্রেম প্রেম খেলায় তার কোন আগ্রহ ছিল না। রীতিনীতি মেনে বিয়ে করে সংসার করতে আগ্রহী সে। সুতরাং বেলাল নিজের বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে বলল সে এই মেয়েটিকে… ভদ্রমহিলাকে… ভালোবাসে এবং বিয়ে করতে চায়। তার পিতামাতা শীঘ্রই জানতে পারলেন যে মেয়েটির বাবা একজন পুলিশ কনেস্টবল। সেই দেশে খুব একটা উঁচু পদের কাজ নয়। বেলালের বাবা ছিলেন এক প্রাইভেট কম্পানীর ডাইরেক্টর। সামাজিক ভাবে তাদের মধ্যে পরিষ্কার পার্থক্য ছিল। তারা বিয়েতে রাজী হলেন না।

                শ্রোতারা সবাই মাথা নাড়ে। হ্যাঁ, এই জাতীয় ব্যাপার তারা সকলেই হয় দেখেছে নয় শুনেছে।

                “বেলাল তার বাবা-মায়ের অনুমতি ছাড়াই কেন মেয়েটাকে বিয়ে করল না,” কায়েল প্রশ্ন করে। “তারা দুজনাই ছিল প্রাপ্তবয়স্ক। কে তাদেরকা বাঁধা দিচ্ছিল?”

                “বাবা-মায়ের বিরুদ্ধাচারণ করলে তাদের মনে ব্যাথা দেয়া হবে না?” চান্দুরান বলে। “তারা হলেন ভগবানের অন্য রূপ।”

                “বেলাল কি করল?” আমি কৌতূহলী হয়ে জানতে চাই।

                “সে ছিল বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। সে তাদের মতের বিরুদ্ধে যেতে পারে না। অনেক চেষ্টা করে তাদের মত পরিবর্তন করতে কিন্তু কোন কিছুতেই কোন কাজ হয় না। বিয়ের জন্য তাকে এতো মরিয়া হয়ে উঠতে দেখে তার বাবা-মা এবার তার জন্য বিয়ের কন্যা খুঁজতে শুরু করলেন। অনতিবিলম্বে একজন সুন্দরী, শিক্ষিতা, মায়াবতী কন্যা পাওয়া গেল। বেলাল আপত্তি করল কিন্তু তার কথায় কেউ কর্ণপাত করল না। এক চমৎকার গ্রীষ্মের বিকালে সেই মেয়েটির সাথে তার খুব ঢাক ঢোল বাজিয়ে বিবাহ বন্ধন হয়ে গেল।

                “অন্য মেয়েটার কি হল?” মাহমুদ জানতে চায়।

                “সে প্রতিজ্ঞা করে জীবনে আর কখন না করবে বিয়ে না কাউকে ভালোবাসবে,” রোলা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে।

                আমরা সবাই মাথা নাড়ি। তার এই সংকল্পের কারণ সহজেই বোধগম্য হয়। কি নিষ্ঠুর বাস্তব! বেলালের বাবা-মায়ের প্রতি সবারই কিছুটা হলেও রাগ হয়।

                “তারপর নিশ্চয় বেলাল বউকে নিয়ে কানাডা আসে,” মাহমুদ তাড়াতাড়ি বলে।

                রোলা চোখ গরম করে তাকায়। “ভাই সাব, গল্প কি তুমি বলছ না আমি বলছি? থেমে যাবো?”

                মাহমুদ খুব মজা পেয়ে হা হা করে হাসে। রোলাকে ক্ষেপিয়ে সে মজা পায়।

                “হ্যাঁ, পরের বছর তারা কানাডা চলে আসে,” রোলা বলে। “প্রধানত বাবা-মাকে শাস্তি দেবার জন্যই। কিন্তু তার কাজেও সমস্যা হচ্ছিল। দুর্নীতি থেকে নিজেকে আর রক্ষা করতে পারছিল না। রাগ-ভয় দুটোই তাকে একরকম বাধ্য করে দেশ ছাড়তে। সে যখন কানাডায় এসে নামে তখন এখানে শীতকাল। যেমন ঠান্ডা তেমন তুষারপাত।”

