প্রবাসে পরহিতকর্ম -১০২

আলবার্টার পথে পথে

রীনা গুলশান

আলবার্টা একটি পর্বতমালা সমৃদ্ধ রাজ্য। তাই এখানকার আকাশটা থাকে দারুন স্বচ্ছতায় ভরা, এবং নানা রঙের খেলায় ভরা থাকে দিন/ রাত্রির ভূ ভাগ ।

আমরা এসে যখন ক্যালগারি-তে  প্রবেশ করেছিলাম , তখন সেই পর্বত রাজ্যে গভীর রাত নেমে এসেছিল। কোন কিছুই দেখতে পাইনি। আমরা দুজন, দুচোখ ভরে আকন্ঠ পান করছিলাম, আমাদের জানটুস নাতনী “কিয়ারা”কে।  ছেলের বউ তিতলী প্রচুর আইটেম রান্না করে রেখেছিল, বিশেষ করে, শুটকি ভর্তা, চিংড়ি ভর্তা (এগুলো আমার জন্য, আমার স্বামী কাজিম খন্দকার শুটকি খায় না), আমি খুবই তৃপ্তি করে খেলাম। তারপর রাতের বেলায় রীতিমত ম্যারাথন আড্ডায় নিমজ্জিত হলাম। কারণ পরের কয়দিন ছিল, শুক্র শনি এবং রবিবার। শুক্রবারটা রুম্মান মোটামুটি  ছুটির  নিয়েছে আমাদের উপলক্ষ্যে। শনি/ রবিবার আমরা সেই বিস্ময়কর সৌন্দর্য ‘ব্যানফ’ কাছে যাবো। 

এতদিন পর বাপী ও মামনি কে পেয়ে ছেলে রুম্মান দারুন উত্তেজিত ছিল। আমার বড় ছেলে রায়হান, SSC’র পর থেকেই দুরে দূরে ছিল, পড়াশুনার জন্য। কিন্তু রুম্মান-কে ছাত্র অবস্থায় কখনো দূরে যেতে হয় নি মা/বাবা কে ছেড়ে। তাই পেশার কারণে কয়েক বছর আগে টরন্টো ছেড়ে রুম্মানের এই ক্যালগারি চলে আসা আমাদের কারো জন্যই সুখকর ছিল না। মন কখনো মেনে নেয় নি। তবু যেতে দিতে হয়েছে, সন্তানের সূবর্ণ জীবনের জন্য।

কিন্তু রুমুর এই চলে আসায় আমাদের জীবনে নেমে এসেছে গভীর তমোসা। মনে হয় জীবন যেন হটাৎ করে আমাদের ছুটি দিয়ে দিয়েছে। এক সাগর ধূ ধূ করা মরুভূমির নির্জনতা, আমাদের জীবন কে বধির করে দিয়েছে। জীবনে যা কিছু করবার ছিল, মনে হলো সব কিছু করা হয়ে গিয়েছে। আর তো কিছুই করার রইলো না, তবে এখন এই জীবনটাকে নিয়ে কি করবো ?? এই রকম চিন্তা ধারায় আমরা দুজনেই নিমজ্জিত ছিলাম। এই চিন্তাভাবনা গুলো কেউ ইচ্ছা করে ভাবে না। অজান্তেই চলে আসে মস্তিস্কে। হৃদয়ের প্রতিটি তন্ত্রিতে।

