প্রবাসে পরহিতকর্ম -৫৮

ইউরোপের পথে পথে

মে ৫, ২০১৯

রীনা গুলশান

(পূর্ব প্রকাশের পর)

কোথাও যাওয়া যতটা সহজ ভাবা যায়, সর্বদা সেটা ততোটা সহজ হয় না। সবকিছু মিলিয়েই এটা হয়। বিশেষত: সেটা নতুন জায়গা হলেতো কথাই নাই। দেখলাম, ‘গ্যাটওয়ে’ এয়ারপোর্ট, লন্ডন সিটি থেকে বেশ দূরে। যাইহোক অনলাইনে দেখে নিলাম কি ভাবে যেতে হবে। আবার মাজেদা আপার বড় ছেলে সাজ্জাদ আর তার বউ পিয়াও সব ডিটেলসে বুঝিয়ে দিল।

যাইহোক, ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় রুম্মান, তিতলী এবং কিয়ারা আমাদের পিয়ারসন্স এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিল। কিয়ারা তার কারসিটে ছিল। আমরা ১৮ মাসের কিয়ারাকে রেখে যাচ্ছি। যদি ফিরে আসতে পারি তো ওকে ১৯ মাসের পাবো। কিয়ারাকে আমরা হাতে করে বড় করছি, তাই ওকে ছেড়ে যাওয়া বড়ই কষ্টের। ওর হাসি, ওর বিষ্ময়ের দৃষ্টিকে পিছনে ফেলে, আমরা ক্রমশ এয়ারপোর্টের জটিলতায় হারিয়ে গেলাম।

আমরা ‘ওয়েস্ট জেট’ এয়ারবাসে উঠলাম। ভেবেছিলাম খুব বেশী যাত্রী হবে না। তাহলে বেশ শুয়ে বসে যেতে পারবো। ওমা! দেখলাম সিট সব মানুষে ভরা। বেশ গম্ভীর চালে বসলাম। আফটার অল ‘লন্ডন যাত্রা’ বলে কথা। সেই ছোট্ট বেলা থেকে সব থেকে বেশী যেখানে যেতে চেয়েছি, সেটা হলো লন্ডন। আর সেই লন্ডনে কিনা যাচ্ছি এই প্রায় বুড়ো কালে! মজার ব্যাপার, এয়ারহোস্টেস-রা খুবই মধুর হাস্যে যাওয়া আসা করছে। ভাবছি এই বোধহয় খাবারের ট্রলি নিয়ে আসবে। একটু পর খাবারের একটা মেনু চার্টও যথারীতি দিয়ে গেল। দেখলাম ভাল ভাল খাবারের লিস্ট। আলো কম, তাই ভাল করে পড়লামও না। ভাবলাম, যাইহোক একটা কিছু দিলেই হবে। ওমা! সে গুড়ে বালি! ৯:৩০ হতে হতে প্রায় ১০টারও কিছু পরে প্লেন ছেড়েছে। আমরা শরবতের বাড়িতে লাঞ্চ খেয়েছি ৩:৩০ এর দিকে। হাঁসের মাংশ দিয়ে গরম ভাত। কিন্তু সেতো প্রায় দুপুরে! কবেই হজম হয়ে ভষ্ম হয়ে গেছে। এখনতো ক্ষুধায় নাড়িভুড়িও হজম হতে চলেছে। একটু পরে দেখি, মধুর হাস্যমায়িরা ট্রলি ঠেলে ঠেলে বলছে “খাবার কিনবেন, খাবার?”

নাও ঠ্যালা, এ কোন জ্বালা? খাবার তাও আবার কিনে খেতে হবে? হায় আল্লাহ্, এর থেকে তো আমাদের গরীব রাষ্ট্র বাংলাদেশ অনেক বেটার। আরে বাবা ঢাকা থেকে যশোরে যেতে ১ ঘন্টার জার্নীতে পুরো একটা স্যান্ডউইচ, জুস এবং চকলেটও দেয়! খেতে খেতেই কখন শাহজালাল এয়ারপোর্ট থেকে যশোর এয়ারপোর্ট এ পৌঁছে যাবেন টেরও পাবেন না।