                “ইস রে! আমার প্রথম শীতকালের কথা মনে করিয়ে দিলে,” লিন বলে। “এখানে আসার আগে কিছু তুষারপাত দেখেছিলাম কিন্তু এইরকম ঠান্ডা আগে কখন দেখিনি। শূণ্যের নীচে ত্রিশ ডিগ্রী সেলসিয়াস? ও মাগো! আমার হাঁড় পর্যন্ত জমে গিয়েছিল যেন।”

                এই কথায় বেশ একটা হাসির রোল উঠল। রোলাও সবার সাথে যোগ দিল। “বেলালেরও সেই রকমই মনে হয়েছিল। কয় দিন পরপরই তার শরীর খারাপ হয়, ভালো কোন কাজকর্মও পায় না, যেখানে থাকে সেটাও খুব একটা যুতসই নয়, জমানো টাকা পয়সা ফুরিয়ে যাচ্ছে…ভীষণ হতাশায় ভুগতে শুরু করে সে। দেশেও ফিরে যেতে পারে না কারণ গেলেই আবার সেই আগুণের মধ্যে গিয়ে পড়বে। তার আত্মসম্মান বলতেই বা আর কি বাকি থাকবে? নতুন দেশে এসে তার জীবন খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না। কিন্তু তেমনটা তো আমাদের সবারই হয়েছে, তাই না? নতুন একটা দেশে গিয়েই তো আর সব কিছু খাপে খাপে মিলে যায় না। তাই না?”

                “এই ব্যাপারে আমি একেবারেই মুখ খুলতে চাই না,” মাহমুদ এক গাল হাসি নিয়ে বলে। “আমি এখনও ন্যুনতম বেতনে মাংশ কাটছি। দেশে থাকতে ব্যাংকার ছিলাম। কিন্তু আমার কোন নালিশ নেই। যেভাবে আছি ভালোই আছি।”

                “হ্যাঁ, তোমার মত অনেকেই আছে,” কেলান বলে। “তোমাদের জন্য আমার অনেক শ্রদ্ধাবোধ আছে। আমরা হলাম ব্যবসায়ী। আমার বাবা এই দেশে এসেছিলেন যখন আমরা ছিলাম তরুণ। আমরা নানা ধরনের ব্যবসা করবার চেষ্টা করেছি। শেষ পর্যন্ত পিজাটা লেগে গেল।”

                “চান্দূ, তোমার কাহিনী কি?” আমি জিজ্ঞেস করি।

“ত্রিশ বছর আগে একটা ভুয়া পাসপোর্ট নিয়ে এসেছিলাম আমি,” চান্দুরান বলে। “আমি তখন যুবক, একটা কলেজ ডিগ্রী ছিল। বিদেশে আসতে চেয়েছিলাম। আসার পর নানা ধরনের কাজ করেছি। শেষে আমার সমস্ত টাকা পয়সা এই রেস্টূরেন্টে ঢেলেছি। ভালই চলছে। আমার দেশের মানুষ জনেরা সবাই আমাকে ভালোমতই চেনে। বাচ্চারা ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে, চমৎকার আছি।”

“আচ্ছা, হয়েছে হয়েছে, পোলাপাইন। তোমাদের জীবন কাহিণী পরেও শোনা যাবে,” লিন ব্যাস্ত ভঙ্গিতে বলে।   “এখন বেলালের গল্পটা শোনা যাক।”   

“তুমি আমাদেরকা পোলাপাইন বললে কেন?” রোলা ছদ্ম কোপে বলে। “আমরা হলাম ভদ্রলোক।”

আমরা সবাই হাসি।  লীনও যোগ দেয়। হাসি থামলে দুই হাত শূন্যে ছুড়ে সে বলে, “গল্পটা শেষ কর তো। তোমরা হলে বেয়াদপ পোলাপাইন।”

“এক সেকেন্ড,” রোলা উঠে দাঁড়ায়। “একজন খদ্দের এসেছে।”

