মনের আয়নাতে

সাইদুল হোসেন

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

চোখ নেই, নাক নেই

(এক)

তিন বছরের মেয়ে ও এক বছরের ছেলেকে নিয়ে ওদের বাবা ঘন্টা দেড়েক আমাদের Rehab Clinic-এ বসেছিল। ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করা ও ছেলেটার চিকিৎসা করানোর ফাঁকে ফাঁকে ওর বাবাকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে মেয়েটিকে আমার কাছে ডেকে এনে আমার চেয়ারে বসিয়ে এক স্টাফের দেয়া কিছু সাদা কাগজ ও কয়েকটা রঙিন পেন্সিল ওর হাতে দিয়ে ছবি আঁকতে দিলাম। জিজ্ঞাসা করলো : কি আঁকবো।

বললাম : একটা গাড়ি আঁকো।

সে বলল : গাড়ি আঁকতে জানি না। অন্য কিছু বল।

বললাম : গাছ আঁকো তাহলে। বলল : ওকে।

তারপর কিছুক্ষণ বিভিন্ন রঙের পেন্সিল দিয়ে কিছু লাইন টেনে, কয়েকটা গোল্লা বসিয়ে কগজটা আমার দিকে ঠেলে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল : ইউ লাইক ইট্?

বললাম : ইট্‌স্ নাইস্। আই লাইক ইট্।

সে পেন্সিলটা হাতে ঘুরাতে ঘুরাতে কাগজটার দিকে তাকিয়ে বলল : ওহ হো, ভুল হয়ে গেছে! আমি ওটাতে একটা নাক এবং দু’টো চোখ দিতেই ভুলে গেছি। তারপর কাগজটাকে ওর কাছে টেনে নিল, এখানে ওখানে কিছু ত্রিভূজ ও কয়েকটা ফোঁটা বসিয়ে দিয়ে বলল : এখন ঠিক আছে। তারপর আবার জিজ্ঞাসা করল : এখন কি আঁকবো?

ইতিমধ্যে একজন স্টাফও এসে যোগ দিল আমাদের সঙ্গে। ও-ই বলল : একটা হাউস আঁকো এখন। বাচ্চাটা একটু নড়েচড়ে চেয়ারে ভালমত বসে নূতন একটা কগজে একটা বড় ত্রিভূজ, একটা বড় গোল্লা আঁকলো। বলল : ডান।

শিশুদের চিত্রাঙ্কনের একটি নমুনা। ছবি : কিন্ডারআর্ট

আমার সাথী বলল : বেশ হয়েছে, আই লাইক ইট্।

শুনে ওর ঘাড় বাঁকা করে ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল : নো, নট নাইস। সেম্ মিস্টেক – নো আইজ্, নো নোজ্, নট নাইস।

তারপর কাগজটাতে ছোট্র একটা ত্রিভূজ আঁকল, বলল : এটা ওর নাক। অন্যখানে দিল তিনচারটা ফোঁটা লালনীল পেন্সিল দিয়ে। বলল : এগুলো ওর চোখ। নাও ওকে, লূক।

বললাম : ইউ আর রাইট। দ্য হাউস নাও লূকস্ বেটার। শুনে বলল : থ্যাঙ্কস্।

আবার প্রশ্ন : এখন কি আঁকবো?

জিজ্ঞাসা করলাম : ফুল আঁকতে পারো?

বলল : আই ক্যান ট্রা-ই!

বেশ, তাহলে ফুলই আঁকো, বললাম আমি।

বাচ্চাটা একটা নূতন কাগজে আগের মতই কিছু লাইন টানল, বড় একটা গোল্লা আঁকল, হিজিবিজি কিছু ছোটছোট লাইন টানলো, তিনচারটা ছোট দাগ দিল গোল গোল করে, একটা ত্রিভূজ আঁকল। তারপর আমার মনোযোগ সেদিকে আকর্ষণ করে বলল : লূক, দিস্ ইজ্ নোজ, দীজ্ আর দি আইজ্। ডান। বলেই পেন্সিলগুলো এক হাতের মুঠোয় ভরে বলল : নাউ আই গো।

