শুচিতা

(কানাডার দৈনন্দিন বাস্তবতার দিকে লক্ষ্য রেখে কাল্পনিক এই উপন্যাস ‘শুচিতা’। লিখেছেন কানাডা প্রবাসী নজরুল ইসলাম। )

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

সুমিতদের প্রতিবেশী ললিত। তার মেয়ে নিমি দিনে বাসায় থাকে না। এই সুযোগে কমল বা সুমিত সময় কাটানোর জন্য ললিতের সঙ্গে বসে গল্প করে এবং অনেক সময় তর্কে জড়িয়ে পড়ে। ডাক্তার সুমিতের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে উত্তেজিত হওয়া থেকে বিরত থাকতে নিষেধ করেছেন। সুমিতের এক দিকে হার্টের এবং অপর দিকে মানসিক সমস্যা, সে অল্পতেই নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ললিত যখন যা পারে আপ্যায়ন করায় এবং দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি নিয়ে আলাপ করতে করতে একপর্যায়ে তর্কে মেতে ওঠে।

নিমি সময়-অসময় কাজ থেকে ঘরে এসে বাবাকে হয় কমল বা সুমিতকে নিয়ে উচ্চ স্বরে চিৎকার করতে শোনে। সে দু-একবার বলেছে, বাবা, তুমি বাইরের লোক কেন ঘরে নিয়ে এসো? আমি কাজ করে ঘরে এসে অস্বস্তি বোধ করি। কিন্তু ললিত নিমির কথায় কর্ণপাত না করে তর্ক করে যে এতে তোমার কী অসুবিধা হচ্ছে?

নিমি বলে, বাবা, তুমি আমার অসুবিধা বুঝতে পারছ না, এতে ঘরের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। আমি রোজ রোজ বাসায় এসে দেখি তুমি ওদের নিয়ে চিৎকার ব্যতীত স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছ না। এতে আমার অনেক কষ্ট হয়। ওরা আমাকে দেখেও বাসায় যায় না এবং আমার সঙ্গেও অসংগতভাবে কথা বলে, যা আমি একদম সহ্য করতে পারছি না। ললিত বলে, কমল একজন ব্রাহ্মণ উচ্চ বংশের লোক, ওকে আমি শ্রদ্ধা করি।

সে যা-ই হোক বাবা, তুমি বাইরের মানুষ সব সময় ঘরে নিয়ে এসো এটা আমি পছন্দ করি না।

ললিত রাগান্বিত স্বরে বলে, ওরা আমাদের প্রতিবেশী। বাইরের লোক কোথায়?

বাবা, আমি তোমার ভালোর জন্য বলছি, এদের সঙ্গে এত মাখামাখি করবে না।

টেবিলে থালাবাসন, খাবারদাবার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এবং কিচেন নোংরা করে রাখে যা রোজ রোজ নিমিকে পরিষ্কার করতে হয়। কিচেন নোংরা করে রাখে যা দেখে বলে, বাবা, তুমি নিশ্চয় অসুস্থ হয়ে গেছ, তোমার চিকিৎসা দরকার।

অনেক সময় নিমি রাতে ঘুমিয়ে পড়ে, ললিত কমলকে নিয়ে রাত একটা-দুইটা পর্যন্ত বসে আড্ডা এবং চিৎকার করে। ললিত বলে, নিমি, তুমি এই উইকেন্ডে বাসায় থাকবে না, বাসায় আমরা চার-পাঁচজন মিলে ছোটখাটো একটা পার্টি করব, তোমার সহ্য হবে না, তুমি বরং প্রিয়ব্রতের বাসায় চলে যাও।

বাবা, তুমি বাইরের লোক ডেকে বাসায় কিসের পার্টি করবে, তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?

আমাকে ঘর থেকে বের করে তুমি এখানে আড্ডা জমাবে আর অযথা চিৎকার করবে।

ললিত বলে, একটু-আধটু বন্ধুবান্ধব মিলে গল্প গুজব করি তোমার অসুবিধা কোথায়?