আলবার্টা একটি পর্বতমালা সমৃদ্ধ রাজ্য। ছবি: লেখক

মজার ব্যাপার, আমাদের বিবাহিত জীবনের চার দশক অতিক্রান্ত হয়েছে, আমি কখনো কাজিমকে অসুস্থতায় দেখিনি। মনে হয় অসুখ গুলো কোথাও ওঁত পেতে অপেক্ষমান ছিল। রুম্মানের টরেন্টো ছেড়ে চলে আসবার পর ,একে একে সেগুলো কাজিমকে  আক্রমণ করে চলেছে। মানুষটা হটাৎ করে রোগে শোকে জীর্ন গ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে। তার চরিত্রটা নারিকেলের মত। উপরটা মারাত্মক শক্ত। ভেতোরটা ততোটাই নরম। সে কোন কষ্ট সহজ ভাবে মানতে শেখেনি। আমি একদম উল্টো চরিত্রের। কারো দেওয়া কষ্টে আমি বিস্মিত হই, কিন্তু বিবর্ণ হই না। জীবন আমাকে অহর্নিশ শক্ত পথে পরিক্রমায় রেখেছে। আমি সেজন্য সৃষ্টিকর্তাকে অজশ্র শুকরিয়া জানাই। শরীর আমাকে ভঙ্গুর করে দিলেও, মনে মনে আমি অটল সিংহাসনে বসে থাকি।

রুম্মানের বাড়ির ব্যাকইয়ার্ড টা অসম্ভব সুন্দর। বিস্তর এক প্রান্তর, শেষে অন্য আর একটি বাসস্থানের সারিবদ্ধ তা শুরু হয়েছে। অনেক দূরে মনে হয় পাহাড়ের হাতছানি। রুম্মানের নর্থ ওয়েস্টের এই রেসিডেন্সিটা নতুন শুরু হয়েছে, এই বছরখানেক থেকে। তাই কারুরই ব্যাকইয়ার্ড সেই ভাবে করা হয় নাই। একমাত্র রুম্মান তার ব্যাকইয়ার্ডের কাজ সুসম্পন্ন করেছে। আঁশে পাশে আর কেউই ব্যাক ইয়ার্ডের কাজে হাত দেয়নি, তাই সব ফাঁকা ফাঁকা লাগে।

আমরা সকালেই রুমুর এরিয়াটা ঘুরতে বের হলাম। ওর দুটো বাড়ীর পরই একটা রাস্তা করে দিয়েছে, পেছনে যাবার জন্য। পেছনে আবার মেইন রোড, সেই জন্য রুম্মান এবং আরো ৫/৬ জন এর বাড়ীর পেছনে ৬/৭ ফুট উঁচু প্রাচীর। মেইন রোডের পাশে  যথারীতি পায়ে চলার রাস্তা রেখেছে। এবং পাশেই “বাস স্টপেজ”। তার পাশ দিয়ে অকস্মাৎ নেমে যাওয়া এক আঁকা বাঁকা রাস্তা। এই রাস্তাটা মূলত রুম্মান দের, রেসিডেন্সির এরিয়ার পেছন টা। রেসিডেন্সির  ফ্রন্ট ফেজে করেছে, আর একটা বাস স্টপেজ, এবং বিশাল আকারের আউটলেট মল, নো-ফ্রিলস (গ্রোসারি স্টোর) অলরেডি করে ফেলেছে। পেছন টা অসম্ভব সুন্দর। পাহাড়ী ঢলের মত, অনেকটা নেমে যাওয়া এই রাস্তার পাশেই বিশাল আঁকা বাঁকা লেক। লেক টা দেখে কেন যেন মনে হয়, বিল্ডাররা নিজেই লেক টা করেছে। কারণ লেক টার দৈর্ঘ্য ঠিক ততোটা, যতোটা এই রেসিডেন্সির সীমানা। এবং অত্যাশ্চার্যের বিষয় হলো, দেখলাম, লেক বোঝাই হয়ে আছে, বলাকা হাঁস ( আমি নাম টা দিলাম)। কারণ এরা দীর্ঘ আকাশ ভ্রমণ শেষে এই লেকে অবতরন করেছে, জলকেলির জন্য। আমি এত গুলো বলাকা হাঁস কখনো একসাথে দেখিনি। অথচ আমি “লেক অন্টারিওর” গা ঘেঁষেই বাস করেছি এক দশক। সেখানে অনেক বড় বড় হাঁস দেখেছি। তবে কিছু কিছু বলাকা হাঁস ও যে নাই, তা নয়। তবে এই ছোট্ট লেকে  যত গুলো দেখছি, অত দেখিনি এক সাথে। এই বলাকা হাঁস গুলোর শরীরের বর্ণ একটু ডার্ক। আর কদিন পর হয়তো এরা আসতে পারবে না। কারণ প্রবল শীত এবং বরফাচ্ছন্ন স্থানে এরা থাকতে পারে না। তখন এরা অন্য কোথাও ডানা মেলে দেবে। জানিনা কোথায় হবে এদের ঠাঁই।