তাকে চেয়ার থেকে নামিয়ে দিলাম। সে তখন তরতর করে হেঁটে যে মহিলা তাকে কাগজ-পেন্সিল দিয়েছিল তার কাছে গিয়ে পেন্সিলগুলো তার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল : থ্যাঙ্কস্। তারপর ওর বাবার কাছে ফিরে গেল।

এই খেলার মাঝে লক্ষ্য করলাম যে পেন্সিলের রং সম্পর্কে ওর স্পষ্ট ধারণা আছে – কোনটা লাল্, কোনটা নীল, অথবা সবুজ সেটা সে ঠিক ঠিক জানে। তবে মজার জিনিস হলো এই যে ঘর, ফুল অথবা গাছ যাই আঁকুক না কেন সবকিছুতেই চোখ এবং নাক থাকতে হবে। এক আরো লক্ষ্য করলাম যে যথারীতি থ্যাঙ্কস্ দিতে ভুল করে না কখনো।

সেদিন ভীড় খুব কম ছিল ক্লিনিকে, তাই খানিকটা সময় বেশ আনন্দে কাটল।

(দুই)

আডিও (Adio)

এক গ্রীক মহিলার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে যিনি একজন ফিজিওথেরাপিস্ট। তাঁর দু’টি সন্তান – ছ’বছরের একটি ছেলে এবং চার বছরের ফুটফুটে সুন্দর একটি মেয়ে, ডোরা। খুবই বুদ্ধিমতী শিশু। এই ডোরার সঙ্গে ভাব জমানোর জন্য একদিন ওর মায়ের সামনেই ওদের গ্রীক ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করলাম।

-কালি মেরা (গুড মর্নিং)। ডোরাও বলল : কালি মেরা।

-টিকানিস? (হাও আর ইউ?)। ডোরাও বলল : টিকানিস?

– কালা (আই অ্যাম ফাইন)। ডোরাও বলল : কালা।

– এফ্হারিস্তো (থ্যাঙ্ক ইউ)। ডোরাও বলল : এফ্হারিস্তো।

– পারাকালো (ইউ আর ওয়েলকাম)। ডোরাও বলল : পারাকালো।

আমাদের এই কথোপকথন শুনে ডোরার মা মিটিমিটি হাসতে লাগল। ওর মাকে জিজ্ঞাসা করলাম : ডোরা কি গ্রীক ভাষা জানে না?

ওর মা বলল : না, জানে না। শেখেনি। আমি গ্রীক কিন্তু ওর বাবা একজন বৃটিশ-কানাডিয়ান। ডোরা ওর বাবার ইংলিশ ভাষাটাই অধিক পছন্দ করে এবং সেটাই সে গ্রহণ করেছে। ওর সঙ্গে আমিও ইংলিশ  বলে থাকি। গ্রীক যদিও খানিকটা বোঝে সে।

আমার অবাক লাগলো এই ভেবে যে মিক্সট্ কালচারের দম্পতিদের সন্তানেরা সচারচর যেখানে মায়ের ভাষাটাই সহজে শিখে নেয় সেখানে ডোরা একটা ব্যতিক্রম।

চলে আসার আগে ওর ছোট্র ডান হাতটি উঠিয়ে বলল : আডিও, অর্থাৎ বা-ই!!

জমজ দুই বোন ও অন্যান্য ঘটনা

(এক)

জমজ বোন

বছর ৫-৬ বয়সের একটি মেয়ের হাত ধরে ছোটখাট গড়নের এক গায়ানীজ মহিলা আমাদের ক্লিনিকে এসে ঢুকলেন। আমার পিছনে রাখা দুই চেয়ারে বসল মা ও মেয়ে। মহিলার চেহারাটা আমার খুব পরিচিত মনে হলো, যেন আগের সপ্তাহেই দেখেছি তাঁকে। তাই জিজ্ঞাসা করলাম : আজ কেমন আছেন? গত সপ্তাহেই তো এখানে আপনাকে দেখেছি বলে মনে পড়ছে।

বিস্মিত হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মহিলা বললেন : কই, নাঃ, গত সপ্তাহে তো আমি এখানে আসিনি! বছর দুই আগে একবার এসেছিলাম বটে।

এবার আমার বিস্মিত হওয়ার পালা। বললাম : গত সপ্তাহে তাহলে কাকে দেখলাম এখানে ঠিক আপনার মতই চেহারা? আমার স্মৃতি কি আমাকে এতই ধোঁকা দিচ্ছে?