কমল ও সুমিত উঁচু বংশের লোক, একজন ব্রাহ্মণ এবং ভালো সম্পর্ক রাখলে ভালো।

বাবা, তোমরা যখন গল্প গুজব করে তখন নিজেদের কন্ট্রোল করতে পারো না, একপর্যায়ে তোমরা চিৎকার শুরু করো। মা মরার পর তোমাকে অনেক সময় দিয়েছি এবং এই তোমার শেষ পরিণতি। তুমি কোত্থেকে এসব যুগিয়েছ, ভাইয়া চলে গেছে এবং আমিও তোমাকে ছেড়ে চলে যাব।

যা তুই যেখানে খুশি, আমি একাই থাকব।

সে দিন অতিরিক্ত স্নো পড়েছে, রাস্তায় গাড়ি, বাস চলাচল অত্যন্ত স্লো, নিমি কাজ থেকে বের হতে অনেক দেরি করেছে, রাস্তায় অতিরিক্ত স্নো ও গাড়ি, বাস চলাচল স্লো হওয়ার কারণে লোকজন কাজ থেকে এসে বাচ্চা নিতে দেরি করছে। এক এক করে সব বাচ্চা অভিভাবকদের নিকট পৌঁছে দিয়ে পার্কিংয়ে গিয়ে দেখে পুরা পার্কিং লটে অতিরিক্ত স্নো। স্নো পরিষ্কার করে গাড়িতে ঢুকে স্টার্ট দিচ্ছে, কিন্তু অতিরিক্ত ঠান্ডায় ইঞ্জিন বসে গেছে এবং স্টার্ট নিচ্ছে না। সে বারবার চেষ্টা করছে, কিন্তু গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করেও পুরোনো গাড়ি কোনো রকমে স্টার্ট নিতে পারছে না। তার সহকর্মী নাহিদ তার অবস্থা দেখে, নিজের গাড়ি নিয়ে এসে বুস্টার দিয়ে স্টার্ট দিয়েছে। সে আস্তে আস্তে চালাচ্ছে, পুরোনো গাড়ি ব্রেক দেওয়া রিস্কি, সারা রাস্তা, বাড়ি, ঘরের ছাদ দেখলে মনে হয় সাদা পেঁজা তুলা দিয়ে ঢাকা। কাজের জায়গা দুই কিলোমিটার দূরত্ব, কিন্তু স্নো আর পিচ্ছিল রাস্তা, একটু জোরে ব্রেক দিলে গাড়ি উল্টা দিকে চলে যায়। অনেকে গাড়ি কাজের জায়গায় রেখে দিয়ে বাসে বাসায় যাচ্ছে। সে ভুল করে গাড়ি নিয়ে রওনা হয়েছে।

বাসায় পৌঁছাতে এক ঘণ্টা সময় লেগেছে। গ্যারেজের গেটের সামনে স্নো পরিষ্কার করা হয়নি, বিল্ডিংয়ের নিচে (বেসমেন্টে) গাড়ি ঢোকাতে কষ্ট হচ্ছে।

সে গাড়ি থেকে বের হয়ে এলিভেটর দিয়ে ওপরে উঠে লেটার বাক্স চেক করে কোনো চিঠি না পেয়ে ভাবছে, বাবা দিনের বেলা হয়তো চেক করে চিঠি নিয়ে থাকবে। সে এলিভেটর দিয়ে ওপর উঠতেই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে লোকজনের চিৎকার শুনতে পায়। সারা দিনের কাজের পর বাসায় আসছে, কিন্তু হয়তো দেখবে বাবা প্রতিবেশী কমল বা আরও দু-একজনকে নিয়ে আড্ডা জমিয়েছে। সুমিতও এ আড্ডায় এসে যোগ দেয়। রোজ রোজ এসব দেখতে ইচ্ছে করে না। সে ভাবছে আজ তার একটা বিহিত করবেই এবং এ আর সহ্য হয় না।

