শুচিতা

 (কানাডার দৈনন্দিন বাস্তবতার দিকে লক্ষ্য রেখে কাল্পনিক এই উপন্যাস ‘শুচিতা’। লিখেছেন কানাডা প্রবাসী নজরুল ইসলাম। )

নজরুল ইসলাম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আজ শুচিতার নামে একটা চিঠি এসেছে। প্রদীপ,  ইন্ডিয়ার বোম্বে থেকে চিঠি দিয়েছে। শুচিতা মনে মনে ভাবে প্রদীপ আমাকে অনেক ভালো বাসে। কিন্তু সুমিত আমার ইউনিভার্সিটি জীবনের বন্ধু। আমি কী করি শ্যাম রাখি না কুল রাখি। প্রদীপ আমাকে ব্যবহার করে কানাডা আসতে চায়। মা-বাবা এবং আত্মীয়স্বজন সবাই চায় আমি যেন প্রদীপকে বিয়ে করি। এতে আত্মীয়তা বজায় থাকে। কিন্তু আমি প্রদীপকে ভালো বাসি না; বরং সুমিতকে ভালোবাসি। সুমিত আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। আমি ক্লাসে ম্যাথ ও সায়েন্স সাবজেক্টগুলোতে ভালো ছিলাম না। সুমিত অনেক ভালো এবং সে আমাকে সাহায্য করেছে। তা ছাড়া সে আমাকে অনেক ভালো বাসে। প্রদীপ অবশ্য অনেক সুন্দর লাভ লেটার লিখতে পারে। তার লেখা চিঠি অনেক আকর্ষণীয়। খাওয়ার পর বেডে গিয়ে আরাম করে শুয়ে চিঠি পড়ব।

মা-বাবা আমাকে অনেক মিস করে। বাবাকে বলেছি, চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বাড়ি বিক্রি করে এখানে চলে আসতে, তাতে তারা আমাকে আর মিস করবে না। মা-বাবা জীবনে অনেক কষ্ট করেছে। বাবা প্রথম জীবনে শিপে কাজ করত। এখনো কত কষ্ট, ১২ ঘণ্টা শিফটে ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। মা রেস্টুরেন্টে পার্টটাইম কাজ করে।

শুচিতা মনে মনে ভাবে, প্রদীপকে বিয়ে না করে, সুমিতকে বিয়ে করলে মা-বাবা মনের দিক থেকে অনেক কষ্ট পাবে। কিন্তু আমি কী করব? কীভাবে আমি সুমিতকে নিষেধ করব?

নিষেধ করতে চাইলেও সুমিত এ কথা কিছুতেই মানবে না। তা ছাড়া প্রদীপকে যদি বিয়ে করি, তাকে স্পনসর করতে হবে। দুই থেকে আড়াই বছর লাগবে তার কেস অনুমোদন হতে এবং এখানে এসে আবার নতুন করে পড়াশোনা করা, চাকরি নেওয়া অনেক দিন লাগবে। এ বড়ই ঝামেলাজনক কাজ। প্রদীপকে নিজের লাইনের কাজ পেতে কমপক্ষে দুই-তিন বছর সময় লাগবে।

শুচিতা বেডে গিয়ে প্রদীপের চিঠি নাড়াচাড়া করে, পড়তে ইচ্ছে করে না। প্রদীপ ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক কিছু লেখে। সারা দিনের ক্লান্ত শরীর, ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়ে। প্রদীপের চিঠি বেডে পড়ে থাকে এবং সকালে সে ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়া করে অফিসে চলে যায়। মাঝখানে চায়ের বিরতির সময়, সে মনে করে যদি চিঠিটা নিয়ে আসতাম, তবে ভালোই হতো এবং অবসর সময় পড়তে পারতাম।

বিকেলে ঘরে এসে সে খাওয়াদাওয়া সেরে চিঠি নিয়ে বসে। প্রদীপের চিঠি পড়ে শুচিতার মন খারাপ হয়ে যায়। সে অনেক দিন থেকে ভাবে প্রদীপকে খোলামেলা কথা বলাই ভালো, তাতে সে অযথা আশা করে হয়রান হবে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাবাকে নিয়ে। বাবা কিছুতেই মানতে রাজি হয় না। নিজের আত্মীয়স্বজনকে একটু সাহায্য করতে কে না চায়?

বাবাকে কোনো মতেই বোঝানো যায় না। আমি বড় হয়েছি, তা ছাড়া আমার নিজের পছন্দ তো অবশ্যই আছে। শুচিতা ভাবে, প্রদীপকে পরিষ্কার করে বলে দেওয়াই ভালো।

শুচিতা টেলিফোন উঠিয়ে প্রদীপকে ডায়াল করে সঙ্গে সঙ্গে লাইন পেয়ে যায়। হ্যালো! আমি অটোয়া থেকে শুচিতা বলছি। প্রদীপ, তুমি কেমন আছ?

প্রদীপ শুচিতার টেলিফোন পেয়ে হকচকিয়ে যায়। বলে, Ñআমি ভালো আছি। শুচিতা, তুমি কেমন আছ?