রোলা চলে যায়। ফিরতে মিনিট পাঁচেক লেগে যায় তার। ইত্যবসরে আমরা সবাই যে যার তিক্ত অভিজ্ঞতা পরস্পরকে বলি। ফিরে আসার পর ঘড়ি দেখে রোলা, আবার নিজের আসনে বসে পড়ে, এবার একটু ব্যস্ত মনে হয়। একটু পরেই দোকানে খদ্দেরদের ভীড় বেড়ে যাবে।

“কোথায় যেন ছিলাম? ওহ, বেলাল তার বউ নিয়ে কানাডা চলে এলো। টরন্টোতেই। খুব হতাশায় ভুগছিল, কিভাবে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তার ভাগ্যও ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে শুরু করে। এখানে আবার পড়াশুনা করবার জন্য কলেজে ভর্তি হয়, দুইটা ছোট কোর্স শেষ করে। ব্যাংকে একটা ক্লারিকাল জব পায়। টাকা পয়সা খুব ভালো না হলেও মোটামুটি চলে যাচ্ছিল। তারপর তাদের সংসারে এলো প্রথম বাচ্চা – একটা ফুটফুটে মেয়ে। মেয়ের নাম রাখলো ধরে নাও ডেইজী। মেয়েটা খুব হাসিখুশি, সব সময় খিলখিল করে হাসে। কিছু কঠিন সময় পেরিয়ে শেষতক তারা কিছু ভালো সময় দেখতে শুরু করে।” রোলা কাপে আরোও কিছু কফি ঢালে। ধীরে ধীরে বার দুই চুমুক দেয়। তার হাবভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এই গল্পে এবার মারাত্বক কিছু একটা ঘটবে।

“তারপর কি হল?” লিন ভ্রূ কুঁচকে অধৈর্য হয়ে জানতে চাইল।

“এক বিকালে, বউ এবং বাচ্চাকে নিয়ে ঐ ওয়ালমার্টে যাচ্ছিল বেলাল,” আঙ্গুল তুলে চৌরাস্তার মোড়ের উত্তর পশ্চিম দিকটা নির্দেশ করে রোলা, যেখানে ওয়ালমার্টটা অবস্থিত। “ঠিক কার দোষে হয়েছিল বলা দুষ্কর কিন্তু বেলাল যখন বাঁয়ে ঘুরছিল তখন একটা TTC বাস কোথা থেকে এসে ধাক্কা দেয় তার গাড়ীটাকে, ঠেলতে ঠেলতে একেবারে ঐ ল্যম্প পোস্ট পর্যন্ত নিয়ে যায়।” অবিশ্বাস নিয়ে মাথা নাড়ে সে। “আমি একটা খুব জোর শব্দ শুনেছিলাম। বাইরে তাকিয়ে দেখি সেই বাসটা ঝড়ের বেগে ছুটছে। প্রথমে গাড়ীটাকে দেখতে পাইনি। কিন্তু যখন দেখতে পেলাম তখন আমার কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেল। দৌড়ে বাইরে গেলাম। দুপরের একটু পর। রাস্তায় গাড়ী তেমন একটা ছিল না। সেই সময়ে এমন বড় একটা দূর্ঘটনা ঘটার কথা নয়। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এমন দৃশ্য যেন কেউ না দেখে।”

“ঘটনাটা কবে ঘটেছিল,” কায়েল জানতে চায়। “আমরা তো এখানে এসেছি প্রায় আট বছর হল। আমি তো এই ঘটনার কথা শুনিনি।”

“তোমরা এখানে আসার ঠিক আগে আগে ঘটেছিল এই দুর্ঘটনা,” রোলা বলে।

“এখন আমার মনে পড়েছে! আমি কাগজে পড়েছিলাম।” মাহমুদ উত্তেজিত কন্ঠে বলে। “কিন্তু তার প্রেম কাহিনী সংক্রান্ত কিছু সেখানে লেখা ছিল না।”

“আমার এক বন্ধু বেলালের বন্ধুর বন্ধু। তার মুখেই আমি এই গল্প শুনেছি,” রোলা বলে।

চান্দুরান মনে হল কিছু একটা স্মরণ করতে পারে। “ওর স্ত্রী তো মারা যায়, তাই না?”

