প্রবাসে পরহিতকর্ম -১০৩

আলবার্টার পথে পথে

রীনা গুলশান

গতরাতে  TAKETOMI রেস্টুরেন্টে বেশ জম্মেস খেয়ে, বাসায় আসতে আসতে প্রায় রাত ১২ টা। বাসায় এসে রুম্মান বললো, সবাই ঘুমাতে যাও, আগামীকাল আবার সকাল সকাল বের হতে হবে। আমার আবার এশার নামাজ। এই নামাজ একটু দীর্ঘ সময় নিয়ে পড়ি। অতএব, যার যার বেডরুমে চলে গেলাম।

যখন ঘুমাতে গেলাম, ঘুম অনেক আগেই উড়ে গেছে। Banff এ যাবো। এই চিন্তায় বিভোর হয়ে রইলাম বাকি রাত।

ফজরের নামাজ পড়ে আমি আবার একটু বিছানায় যাই। আজ আর গেলাম না। কাজিমকেও বললাম, সকালের নাস্তা পর্ব সব সেরে ফেলো। আমার হাক ডাকেই বরং রুম্মান ও তিতল উঠে পড়লো। রুম্মান বললো- মামনি, যদিও অক্টোবর মাস, তবু হালকা জ্যাকেট সাথে নিও। তোমার ঠান্ডা লাগতে পারে।

সবাই রেডি হয়ে রওনা দিলাম। সাথে বিভিন্ন রকমের চিপস, স্ন্যাকস জাতীয় খাবার এবং ড্রিংস নিলাম। রুম্মানের বাসা থেকে ‘লেক লুইস’ (Lake Louise) এর পথ দেড় ঘন্টার মত হাইওয়েতে। Banff হলো আলবার্টার একটা পর্যটন শহর। এখানে লোক বসতি খুব বেশী না। আবার কমও না। প্রায় আট হাজার মানুষ বাস করে Banff এ। যদিও এটি সাম্প্রতিক সময়ের হিসাব নয়। ৬/৭ বছর আগের হিসাব।

রুম্মান একটু দ্রুত গতিতে গাড়ি চালায়। আধা ঘন্টার মধ্যেই চারপাশের দৃশ্যাবলী একেবারে পাল্টে গেল। এখন চারপাশে পাহাড়ের হাতছানি। পাহাড়গুলো এত বড় বড় যে আকাশের সাথে একদম মিলেমিশে একাকার। যতই এগিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের রূপ একেবারেই অন্যরকম। উচ্চতায়ও একেকটা যেন আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে।

এই সেই ‘রকি মাউন্টেন’! যার নাম শুনে আসছি সেই ছোট বেলা থেকেই। ছোট বেলায় জিওগ্রাফিতে পড়েছি এই রকি মাউন্টেনের কথা। তারপর বড় হয়ে পড়েছি সুনিলের ‘পায়ের তলায় সরষে’ এর দুই খন্ডে। দুইটা বই এর ব্যপ্তি ঘটেছে নানা বিষয়ের উপর। কিন্তু মূল বিষয়টা ছিল এই ‘রকি মাউন্টেন’। কবি এর শেষ দেখতে চেয়েছিলেন। উনি সত্যি সেটা করেছিলেন। আমি তো কেবল ‘বুড়ি ছোঁয়া’ করে এলাম। 

লেক লুইসের কর্নার। পাহাড়ের শরীর দিয়ে পাইনের সারি। ছবি: লেখক

সেদিন ছিল আকাশ ভরা রোদের ছোঁয়া। এত ভাল লাগছিল। মাঝে মাঝে জীবনটা এত সুন্দর হয়ে যায়। রুম্মানের পাশের সিটে বসেছিল কাজিম। আমার খুব প্রব্লেম হচ্ছিল ছবি তুলতে। এমন এমন দৃশ্য আমি মিস করছিলাম যে কি আর বলবো? আমি খুব রেগে যাচ্ছিলাম, ছবি তুলতে পারছিলাম না, তাই।

এদিকে রুম্মান এত সুন্দর ভাবে প্রতিটি বাঁকের বর্ণনা করছিল যে কি আর বলবো। এই সব রাস্তা রুম্মানের একদম মুখস্ত। এতবার এই রাস্তায় সে গিয়েছে যে চোখ বন্ধ করে সব বলে দিতে পারবে। নিজেরাতো মাঝে মধ্যে যায়। তারপর রুম্মান এখানে অবস্থান নেবার পর প্রচুর বন্ধুবান্ধব বেড়াতে আসে এই Banff দেখার জন্য। এখন আবার আমরা এলাম।

