প্রবাসে পরহিতকর্ম -৮৩

ইউরোপের পথে পথে

রীনা গুলশান

প্রায় ৩২/৩৩ বছর পর দুই ভাই-বোনের দেখা হলো। ওর বাসায় আসার পর এত ভালো লাগলো কি বলবো? ওর এপার্টমেন্টে ঢুকেই বেশ অবাক  হয়েছিলাম। এখন রাতে ওর রেস্টুরেন্ট থেকে ফিরে আবার যখন এলাম, একটা হট শাওয়ার নিয়ে বেশ রিলাক্স লাগছিলো। তারপর আমরা ওর ফ্যামিলি রূমে বসে যাকে বলে রীতিমত জম্পেশ আড্ডা শুরু হলো। ৩২/৩৩ বছরের কথা কি এক রাতেই শেষ করবো? তারপর ওর ঘরের প্রতিটি জিনিস-ই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খেয়াল করছিলাম। সারা পৃথিবীর শো-পিস তার ঘরের নানান জায়গাতে ছড়ানো। যে সোফায় বসে আড্ডা মারছিলাম সেটা বাংলাদেশ থেকে অর্ডার করে বানিয়ে এনেছে শীপে করে। বেত এবং কাঠের। অসম্ভব সুন্দর। এছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন শো-পিস, আর্ট পিস। এবং তার বইয়ের আলমারি। এটাতো রীতিমত ছোখে পড়ার মত। পৃথিবীর মোটামুটি বিখ্যাত সব লেখকের এক পিস হলেও, তার সংগ্রহে আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের প্রায় সব লেখকের বই তার বুক সেলফে আছে। আমার স্বামী মজা করে বললো – এখন তো বাকি কেবল ‘রীনা গুলশান’ এর বই রাখা। মিঠু তৎক্ষনাত জবাব দিল ‘ঐ যে উপরের কর্ণারে, ঐ খানে রীনা আপার বই থাকবে। আমি হাসছিলাম। তখনও জানতাম না, মিঠু কথাটি কতটা সিরিয়াসলি বলেছিল। পরবর্তীতে ২০১৯ এর ফেব্রুয়ারিতে যখন ‘অনন্যা’ থেকে আমার বই প্রকাশ হয়েছিল মিঠু তখন আমার বই নিতে, সুদূর বেলজিয়াম থেকে উড়ে এসেছিল দুবাইতে। আমি তখন বাংলাদেশের বইমেলা উৎসব পুরোপুরি উপভোগ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ঘুরছি। সব জায়গাতে ঘুরে যখন দুবাই এর ‘হোটেল প্লাজা’ তে প্রবেশ করছি তখন দেখি মিঠুর চাঁদ বদন। আমিতো হতভম্ব। কি ব্যাপার?

আপনার বই নিতে এসেছি।

কি বলবো? ভাষা ছিল না। তবে এটাই মিঠুর এবং তার টোটাল চরিত্রের কাঠামো। যাকে ভালবাসে, তার জন্য জান দিতে পারে। আবার একবার যদি ঘৃণা করে, সেটাও আর ফিরিয়ে নেয় না।

আসলে এই যে আমি ইউরোপের পথে পথে লিখছি এটা কেবল ভ্রমণ কথা নয়। এর প্রতি পদে পদে লেখা আছে আমার প্রতি অন্য কারো ভালবাসা। অথবা আমার অন্য কারো জন্য ভালবাসা। নাহলে ভ্রমণ কাহিনী তো এখন কোন ব্যাপার নয়। গুগুল সার্চে দিয়েই সব জানতে পারা যায়। এই ইউরোপ ভ্রমণে বের না হলে বুঝতে পারতাম না আমার জন্য মানুষের কতটা ভালবাসা জমা ছিল। একটা মানুষ কতটা ভালবাসলে সে বেলজিয়াম থেকে দুবাই পর্যন্ত ছুটে আসে কেবলি আমার বই নেবার জন্য। না হলে দুবাইতে সে কতবার যে এসেছে নিজেই জানেনা। তার মেনু ক্রিয়েশনের জন্য সর্বত্র যাওয়া লাগে। আগেই বলেছি, এখানে তার দেখার কিছুই ছিল না। তবু এসেছিল রীনা আপার বই গুলো আমার হাত দিয়ে নিবে তাই। আমি বলেছিলাম তোকে পার্সেল করে দিব, চিন্তা করিস না। কিন্তু সে যখনি শুনেছিল আমি বাংলাদেশ থেকে ফিরার পথে আরব আমিরাতে ঘুরছি তখন সাথে সাথে ডিসিশন নিয়েছিল আমার সাথে দেখা করবে। শুধু যে বই নিতে এসেছিল তা নয়। পরবর্তীতে আমার প্রতিটি বইয়ের আলাদা করে রিভিউ দিয়েছিল। আমার উপন্যাসের রিভিউটা এতটাই উচ্চ মার্গের দিয়েছে যে আমি সেটা ফেসবুকে দেইনি। খুব লজ্জা করছিল। এতটা খুটিয়ে রিভিউ আর কেউ দিতে পারেনি।

