ভালবাসার এই শহরে

জসিম মল্লিক

১.    টরন্টো শহরটা আমার কেমন লাগে? এখানকার মানুষরা কেমন? এই প্রশ্নটা আমি প্রায়ই করি। অন্য কাউকে করি না। নিজেকে নিজে করি। নিজের সাথে আমার অনেক কথা থাকে। যেহেতু আমার কথা বলার মানুষ কম তাই নিজের সাথে নিজে কথা বলি। আমার তেমন কথাও থাকে না। কথার পিঠে কথা একদমই আসে না আমার। কেউ আমাকে কথা দিয়ে আক্রমণ করলে আমি তোতালাতে থাকি। কথা হারিয়ে যায়। তাই যেখানে কথা আছে সেখানে আমি পারতপক্ষে যাই না। বস্তুতঃ আমি গর্তজীবি মানুষ। মানুষ অনেক কথা বলে। বলতে ভালবাসে। নিজের কথাই বলে বেশি। অন্যের কথা শুনতে চায় না। রাস্তাঘাটে, হোটেল রেষ্টুরেন্ট, সিনেমা হলে, লীভিংরূমে, বক্তৃতার মঞ্চে, লবিতে, পার্কে, পিকনিকে, বাসে, ট্রেনে, প্লেনে, আড্ডায় শুধু কথা আর কথা। কথা জিনিসটা যে কে আবিষ্কার করেছে! বড় ভাল জিনিস। তবে বেশিরভাগই আগড়ুম বাগড়ুম। ফেলে দেওয়ার মতো। মাঝে মাঝে দু’একটা ওজনদার কথাও শোনা যায়। তখন মনে হয় কথা তো নয় যেনো কুন্ডুল! অনেক কথার ভীড়ে আমার কথা তলিয়ে যায়। আমি কিছু বললে তা কারো কর্নকুহরে প্রবেশ করে না। অরিত্রি একদিন বলেছিল, মা দেখেছো বাবা একা একা কথা বলে! জেসমিন উত্তরে বলল, মাথায় ছিট আছে তাই। আমি ঘরে যে কথা বলি প্রায়ই জেসমিন শুনতে পায় না। আমি তখন রেগে যাই। জেসমিন ততোধিক রেগে বলে, মিন মিনা স্বভাবটা বদলাও।

তবে আমি লিখে ভাল বোঝাতে পারি। আমার অবজারভেশন অনেক ভাল। আগামীকাল কি ঘটবে তার একটা আগাম বার্তা পাই প্রায়শঃই। এই ধরণের অলৌকিক ইমাজিনেশন আমি প্রকৃতি থেকে পেয়েছি। এই কারণে আমি জীবনে অনেক অঘটন থেকে মুক্তি পেয়েছি। কানাডা আসার আগে টরন্টো সম্পর্কে আমার তেমন কোনো ধারণা ছিলনা। কানাডা নিয়ে আমি কোনো গবেষণা করিনি। কানাডা আসার আগেও আমি ইউরোপ আমেরিকা ঘুরেছি। কিন্তু কখনও কোথাও স্থায়ী হওয়ার কথা ভাবিনি। কিন্তু মানুষ যা ভাবে হয় তার উল্টো। একদিন আকস্মিক আমি পরিবার নিয়ে কানাডা আসলাম। কেনো কানাডাকেই বেছে নিয়েছিলাম কে জানে। কানাডা না হয়ে হতে পারত আমেরিকা, হতে পারত ইংল্যান্ড বা অন্য কোনো দেশ। কিন্তু নিয়তি আমাকে কানাডার মতো মহান একটি দেশে নিয়ে এলো। আমি যেহেতু বিচিত্রা বা সাপ্তাহিক ২০০০ এর মতো পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছি তাই সাংবাদিক ক্যাটাগরিতে এপ্লাই করি। ইন্টারভিউ দিয়েছি লসএঞ্জেলেসে গিয়ে। এবং অনায়াসেই কোয়ালিফাই করি। আমি কখনও কারো কাছে দয়া ভিক্ষা করিনি। যখন আমার অনেক কষ্টের দিন গেছে তখনও আমি কারো কাছে হাত পাতিনি। আমি চাইলেই আমেরিকা বা অন্য কোথাও থেকে যেতে পারতাম। কিন্তু সন্তানদের কথা চিন্তা করে কোনো অনিশ্চিত জীবন বেছে নেইনি।