শুনে মহিলা হেসে বললেন : আমাকে দেখেননি সেটা নিশ্চিত। হয়ত আমার জমজ বোনটাকে দেখেছেন। আমরা দুই বোন দেখতে ঠিক এক রকম -we two are identical twins..

মহিলার মেয়েটি বলল : She is a hijabi lady. Can you remember that?

বললাম : হতে পারে, অতটা মনে নেই। আপনারা কি মুসলিম?

মহিলা আবার হেসে দিলেন, বললেন : না, আমরা হিন্দু। কিন্তু আমার সেই বোনটা একজন মুসলিমকে ভালবেসে বিয়ে করে মুসলিম হয়েছে, সে এখন হিজাব পরে। গায়ানাতে আমরা হিন্দু-মুসলিম-খৃষ্টান সব ধর্মের লোকই মিলেমিশে বাস করি। বিয়েশাদীর ব্যাপারে আমরা খুব উদার, যার যাকে ভাল লাগে সে তাকে বিয়ে করে, ধর্ম নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।

মহিলা বেশ মিশুক প্রকৃতির। কাজের শেষে যাবার আগে ‘বা-ই’ বলে বিদায় জানিয়ে গেলেন।

(দুই)

SEEMA নামের মেয়েটি

এক স্টোরে গিয়েছিলাম এক জোড়া জুতা কিনতে। সেখানে আমাকে সাহায্য-সহায়তা করলো যে অল্পবয়সী মেয়েটি তার আইডি ট্যাগে নাম লেখা রয়েছে SEEMA। জিজ্ঞাসা করলাম : তোমার যা নাম সেটা তো সচরাচর ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মেয়েদের হয়ে থাকে। অথচ তোমার গায়ের রঙ এবং চেহারা ফিলিপিনো মেয়েদের মত। তোমার এই নাম রাখলো কে?

মিষ্টি হেসে মেয়েটি বলল : আমার বাবা একজন বাংলাদেশী, মা ফিলিপিনো। আমি মায়ের চেহারা পেয়েছি, নামটা রেখেছে আমার বাবা।

জানতে চাইলাম সে বাংলা ভাষা বোঝে কিনা অথবা বলতে পারে কিনা।

বলল : বুঝি বেশ খানিকটা কিন্তু বলতে পারি কম। বাবা বাংলা শেখাতে উৎসাহী নয়, বাংলা বলেও কম। তবে সামান্য যে কটা কথা বাবা মাঝে মাঝে বলে সেগুলো মনে আছে, যেমন এখানে আস; চুপ, বেশি কথা বলবে না, ইত্যাদি।

তোমার ভাইবোন?

বলল : না, কেউ নেই। আমিই বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান।

(তিন)

তুমি সুখী ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখ কি?

একদিন ক্লিনিকের একজন স্টাফ আমাকে জিজ্ঞাসা করল : সাইদ, তুমি কি স্বপ্ন দেখ? সুখের-আনন্দের স্বপ্ন দেখতে ভালবাস?

হেসে দিয়ে বললাম : লেডি, তোমার বয়স অল্প, তোমার ভবিষ্যত নিয়ে স্বপ্ন দেখার এইতো সময়। আমার বয়স এখন ৭৪ বছর, আমার জীবনে আর সুনির্দিষ্ট কোন মড়ধষ নেই। অতীতে ছিল, এবং তখন ওখানে পৌঁছার উদ্যম ছিল, চেষ্টা ছিল যা মানুষের বয়সের ধর্ম। আমার আর সেই স্বপ্ন দেখার অবকাশ নেই। তবে একটা আকাঙ্খা আছে এবং সেটা হলো শান্তির সন্ধান। সেই চেষ্টারই একটা অংশ হলো তোমাদের হাসপাতালে ভলন্টিয়ার হয়ে কাজ করা। এই কাজটা আমাকে বড় আনন্দ দেয়, খুব তৃপ্তি পাই। সপ্তাহে তিনদিন আমি কাজ করি, ভাবছি আগামী মাস থেকে সপ্তাহে চারদিন করে কাজ করব।

আমার কথা শেষ হলে সে আগ্রহ দেখিয়ে বলল : যদি সত্যিই তুমি আরো একদিন কাজ কর তাহলে আমাদের ক্লিনিকেই কর। তোমাকে আমার বড় ভাল লাগে, তোমার সঙ্গে কথা বলে বড় আনন্দ পাই।  I like you so much!