বোঝাই যায় বিশাল বিশাল পর্বত মালা কে বিসর্জন দিয়ে, এই নবনির্মিত বাসস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। গোটা আলবার্টার সৃষ্টিই হয়েছে, এক একটি পর্বতমালার বিসর্জনের মধ্য দিয়ে। 

সুনিল গঙ্গোপাধ্যায় যখন “পায়ের তলায় সরষে-২ খন্ড” লিখেছিলেন, এই বই দুটোর মূল বিষয়বস্তুই ছিল  কানাডা। আর তাতে প্রাধান্য পেয়েছে, আলবার্টা। শেষ করেছেন, একজন বন্ধুর- বন্ধু, নব পরিচিত, তার সাথে ক্যালিফোর্নিয়া গমন। এবং সেখানকার কিঞ্চিৎ বর্ণনা শেষে, বইটির সমাপন। মূলতই সুনিল বর্ণনা করেছেন, এই আলবার্টার অতি বিস্ময়কর সৌন্দর্য নিয়ে।

এই সৌন্দর্যর বর্ণনা, আমরা কিছুটা চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু সেটা চোখে দেখার সেই অপার সৌন্দর্যর এক চতুর্থাংশের কম মনে হবে। এটা সম্পূর্ণটা সম্ভব হতো যদি ভিডিও তে ধারণ করে দেখানো যেত।

রুম্মানের বাসায় কাজিম খন্দকারের একজন সহপাঠির, পুত্রও অকস্মাৎ আগমন করেছে। সে আবার ৪/৫ জন টরেন্টোর বন্ধু নিয়ে এসেছে। তারা অবশ্য “এয়ার বি এন বি” তে উঠেছে ।

শুক্রবার জুম্মার নামাজ বিধায় কাজিম কোথায় যেতে চায় না। রুম্মানের হাফ অফিসও আছে। তবু সে বলেছে, বিকালের দিকে আমাদের নিয়ে বের হবে। মোটামুটি শহর টা দেখাবে। তবে ডাউন টাউনটা দেখানোর জন্য পরে একদিন নিয়ে যাবে, যেদিন ডিটেলসে দেখাবে। আগেই শুনেছিলাম, ক্যালগেরীর ডাউন টাউন টা বেশ সমৃদ্ধ।

দুপুর থেকে তিতলী আমাদের তাড়া দিল, রেডী হয়ে নিতে। সেও রেডী হলো আমরা সবাই বের হলাম। প্রথমে রুম্মান, ওদের রেসিডেন্সি এরিয়াটা ঘুরিয়ে দেখালো। বেশ চমৎকার সব বাড়ী। যেখানে এই এরিয়াটা শেষ হয়েছে, সেখানে অসম্ভব সুন্দর স্টিলের অনেক লম্বা লম্বা টাওয়ারের মত আছে। অনেকটা দেখতে ছাতার মত। অনেক বড় বড়। ওটাই সেড। দু’পাশেই আছে, ওখানেই বাস স্টপেজ। এবং এই এরিয়া থেকে বের হতেই ডান হাতে ‘No Frills’ ও বিশাল আউট লেট মল।