আজ থেকে বিশ বছর আগে যখন এই শহরে পা দেই তখন আমার চোখে বিরাট কোনো স্বপ্ন ছিল না। আমি শুধু চেয়েছি আমি যেখানেই থাকব আমার সন্তানরা আমার সাথে থাকব। ওদের ছাড়া আমি থাকতে পারব না। আমি যে ধরণের কষ্টের মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছি আমার সন্তানদের যেনো সেটা না পেতে হয় সেটা আমার মাথায় ছিল। জেসমিন সবসময় আমার সংগ্রামী জীবনের সাথে ছায়ার মতো থেকেছে। কখনও বিরক্ত হয়নি। হাল ছেড়ে দেয়নি। আমি যে শুধু লেখক হতে চেয়েছি জেসমিন কখনও তাতে বাঁধা তৈরী করেনি, আমার জগতে কখনো নাক গলায়নি। আমার সন্তানরাও তাই। ওরা আমাকে আমার মতো থাকতে দিয়েছে। আমার কোনো কিছুর সাথে ওরা জড়িয়ে পড়েনি। আমিও স্বাতন্ত্র বজায় রেখে চলেছি। কোনো কিছু চাপিয়ে দেইনি। সেটা আমার জন্য ভালই হয়েছে। আমি নিজে কিছুটা কমিউনিটিবেজ হলেও ওদেরকে এই জগতের নেগেটিভ কোনো কিছু যাতে স্পর্শ না করে সে ব্যাপারে আমি সচেতন থেকেছি। জেসমিন প্রচন্ড দূরদর্শী মানুষ। সে টরন্টো পা দিয়েই আবহাওয়া টের পেয়ে যায়।

আমি ২০০৪ সালে টরন্টো আসি। তার আগে এক বছর অটোয়া ছিলাম। ওরা যেমন একদমই কানাডা আসতে চায়নি। তেমনি অটোয়া থেকে টরন্টোও আসতে চায়নি। আমি জোর করে এনেছি। তখন টরন্টোর বাঙালি কমিউনিটি এতো বড় ছিল না। এতো সংগঠন, সমিতি, রাজনীতি, গ্রুপিং, দলাদলি, এতো পত্রিকা, টেলিভিশন ছিল না। টরন্টো এসে আমি একটা নতুন ভূবনের সন্ধান পেলাম। চমৎকার গোছানো একটি শহর। পৃথিবীতে কত শহরইতো দেখেছি কিন্তু টরন্টোর কোনো তুলনা নাই। টরন্টোর রাস্তায় পা দিলেই মনে হয় এটা আমার নিজের শহর। শক্তি ও সাহস পাই। এই শহর কাউকে পর করে না। বিপদগ্রস্থ করে না। উপেক্ষা করেনা। একা একা এই শহরে বসবাস করা যায়। এটা এমনই এক শহর যে শহর যে কাউকে বুকে তুলে নেয়। তবে যত বেশি মানুষের সাথে জড়াবেন ততবেশি যন্ত্রণাময় হবে জীবন। প্রবাসে সর্বত্র যেটা দেখা যায় সেটা হচ্ছে যার যেটা বলার কথা না সে যখন সেটা বলছে, যার যা হওয়ার কথা না সে যখন তা হতে চাইছে, তখন এই জাতীয় মানুষদের সাথে মানিয়ে চলা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক ভাল ভাল কর্মকান্ডও হচ্ছে এই শহরে। তবে ভাল মন্দ থাকবেই, কোনোকিছু নিয়েই বিস্মিত হওয়ারও কিছু নাই। সবার সমান স্বাধীনতা। আপনি চাইলেই যে কাউকে উপেক্ষা করতে পারেন। চাইলেই নিজেকে বিরাট কিছু ভাবতে পারেন। জমিদার বলে প্রচার করতে পারেন। চাইলেই কাউকে ছেটে ফেলতে পারেন। কেউ আটকাচ্ছে না। তবে সবকিছুই নির্ভর করে মানুষের শিক্ষা, রুচি আর কালচারের উপর। একাডেমিক এবং পারিবারিক শিক্ষা অনেক বড় ফ্যাক্টর।

