প্রবাসে পরহিতকর্ম -১০০

ইউরোপের পথে পথে

রীনা গুলশান

(জনপ্রিয় কবি, ঔপন্যাসিক ও কলামিস্ট রীনা গুলশান প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনের প্রায় জন্ম লগ্ন থেকেই ‘প্রবাসে পরহিতকর্ম’ নামে একটি কলাম লিখে আসছেন। চলতি সংখ্যায় তার কলামের শতমাস পূর্ণ হলো। অর্থাৎ বিগত ১০০ মাস ধরেই তিনি তার জনপ্রিয় কলামটি লিখে আসছেন। তার এই অক্লান্ত প্ররিশ্রম, প্রবাসী কণ্ঠ ও এর পাঠকদের প্রতি তার অপরিমেয় ভালবাসার কথা আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি। আমরা প্রবাসী কণ্ঠ পরিবারের পক্ষ থেকে রীনা গুলশানকে সশ্রদ্ধ অভিনন্দন জানাচ্ছি এবং তার দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য কামনা করছি । – সম্পাদক)

‘আমি একদিন পাখি হবো –

একলা আকাশে একলা ডানায় চুপটি করে পাড়ি দিব।

সঙ্গে নিবো গোপন কথা

ছোট্র বুকের বিশাল ব্যাথা

ডানায় ডানায় মেঘের ভেতর সেসব কিছু ছড়িয়ে দেব।’

সরব আড্ডার মধ্যে কবিতার পংক্তি মাথার মধ্যে ঘুরছিল। যদিও মাহিন, তিন্নি আর রায়হানের গল্প, স্মৃতিচারণের আনন্দ এক একবার চিৎকারের পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল। আশপাশের জনগণ চকিত হচ্ছিল। তাতে করে ওদের আড্ডা একটুও বিড়ম্বিত হচ্ছিল না। নাসির আমি আর কাজিম, আমাদের বিষয়ান্তিক আলোচনায় মগ্ন ছিলাম। এর মধ্যেই ‘মিউজিয়াম ইন ফ্রাঙ্কফুর্ট’ এর দোড় গোড়া চলে এলো। সবাই হৈ চৈ করতে করতে ঢুকলোও। এবারে সবাই চুপ হয়ে গেল।

এক অতি প্রাচীন সভ্যতার কাছে এসে মানুষ কেমন যেন মুক হয়ে যায়। এই মিউজিয়ামটির স্থাপত্যটি অসম্ভব পুরাতন মনে হচ্ছিল। অনেকটা বেলজিয়ামের ব্রুজেস শহরটির মত। এখানেও সেই সমৃদ্ধময় পূরাতন ঘ্রাণ। আমি আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে তার সুবাস টেনে নিলাম আমার অস্তিত্বে।

গোটা ইউরোপের মিউজিয়াম অথবা আর্ট গ্যালারি সব কিছুরই ধাচ অনেকটা একই ধরণের। অত্যন্ত পুরাতন। এবং অসম্ভব সমৃদ্ধ। এখানে আসলে মনে হয় ‘ইতিহাস’ এর সামনে এসে দাঁড়ালাম।

তবে আগেই বলেছি প্যারিস এর মত এই মিউজিয়ামটি ছিল না। এটাতে সত্যিকার অর্থেই শ্বাশ্বত কালের গন্ধ ছিল। এর বিল্ডিং এর ডিজাইন-ই শুধু নয়, এর সাজানোর ভঙ্গিটিও তাই।

ঐতিহাসিক প্রচুর মাস্টার পিসে সমৃদ্ধ এই মিউজিয়ামটি। তবে প্রায় বেশীর ভাগ শো পিস-ই দেখলাম কাঁচের ঘেরা টোপে। এদের কর্তৃপক্ষ বেশ সচেতন। ব্রিটেনের মিউজিয়ামে যেমন বেশীর ভাগ জিনিষই খোলা মেলা। তবে জার্মানীতে মিউজিয়ামগুলো ভাগ করে করে দিয়েছে। তাই অনেকেই ঠিক যেটা নির্দিষ্ট করে দেখতে চাইবেন, সে সম্ভব হবে না।

এই মিউজিয়ামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক কিছু ছিল। আবার বিখ্যাত সব আর্টিস্টদের বেশ কিছু মাস্টারপিসও আছে। আবার কয়েকটি কক্ষে মডার্ন আর্টও আছে। অনেক গুলোতে চোখ এর সাথে পা ও আটকে যাচ্ছিল। বরাবরের মত আর্ট এর দিকেই আমাকে টানছিল। এবং রায়হান সেটা জানে। তাই চুপি চুপি বললো, তোমাকে আবার তোমার প্রিয় আর্টের শহর আর্টের গ্যালারিতে নিয়ে যাবো, মানে প্যারিসে। আমি খুব হাসলাম। আসলে আমার প্রথম সন্তান তো, অনেকটাই বন্ধুর মত। আমাকে বেশ ভাল বোঝে।