মা মারা যাবার পর নিমি কতবার বাবাকে বলেছে, তুমি বিয়ে করে নাও। কিন্তু সে করবে না, এদিকে নিমির বাবা সারা দিন এ ঘর থেকে সে ঘর হাঁটাহাঁটি করে এবং চোখের দিকে তাকালে মনে হয় কী যেন ভাবছে, তা ছাড়া সারাক্ষণ বিড়বিড় করে আপন মনে কথা বলে। কতবার বলেছে, বাবা, তোমার ট্রিটমেন্ট দরকার। কিন্তু সে ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না। রাতে বাবাকে অন্য মনস্ক দেখলে নিমির ভয় লাগে।  নিমি ভাবে, আমি বয়স্ক মেয়ে, আমাকে দেখলেও বাবার একটু অনুশোচনা হয় না। দাদা ও বউদিকে নিমি অনেকবার বলেছে বাবাকে দেখেশুনে বিয়ে করিয়ে দাও। ওরা বলে, বাবা একটু অন্যমনস্ক থাকে, ওটা তার চিরদিনের অভ্যাস, তা ছাড়া সে বিয়ে করবে না।

নিমি দরজার কাছে গিয়ে কান পেতে শোনে ললিত ও কমল জোরে জোরে চিৎকার করে কী একটা বিষয় নিয়ে তর্ক করছে। প্রায় দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে সে ভাবে, আজ আর ঘরে ঢুকবে না; বরং কোথাও রাতের জন্য চলে যাবে। কিন্তু বরফ আর ঠান্ডার মধ্যে কোথায় যাওয়া যায়?

নিমি কিছু সময় দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে চিন্তা করে বিল্ডিংয়ের কর্নারে বাস থামে এবং বাসে তার দাদা প্রিয়ব্রতের বাসায় গেলে দাদা এবং অদিতি তাকে এই অসময়ে রাতে ফেলে দেবে না। অন্তত একটু খেতে ও ঘুমাতে দেবে। তা ছাড়া তার দাদা ও বউদি বাবা ললিতের সঙ্গে কথা বলবে। সে দেরি না করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে বাসের জন্য অপেক্ষা করে। অতিরিক্ত স্নো ও ঠান্ডায় শরীর বরফ হয়ে যাচ্ছে, পায়ে জুতা ও মোজা পানিতে ভিজে গেছে। বাস স্টপে কোনো ছাউনি নেই যা ঠান্ডা থেকে রক্ষা পেতে পারে।

সে ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে, বাস আসতে ১৫-১৬ মিনিট লেগেছে এবং নিমি ঝটপট বাসে উঠে সিট নিয়ে বসে। ভাগ্যিস বাসে হিট দেওয়া আছে, সে জুতা থেকে পা খুলে হিটারের ওপর রেখেছে নিজেকে আরাম দেওয়ার জন্য। বাস সম্পূর্ণ খালি, পথে যেতে যেতে ৫-৭ জন প্যাসেঞ্জার উঠেছে। সে সারা দিনের কাজের পর ক্ষুধা ও ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাস থেকে নেমে টিম হর্টন ঢুকে একটা মাফিন ও এক কাপ কফি নিয়ে বসে খাচ্ছে আর মনে মনে ভাবছে, বাবা একটু বুঝে দেখুক। বাবাকে অনেক ছাড় দিয়েছি, আর না।

নিমি এক ব্লক হাঁটতে হাঁটতে প্রিয়ব্রতের বিল্ডিংয়ে গিয়ে অ্যাপার্টমেন্টে দরজা নক করতেই অদিতি দরজা খুলে অবাক হয়ে বলে, আরে নিমি! ভেতরে আয়।

নিলয়, এদিকে এসে দেখো কে এসেছে?

নিলয় এসে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলে, নিমি এসেছে। সে ভেতরে ঢুকে বলে, বাইরে আজ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, ঠান্ডায় আমি জমে গেছি, সারা দিন বরফ আর বরফ, মনে হয় আকাশ ফুটা হয়ে গেছে।

আজ কাজে না গেলেও পারতে?

ডে কেয়ারে কাজ করি, না গেলে কে বাচ্চা সামলাবে? না গিয়ে উপায় তো নেই। অদিতি রাতের কাপড় এনে বলে তুমি ড্রেস চেঞ্জ করে হাত-মুখ ধুয়ে টেবিলে খেতে এসো, আমি ততক্ষণে খাওয়া লাগিয়ে দিই।

নিমি বলে, দাদা কোথায়?