মজার ব্যাপার দেখলাম, এত দূর এলাম কিন্তু একটিও ঘর বাড়ি চোখে পড়লো না। মাঝে মাঝে দেখলাম পাহাড়ের পদদেশে পানির রেখা। পাহাড়ের উপর রোদের ঝিলিক দেখা যাচ্ছে, তখন দেখলাম, পাহাড়ের রঙগুলো। অসাধারণ সব। একটির সাথে অন্যটির কোন মিলই নাই। প্রতিটির রঙ যেন আলাদা। আগে জানতাম সব পাহাড়ের একই বর্ণ হয়। সুরমা ধরণের। কিন্তু রকি হিলস তো রকি হিলস, এর এক একটির এক বর্ণ। সাদা, এ্যাশ, এমনকি হালকা সবুজ এবং গাঢ় সবুজ রঙের পাহাড় দেখলাম। জীবনে কখনো সবুজ পাহাড় দেখবো, ভাবিইনি। কোনটা হালকা সবুজ, আবার Banff এর অন্য আর একটি লেকে গিয়েছিলাম, অতি বিস্ময়ের সাথে দেখেছিলাম গাঢ় সবুজ আদিগন্ত পাহাড় স্থির দাঁড়িয়ে আছে, মানুষকে অদ্ভূত ভাবে অবাক করে দিয়ে। কোন কোন পাহাড় দেখেছি আকাশী রঙের যেখানে আকাশ মিলে যায়। বোঝার কোনই অবকাশ নাই, কোনটা আকাশ আর কোনটা পাহাড়? সৃষ্টিকর্তার কি অপরূপ সৃষ্টি! যতই দেখছি, বিস্ময়ের ঘোর আর কাটে না।

‘দেখি, বিস্ময়ে অবশ, আত্মহারা,

আমার নয়নে তাকিয়ে নিমেষ হত,

সপ্রান মনি, স্বচ্ছ আলোর মতো

তার সাগ্নিক, হালকা চোখের তারা।’

একটু পরই দেখলাম Banff লেখা নাম ফলক। দিক চিহ্ন দেওয়া নতুন পর্যটকদের জন্য দূরাগত মানুষের জন্য। জানি যে এখন আমরা Banff’র মধ্যেই আছি, তবুও সাইনবোর্ড দেখবার পর থেকে হাজারটা প্রজাপতি বুকের মধ্যে নেচে উঠলো।

এতক্ষণ ধরে যে চলেছি, হাইওয়ের দু’পাশে কোন ঘর/বাড়িই দেখতে পাইনি। এখন কিছু দূর চলবার পর একটি দুটি ঘর দেখতে পাচ্ছি। রাস্তা বাঁক নিল। আর হাইওয়েতে রইলাম না। এবারে সত্যিকার অর্থে পাহাড় কেটে রাস্তা, সেখানে প্রবেশ করলাম। এর আগেও আমি যত পাহাড়ী এলাকায় গিয়েছি, যেমন ভারতের ঊটি, ত্রিপতি, সিমলা, দার্জিলিং, আর ইউরোপের সুইজারল্যান্ড… আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটতো না। মানুষের পক্ষে কি ভাবে সম্ভব এই সুউচ্চ পাহাড় কেটে রাস্তা বানানো? বেশ ভালভাবেই দুটো গাড়ি যেতে পারে। এবং যেহেতু দু’পাশেই পাহাড় আছে তাই কোন ভয়ও করে না তেমন, যারা ড্রাইভ করে। আমি জীবনে একমাত্র ভয় পেয়েছিলাম ‘ত্রিপতি’ যাবার সময়। রাস্তাগুলো ভীষণ চাপা এবং তার মধ্যেই দুটো গাড়ি যাতায়ত করছে এবং কিনারাতে ফাঁকা। অর্থাৎ পড়ে গেলেই নির্ঘাত পরপারে। সেই অর্থে ‘ঊটি’র রাস্তা অনেক চওড়া।

এবার আমরা ‘লেক লুইস’ এর দিকে যাচ্ছি। এসবই আলবার্টার ‘ন্যাশনাল পার্ক’ এর মধ্যে অবস্থিত। এই ‘ন্যাশনাল পার্ক’ এর মধ্যে পৃথিবীর সব অমূল্য সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে।

‘লেক লুইস’ এত সমৃদ্ধ কারণ বোধহয় এর অপার সৌন্দর্যময় রঙ এর জন্য। এবং হাইকিং এর জন্য বিখ্যাত। রুম্মান বেশ আঁকা বাকা পথে এগিয়ে চলছে। মনে হচ্ছে পথ কি শেষ হয়ে যাচ্ছে? Banff এর শুরু থেকে ‘লেক লুইসের দূরত্বটা ঠিক কতটা? টুরিস্টদের মনে এটা আসতেই পারে। ৫৭ কিলোমিটার।