ব্রাসেলস এ এটোমিয়াম। নির্মান কাল ১৯৫৮ । ছবি : লেখক

যাইহোক, আমি মিঠু আর আমার স্বামীর আড্ডা চললো রাতে প্রায় ম্যারাথন স্টাইলে। প্রায় শেষ রাতে ঘুমাতে গেলাম। ফজরের নামাজ পড়েই ধরতে গেলে ঘুমাতে গেলাম। তারপর খুটখুটে, খুউব নিঃশব্দের শব্দ শুনে জেগে উঠে পরলাম। নতুন জায়গাতে ঘুম থেকে উঠলেই কেমন এক অজানিত অনুভূতির পাখিরা ডানা মেলে দেয়। আমারও তাই হলো। তবু ওয়াশরূমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে একেবারে বাইরে বের হবার ড্রেস পরেই লিভিং রূমে এলাম। দেখি রান্না ঘর থেকে খুটখাট শব্দ আসছে। তখন প্রায় সাড়ে নয়টা বেজে গেছে। দেখি মিঠু বাঙ্গালী স্টাইলে আলু ভাজা করা চেষ্টা করছে। আলু অবশ্য কেটেছে, ফ্রেন্স ফ্রাই এর মত মোটা মোটা করে। খুবই অদ্ভুত লাগলো। তবে কোন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকলাম। এদিকে দেখি হটপটে আটার রুটি। নিজেই বানিয়েছে, বেশ মোটা মোটা। আমি বেশ মজা পেলাম। আমি ওকে ইম্প্রেস করবো কি, ওই আমাকে ইম্প্রেস করলো। যাইহোক, আমার স্বামীও রেডী হয়ে এলো। আমরা দুজন-ই খুব তারিফ করতে করতে তার হাতে বানানো নাস্তা খেলাম। এছাড়া সামনে আরো অনেক কিছু ছিল। বেলজিয়ামের বিখ্যাত গারলিক ব্রেড। চকলেট বার। অনেক রকম বিখ্যাত জ্যাম (এটার কথা আমি আগেই শুনেছি)। আমি আটার রুটির মধ্যেই একটু মিক্সড জ্যাম মাখিয়ে খেলাম। অরগানিক জ্যাম। মজার ব্যাপার, মিঠুর দেখলাম সব কিছুতেই অরগানিকের ব্যাপারে ঝোক। ঝোক বললে ভুল হবে, রীতিমত বাতিকগ্রস্ত। তার ওয়াশরূমে গিয়েতো আমার মাথা খারাপ। যে  শ্যাম্পু ৫ ইউরোতে কিনতে পাওয়া যায়, সে সেটা কিনবে অরগানিক এবং ১৫ ইউরো দিয়ে। ওয়াশরূমে সাজানো আছে থরে থরে  নানান টাইপের কসমেটিকস। মহিলারাও ফেল তার কাছে। এবং সবই অরগানিক। কিচেনেও মশলা, জ্যাম, রুটি সবই অরগানিক। আমার হাসি পাচ্ছিল। যেদিন কাচ্চি রান্না করলাম, দেখি ল্যাম্ব এনেছে। সেটাও অরগানিক। সে একেবারে অরগানিকের চুড়ান্ত ম্যানিয়াক। যাইহোক, পেটভরে, মন ভরে সকালের নাস্তা খেলাম। এরপর ওরা দুজনে রেডী হলো। আবার দেখি, পথে ঘুরা ঘুরি করবো তাই আমার জন্য পানি এবং জুস নিলো এবং অনেক ধরনের চকলেট নিলো।