জীবনের সবকিছুই একটা অভিজ্ঞতা। কোনো অভিজ্ঞতাই বৃথা যায় না। সবকিছু থেকেই মানুষ শেখে। জীবন এমনই। আমি টরন্টো শহরটাকে ভালবাসি। এই শহর আমাকে অনেক দিয়েছে। যদিও আমি কোনো কিছুর সাথে জড়িত নই, আমি কোনো সভাপতি বা সেক্রেটারি নই, মঞ্চের লোক নই। মাইকের সামনে দাঁড়ানোর সবিশেষ ইচ্ছা আমার নাই। আমি সামনের আসনের স্যুট টাই পড়াও কেউ নই। আমি সবসময় পিছনের সারির মানুষ। আমাকে কেউ খেয়ালও করে না। সামনের আসনের বড় মানুষরা পিছনের মানুষদের দেখতে পায় না। সেটা আমার জন্য স্বস্তির। আমি বড় মানুষদের সামনে একদমই সহজ হতে পারি না। তাদের মধ্যে কি একটা যেনো ব্যাপার আছে, যা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। আমার দম বন্ধ লাগে।

আমি কোনো কিছু পাওয়ার জন্য কারো কাছে ধর্না দেইনি। পৃথিবীতে কিছুই আমার কাছে অনিবার্য মনে হয় না। এটা না পেলে আমি বাঁচব না, ওটা না হলে আমার চলবে না এমন মনে হয় না। জীবনে অনেক কিছুই পাবনা তাই বলে জীবন বৃথা হয়ে যাবে না। জীবনে যা পেয়েছি তাওতো কম না। এতো পাওয়ার কথা ছিল না। বেশি পেয়েছি মানুষের ভালবাসা। সামান্য উপেক্ষা ভালবাসার কাছে নস্যি। ওসব গায়ে না মাখলেও চলে। গত পনেরো বছর ধরে টরন্টো বইমেলায় আমার বই বেষ্ট সেলের তালিকায় থেকেছে। আমি যেহেতু লেখকই হতে চেয়েছি তাই এটা আমার জীবনে বড় প্রাপ্তি। কবি আল মাহমুদ বলেছেন, লেখকদের বেশি সামাজিক হতে নেই, এতে লেখক সত্বা নষ্ট হয়, এটা আমি মেনে চলি।

প্রকৃতপক্ষে আমি কোথাও থিতু হতে পারিনি। সেটা আমার অস্থির স্বভাবের জন্যেই। কি যে চাই, কোথায় যে স্বস্তি, কোথায় সুখ সেটাই জানিনা আজও। সুখ দুঃখের হিসাবটাও মেলাতে পারলাম না। কখনও মনে হয় এই যে সামান্য জীবন, এই যে বেঁচে আছি এতেই সুখ, আবার পরক্ষণে মনে হয় কোথায় সুখ! কোথাও সুখ নাই। বুঝতে পারি না কিছুই। সুখ দুঃখের সংজ্ঞাটা বড়ই গোলমেলে। কিছুতেই মেলাতে পারি না। একসময় বরিশাল ছেড়েছিলাম স্ব-ইচ্ছায়। মনে হয়েছিল বরিশালের গন্ডিবদ্ধ যে জীবন সে জীবন আমার না। বরিশাল ছাড়তে হবে। কিন্তু বরিশাল ছেড়ে কোথায় যাব, কার কাছে যাব, কেনো যাব তা জানতাম না। কিন্তু পূর্বাপর পরিণতি না জেনেই বরিশাল ছাড়লাম একদিন। নিজেকে নিয়ে যেহেতু আমার কোনো উচ্চাকাঙ্খা নাই, কোনো লক্ষ্য নাই তাই আমি যে কোনো কিছুই করতে পারি। নিজেকে আমি প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দিয়েছি। বরিশালের পর আমি ঢাকায় একটা লম্বা সময় কাটালাম। পরিবার তৈরী হলো। সবকিছুই যেনো অটো সিস্টেমে ঘটে গেছে। নিয়তি আমাকে চালিত করে গেছে। যেনো এক অদৃশ্য শক্তি কলকাঠি নাড়ছে। সেই শক্তি বিপদ দিয়েছে আবার বিপদমুক্তও করেছে। নিজের প্রত্যাশা ও ইচ্ছার বাইরে অনেক কিছু ঘটেছে। জীবনে অলৌকিক অনেক কিছু ঘটে। আমার জীবনটাও তাই।