Ñআমিও ভালো আছি।

Ñঅটোয়ার আবহাওয়া কেমন?

Ñএখানে অনেক ঠান্ডা এবং গতকাল প্রচণ্ড স্নো পড়েছে। আজ ট্যাম্পারেচার -১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

Ñপ্রচণ্ড ঠান্ডা!

Ñআমরা ঠান্ডার দেশে থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।

Ñতুমি কি আমার চিঠি পেয়েছ?

Ñহ্যাঁ! পেয়েছি।

শুচিতা প্রায় আধ ঘণ্টা কথা বলে এবং পরিষ্কার করে বলে যে আমি কাউকে অনেক দিন থেকে ভালোবাসি। এ অবস্থায় আমি তাকে ব্যতীত কাউকে বিয়ে করতে পারব না। তুমি আমার আত্মীয়, তোমার প্রতি আমার অবশ্যই আন্তরিকতা আছে। আমি জানি তুমি মনে মনে দুঃখ পাবে। কিন্তু আমার পক্ষে করার কিছুই নেই। আমি দুঃখিত তোমাকে কোনো প্রকার সাহায্য করতে পারলাম না। তোমার যোগ্যতা আছে, তুমি নিজের থেকে চেষ্টা করে এখানে এলে আমরা যতটা পারি সাহায্য করব। প্রদীপ বলে, ঠিক আছে, তোমার সুখে আমিও সুখী।

অনেক দিন পর শুচিতা তার মা-বাবাকে বুঝিয়ে বলে, আমি প্রদীপকে বিয়ে করতে পারব না, আমি সুমিতকে ভালোবাসি। আমি সুমিতকে বিয়ে করব। মা-বাবা বলে, Ñসুমিতকে বিয়ে করবে?

Ñহ্যাঁ!

Ñতুমি কী ভালোভাবে চিন্তা করে দেখেছ?

Ñহ্যাঁ, আমি এ ব্যাপারে ভালোভাবে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং প্রদীপকে বুঝিয়ে বলেছি। ও আমার অবস্থা শুনে মেনে নিয়েছে এবং ওকে আমি বুঝিয়ে বলেছি ইমিগ্রেশনের জন্য নিজের থেকে চেষ্টা করলে যত দূর সম্ভব আমরা ওকে সাহায্য করব।

প্রিতম ও আভা শুচিতার কথা শুনে বলে, এটা তোমার জীবন। তুমি যা কিছু করো ভালোভাবে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেবে।

শুচিতা সুমিতকে বলে,

Ñতুমি কাজ করো টরন্টো, আমি কাজ করি অটোয়া, এ অবস্থায় তো তোমাকে বিয়ে করে ছোটাছুটি করা আমার পক্ষে সম্ভব না। তুমি যেকোনো কাজ নিয়ে অটোয়া চলে এসো এবং তারপরই দেখা যাবে।

প্রায় এক বছর চেষ্টার পর কোনো একটা কোম্পানিতে কাজ নিয়ে সুমিত অটোয়া মুভ করেছে।

শুচিতা বাবা-মাকে চেষ্টা করে তাদের টরন্টোর বাড়ি বিক্রি করে অটোয়া একটা অ্যাপার্টমেন্ট খরিদ করে বাকি ডলার ব্যাংকে ওদের নামে ফিক্সড ডিপোজিট করে বলে, তোমরা নিজেদের অবসর জীবন ভালোভাবে উপভোগ করো। সুমিত কাজে যোগদানের পর শুচিতাকে চাপ দিচ্ছে বিয়ে করার জন্য। কিন্তু শুচিতা বলে, একটু সময় দাও, আমি মা-বাবাকে বুঝিয়ে ঠিক করতে হবে। এই করে তাদের এক বছরের বেশি সময় লেগে যায়।

শুচিতার ইউনিভার্সিটি জীবনের চলাফেরার গতি আজকাল আর নেই। এ নিয়ে সুমিত প্রায়ই অভিযোগ করে, তুমি আগের চেয়ে অনেক রিজার্ভ কেন?

শুচিতা বলে, আমি আজকাল অনেক ব্যস্ত থাকি। তুমি বুঝতে চাও না, অফিসে আমার কাজের চাপ বেড়েছে এবং পড়াশোনা করতে হয়।

উইকেন্ডে শুচিতাকে নিয়ে সুমিত ঘোরাঘুরি করতে পছন্দ করে। শুচিতা অফিসের কাজের চাপ এবং অনেক ধরনের পার্টটাইম কোর্স নিয়ে ব্যস্ত। শুচিতা আগের মতো ঘোরাঘুরি করা থেকে বিরত থাকলে সুমিত বলে, আগের চেয়ে তোমার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আগে ছিল তোমার উৎফুল্ল হাসি, আজকাল তুমি অতিরিক্ত রক্ষণশীল, কথা কম বলো এবং আমাকে এড়িয়ে চলো। শুচিতা বলে, তুমি আমার অসুবিধা বুঝতে চেষ্টা করো। অফিসে আমার কাজের অনেক প্রেশার আছে। তা ছাড়া আমি অনেকগুলো কোর্স নিয়েছি। পাস না করলে আমার চাকরির রেকর্ড খারাপ হবে। তাছাড়া মা-বাবাকে বুঝিয়ে নিতে হবে।