আর এটা টরন্টো থেকে লন্ডন! সোজা ৬/৭ঘন্টার জার্নি। তাও আবার আমাদের বাঙ্গালীদের পিওর ডিনার টাইম। তবে এখানে বলেতো লাভ নাই। এই সব সাদারা আবার ডিনার করে সন্ধ্যা ৬/৭টার মধ্যে। আমারা দেরী করে ডিনার করি সেই জন্য আমরা নাকি সব মোটাসোটা। আমাদের ভুড়ি মোটা?? আহারে সাদাদের যেন আর কোরো ভুড়ি মোটা নাই! যাইহোক, ভাবছিলাম খাবারের ট্রলির কথা। তারা বিভিন্ন ভাবে বিক্রি করে যাচ্ছে। সমানে সব সাদাদের দেখলাম ছোট্ট ছোট্ট চার ইঞ্চি সাইজের বোতল কিনলো। সাথে চিপস কিনছে। ফটাফট ঐ ছোট্ট শিশিগুলো বিক্রি হয়ে গেল। আমার সামনের এক মহিলা একটা স্যান্ডউইচের দর করলো। দাম শুনে সে ক্ষান্ত হয়ে গেল। পরে আপার কেবিনে রাখা ব্যাকপ্যাক নামিয়ে সেখান থেকে বড় একট চিপস এর প্যাকেট বের করে রাগে কামড়ে খচমচ করে খেতে লাগলো।

অবশেষে রাত প্রায় ১২টারও পর এক আধা সুন্দরী, অর্ধেক হেসে আমাদের এক কাপ পবিত্র কফি পরিবেশন করলো। সাথে ১০/১২ পিস বাদামের টুকরোর একটা প্যাকেট। এত্ত ছোট বাদামের প্যাকেট আমি কানাডার কোন গ্রোসারী স্টোরে দেখি নাই। নিশ্চই ব্যাটারা স্পেশাল অর্ডার দিয়ে বানিয়েছে। মুখে দিতে দিতে শেষ হয়ে গেল। সেটাই প্রতিটি দানা অমৃতের মত খেলাম। তারপর খালি পেটে খেলাম কফি। আগামী কাল, ওয়ান হান্ড্রেড পারসেন্ট সিউর আমার আসলারের ব্যাথা বেড়ে যাবে। মনে মনে ভাবলাম। তবুও… অগত্যা।

খালি পেটে ঘুম এলো না। সবাই দেখলাম ঐ সব শিশির তরল পানীয় পান করে একটু পরই ভোস ভোস করে নাক ডাকা শুরু করলো।

আমার রাত জাগা চোখের উপর কুচ কুচে কালো আকাশে একটু একটু করে আলো ফুটে উঠলো। আমি সবার ক্রূর দৃষ্টি উপেক্ষা করে জানালার শেড আধখানা খুলে দিলাম। জানালার পাশেই আমার আসন ছিল। বাইরে তাকিয়ে দেখলাম- দূর আকাশের হালকা গোলাপী বর্ণ থেকে একটু একটু করে রক্তিম সূর্য উঠার অপরূপ দৃশ্য… এই দৃশ্য এই সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আর যেহেতু মেঘের অনেক উপরে আমরা, ওহ এ এক অসাধারণ মাহেন্দ্রক্ষণ। যার রক্তিম আভা যেন উর্ধমুখী গোলককে বিদ্ধ করবার জন্য ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। ইশ! একেই কি সেই ঊষা লগ্ন বলে!! নিজের চোখে একটু একটু করে রাত থেকে সকাল হতে দেখে রাতের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল।

অবশেষে আমরা লন্ডন, ‘গ্যাটওয়ে’ এয়ারপোর্টে অবতরণ করলাম। ফরমালিটিস শেষ করে ইমিগ্রেশন ক্রস করে ইতি উতি উকি দিতেই

দেখি গ্যাটওয়ে এয়ারপোর্ট এক হুলস্থল এয়ারপোর্ট। আমাদের নর্থ টার্মিনালে নামিয়েছে। এবার সাউথ টার্মিনালে যেতে হবে। যেতে হবে এয়ারপোর্ট ইন্টারনাল ট্রেনে করে। এসব ট্রেনও খুবই মজার। এখানে কোন ড্রাইভার থাকে না। কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ট্রেন।

যাইহোক, আমাদের যেহেতু কেউ নিতে আসবে না, তাই আগেই সব জেনে-শুনে এসেছিলাম। তবু সব দেখে শুনে আবার ক্ষুধার ক্লান্তিতে বেশ ভড়কানো ভাব লাগছিল।