আমরা বেশ কাছাকাছি চলে এসেছি। তবে ‘লেক লুইস’ এর বেশ দূরেই গাড়ি পার্ক করতে হয়। পৃথিবীর যা কিছু মনোরম সেখানে পদব্রজেই যেতে হয়। বেশ কিছুটা পথ হেটে সেখানে পৌছালাম।

এই সেই ‘লেক লুইস’। আমি অনেক্ষণ, কতক্ষণ জানিনা, কথাই বলতে পারছিলাম না। বিস্ময়ে মূক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম কতক্ষণ, বলতে পারবো না। সারা পৃথিবীর সৌন্দর্য্যরে বেশীর ভাগ জায়গাতে সৃষ্টিকর্তা আমাকে নেবার সৌভাগ্য দিয়েছেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত আমি এই পরিমান বিমুগ্ধ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই নি।

জান্নাত দেখিনি, কিন্তু মনে হলো এটা জান্নাতের একটি টুকরো। মনে হলো জান্নাতের সিড়িঁ বেয়ে নেমে আসা, এই সেই জান্নাত।

এরকম গাঢ় ফিরোজা রঙের পানি এর আগেও একবার দেখেছিলাম। নৈনিতাল এর প্রথম তাল (লেক), তার পানিও ফিরোজা রঙের। মাদ্রাজের ‘বীচ’ এর পানিও নীল। শারজাহ’র আরব সাগরের পানিও গাঢ় নীল বর্ণের। সবই সত্য।

তবে এটাও সত্যি ‘লেক লুইস’ এর গোটা ছবিটা, প্রথমেই আপনাকে বিস্ময়াভূত করবে। এটা পৃথিবী যে সৃষ্টি করেছেন, সেই মালিকুল মূলক, সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি।

লেক লুইসের ঠিক পেছনটাতে বিস্তির্ন পাহাড়। দুই পাশে দুটো পাহাড়, আর মাঝখানে মনে হবে জল। আসলে ওটাও পাহাড়। এবং অত্যাশ্চর্য-ঐ পাহাড়টা কেমন জানি সমতলের মত, আকাশের সাথে মিলানো রঙের। গোটা ব্যাপারটা নীল রঙের। আর সেই নীলের সেডে, এটার সৃষ্টি। হালকা আকাশী থেকে গাঢ় আকাশী, তারপর গাঢ় ফিরোজা। আর পাহাড়ের শরীর ঘেষে, নীচ থেকে গাঢ় সবুজের পাইনের সারি। একদম পাহাড়ের শরীর বেয়ে, ছোট থেকে বড় সেই বৃক্ষরাজি। তার উপরে, গাঢ় সুরমা বর্ণের পাহাড় এবং তার উপরে গভীর আকাশী বর্ণের আকাশ।

দিগন্ত বিস্তির্ন সেই আকাশ। লেকের সমস্ত পানি কাঁচের মত স্বচ্ছ। একটি একটি পাথরের কুচিও আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। রাস্তা থেকে, লেক লুইসে নেমে যাবার গোটা পথটা পাথরের টুকরো। এটাও প্রাকৃতিক। সরকার ৬/৭ ফিটের মত একটা রাস্তা বানিয়ে দিয়েছে, মানুষের যাতায়তের জন্য।

এখান থেকে এরপর টুরিস্টরা ‘হাইকিং’ করে। রুম্মান, তিতলী, ছোট্র কিয়ারাকে নিয়ে বেশ অনেকটা দূর পর্যন্ত হাইকিং করেছে।

আমার পক্ষে সম্ভব নয় এবং হাইকিং করবার এমনকি ইচ্ছাও পোষন করি না।

আমি একটা উচুঁ পাথরের টুকরোর উপর স্থবির হয়ে বসে রইলাম। আর ভাবছিলাম এই এ্যাদ্দুর আসা, শুধু সার্থক হয়নি, তাই নয়, জীবন ধন্য

হলো এবং হঠাৎ করেই মনে হলো, এই জীবনে আর কিছু দেখবার রইল না। এক জীবনে রাব্বুল আলামিন আমাকে সব দিয়েছে –

‘তারপর এতদিন পৃথিবীর রঙিন সম্ভার দৃষ্টির চুম্বনে,

পান করে বিমুগ্ধ হয়েছি।

দেখেছি প্রত্যেক রাত্রির অন্ধকারের জঠরে

কী করে নতুন দিন পদ্ম কলির মত জন্ম পায় -’

চারপাশে প্রচুর দর্শনার্থির ভীড়। তবে বেশীরভাগই শব্দ করছে না। বাচ্চারা একটু কিচির মিচির করছে। সেটাও এখানে ভাল লাগছে না। এখানে কেবল-ই শব্দহীনতা, একেবারে নির্জনতা ভাল লাগে। (চলবে)

রীনা গুলশান, টরন্টো

gulshanararina@gmail.com