একটা বিল্ডিং শক্ত পোক্তভাবে তৈরী না হলে তার আয়ূ হয় ক্ষনস্থায়ী। ভাল রড, সিমেন্ট দিতে হয়, তাহলেই বিল্ডিং মজবুত হয়। ঝড় বৃষ্টি আসলে ছনের ঘর মুহূর্তে খসে পড়ে, উড়িয়ে নিয়ে যায়। পলকা কোনো কিছু টেকে না। ভাল মেধা না থাকলে, বৈষয়িক বুদ্ধি না থাকলে, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মানুষ সফল হতে পারে না, ঝড়ে যায়, খসে পড়ে। আমার ক্ষেত্রে এসবই হওয়ার কথা ছিল। ঝড়ে যাওয়ারই কথা ছিল। আমি নিজেকে গুছিয়ে এক জায়গায় জড়ো করতে পারিনি। নিজেকে কখনও তৈরী করতে পারিনি। গোটা জীবনটাই প্রিম্যাচিউরড বেবির মতো। মানুষ নিজেকে সবটা গোছাতে পারে না। আমি অনেক স্পর্শকাতর মানুষ। আবেগী মানুষ। এগুলোই আমার সমস্যা। মানুষ তার স্বভাব বদলাতে পারে না। আমিও না। কোনোকিছু গভীরভাবে তলিয়ে ভাবতে পারি না। আবেগের কাছে বাস্তবতা পরাভূত হয়। সামান্য কারণে আমি বেসামাল হই, ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাই। নিজেকে ভাঙ্গাচোরা কিছু মনে হয়। ভগ্নস্তুপের বাসিন্দা মনে হয়। আমি যা কিছু করি- এই জীবন যাপন, সংসার, সন্তান, বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা, লেখালেখি এর কিছ্ইু মনে হয় আমার জন্য প্রযোজ্য না। আমি এর কোনো কিছুর অংশ মাত্র না। মনে হয় রাগ, দুঃখ, মায়া, অভিমান, প্রেম, আশ্লেষ এসবের উর্ধ্বে এক অলৌকিক জীবনে বসবাস করতে পারলে ভাল হতো।

চারিদিকে মানুষের এই যে এতো আয়োজন মনে হয় আমি এসবের অংশ না। প্রতিযোগিতাময় এই পৃথিবী, যুদ্ধ, দখল, খুন. হত্যা, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি, প্রতিযোগিতা, ঈর্ষা, ঘৃণা, ভুল বোঝাবুঝি, সাফল্য লাভের চেষ্টা এসব থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলে ভাল হতো। বাকী যে কয়দিন বাঁচি শান্তিতে থাকতে পারলেই ভাল। মনের এইসব চঞ্চল ভাবনাই আমাকে কোথাও স্থির হতে দিল না। কখনোই দেবে না। একদিন আমি ঢাকা শহর ছেড়ে দিলাম। চলে আসলাম কানাডা পরিবার নিয়ে। কোনো ঝুঁকির কথা মাথায় আসেনি। জীবনটা সমান তিনভাগে বিভক্ত আমার। বরিশাল-ঢাকা-টরন্টো। টরন্টো শহরে দীর্ঘদিন থেকেও নিজেকে উন্মুল মনে হয়। এখানেও আমি আসলে থিতু না। নানা কিছু মাথায় আসে এখনও। যে কোনো সময় সবকিছু ফেলে চলে যেতে হবে অজানা কোথাও। সেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। কাফনের কাপড় কেনা আছে।  আমি এমনই। কিছুই অনিবার্য না পৃথিবীতে। আবেগী বলেই মানুষকে ভালবাসি, নিজের সাথে জড়িয়ে ফেলি, আপন মনে করি। নিজেকে উজার করে দেই। গোপনীয়তা বলেও কিছু থাকে না। আমার হারানোর কিছু নাই। আড়াল করার কিছু নাই। যাদের আপন করতে চেয়েছি কোনো এক দুর্ভেদ্য কারণে তারা আপন থাকেনি। আবার যাদের আপন মনে করিনি তারাই আপন হয়েছে। এই রহস্য কিছুতেই ভেদ করতে পারি না। টরন্টো শহরও শেষ পর্যন্ত আমাকে আটকে রাখতে পারবে কিনা জানিনা। থিতু হতে দেবে কিনা জানি না!