তোমার দাদা অফিসের কাজে শহরের বাইরে গেছে এবং কাল আসবে।

কী রান্না করেছ?

আমি আজ শুঁটকি রান্না করেছি, তুমি কি শুঁটকি খাবে?

শুঁটকি আমার পছন্দের খাবার। শুঁটকি আর বেগুন এবং শিমের বিচি দিয়ে রান্না করেছি। মুখরোচক খাবার, ডাল ও কালকের মুরগির মাংস আছে খেতে পারো।

অদিতি বলে, বাবা টেলিফোন করেছিল এবং তুমি বাসায় যাওনি আমাকে জানিয়েছে। আমি বলেছি যে নিমি আমাদের এখানেও আসেনি।

বাবার কাণ্ড আর বলবে না, বাবা পাশের বাসার কমল আংকেলকে নিয়ে সারা দিন এখানে আড্ডা জমায়। এতে আমাদের বাসার গোপনীয়তা (প্রাইভেসি) নষ্ট হচ্ছে, সে বোঝে না। কমলের ছেলে সুমিত অসুস্থ, হুইল চেয়ার ঠেলে ঠেলে এই ঘরে এসে বাবা-ছেলে আমার বাবার সঙ্গে কী নিয়ে তর্ক থেকে চিৎকার শুরু করে। আমি এসব সহ্য করতে পারি না, আমি বাসায় থাকলে ওদের জন্য কিচেন এবং বাথরুমে যেতে পারি না। বাবা লোকজন নিয়ে কিচেন এবং সিঙ্ক থালাবাসন দিয়ে পুরিয়ে রাখে। বাবা মানসিক দিক থেকে অসুস্থ, ওকে চিকিৎসা করানো দরকার।

আমি সুমিতের স্ত্রী শুচিতাকে দেখেছি ও তো ভালো মেয়ে এবং ভালো চাকরি করে। এটা তো সম্পূর্ণ অকৃতজ্ঞতা, তার সাহায্য নিয়ে ওরা এখানে আছে অথচ তাকেই দেখতে পারে না।

তাহলে শুচিতা কি এ বাসায় থাকে না?

না, কীভাবে থাকবে ওরা ওকে একদম সহ্য করতে পারে না। ওকে দিয়ে চাকরবাকরের মতো কাজ করায়। ও সারা দিন অফিসে কাজ করে, ঘরে তার জন্য সব কাজ রেখে দিয়ে চাকরানীর মতো কাজ করায় এবং বলে শুচিতা কাজ জানে না। সব সময় বলে ও নিচু বংশের। এ ধরনের কথা বললে কে থাকতে চায়। সুমিত অসুস্থ, বহু বছর বেকার এবং কাজ করে না। এরা আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে এখানকার পরিবেশও নষ্ট করে দিচ্ছে।

আজ রাস্তায় গাড়ি চালানো ঝুঁকিপূর্ণ, আমি কাজ থেকে অনেক কষ্ট করে বিল্ডিংয়ে ঢুকেছি। এলিভেটর থেকে বের হয়ে শুনি ওরা আমাদের বাসায় চিল্লাচিল্লি করছে, সে জন্য আমি আর ঘরে ঢুকিনি।

ঠিক আছে প্রিয়ব্রত আসুক, ওকে দিয়ে বাবাকে বলাব। তবে তুমি এখানে এসেছ এ খবর দিতে হবে, নতুবা বাবা দুশ্চিন্তা করবে।

বাবা কাল আমাকে বলেছে, আজ বাসায় পার্টি করবে, আমি যেন বাসায় না যাই।

তুমি খাওয়া দাওয়া করো, আমি বাবাকে কল দিই। অদিতি টেলিফোন করেছে, কিন্তু কেউ টেলিফোন ধরছে না।

টেলিফোন তো ওঠাচ্ছে না, কী হতে পারে?

