পরপর দু’জন ডাক্তার বলেছিলেন, তার মারাত্মক রোগ আছে এবং ক্রিসমাস পর্যন্ত বাঁচবেন না। তারপর যা হলো…


প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : উইনিপেগের জনৈক ব্যক্তি বলেন, জীবন সংশয়ে আছেন বলে মনে করা যে কারো উচিৎ চূড়ান্তভাবে রোগ নির্ণয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া। তাকে দুজন ভিন্ন ডাক্তার ভুলভাবে মারাত্মক রোগে আক্রান্ত বলে জানিয়েছিলেন।
এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন সানিব্রুক হাসপাতালের একজন নিউরোলোজিস্ট।
দৃশ্যমান কোন কারণ তার এক পায়ে ছাড়াই অসাড়তা দেখা দিলে ৫১ বছর বয়সী ফ্রেডরিক বার্গস্টর্ম গত মার্চে তার পারিবারিক চিকিৎসকের কাছে যান।
বার্গস্টর্ম বলেন, “তিনি ১০ মিনিটের একটি পরীক্ষা করেন এবং তারপর আক্ষরিক অর্থেই অশ্রুসজল হয়ে পড়েন। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘ফ্রেডরিক, আপনার রোগটা এএলএস (ALS)।
চিকিৎসক তাকে বলেন, রোগটা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে এবং তা দ্রুতই ছড়িয়ে পড়বে।
তিনি ডাক্তারের বক্তব্য স্মরণ করেন। ডাক্তার বলেছিলেন, “আমরা এমন জায়গায় আছি যেখানে আর কিছুই করার নেই।”
বাকরুদ্ধ বার্গস্টর্ম তৎক্ষণাৎ তার স্ত্রীকে ফোন করে কর্মস্থল থেকে ঘরে ফিরতে বলেন। তিনি বলেন, সে রাতে দুজন রাতভর কেঁদেছেন। তার ভাষায়, “এটি ছিল সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসাত্মক।”
অ্যামিওট্রোফিক লেটারেল স্কে¬রোসিস, যা এএলএস অথবা লোউ জেহরিগস রোগ বলেও পরিচিত। এটি মানুষকে ক্রমশ অবশ করে ফেলে কারণ এই রোগ হলে মানুষের মস্তিষ্ক আর দেহের পেশির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে না।
সময়ের সাথে সাথে পেশীগুলো অচল হতে থাকে, ফলে মানুষ হাঁটাচলা, কথা বলা, খাওয়া, গেলা এবং শেষপর্যন্ত শ্বাসগ্রহণের সক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে।

ফ্রেডরিক ও কার্লা বার্গস্টর্ম, তাদের দুই কিশোরী মেয়ের সঙ্গে (বার্গস্টর্ম পরিবারের সৌজন্যে)