মাঝে মাঝে মনটা কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। আউলা ঝাউলা লাগে। সবকিছু খাপছাড়া মনে হয়। জগতের সবকিছু বিষময় লাগে। কোনো কিছুতে মন বসে না। কোনো কিছু ভাল লাগে না। খেতে ভাল লাগে না, পড়তে ভালো লাগে না, সিনেমা দেখতে ভাল লাগেনা, বেড়াতে ভাল লাগে না, গল্প করতে ভাল লাগে না। এমনকি প্রিয় গানও বেসুরো হয়ে কানে বাজে। এর পিছনে নির্দিষ্ট কোনো কারণ হয়ত নাই কিন্তু তবুও মন বিক্ষিপ্ত লাগে। তখন ভাল ভাল কথাও ভাল লাগে না। সংসার অসহ্য লাগে, বাজার করতে অসহ্য লাগে, চারপাশের মানুষজনকে অসহ্য লাগে। ঠিক সেই রকম মুহুর্তে লেখার টেবিলে বসে বসে ঝিমোই। ডেক্সটপের সাদা স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে থাকি। ফেসবুক লগ অন করি। কিন্তু কিছুই মন দিয়ে দেখি না। সুন্দর সুন্দর নারী পুরষের ছবিও আর সুন্দর লাগে না, সুন্দর লেখাও হৃদয়ঙ্গম হয় না। সব ঝাপসা মনে হয়। কম্পিউটারের সামনে বসা মানেই তো লেখা নয়, এটা একটা অভ্যাসের মতো। সব লেখকদেরই মনে হয় এমন দৈন্য দশা হয়। বসে থাকেন ঘন্টার পর ঘন্টা। যন্ত্রণাময় সময় পার করেন কিন্তু কিছুই লিখতে পারেন না বা কিছুই লিখেন না।

কোনো এক দিন ঘুম ভেঙ্গে হয়ত একটা ম্যাসেজ আশা করছি হোয়াটসএপ বা ম্যসেঞ্জারে, বিশেষ কারো রিপ্লাই আশা করছি কিন্তু সেই রিপ্লাই আসে না, ম্যাসেজ সীনও হয় নাই তখন মন বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। কেনো ম্যাসেজ এলো না! নানা শঙ্কা কাজ করে। কোনো বিপদ হয়নিতো! কিন্তু জানার কোনো উপায় নেই। তখন খুবই হেল্পলেস লাগে। দ্রুত লিখে দ্রুত উত্তর পাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ সেটা ঘটেনা বলে হতাশা ভর করে। একসময় পত্রমিতালী করতাম। একশর মতো পত্র মিতা ছিল আমার। চিঠি লিখে এক সপ্তাহ দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করতাম। কবে আসবে চিঠির উত্তর! কবে ডাকপিয়ন সাইকেলের ঘন্টি বাজিয়ে সুগন্ধি মাখা এনভেলাপ এনে হাতে দেবে! সেই মুহূর্তের আনন্দের কোনো তুলনা নাই। ডাকবিভাগ কী থাকবে শেষ পর্যন্ত! পার্সেল আদান প্রদান ছাড়া চিঠির আবেদন কি শেষ হয়ে যাবে! নতুন প্রজন্ম জানেই না ডাক বিভাগের মাধ্যমে চিঠি আদান প্রদানের কি তীব্র আবেদন ছিল! এখন চ্যাটবক্সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সবাই। সোশ্যাল মিডিয়া দূরের মানুষকে কাছে এনে দিয়েছে। নৈকট্য তৈরী করতে সাহায্য করছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিপদ যেমন আছে বিপদমুক্তিও আছে। শঙ্কা যেমন আছে আনন্দও আছে। অপেক্ষা যেমন আছে উপেক্ষাও আছে।