(চার)

মা ও মেয়ে

সার্জারি ডিপার্টমেন্টের ইনফর্মেশন ডেস্কে কাজ করছি এমন সময় দু’জন মহিলা (একজন বেশ বয়স্কা) আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞাসা করলাম : কোন সাহায্য করতে পারি কি?

হেসে বৃদ্ধা বললেন : নো, থ্যাঙ্কস্। আমি এসেছি আমার এই মেয়েটিকে দেখাতে হাসপাতালের ম্যটার্নিটি ইউনিটের কোন বেডে ওর জন্ম দিয়েছিলাম।

বেশ মজার ঘটনা। তাই প্রশ্ন করলাম : কতদিন আগের ঘটনা সেটা?

এবার মেয়েটি হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে জবাব দিল : তা অনেক বছর হলো বৈকি! আমার বয়স এখন ৪৯ বছর।

আমি একটু অবাক হয়ে মন্তব্য করলাম : এত বছর আগেও এই  হাসপাতাল ছিল?

বৃদ্ধা জানালেন : আরো আগে থেকেই ছিল তবে এত বড় নয়, আরো ছোট হাসপাতাল ছিল এটা। ইতিমধ্যে কত-না পরিবর্তন ঘটেছে, কত বড় হয়েছে, কত নূতন ডিপার্টমেন্ট খোলা হয়েছে এখানে। চেনাই যায় না!

তারপর থ্যাঙ্ক ইউ, বা-ই জানিয়ে বিদায় নিলেন সেই মা ও মেয়ে।

(পাঁচ)

অথর্ব বৃদ্ধ রোগী

একদিন এক রোগীকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে ঠেলতে ঠেলতে ফ্র্যাকচার ক্লিনিকে নিয়ে এল তার কোন এক আত্মীয়। বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করতে হয়েছিল ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করার জন্য।

লক্ষ্য করলাম, রোগী অতি বৃদ্ধ, চোখ বুঁজে মাথা নীচু করে বসে আছে, চারপাশে কি হচ্ছে খেয়াল নেই তার। দু’হাতের মুঠি বন্ধ করছে, খুলছে, আবার বন্ধ করছে, আবার খুলছে। মুখ থেকে লালা গড়িয়ে পড়ছে। অতি করুণ অবস্থা।

এ সময়ে ক্লিনিকের এক মহিলা অ্যাসিস্টেন্ট এসে রোগীকে জিজ্ঞাসা করল : কেমন বোধ করছ এখন? কি জবাব দিল সে সেটা শুনতে পেলাম না। দেখলাম সেই মহিলা ক্লিনিকের ভেতরে চলে গেল, ফিরে এল হাতে একটা টেডি বেয়ার নিয়ে। সেটা সেই বৃদ্ধের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল : নাও এটা নিয়ে খেলতে থাক, আরাম পাবে। তারপর সে নিজের কাজে ফিরে গেল।

দৃশ্যটা দেখে মনে মনে ভাবলাম : আমি কত ভাগ্যবান। এই ৭৪ বছর বয়সেও নিজের সামর্থ্য নিয়ে চলাফেরা করতে পারছি। বড় ধরনের কোন অসুখবিসুখ নেই। আলহামদুলিল্লাহ!

কিন্তু একই সঙ্গে একটা প্রশ্নও মনে জাগল : আল্লাহ, তুমি এই অথর্ব, অসহায় লোকটাকে কোন বাঁচিয়ে রেখেছ আজো?

(ছয়)

গুড ম্যান এ্যান্ড ব্যাড ম্যান

স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য তাঁকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর স্বামীও এলেন আমাদের ক্লিনিকে। ঢোকার আগে যথারীতি গুড মর্নিং, হাউ আর ইউ? ইত্যাদির বিনিময় করলাম আমরা। স্ত্রী ডাক্তারের কাছে চলে যাওয়ার পর ভদ্রলোক আমার ডেস্কে ফিরে এসে হাসতে হাসতে বললেন : Good man loses his wife, bad man sticks to her, কথাটা কখনো শুনেছেন কি?