“হ্য! হ্যা!” লিন এবার চীৎকার করে ওঠে। “কিন্তু বাচ্চাটা বেঁচে যায়! কার সিটে বসে ছিল সে। গাড়ীর ছাদ কেটে বেলালকে বের করতে হয়। তার দুটি পাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল ফলে কেটে ফেলতে হয়। আহারে! কি ভয়াবহ ঘটনা! যা খারাপ লেগেছিল শুনে। তাহলে এই লোকই সেই হতভাগা! চল না আমরা গিয়ে একটু কথা বলি।”

“না, না,” আমি দ্রুত বলি। “সে নিশ্চয় এখানে আসে তার স্ত্রীর প্রতি সম্মান জানাতে। আমাদের তাতে বিঘ্ন ঘটানোটা উচিৎ হবে না। থাক সে তার মত বসে।”

লিন কাঁধ ঝাঁকায়। তার চোখে মুখে দুঃখ দুঃখ ভাব। “আমার ওকে একটা আলিংগন করতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।”  

“মানুষ এই দেশে আসে নানা কারণে কিন্তু সবারই আশা থাকে একটিই – একটা উন্নত জীবন যাপন করা,” আমি দার্শনিকের মত বলি। “কিন্তু এই ধরনের ঘটনা শুনলে বুকটা ভেঙে যায়।”

পরিবেশটা হঠাৎ করেই কৌতূহল থেকে দুঃখ আর সহানুভুতিতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। আমরা সবাই জানালার কাছে গিয়ে একজন আরেকজনের ঘাড়ের উপর দিয়ে বেচারা বেলালকে ভালো করে এক নজর দেখার জন্য হুড়াহুড়ি করি। কিন্তু রোলা নিজের আসন ছেড়ে নড়ে না। আমরা যখন লক্ষ্য করি সে মুচকি মুচকি হাসছে তখন বুঝতে পারি কাহিনী এখনও শেষ হয় নি।

“আমাদের কাছ থেকে তুমি কি লুকিয়ে রেখেছ বন্ধু?” আমি জানতে চাই।

আমরা সবাই তার দিকে প্রশ্ন বোধক চিহ্নের মত তাকাতে রোলা বিশাল এক গাল হাসি দেয়। “এই গল্পের শেষটুকু আনন্দের। মনে আছে বলেছিলাম তার পূর্ব প্রেমিকার কথা যে কখন বিয়ে করে নি? বেলালের দূর্ঘটনার কথা তার কানে যাবার পর সে নিজে যেঁচে এসে তাকে বিয়ে করার আগ্রহ দেখায়। বিয়ের পর সে কানাডা এসে বেলালের বাচ্চা মেয়েটির সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়। শুনেছি তাদের জীবন খুবই আনন্দময়।”

“কিন্তু বেচারার পা তো দুটিই গেছে। সে উপার্জন করছে কিভাবে?” চান্দুরান জানতে চায়। “সরকার কি তাকে আর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করছে?”

রোলা এবার আকর্ণবিস্তৃত হাসি দেয়।  “দেখ বন্ধুরা, এটাই হচ্ছে এই কাহিণীর সবচেয়ে চমৎকার দিক। বেলাল TTC’র বিরুদ্ধে কোর্টে কেস করে। তারা কোর্টের বাইরেই কেসটা মিটিয়ে ফেলতে রাজী হয়। মানুষ নানা ধরনের কথাবার্তা বলে কিন্তু আমি তোমাদেরকে এইটুকু বলতে পারি বেলাল কম করে হলেও সাত অংকের একটা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিল। আট অংকেরও হতে পারে। সেতো অনেক টাকা, তাই না?”

কয়েক মুহুর্তের জন্য আমাদের মাঝে নীরবতা বিরাজ করে। শেষে লিন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে সেই নীরবতা ভাঙে। “ঈশ্বরের কি মেহেরবাণী!”

আমরা সবাই এক ছেলেমানুষি হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠি। বেলালের জন্য মনটা এক চমৎকার আনন্দে ভরে ওঠে।

(লেখক পরিচিতি : শুজা রশীদ।

কথা সাহিত্যিক ও কলামিস্ট। টরন্টো।)