কিছু মানুষ আছে খুবই নির্লিপ্ত। আবেগের মুল্য দিতে পারে না। আমার মধ্যেও নির্লিপ্ততা আছে। উদাসীনতা আছে। এটা আমার স্বভাবের অংশ। এটা আমি সবসময় কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করি। তবে আমার উদাসীনতা কোনোভাবেই উপেক্ষা না। আমি কাউকে উপেক্ষা করি না। আমি নিজেও উপেক্ষা জিনিসটা একদম নিতে পারি না। আজকের পৃথিবীতে সবকিছু এতো দ্রুত ঘটছে, এতো দ্রুত সবকিছু ছাড়িয়ে যাচ্ছে, ভাইরাল হচ্ছে, যে, কোনো একটা ঘটনায় মনোনিবেশ করা যাচ্ছে না। আপনজন বিয়োগে শোক পর্যন্ত করার সময় নাই। শোকের আয়ূ দ্রুত কমে যাচ্ছে। পৃথিবীতে এতো এতো ট্রাজিক ঘটনা ঘটছে, আপনজন চলে যাচ্ছে, ভালবাসার মানুষ চিরবিদায় নিচ্ছে, রোগে শোকে কাতর পৃথিবী। একটা থেকে আর একটা ঘটছে প্রতিনিয়ত। চোখের পানি শুকোতে না শুকোতেই অন্য একটা ঘটনা সামনে চলে আসছে। অচিন্তনীয় সব ঘটনা, হৃদয় বিদীর্ণ করা শোক গাঁথা। কিন্তু কোনোটারই স্থায়িত্ব নাই। তাই আবেগটাও ক্রমশঃ ফিঁকে হয়ে আসছে। এসব যখনই ভাবি তখনই মনটা এলোমেলো হয়ে যায়।

কি এক যন্ত্রণাময় পৃথিবীতে বাস করছি আমরা। এই যে যুদ্ধে গাজায় হাজার হাজার নারী শিশু মারা যাচ্ছে তাও আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করছে না। পৃথিবী নির্বাক তাকিয়ে দেখছে। এতো অন্যায়, এতো ক্ষমতার দাপট পৃথিবীজুড়ে। অথচ মানুষ কত অসহায়। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহসটুকু পর্য্যন্ত হারিয়ে ফেলছে মানুষ। শুধু তো যুদ্ধই নয়, পৃথিবী জুড়েই শুধু অন্যায়। ঘরে, বাইরে, সমাজে, রাষ্ট্রে সর্বত্র অন্যায়। এতো অন্যায়, অনাচার, অনিয়ম, দুঃখ কষ্ট, শোক সহ্য করার ক্ষমতা মানুষের নাই। এতোকিছু একসাথে মানুষ ধারন করতে পারে না। মানুষ দুঃখ, কষ্ট, শোক ভুলে যায়, ভুলতে পারে বলেই বাঁচে, টিকে থাকে। আমরা সবাই কষ্ট ভুলে থাকতে চাই। মা বাবার মৃত্যু বা প্রিয় সন্তানের মৃত্যুও আমরা সহ্য করি, প্রিয়তম স্ত্রী বা স্বামীর মৃত্যু সহ্য করি। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। ভুলে যায় ঠিকই কিন্তু হারিয়ে যায় না। যখন নির্জনতা বা একাকীত্ব গ্রাস করে তখন আপনজনরা সামনে চলে আসে। আমার ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে। আপন মানুষদের জন্য, যাদের ভালবেসেছি বা যেসব আপজন হারিয়েছি তাদের জন্য একটা কষ্টকর অনুভূতি, একটা যন্ত্রণা অহর্নিশ আমাকে ভোগায়, আমাকে এলোমলো করে দেয়। আউলা ঝাউলা করে দেয়।