কয়েকবার টেলিফোন করা হয়েছে, রিং হচ্ছে, কিন্তু ওঠাচ্ছে না। জানাশোনা দু-একজনের বাসায় অদিতি টেলিফোন করেছে, কেউ কিছু বলতে পারছে না। শেষে নিমি কমলদের বাসায় টেলিফোন দেওয়ার পরে জেনেছে যে ললিত এবং কমলকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে গেছে।

নিমি বলে, অদিতি, আমি তোমাকে বললাম যে বাসায় অনেক হইচই শুনেছি। কেউ হয়তো রিপোর্ট করেছে, পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেছে।

পরদিন নিমি কাজ থেকে জানতে পারে যে গত রাতে ললিত ও কমল দুজনে অনেক হইচই করাতে পাশের অ্যাপার্টমেন্টের লোকজন ৯১১ কল দিলে পুলিশ এসে কমল ও ললিতকে ধরে নিয়ে যায়। যেহেতু সুমিতকে হুইল চেয়ারে বসা পেয়েছে, তাই ওকে নেয়নি। এখনো কমল এবং ললিত পুলিশ কাস্টডিতে আছে বলে জানিয়েছে।

নিমি পুলিশ স্টেশনে গিয়ে এবার মুখ খুলেছে। বলে, বাবা, তুমি আমার কথা শোনো না। এখন দেখো, আমি থাকলে যে কী অবস্থা হতো তা একমাত্র ভগবান জানে। হয়তো আমাকেও এর মধ্যে জড়িয়ে ফেলত। কোর্টে উপস্থিত করার পর জজ বিবরণ শুনে বলে, তোমরা দুজন এক বিল্ডিংয়ে থাকতে পারবে না।

অ্যাপার্টমেন্টের ম্যানেজমেন্ট কমল ও ললিতের অ্যাপার্টমেন্ট বাতিল করে দিয়ে বলে, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তোমাদের বাসা ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু ওরা ম্যানেজমেন্ট অফিসে গিয়ে বলে তোমরা আমাদের এক মাসের সময় না দিলে আমরা কোর্টে যাব। ম্যানেজমেন্ট অফিস বলে, তোমরা কোর্টে যেতে পারো, আমরা তোমাদের অপরাধের জন্য বাসার আলোটমেন্ট কেটে দিয়েছি। তোমরা গেলে যাবে আমাদের কিছু বলার নেই। শেষে ওরা দুজনই কোর্টে গিয়ে ম্যানেজমেন্ট অর্ডারের বিরুদ্ধে আপিল করলে জজ বাসা না পাওয়া পর্যন্ত ওদের এখানে থাকার অনুমতি দিয়ে ম্যানেজমেন্ট অফিসকে নোটিশ দিলে সেই নোটিশ নিয়ে অফিসে জমা দিয়ে বলে, জজ আমাদের থাকার পারমিশন দিয়েছে।

ম্যানেজমেন্ট অফিস বলে, যেহেতু কোর্ট এক মাসের থাকার অনুমতি দিয়েছে, তোমরা এক মাস থেকে চলে যাবে। নতুবা আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে পুনরায় কোর্টে আপিল করব।

নিমি ম্যানেজমেন্ট অফিসে গিয়ে বাবার পরিবর্তে নিজের নামে বাসা অ্যালোটমেন্ট চেয়ে দরখাস্ত করে। তার দরখাস্ত অনুসারে ম্যানেজমেন্ট অফিস বলে, তোমার বাবাকে এখানে রাখা যাবে না, যদি রাজি হও তাহলে তোমাকে বাসা দিতে পারব।