দি ফ্রাঙ্কফুর্ট ইউনির্ভার্সিটি লাইব্রেরী। ছবি : লেখক

যাইহোক, এক যাত্রায় দুটি মন ভাল দেখায় না। তাই নিজেকে বেশ খানিকটা জোর করেই মিউজিয়াম থেকে বের করে আনলাম।

মিউজিয়াম থেকে বের হতেই সবার আবারও ক্ষুধার উদ্রেক হলো। তাই পাশেই একটা ‘ফুটপাতেই’ রেস্টুরেন্ট থেকে সবাই একটা করে কফি নিল। আমি অবশ্য কফি নিলাম না। সকাল থেকে দু’বার কফি খাওয়া হয়েছে। তাই ছোট একটা চিপস এর প্যাকেট নিলাম। আর কাজিমতো কফির পরই একটা সিগারেট ধরাবেই। এবারে আমাদের টার্গেট ছিল মাইন নদীর বেশ কাছে ‘শো পিস’ স্টোরে।

এইসব স্টোর সাধারণত কোন মলের মধ্যে থাকে। কিন্তু বেশ বৃহৎ এই স্টোরটি ‘সেন্টার’ এ এবং মাইন নদীর তীরেই। তাই প্রচুর ভিড়। কারণ কোন টুরিস্ট যদি কোন মলে নাও যেতে চায় তাহলে টুরিস্ট স্পটে এই ‘সেন্টার’ থেকেই টুকটাক শপিং করে নিতে পারবে। বেশ ভিড় স্টোরটিতে। এখান থেকে কেউ শপিং করবে না।

জাস্ট জার্মানীর ঐতিহ্যবাহী টুকটাক শো-পিস। আমি প্রথমে কিছুটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। একটি ২০/২১ বছরের ছেলে আমার কাছে এসে বললো, এটা ভাল, ওটা নিতে পারো। আমি ‘হুম’ বলে দেখে যাচ্ছিলাম। কারণ আমার ব্যক্তিগত মতাদর্শ হলো, ট্যুরে গিয়ে শপিং করতে হয় না। আমি জার্মানীর ঐতিহ্যবাহী দুইটা শো পিস নিলাম। একটা রুম্মানের জন্য, অন্যটি আমাদের জন্য। নাসির আর মাহিন বেশ কিছু শো পিস কিনলো, আমি জানি সেগুলো সব রায়হানের জন্য। রায়হানকে কিছু কিনতেই দিল না। বেশ কিছু শাপিং করে আমরা বের হলাম।

এরপর আমি বললাম, দি ফ্রাঙ্কফুর্ট ইউনির্ভার্সিটি লাইব্রেরী’ টা কতদূর? নাসির বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। ভাবখানা এই যে, এটা আবার দেখার কোন বিষয় হলো? ট্যুরে এসে কেউ লাইব্রেরী দেখে? আমি বললাম-আমি ওটা দেখতে চাই। তখন ওরা বললো, ঠিক আছে চলেন যাই। ঘন্টা খানেক হাটার পথ ছিল সেটি। আমি প্রচুর নাম শুনেছি এর। অতএব চলে এলাম সেই বিখ্যাত ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরীতে। ভেবেছিলাম আমি ছাড়া কেউ নাই। আমাকে ভুল প্রমাণিত করে দেখলাম, প্রচুর মানুষের সমাগম। অবশ্য তার মধ্যে স্টুডেন্ট এর সংখ্যাই বেশী মনে হলো। আবার দর্শনার্থীর সংখ্যা নেহায়েত অপ্রতুল নয়।