দোকানপাটে গেলেই দেখা যাবে কোনো না কোনো আইটেমের সেল চলছে। ছবি : অটোয়াসিটিজেন.কম

পশ্চিমা দুনিয়ার দোকানপাটে গেলেই দেখা যাবে কোনো না কোনো আইটেমের সেল চলছে। আর প্রতি সপ্তাহে ফ্লায়ার দিয়ে যাবে বাড়িতে। বিশেষকরে নারীদের কাছে ফ্লায়ার জিনিসটা খুবই মহার্ঘ বস্তু। অন্ততঃ জেসমিনের কাছে তাই। জীবনে একটা বইও পড়েনি কখনও, আমার লেখাও না। কিন্তু খুব মন দিয়ে ফ্লয়ার পড়ে। কোথায় কোন আইটেমের সেল আছে দেখে। আমার এক আত্মীয় কানাডা এসেই প্রথম আবিষ্কার করেছিল সেল। একদিন সে বলল, সেল’টা টাইম মতো ধরতে হয়। অনেকে ফ্লায়ার রি-সাইকেল করার যন্ত্রণায় নো ফ্লায়ার লেখা সাইন টানিয়ে রাখে বাড়ির সামনে। আমেরিকায় পোষ্টবক্সগুলো বাড়ি থেকে একটু দূরেই থাকে। ওখানকার বাড়িগুলো বড় বড় লটে তৈরী হয়। ওখানেই চিঠিপত্র বা ফ্লায়ার রেখে যায় পোষ্ট অফিসের লোকজন। কানাডাতে বেশিরভাগই বাড়ির সাথে লাগোয়া থাকে পোষ্টবক্স। এপার্টমেন্ট, কন্ডো বা টাউন হাউজগুলোতে কানাডা পোষ্টের লোকজন ঘরে ঘরে দরজায় একটা হোল আছে সেখানে ফেলে রেখে যায় চিঠিপত্র। অনেক বিল্ডিংএর নিচে কানাডা পোষ্টের বক্স আছে। ঘরে কাউকে না পেলে দরকারী পার্সেল বক্সে রেখে যায়। নির্দিষ্ট জায়গায় চাবি এবং বক্স নম্বর থাকে, চাবি দিয়ে নিজের চিঠি বা র্পার্সেল পিক করে চাবি যথাস্থানে রেখে দিতে হয়। কুরিয়ার সার্ভিস যেমন পিউরোলেটার বা ডিএইচএলের মতো কোম্পানীর আইটেম প্রাপককে না পেলে নিকটস্থ পোষ্ট অফিস থেকে পিক করা যায়।