বললাম : আগে শুনিনি কোনদিন, আজ শুনলাম। কিন্তু এ কথাটা বলার অর্থ কি এই যে আপনি এই স্ত্রীকে লুজ করে আরেকটা স্ত্রী ঘরে আনতে চান?

শুনে চোখ বড় বড় করে বললেন, আরে না, না, কি যে বলেন। সেটা নয়। আমি একজন ব্যাড ম্যান, এ-মাসেই ২১ তারিখে আমাদের বিয়ের 60th anniversary হতে যাচ্ছে। গুড ম্যান হলে তো এই diamond jubilee of marriage টা পালন করার সৌভাগ্যটা হতো না আমার। সুদীর্ঘ ৬০টি বছর ধরে আমার শত দোষত্রুটি উপেক্ষা করে একটি মহিলা আমাকে আঁকড়ে ধরে আছে, কম্পানি দিয়ে যাচ্ছে এটা তো বিরাট একটা পাওয়া। আমি গুড ম্যান হতে যাব কোন্্ দুঃখে!

বললাম : কংগ্রাচুলেশন্স।

থ্যাঙ্ক ইউ বলে পাশে রক্ষিত একটা চেয়ারে গিয়ে বসলেন। 

নওয়াব আলী

সেপ্টেম্বর (২০০৭)-এর শেষ সপ্তাহে একদিন রাত সারে বারোটায় ঘুম ভাঙলো টেলিফোন বাজার শব্দে। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে শুনলাম অপরিচিত কণ্ঠে, সেলামালেকুম, আমি নওয়াব আলী। আমি আপনাদের গ্রামের বাড়ি থেকে আপনার ভাতিজার সেলফোনে কথা বলছি। আপনি কেমন আছেন, বলেই হাঁউমাউ করে সে কেঁদে দিল।

নওয়াব আলী! কত যুগ আগের কথা! সে ছিল আমার প্রাইমারী স্কুলের (১৯৩৯-৪৫) সহপাঠি। ধনী কৃষক পরিবারর ছেলে। গ্রামে যাই না কত যুগ ধরে। শেষ দেখা হয়েছিল ১৯৬৮ সনে যখন সর্বশেষ গ্রামে গিয়েছিলাম।

একটু সামলে নিয়ে আমার কুশলবার্তা জিজ্ঞাসা শেষ করে জানাল যে আমার কথা ওর সব সময়ই মনে পড়ে, কথা বলতে ইচ্ছা করে। অনেক স্মৃতি মনে পড়ে। আমার লেখা বাংলা বইগুলো সব পড়ে। আমাকে দেখতে ইচ্ছা করে।

সে জানাল যে ওর বয়স এখন ৮১ বছর, তবে স্বাস্থ্যটা ভাল, চলাফেরা অনায়াসেই করতে পারে। আমি যেন দু’আ করি যাতে সে আরো কয়েক বছর বেঁচে থাকে। এখন রোজার মাস, সে নিয়মিত রোজা রাখতে পারছে। এই ৮১ বছর বয়সেও সে রোজা রাখতে পারছে শুনে আমি অবাক না হয়ে পারিনি সেদিন।

ওর সঙ্গে কথা বলা শেষ করে আমি নিজেও সেই শৈশবের ফেলে আসা দিনগুলোকে নূতন করে স্মৃতিতে এনে জাবর কাটার চেষ্টা করলাম বেশ কিছু সময় ধরে। মনে পড়ে গেল স্কুলে আমার সহপাঠি মর্তুজার কথা যে ছিল সারা স্কুলে একমাত্র ছাত্র যে তার বাম হাত দিয়ে লিখত আর আমরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখতাম! আরো মনে পড়ল অপর সহপাঠি আবুল হাশেমের কথা যে ছিল বয়সে আমার চেয়ে ৬-৭ বছরের বড় এবং ক্লাস সিক্সে থাকতেই বিয়ে করে আমাদের ছাত্রদের মাঝে এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। মনের আয়নাতে আরো কত স্মৃতিই না ভেসে উঠল একে একে। হায়রে মধুর অতীত! আবার যখন ঘুম পেল তখন রাত তিনটা গড়িয়ে গেছে।

(চলবে)

সাইদুল হোসেন। মিসিসাগা