নিমি তার ভাই প্রিয়ব্রত ও অদিতির সঙ্গে আলাপ করে জানায় যে তার বাবা ললিত অবসর জীবনে কিছুই করছে না এবং সারা দিন রাত ঘরের এই মাথা থেকে ওই মাথা হাঁটে এবং অন্যমনস্ক থাকে এবং তার ট্রিটমেন্ট দরকার। ওকে ভালো করতে হলে মানসিক (ঈঅগঐ) হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে ভালোভাবে চিকিৎসা করাতে হবে। তা ছাড়া তাকে ঘরে কারও সঙ্গেই রাখা নিরাপদ না। সে বলে, আমি বাবাকে অনেক ভালোবাসি, তবে বাবার সঙ্গে বাসায় থাকা নিরাপদ মনে করি না। প্রিয়ব্রত ললিতকে নিয়ে পুলিশ রিপোর্টসহ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয় এবং ওরা ওকে কয়েক দিন রেখে বলে, যেহেতু ললিত কাউকে আঘাত করছে বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না, কাজেই তাকে রাখা যাবে না। প্রিয়ব্রত বলে, সেই দুর্ঘটনার রাতে তার বাবা এবং কমল হাতাহাতি করেছে এবং প্রতিবেশী পুলিশ না ডাকলে হয়তো এটা মারাত্মক হতে পারত। ঈঅগঐ (পবহঃৎব ভড়ৎ ধফফরপঃরড়হ ধহফ সবহঃধষ যবধষঃয) কেস অনেক পরীক্ষা করার পর ওকে এক মাস অবজারভেশনে রেখে দেয়। কিন্তু ওর অবস্থা ভালো না দেখে ওকে আরও ৬ মাসের জন্য রেখে চিকিৎসা করার সুযোগ দেয়।

ললিত হাসপাতালে থাকতে চায় না। সে বলে, আমার কিছুই হয়নি। তোমরা আমাকে অযথা এখানে ফেলে রেখেছ। প্রিয়ব্রত এবং নিমি হাসপাতাল থেকে অনেক অনুরোধ করে তাকে একটা শেয়ারিং প্লেসে থাকার ব্যবস্থা করে। এই শেয়ারিং প্লেসে ললিতের মতো কয়েকজন যারা একত্রে থাকে, হাসপাতাল থেকে সব সময় সোশ্যাল ওয়ার্কার এবং নার্স এসে দেখাশোনা করে। এদের কারও অবস্থা খারাপ হলে, হাসপাতালে পাঠানো হয়।

নিমি একা বাসা নেওয়ার জন্য দরখাস্ত দিলেও শেষ পর্যন্ত বাসা না নিয়ে তার দাদা ও বউদির সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। কাছাকাছি থাকাতে, ওরা বাসার সবাই পর্যায়ক্রমে ললিতকে দেখাশোনা করতে পারে।

মানস, নিমির তিন বছরের কলেজমেট, কলেজে থাকাকালে অ্যাকাউন্টিং এবং কম্পিউটারের ওপর কোর্স করে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করে। কলেজজীবনে তাদের জানাশোনা হয়েছে। মানসের মা-বাবা পশ্চিমবাংলার ২৪ পরগনার লোক। সে পড়াশোনার জন্য কানাডা এসে লেখাপড়া শেষ করে কাগজ বানিয়েছে। সে কয়েকজনের সঙ্গে মিলে মেস করে থাকে পয়সা বাঁচানোর জন্য, উইকেন্ডে মানস এবং নিমির মাঝেমধ্যে দেখাশোনা হয়ে থাকে। ওরা প্রতিজ্ঞা করেছে যে দুজনেই বিয়ে করে সংসারী হবে। কিন্তু মানসের হাতে কোনো টাকাপয়সা থাকে না, যা কিছু জমে, দেশে অভাবী মা-বাবা এবং ভাইবোনকে দিয়ে খালি হাতে থাকে। মানস বলে, তার মা-বাবা চায় সে দেশে গিয়ে মা-বাবার পছন্দমতো বিয়ে করে কানাডা নিয়ে আসবে। কিন্তু সে মা-বাবার সঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করে। বলে, আমি এখানে বিয়ে করব। মা-বাবা শুনতে রাজি নয়। বলে, তুমি দেশে এসে বিয়ে করে যাবে, এ নিয়ে পরিবারের সঙ্গে ওর মতপার্থক্য। এ জন্য সে বিয়ে নিয়ে দেরি করছে।