বাড়ী থেকে বের হতেই রাস্তা গুলো দেখলেই বোঝা যায়, এগুলো পাহাড় কেটে করা। মাঝেমাঝে বেশ উপরে উঠে যেতে হয়। তারপর আবার বেশ নীচু। আমাদের অন্টারিও তে গাড়িতে উঠলেই যেমন চারপাশে সব সারি সারি বাড়ী, দোকান পাঠ। এখানে তা নয়। এখানে প্রায় সব কিছু সিস্টেমেটিক ওয়েতে করা। একটা এরিয়া থেকে অন্য এরিয়া অনেক দূরে দূরে। এক / দেড় ঘন্টা করে লাগে। আমরা মোটামুটি শহরটা ইতি উুতি ঘুরছি। এখানে গাড়িতে উঠার পরই আপনার চোখ টানবে, দূরে অনেক দূরে। সর্বত্রই মনে হবে পাহাড় এর হাতছানি। এদিক ওদিক অনেক ঘুরালো, এবং সামনের থেকে মোটামুটি ধারাবর্ণনা দিয়ে চলেছে , ওর বাপী কে। আমরাও কিছু কিছু শুনছি। সাড়ে সাতটার মত আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালো। এরপরই ডাউন টাউনের দিকে মোড় নিল। তার উদ্দ্যেশ্য হলো, আমাদের, এখানকার একটা ভাল মানের রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাবে। সবাই নাকি এদের খাবার খুব পছন্দ করে। নাম টি হলো TAKETOMI. এটি একটি হাক্কা চাইনিজ কুইজিন।

যারা অতি নিকট অতীতে টরেন্টো ছিল, সেই সব জনগনের এখানে খুব ভীড়। আমার ছেলে আর রওনক এর পরিবার প্রায়ই এখানে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে আসে। তারা হাক্কা নামের

একটা মিক্সড কিছু খেতে আসে। এখন আমাদেরও নিয়ে এসেছে। রেস্টুরেন্ট টা বেশ বড় এবং ডেকোরেটেড। লালের প্রভাবে সাজানো। এখানে যেহেতু দুবার খেয়েছি। তাই দেখলাম দ্বিতীয় বারের সার্ভিস টা ভাল ছিল। এই দুই ছেলে একটার পর একটা অর্ডার দিয়ে চলেছে। কত খাবে এরা ? খাবার এলে, খাওয়া শুরু করলাম। ওমা বলে কি, এটা নাকি হাক্কা ? আমি আর কাজিম, দুজনই কোন কমেন্ট না করে টুকটাক খেয়ে নিলাম। রুমু বললো : বাপী কেমন লাগলো হাক্কা ?

এর উত্তরে আমি হেসে ফেললাম। আমার হাসিতে, সবাই হেসে দিল। আর ঐ হাসির মাঝেই ছিল, প্রকৃত জবাব। চাইনিজ মনে করে এটা খেতে হবে। হাক্কার “হ” পর্যন্ত নাই এখানে। অস্টিনে (টেক্সাস) ও একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এমনিতে খাবার গুলো ভালই ছিল।

যাইহোক খেতে খেতে রাত ১১ টার মত বেজে গেল। এখন উঠতে হয়। এ তো খাওয়া নয়, ভালবাসার একটানা আড্ডা।

রাতের আঁধারে ঘরমুখো হলাম। পাহাড়গুলো রাতের গভীর আঁধারে দেখা যায় না বললেই চলে। তবু ডাউন টাউনের চাকচিক্য ভরা, সাজানো হাইরাইজ বিল্ডিং এর মাঝ দিয়ে, অকস্মাৎ তার ছোয়া দেখতে পাচ্ছিলাম। আর অন্ধকারের  নিজস্ব আলোটা, যে একবার দু চোখ ভরে দেখতে পেয়েছে, তার আর কিছু দেখার সাধ হবে না। কি যে সেই মায়াবী সৌন্দর্য, দু চোখ ভরে দেখতে দেখতে একবারও মনে হবে না, চোখ দুটো লুকিয়ে ফেলি আলোতে।

রীনা গুলশান, টরন্টো

gulshanararina@gmail.com