এ রোগের কোনও চিকিৎসা বা প্রতিষেধক নেই

বার্গস্টর্ম বলেন, এই রোগ তার পরিবারে আছে। তার ছোটভাই এক দশকেরও বেশি আগে এই রোগে মারা যান। দুবছর আগে বাবাও মারা যান একই রোগে।
তিনদিন পর বার্গস্টর্ম একই হাসপাতালে আরেকজন ডাক্তারের কাছে যান নিশ্চিত হবার জন্য। এই ডাক্তারও তার পারিবারিক চিকিৎসকের রোগ নির্ণয়ের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন।
“ঐ চিকিৎসক ‘বিপর্যয়কর স্নায়বিক ধস’ এবং ‘দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এএসএল’ এরকম শব্দ ব্যবহার করেন। তিনি বলেছেন, “সুতরাং আমি কেবল মারা যাচ্ছি তাই নয়, দ্রুত গতিতে মৃত্যুর দিকে যাচ্ছি। সবকিছু অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে চলছে।”
এ পর্যায়ে বার্গস্টর্ম ও তার স্ত্রী কার্লা তাদের দুই টিন এজ মেয়েকে বিষয়টি জানান।
কার্লা বলেন, “এটি ছিল ভীতিকর, আমাদের জীবনে, আমাদের জগতে যা ঘটতে যাচ্ছে… এটি মোটেই সহজ ছিল না।”
তার লক্ষণগুলো বাড়ছিল এবং তার অন্য পায়েও অসাড়তা অনুভব করতে শুরু করেন। হাঁটার সুবিধার জন্য তিনি লাঠি ব্যবহার করতে শুরু করেন।
বার্গস্টর্ম বলেন, এ পর্যন্ত পরিকল্পনাগুলো দ্রুত এগুচ্ছিল।
দুই সপ্তাহের মধ্যে, তার রোগের বিষয়টি বীমা এবং অক্ষমতার দাবির জন্য লিখে জানানো হয়েছিল। তাকে বলা হয়েছিল, তিনি কখনই কাজে ফিরতে পারবেন না এবং শিগগিরই হাঁটতে অক্ষম হয়ে পড়বেন। তাকে তার গাড়ির জন্য একটি ফরংধনরষরঃু প্ল্যাকার্ড দেয়া হয় এমনকি চিকিৎসকের-সহায়তায় মৃত্যু বেছে নেয়ার জন্য একজন থেরাপিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ পর্যন্ত করা হয়েছিল।
তিনি ব্যবসা বন্ধ করে দেন এবং সবার কাছে ফোন করতে শুরু করেন।
তিনি বলেন, “আমাদের বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের জানানোর ছিল। বয়োবৃদ্ধ মা যিনি এরই মধ্যে এক ছেলেকে এই রোগে হারিয়েছেন এবং শেষ ছেলেটিকেও হারাতে যাচ্ছেন তাকে জানানোর ছিলÑ এই আলোচনাটা ছিল কঠিন।”
বার্গস্টর্মকে বলা হয়েছিল, ক্রিসমাসে তিনি আর বেঁচে থাকবেন না, বেশি হলে সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর পর্যন্ত বাঁচতে পারেন।
কার্লা বলেন, তাদের পরিবার বার্গস্টর্মের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাও শুরু করেছিল। “২০২৩ এর গ্রীষ্মটা ছিল শুধুই কান্নার,” বলেন কার্লা। “এটি ছিল ভয়ঙ্কর রকমের বিষাদময়।”

‘তিনি কি ঠিক এটাই বলছেন যে আমি মারা যাচ্ছি না?’

জুলাই মাসের শেষে বার্গস্টর্মের অ্যাপয়েনমেন্ট ছিল তৃতীয় আরেকজন ডাক্তারের সঙ্গে। ইনি একজন নিউরোলজিস্ট। যাবতীয় টেস্ট এবং বিশদ পরীক্ষার পর তাকে আরেকটা ধাক্কা দেন ডাক্তার।
ডাক্তার বার্গস্টর্মকে বলেন, তিনি ভেবেছিলেন, তাদেরকে একটি উপশমমূলক, জীবনের সমাপ্তির বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হবে, কিন্তু পরিবর্তে ডাক্তার তাকে বলেন, সম্ভবত তার রোগ নির্ণয়ে কোনও ভুল করেছেন আগের ডাক্তাররা।
বার্গস্টর্ম বলেন, “আমি হতবাক হয়ে পড়ি। তিনি কি ঠিক এটাই বলছেন যে, আমি মারা যাচ্ছি না?” “আমি অভিভূত হয়ে যাই। আমি আমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার একটি সূচি তৈরি করেছি। লোকদের বলেছি আমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে কথা বলার জন্য। এখন আমি আর মারা যাচ্ছি না?”
বেশ কয়েক মাসের মধ্যে এই প্রথম বার্গস্টর্ম ও তার স্ত্রীর মনে কিঞ্চিৎ আশার আলো দেখা দেয়।
“আমরা সেই দফতর ছেড়ে আসি এমনই এক নতুন অনুভূতি নিয়ে, ” বলেন কার্লা। “কী হবে (যদি অন্য ডাক্তাররা ভুল করে থাকেন)? শেষ পর্যন্ত এটি আমাদেরকে ঘরে ফেরার পথে কিছুটা আনন্দের জোগান দেয়।”
তাকে আরো একাধিক ডাক্তারের কাছে রেফার করা হয়। তারা তাকে জানান যে, তার এএলএস হয়নি।
তারা রোগনির্ণয় নিয়ে নিশ্চিত। বরং তার যেটা হয়েছে সেটি হলো নিউরোপ্যাথি বা নার্ভ ড্যামেজ, স্নায়ুক্ষয়; যা ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে সচরাচর হয়ে থাকে, যেমন তার।
তিনি বলেন, “এটি ছিল মহাআনন্দের, তবে রাগেরও কারণ। “এটি আমাকে আহত করেছে। এটি আমার পরিবারকে আহত করেছে, আমাদের চরম শোকে ভাসিয়েছে।”
বার্গস্টর্ম তার ভুল রোগনির্ণয়কারী পেশাজীবীদের বিরুদ্ধে কোনও আইনী ব্যবস্থা নিতে চান না, তিনি জানেন, এটা নিছক ভুলই ছিল।
তিনি বলেন, “আমি মনে করি, ডাক্তারদের সত্যিই এই ধরণের কঠিন এবং গুরুতর রোগ নির্ণয়ের ভয়াবহ পরিণতি বুঝতে হবে।”
“আপনি যদি এ ধরণের মারাত্মক ও কঠিন রোগ ধরা পড়ার বিষয়ে সন্দেহ করেন তাহলে রোগীকে বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো উচিৎ। ঘটনা এই যে, মৌখিক এবং লিখিতভাবেও আমার এএলএস আছে বলে জানানো হয়। এমনটা ঘটা উচিৎ হয়নি।”