তবু জিজ্ঞাসা করতে করতে শেষ পর্যন্ত, এবারে লন্ডনে ছড়িয়ে পরার দিশায় চলে এলাম। অর্থাৎ মূল ট্রেনের কাছে চলে এলাম। এটাকে বলে ‘গেটউইক এক্সপ্রেস’। এটা আমাদের টরন্টোর ‘গো ট্রেন’ এর মত। এটাতে করেই মূল গন্তব্যের দিকে যেতে হবে। এবং এই ট্রেনের টিকিটও যথেষ্ট এক্সপেন্সিভ। এই ট্রেন আমাদেরকে ‘ভিক্টোরিয়া’ স্টেশনে নিয়ে যাবে। ২০ পাউন্ড নিল। অর্থাৎ আমাদের কানাডা থেকে বেশ অনেকটা বেশী। তারপর আবার ভিক্টোরিয়ার পরের ট্রেনের টিকিটও কিনতে গেলাম। তখন কাউন্টারের ভদ্রলোকই বুদ্ধি দিল, শুধু আজকের বা রোজ রোজ টিকিট না কিনে তোমরা বরং ‘ওয়েস্টার কার্ড’ কিনে ফেলো। এটা অনেকটা আমাদের টরন্টোর ‘গো ট্রেন’ এর মান্থলী কার্ড এর মত। কার্ড এর জন্য একটা চার্জ নেয় ৫ পাউন্ড। এ ছাড়া যত ইচ্ছা তত পাউন্ড ভরে রাখা যায়। তো আমরা এ যাত্রায় ৫ দিন থাকবো। আবার ২৪ ডিসেম্বর আসতে হবে। যেতে হবে আবারো ‘ইস্টহ্যামে’। তাই ‘ওয়েস্টার কার্ড’ কিনে আপাতত আমরা ৩০ পাউন্ড করে ২ কার্ডে ৬০ পাউন্ড ভরলাম। কারণ, প্রতিদিন এক এক যাত্রায় ২.৮ পাউন্ড এর মত নেয়। ৭/৮ পাউন্ড এর মত খরচা হয় রোজই যতখুশী যাতায়ত করো। আবার লন্ডন থেকে চলে আসবার দিন ওয়েস্টার কার্ড জমা দিলে ওরা ৫ পাউন্ড ফিরিয়ে দেয়।

অতএব বাক্স পেটরা নিয়ে আমরা ‘গেট-উইক’ এক্সপ্রেস এ চেপে বসলাম। প্রচুর ভিড়। কারণ যে যেদিকই যাক না কেন, ভিক্টোরিয়া পর্যন্ত তাদের যেতেই হবে। বাক্স পেটরা এবং ক্লান্ত নর/নারীতে ঠাসা। ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল রাত জাগায়। সেই সাথে ক্ষুধার জ্বালা। ট্রেনে যেতে যেতে চারপাশে দেখতে আমার কোন ক্লান্তি লাগে না। আজ লাগছিল। তবু চোখ টান করে দেখছিলাম। মনে মনে বলছিলাম, “রীনা দেখে নে, ঘুমাবার সময় অনেক পাবি, আর যদি কোনদিন না আসা হয়?“

যতই ক্লান্ত লাগুক, মনের মধ্যে তীর তীর করে কেঁপে ওঠা অজানিত আনন্দ। আজ আমার বড় ছেলেও আসছে যে! আমরা এবারের এই ট্যুরে দু’দেশের এক পথিক। কারণ আমার ছেলে আসছে আমেরিকার টেক্সাস থেকে। আমরা কানাডার টরন্টো থেকে। যদিও আমার ছেলের এটা অফিসিয়াল ট্যুরও বটে। অফিস থেকে ওকে স্পেনে পাঠিয়েছে ওখানকার নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট দেখবার জন্য। ওখানে ওকে ৮ দিন থাকতে হবে। বাকিটা লন্ডন এবং পরবর্তী ট্যুরের দিনগুলো রায়হান অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। মা বাবাকে সময় এবং সঙ্গ দিবে বলে। গত এক বছরেরও কিছু বেশী সময় ধরে ছেলেকে দেখিনি। কাগজ পত্রের অসুবিধা জনিত কারণে সে আমাকে আমার ঘোরতর দুর্দিনেও দেখতে আসতে পারেনি। নভেম্বরের লাস্ট উইকে অফিসিয়ালি ক্লিয়ারেন্স পেয়েছে, তাই আমাদের কথা বলে ছুটি নিয়েছে।

যখনি মনে পড়লো আজ রায়হান আসবে তখনি এক নিমিষে সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। বুকের মধ্যে আনন্দের ঝঙ্কার বয়ে গেল। আর কিছুক্ষণ পরই আমার বুকের মানিককে দেখতে পাবো। (চলবে)

রীনা গুলশান

টরন্টো