নিমি বলে, আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী আমরা খরচ করে বিয়ে করব। মানস বলে, সে ঠিক আছে, তবে মা-বাবাকে বুঝিয়ে বিয়ে করব, এতে পরে কোনো সমস্যা যেন না হয়। তা ছাড়া আমি অনুষ্ঠান করব, মা-বাবা ও ভাইবোনের সঙ্গে। আত্মীয়স্বজন দেখবে এবং আনন্দ করবে, কারণ এটা পরিবারের সর্ব শেষ বিয়ে। আমি ওদের অসুখী করতে চাই না। তোমার ছবি পাঠিয়েছি, মা পছন্দ করছে। আশা করি ওদের সবার সমর্থন পেয়ে যাব এবং তখন আমি তোমাকে নিয়ে যাব।

নিমি অদিতিকে বলে, দেখো, আমি মানসকে বিশ্বাস করি, ওকে বাদ দিয়ে কোথায় কোন ছেলে বিয়ে করব?

অদিতি বলে, দেখো শেষ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকমতো হলেই হয়। বাবা অসুস্থ, মানস কী এ ব্যাপারে কিছু জানে এবং তোমাকে কিছু বলে?

হ্যাঁ, মানস সবকিছু জানে এবং বলে, মানুষের অসুখ তো থাকবেই, ওতে আমাদের অসুবিধা কী?

আমি ওকে বুঝিয়ে বলেছি যে মা মারা যাওয়ার পর বাবা আমাদের আগলিয়ে ধরে রেখেছে এবং যদিও আমরা বাবাকে বলেছি যে তুমি বিয়ে করে নাও। কিন্তু আমাদের অসুবিধা হবে ভেবে সে বিয়ে করেনি। এটা আমাদের জন্য বাবার অনেক বড় ত্যাগ, তাই না?

মানস বলে, তা তো ঠিকই।

মা মারা যাওয়ার পর বাবা আমাদের ছেড়ে এক দিনের জন্যও কোথাও যায়নি বা তার কোনো রকম উল্টাপাল্টা চলাফেরা দেখিনি। আজ বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছে, আমরা ব্যতীত বাবার কে আছে?

মানস বলে, তা ঠিকই বলছ। চলো একদিন বাবাকে দেখে আসি।

ঠিক আছে।

অদিতি বলে, অনেক রাত হয়েছে, যাও ঘুমিয়ে পড়ো। সকালে আবার তোমার এবং আমাদের সবার কাজ আছে। নিমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু তার ঘুম আসে না। এ পাশ-ও পাশ করতে করতেই ভোর হয়ে যায়।

সে রাতের কাপড় ছেড়ে সকালের নাশতা খেয়ে টিফিন ক্যারিয়ার করে দুপুরের লাঞ্চ নিয়ে বাসে কাজে গিয়ে পৌঁছে। রাতে ঘুম হয়নি, আজ খারাপ দিন যাবে।

বিকেলের দিকে অদিতি টেলিফোন করে বলে, বাবা তার আশ্রয় থেকে না বলে কোথায় চলে গেছে, কেউ বলতে পারে না।

সে বলে, দাদা কী জানে?

তোমার দাদা ডাক্তারকে টেলিফোন করেছে এবং ডাক্তার বলে, পুলিশে রিপোর্ট করা হয়েছে এবং ওকে যেখানে পায় নিয়ে আসবে।

নিমি কাজ সেরে বাসায় টেলিফোন করে অদিতিকে বলে, আমি কি বাবার ওখানে যাব?

না, তোমার দাদা কাজ সেরে ওখানে যাবে এবং ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করবে। তুমি বাসায় চলে এসো।

নিমি বাসায় এসে দেখে ওর দাদা প্রিয়ব্রত বাসায় এসেছে এবং নিমি জিজ্ঞেস করে দাদা, বাবার কী কোনো খবর পেয়েছ?