‘এটি জটিল রোগনির্ণয়’ : এএলএস বিশেষজ্ঞ

কানাডার এএলএস সোসাইটির মতে, এ রোগ চিহ্নিত করা কঠিন। কারণ, এর লক্ষণগুলির সঙ্গে অন্য রোগের লক্ষণের অত্যন্ত মিল আছে।
সানিব্রুক হাসপাতালের নিউরোলজিস্ট এবং কানাডার বৃহত্তম এএলএস ক্লিনিকের প্রধান ডা. লোরনি জিনম্যান সিবিসিকে বলেন, “এটি বিরল রোগ। প্রতি লাখে মাত্র দুই থেকে তিনজনের এই রোগ হয়।”
তিনি বলেন, এএলএস রোগ সনাক্ত করাও জটিল কাজ এবং কয়েক মাসও সময় লাগতে পারে।
ডা. জিনম্যান বলেন, টরন্টোর সানিব্রুক ক্লিনিকে প্রতি বছর প্রায় ৩০০ নতুন এএলএস রোগী সনাক্ত হয় এবং বর্তমানে সেখানে প্রায় ৭৫০ জন রোগী চিকিৎসাধীন।
এএলএস অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ১০ থেকে ১৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে এই রোগ নির্ণয়ে প্রাথমিকভাবে ভুল হয়, তার মানে, অন্য কোনও রোগের বা অবস্থার লক্ষণ মনে করা হয়।
জিনম্যান বলেন, অবশ্য, নিউরোলজিস্ট বা বিশেষজ্ঞের হাতে এমন ভুল বিরল।
তিনি বলেন, নিউরোলজিস্ট বা নিউরোমাসকুলার বিশেষজ্ঞরা রোগীর অবস্থা বিশ্লেষণ করেন এবং ছদ্ম এএলএসের ধারণা দিতে পারে এমন অবস্থাগুলি নাকচ করে দেন।
তিনি উল্লেখ করেন যে, এই রোগ নির্ণয়ের জন্য লক্ষণ প্রকাশের পর থেকে ১৮ মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
তিনি বলেন, ফ্যামিলি ডক্টররা তাদের সারা জীবনে মুষ্ঠিমেয় এএলএরস রোগীর চিকিৎসা করে থাকেন।
ডা. জিনম্যান বলেন, আমি দুঃখের সাথে বলি, ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানদের কখনই এএলএস নির্ণয়ের কাজ করা উচিৎ নয়, কারণ এটি বিশেষ দক্ষতার একটি কাজ এবং এতে অনেক কিছু বর্জনেরও বিষয় থাকে। এই রোগ নির্ণয় করা খুবই কঠিন।”
জিনম্যান বলেন, এএলএস নির্ণয়ের জন্য এ সম্পর্কিত কোনও বায়ো-মার্কার বা রক্ত পরীক্ষার সুযোগ নেই, তাই রোগীকে যথাযথ বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো অপরিহার্য।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই রোগে আক্রান্তদের সহায়তার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করাও অত্যন্ত জরুরী।
তিনি বলেন, পারিবারিক চিকিৎসক যদি রোগীর এএলএস আছে বলে সন্দেহ করেন তাহলে তার উচিৎ রোগীকে বিস্তারিত টেস্ট করানোর জন্য কোনও বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করা এবং তাৎক্ষণিকভাবে তাকে কোনও এএলএস ক্লিনিকের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়া। সূত্র : ব্রিটানি গ্রিনস্লেড – সিবিসি নিউজ