প্রথমেই দিনের আলোতে বিভিন্ন পথে পথে কিছুক্ষণ ঘুরালো। অতপর আমাদের মূল গন্তব্য ‘গ্রান্ড প্লাজা’য় নিয়ে চললো। পথে যেতে দেখছিলাম, প্রায় সবই বেশ পুরানো স্টাইলের বাড়ি ঘর। তবু ব্রাসেলসে বেশ কিছু বাংলাদেশের স্টাইলে হাইরাইজ বিল্ডিংও দেখতে পেলাম। গ্রান্ড প্লাজায় যেতে যেতে মিঠু অনর্গল টুরিস্ট গাইডদের মত কথা বলে যাচ্ছিল। পথে যেতে যেতে একজায়গায় বেশ স্লো করে সেই এরিয়াটা আমাদের দেখাতে দেখাতে নিয়ে চললো। বললো, বাড়ীগুলো দেখেন। বললো এখানে সব ইউরোপের তথা বেলজিয়ামের ধনীরা থাকে। বিশাল এরিয়া নিয়ে এক একটা বাড়ী। আগেই বলেছি, বেলজিয়ামে তিন ভাষার প্রচলন রাষ্ট্রিয়ভাবে। তবে দেখলাম ফ্রেঞ্চটা বেশী চলে। তারপরই ডাচ। তবে টোটাল বেলজিয়ামের ধনীদের হিসাব করলে দেখা যায় তার ৯০ পার্সসেন্টই ডাচ। অবাক কান্ড টোটাল বেলজিয়ামের ৭০ পার্সেন্ট ইউরো ডাচদের হাতে। মিঠুর কণ্ঠে একটু কি দুঃখের সুর? কারণ ওর বউ ফ্রেঞ্চ বলে। আমার আবার একা একা হাসি পেল। যাইহোক বেশী টাকাওয়ালাদের কথা শুনলে আমার ভাল লাগে না। আমরা ভাই ‘আদার ব্যাপারী’ জাহাজের খবরে কি দরকার? যাইহোক গন্তব্য গ্রান্ড প্লাজা হলেও দূর থেকেই উচু এক চরকার মত জিনিশ দেখতে পেয়ে মিঠুকে জিজ্ঞাসা করতে সে তার গন্তব্য সেদিকেই করলো। খুব সুন্দর একটা পার্কের মধ্যে এটার নির্মান। নাম দি এটোমিয়াম। আমার স্বামী দেখলাম কাছে গিয়ে ওটার সম্পর্কে বিস্তারিত পড়লো। তার খুব ভালো লাগলো। এটা একটা মনুমেন্ট হলেও শুধু মাত্র দেখার জন্য নয়। অন্তত্য কার্যকরী মনুমেন্ট বলা যায়। এটার নির্মান হয়েছিল ১৯৫৮ সালের এটা ওয়ার্ল্ড ফেয়ারে। এটার ডিজাইন করেছিল  এন্ড্রে ওয়াটারকেইন। এই মনুমেন্টের উচ্চতা ১০২ মিটার অর্থাৎ ৩৩৫ ফুট। (অহফ হরহব ংঃববষ ংঢ়যবৎবং পড়হহবপঃবফ ঃড় ভৎড়স ঃযব ংযধঢ়ব ড়ভ ঁহরঃ পবষষ ড়ভ ধহ রৎড়হ পৎুংঃধষ সধমহরভরবফ ১৬৫ নরষষরড়হ ঃরসবং) । আমি অবশ্য বাইরের সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হলাম। এবং এত সুন্দর এর পরিপাশর্^। তবে আমার যন্ত্রকৌশলী প্রকৌশলী স্বামী যারপরনাই চরম মুগ্ধ হয়ে দেখছিল এবং বারবার বিস্ময় প্রকাশ করছিল। বেশ অনেকটা সময় সে এখানে অতিবাহিত করলো।

তারপর আবার আমরা রওনা দিলাম গ্র্যান্ড প্লাজার উদ্দেশ্যে। খুব বেশী সময় লাগলো না। তবে সময় লাগলো গাড়ি পার্কিং এ। যেহেতু সময়টা ছিল ডিসেম্বর। ক্রিসমাসের মধ্যবর্তী সময়। মানুষ একেবারে থৈ থৈ করছে। আমাদের পার্কিং করতেই অনেকটা সময় পার হয়ে গেল। ৫/১০/২০ ইউরো কোন জায়গাতেই গাড়ি পার্ক করা গেল না। যদিও মিঠু যেতে যেতে বলছিল। অতপর প্রায় সারাদিনের জন্য এক জায়গায় পার্ক করলো ২৫ ইউরোতে। আমি আবার কানাডিয়ান ডলারে হিসাব করছিলাম। অনেকগুলো টাকা। কিন্তু মিঠু আমার স্বামীর পকেটে হাতই দিতে দেয় না। মিঠুর জন্য এটা কিছুই না।

কারণ তার আপা-দুলাভাই এসেছে। প্রবাস জীবনে এই প্রথম তার বাড়িতে কোন আত্মীয় বা রক্তের সম্পর্কের কেউ এসেছে। মিঠু যে কতটা খুশী, আমাদেরকে পেয়ে সেটা তার প্রতিটি পদক্ষেপেই বোঝা

যাচ্ছে। যদিও আমার স্বামী টিচার মানুষ, তার এই সব পছন্দ নয় বলে ক্রেডিট কার্ড ছাড়াও ক্যাস টাকা ভালই এনেছে। আমরা কানাডা থেকেই আসবার সময় পাউন্ড ইউরো ফ্রাঙ্ক সব করে এনেছিলাম। কিন্তু মিঠু রীতিমত রুদ্রমূর্তি ধারণ করলো। এবং অতপর ইমোশনাল। তখন আমি বললাম, আরে সাতকূলে তোমার একটি শালা, চুপচাপ আদর নিয়ে যাও। তোমার তো কোন আপন শালা শালী নাই বলে বিয়ের সময় দুঃখের সীমা ছিল না। তাহলে এখন কোন দ্বিধান্বিত? তখন মিঠু এবং তার দুলাভাই দুজনেই হেসে ফেলে।

অতএব আমরাও ফুরফুরে মেজাজে গন্তব্যে পা বাড়ালাম। (চলবে)

রীনা গুলশান। টরন্টো। মঁষংযধহধৎধৎরহধ@মসধরষ.পড়স