হ্যাঁ ও বেশি দূরে যায়নি। পাশে এক শপিং মলে গিয়ে বেঞ্চে বসে ছিল এবং পুলিশ গিয়ে তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ডাক্তারকে রিপোর্ট করেছে। আমি ওখানে যাইনি এবং ডাক্তারের অফিস থেকে আমাকে জানিয়েছে যে সে ভালো আছে। যাক অল্পতে বেঁচে গেলাম।

কমল, সুমিত এবং তাদের পরিবার কোর্ট থেকে এক মাস থাকার অনুমতি পাওয়ার পর পাশে একটা অ্যাপার্টমেন্টে মুভ করে। শুচিতা জেনেছে কমলকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে তার প্রতিবেশীর বাসায় গিয়ে চিৎকার ও মারামারির জন্য। প্রতিবেশী রিপোর্ট করেছে যে কমল এবং সুমিত পাশের বাসায় গিয়ে সব সময় চিৎকার ও তর্ক করে। এসব কেন্দ্র করে পুলিশ ললিত এবং কমলকে ধরে নিয়ে গিয়েছে। সে মনের দুঃখে বেশ কয়েক দিন ওদের বাসায় টেলিফোন করেনি।

আভা বলে, শুচিতা, তুমি সুমিতের কোনো খবর কেন নিচ্ছ না?

মা, আমি অনেক কিছুই শুনি তাদের ব্যাপারে যে জন্য কোনো খবর নিতে ইচ্ছা করে না।

কী খবর শুনেছ?

আমার শ্বশুর কমলকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে।

কবে, তা তো কিছুই বলোনি?

মা, এসব বলতে কী ভালো লাগে?

তা তো বুঝি, কী করবে দুঃখ করে?

মা, দুঃখে আমার কাঁদতে ইচ্ছে করে।

সে বুঝি, সবই তোর কপাল।

মা, এ রকম ভাগ্য আমার, আমি কিছুই সহ্য করতে পারি না। প্রিতম বলে, একবার বাসায় গিয়ে দেখে আসলে কেমন হয়?

বাবা, কোথায় যাব, ওরা তো ওই বিল্ডিংয়ে নেই। ওরা কোন বিল্ডিংয়ে গেছে?

পাশে কোন বিল্ডিংয়ে গেছে, জানি না।

কমল ধর্মকর্ম করে, সে কেন অন্য লোকের বাসায় গিয়ে চিৎকার ও মারামারি করবে?

বাবা, মানুষের ঘাড়ে যখন শয়তান চাপে, ন্যায়-অন্যায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তা ছাড়া মানুষ যদি নিয়মমাফিক কাজ না করে, তখন শয়তানের তাড়নায় উল্টাপাল্টা কাজ করে ঝামেলায় পড়ে। ওদের ঘরে কোনো লোক কাজ করে না, সবাই সরকারের অনুদানের ওপর নির্ভর, এরা মনে করে এ করেই সবকিছু চলবে। এ দেশে কোনো কিছুই করার দরকার নেই। ওরা রিফিউজি ক্লেম করেছে, সংসারে কেউ দুই পয়সাও রোজগার করে না বা করার যোগ্যতা অর্জনও করে না। তা ছাড়া ওরা মানুষের সমালোচনা করে। সারাক্ষণ এদের মুখে সমালোচনা। এ ছাড়া কিছুই শুনবে না।

কমল ও আরতি দুজনে দিনের ৯টা বাজে সেজেগুজে শপিং মলে গিয়ে বেঞ্চে বসে দুই কাপ কপি এবং ডোনাট বা মাফিন নিয়ে এদিক-সেদিক তাকাবে, গালগপ্পো করবে, দুপুরে খাওয়ার সময় হলে বাসায় এসে খেয়ে ঘুম বিকেল ৫টা পর্যন্ত। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে এক কাপ চা, বিস্কুট যা কিছু আছে নিয়ে বসবে টেলিভিশন খুলে ইন্ডিয়ান মুভি দেখবে এবং অপেক্ষা করবে শুচিতা কখন আসবে এবং টেবিল সিঙ্ক পরিষ্কার করে রাতের রান্না করবে। খেতে বসবে, রান্না ভালো হয়নি সমালোচনা করবে। এত নবাবি জীবন ওদের।

আমি জানি সুমিত অসুস্থ, এখন দেখি ওর বাবা কমলও অসুস্থ, তা না হলে পুলিশ ওকে কেন নিয়ে যাবে? (চলবে)

নজরুল ইসলাম