বিশেষ বিশেষ দিবসেও সেল থাকে। এখন বাংলাদেশেও সেল কালচার চালু হয়েছে। অনেক বিলাসবহুল শপিং কমপ্লেক্স হয়েছে ঢাকায়। বিভিন্ন ব্রান্ডের দোকান আছে। প্রচুর ক্রেতা। টাকাওয়ালার অভাব নাই বাংলাদেশে। লক্ষ লক্ষ নব্য কোটিপতি। এখন লেছরাগঞ্জের চরে যে মেয়েটি বাস করে সেও জানে লাসেঞ্জা বা ভিক্টোরিয়া সিক্রেট আন্ডারগার্মেণ্টসের নাম। ল্ইু ভুটন, জারা, মাইকেল কোর, জিমি চো, সেইন্ট লরেন্টের ব্যাগ বা লরিয়েল, শ্যানেল আর ম্যাকের কসমেটিকসের নাম মুখে মুখে। নাম জানতে সমস্যা নাই। আমরা যারা বাইরে থাকি দেশে গেলে লেটেষ্ট আইফোন, এপেলের স্মার্ট ঘড়ি বা আইম্যাক না থাকলে খ্যাত মনে করে। ক্রিসমাস বা ব্লাক ফ্রাইডেতে বিশাল বিশাল সেল দেয়। উত্তর আমেরিকার লোকজন সেল খবুই পছন্দ করে। এক সেন্ট সেল দিলেও হুমরি খেয়ে পড়ে। ডোর ক্রাশ বলে একটা কথা চালু আছে। অনেক সময় ভোর রাতেও ঠান্ডার মধ্যে লাইন দেয়। এটাই সম্ভবত ডোর ক্রাশ। এ দেশে কোনো আইটেম নির্দিষ্ট তারিখের আগেই ফুরিয়ে গেলে রেইনচেক দেওয়ার বিধান আছে। ওটা দিয়ে পরে আবার সাশ্রয়মূল্যে ক্রয় করা যায়। এখানকার বিউটি হচ্ছে রিফান্ড পলিসি। অনেকেতো জিনিস ব্যবহার করার পরও ফেরত দেয়। তবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এবং অবশ্যই স্লিপ থাকতে হবে। সাধারণত ১৫ থেকে ৩০ দিন টাইম থাকে। কষ্টকো বলে একটা শপিং আউটলেট আছে, তাদের রি-ফান্ডের কোনো টাইম লিমিট নাই। এমনকি স্লিপও লাগে না। তবে কস্টকোর মেম্বার হতে হবে। বাংলাদেশে কিছু দোকানে একচেঞ্জ করা যায় কিন্তু রিফান্ড পলিসি নাই।

আমার বাইশ বছর বিদেশ জীবনে কখনও সেলের সুবিধা বেশি পাইনি। যদি কখনও সেল থেকে জিনিস কিনেও থাকি সেগুলো ব্যবহার করতে কেমন দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগি। কেনো যেনো মনে হয় সেলের আইটেম বোধহয় ডিসকন্টিনিউ হয়ে গেছে। যদিও এটা একেবারেই মানসিক। অবাক কান্ড গতকাল শপার্সে গিয়ে দেখি ওল্ড স্পাইসের বডি স্প্রে, নিভিয়ার শেভিং বাম, ওরাল-বি’র টুথব্রাশ দিয়েছে জাষ্ট হাফ প্রাইসে। টপাটপ কিনে ফেললাম কয়েকটা। মার্কসে গিয়ে পেলাম ৪০% অফে জ্যাকেট। ঢাকায় যেমন বাণিজ্য মেলায় সব ত্রুটিপূর্ণ জিনিস কম দামে বিক্রী করে দেয়। সেলও অনেকটা তেমনই। তবে সবসময় নয়। বেশিরভাগ সময়ই একেবারে ব্রান্ডনিউ পাওয়া যায়। আমি আজ থেকে আট নয় বছর আগে এক ব্লাক ফ্রাইডেতে স্টেপলস থেকে স্যামসংয়ের একটা লেজার প্রিন্টার কিনেছিলাম। আজও সেটা বহাল তবিয়তে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। আসলে শপিং করার ব্যাপারে আমি খুবই পিছিয়ে থাকা মানুষ। ছোটবেলায় মা আমাকে কখনও বাজারে পাঠাত না। যখনই পাঠিয়েছে আমি নির্ঘাত ঠকে এসেছি। জেসিমনও আমাকে বাজার করতে দেয় না। আমার কাজ ওর পিছন পিছন ট্রলি ঠেলা। কখনো একলা গেলে কোন আইলে কোন আইটেম থাকে তাও খুঁজে পাই না। তখন জেসমিনকে ফোন করি। নিজের জিনিস কেনার সময়ও ছবি তুলে বা ভিডিও কলে দেখাতে হয়। যদি কখনো নিজ দ্বায়িত্বে কিনি বেশিরভাগই পছন্দ করবে না। বলবে এটা কি কিনছ! রঙ টা খ্যাত হইছে বা এই কালারের জ্যাকেট তো আছে।

জসিম মল্লিক, লেখক ও সাংবাদিক

টরন্টো