এই লাইব্রেরীর প্রচুর নাম আমি শুনেছি। এমনকি কানাডার ‘Indigo’ (সব থেকে বড় চেইন লাইব্রেরী) সেখানে আমি প্রায়ই যেতাম, যখন ইটন সেন্টারে কাজ করতাম। সেখানেও গিয়েও এই লাইব্রেরীর একটা ম্যাগাজিন দেখেছিলাম। এদের কর্মপদ্ধতি ইত্যাদি। খুব দেখার ইচ্ছে ছিল। এর আগের বার যখন জার্মানীতে এসেছিলাম, তখনও খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সময়ের অভাবে দেখতে পারিনি। এবারে যেতে পারলাম। এত বড় বিল্ডিং যে অবাক হয়ে ভাবছিলাম, কোন লাইব্রেরী এত বড় হয়? তার থেকেও বড় এর বিশাল সীমানা। আর এই সীমানাতেই হয় পৃথিবীর সব থেকে বড় ‘বইমেলা’। যার সময়কাল থাকে গোটা একটি মাস। পৃথিবীর কম দেশ আছে যারা এখানে স্টল দেয় না। বাংলাদেশের স্টল তেমন একটা না হলেও, দেশের কিছু প্রতিনিধিরা যায়। এর মধ্যে ভারতের বই এর স্টলের ব্যাপকতা প্রচুর। যদিও সব থেকে এগিয়ে থাকে বই এর সমৃদ্ধিতে রাশিয়া এবং বৃটেন। এটাকেই বোধ হয় ‘কাকতাল’ বলে, যে পৃথিবীর সব থেকে নামী লেখকের, বেশীর ভাগ সংখ্যাই রাশিয়াতে জন্ম। তাই এদের পুস্তকের ব্যাপকতা যে সমৃদ্ধশালী হবে তাতে কোনই সন্দেহ নাই।

এই লাইব্রেরীতে একটি কক্ষ আছে দর্শনার্থীরা যেয়ে একটি খাতায় তাদের মন্তব্য লিখবে। সেই কমেন্টস বুকটাই দেখবার মত। আমাদের তরফ থেকে রায়হান লিখলো। রায়হান বাংলা ইংরেজী এবং ফ্রেঞ্চ এই তিন ভাষাতেই সমানভাবে দক্ষ। অর্থাৎ লিখতে এবং পড়তেও পারে। বলতেতো পারেই। ১৮০১ সালে লাইব্রেরীর জন্ম। এর কেবলমাত্র ভিজিটরের সংখ্যা দেখলেই চোখ কপালে উঠে যায়। ৮০৫,০১৯ – ২০২১ সাল পর্যন্ত এই পরিমান ভিজিটর ছিল। অবশ্যই লিখিত। এছাড়া অলিখিতও প্রচুর। আর রেগুলার স্টুডেন্টদের কথা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। কত যে রুম তার কোন ঠিক ঠিকানা নাই। তবে এর কোন তলায় কোন কক্ষে কার বই পাওয়া যাবে তার একটা লিস্ট আছে।

অনেকগুলো কক্ষ ঘুরলাম। বই হাতে নিলাম। বিখ্যাত প্রিয় বেশ কিছু লেখকের বই নাড়াচাড়া করে, গন্ধ নিলাম। মনে হচ্ছিল কাল থেকে কালান্তরে হারিয়ে যাচ্ছিলাম।

নাসির তাড়া দিল যদিও রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে, কিন্তু রাতের ডিনারে আমাদের মাহিনের বাসায় দাওয়াত ছিল। যদিও এই কদিন সে আমাদের সাথেই ছিল। তবু জোরাজুরি এতটাই ছিল যে আমরা মাহিনের বাসায় যেতে বাধ্য হলাম। ওর বাসায় যেতে হলে এখন আবার সাবওয়েতে উঠতে হবে।

আমরা মাহিনের বাসার জন্য রওনা দিলাম। এটা Offenbach am Main স্টেশন এ নেমে পাঁচ মিনিটের হাটা পথে ওর বাড়ি। বাড়িটা একটি হাই রাইজ বিল্ডিং। মাহিন একা মানুষ। ওর এপার্টমেন্ট একটা স্টুডিও। কিন্তু অনেক বড়। সম্ভবত অর্ডার দেওয়া ছিল, খাবারের। সেগুলো দিয়ে মজা করে ডিনার করলাম।

রাত বাড়ছিল। তবু মাহিন ছাড়লো না। বললো, সময়ের অভাবে কিন্তু রান্না করতে পারলাম না। তবে এক কাপ কফি বানিয়ে খাওয়াবো। খুব সুন্দর করে কফি বানালো। কফি খেতে খেতে ওর ঘরের ডেকোরেশন দেখছিলাম। খুব বৃক্ষ প্রেমিক, বোঝাই যায়।

অন্ধকার গাড়িয়ে দীর্ঘতর হচ্ছিল। আমাদের অতপর উঠতে হলো। এবং আমাদের সাথে মাহিনও চললো। আমরা যে কদিন থাকবো, মাহিন আমাদের সাথে, তিন্নীর বাসায় থাকবে।

রাতের প্রায় শেষ ট্রেনটা তিন্নীদের স্টেশনে থামলো। আমরা অবসন্ন পায়ে ওদের এপার্টমেন্টের দিকে চললাম। (চলবে)

রীনা গুলশান, টরন্টো

gulshanararina@gmail.com