শুচিতা আজকাল করে সময় নিয়ে মা-বাবাকে বোঝাতে চেষ্টা করে। পরে তারা বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করে দুইপক্ষের লোকজনকে একত্র করে মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করে নেয়। বিয়েতে সুমিত মা-বাবাকে দেশ থেকে চিঠি দিয়ে ভিসার ব্যবস্থা করিয়ে নিয়ে এসেছে এবং পরবর্তীতে তাদেরকে স্থায়ীভাবে রাখার জন্য দরখাস্ত সাবমিট করেছে।

সুমিত শুচিতাকে এ ব্যাপারে কিছুই বলেনি। সে যা-ই হোক শুচিতার এ ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই। দুই কামরার বাসা, মা-বাবা ও ভাইবোন ছয়জন নিয়ে থাকার কোনো ব্যবস্থা না করে সুমিত দায়িত্বহীনতার কাজ করে ওদের থাকতে দিয়ে সংসারে বিবাদের সৃষ্টি করেছে।

শুচিতা এ নিয়ে তার বান্ধবী মনিকার সঙ্গে আলাপ করে এবং সে সুমিতকে বলে, এই ছোট বাসায় কোনো প্রকারে ও ছয়জন লোক থাকতে পারে না। এক কামরা সুমিত ও শুচিতার জন্য, বাকি এক কামরায় ওর মা-বাবা-ভাইবোন থাকা কোনোভাবেই সম্ভব না। তাও শুচিতা আপত্তি করছে না।

অপর দিকে সুমিতের চাকরি কোম্পানি থেকে স্থায়ী হয়নি। সে বেকার ভাতার জন্য দরখাস্ত করে পুনরায় চাকরি খোঁজ করতে থাকে; এতে শুচিতার ওপর বাড়তি চাপ পড়ে।

শুচিতা পাঁচটা বাজে কাজ থেকে বাসায় আসার পর দেখে কিচেন সিঙ্ক ভর্তি হান্ডি-পাতিল, থালাবাসন। ঘরে শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ থাকে, কেউ পরিষ্কার করে না, ফেলে রাখে শুচিতার জন্য। সে চোখের পানি সংবরণ করতে না পেরে অনেক সময় বাথরুমে গিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। সে রান্না করে টেবিলে খাবার দিলে সবাই খাওয়া শেষ করে থালাবাসন রেখে চলে যায়। সুমিতও আজকাল শুচিতাকে সহ্য করতে পারে না। তার কারণ শুচিতা খাওয়াদাওয়া শেষ করে কিচেন পরিষ্কার করে কম্পিউটার ও বইপত্র নিয়ে বসে পড়াশোনা করে। সুমিত চায় তার সঙ্গে বসে খানিক সময় দেওয়া।

সুমিত শুচিতাকে সাহায্য না করে বলে, তরকারিতে লবণ কম হয়েছে, মসলা বেশি দিয়েছে। শুচিতা রুটি বানাতে জানে না, এ নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে সুর মিলিয়ে কথা বলে। শাশুড়ি বলে, তুমি তোমার মায়ের কাছ থেকে রান্না শেখোনি। তরকারিতে লবণ বেশি, মসলা কম বা বেশি দাও, যে জন্য রান্না ভালো হয় না।

শাশুড়ি আরতি সারাক্ষণ টেলিফোন উঠিয়ে তাদের দেশীয় লোকজনকে বলে, সুমিত এ কী বিয়ে করেছে?

লোকজন তাল মিলিয়ে কথা বলে, যা শুচিতার কানেও যায়। সে ঘরে এসেই মুখ কালো করে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে এবং আর কারও সঙ্গে কিছু বলে না। কমল ও আরতি শুচিতাকে অত্যন্ত ছোট ঘরের মেয়ে বলে প্রকাশ্যে লোকজনের কাছে নানা ধরনের কথা বলে। সে প্রতিবেশী শারোধীকে বলে, প্রিতম তো দেশে শিপে খালাসির কাজ করতো। এখানে এসেও কারখানায় কাজ করে। ভদ্রভাবে কথা বলতে জানে না। শারোধী বলে, আপনারা এত বড় ঘরের মানুষ, এত ছোট ঘরে ছেলেকে বিয়ে দেওয়া কী ঠিক হয়েছে?

আরতি বলে, সবই কপাল। সুমিত পছন্দ করেছে, আমরা কী করব?

একদিন শুচিতা ঘরে এসে শুনতে পায় যে আরতির গয়না হারানো গেছে। ওরা গয়না হারানো নিয়ে শুচিতাকে সন্দেহ করেছে। আরতি বলে, আমি বাথরুমে গয়না রেখেছিলাম, তুমি কি নিয়ে রেখেছ?

শুচিতা বলে, মা, আমি তোমার গয়না দিয়ে কী করব?

আরতি বলে, দেখো কোথাও হয়তো ভুলে রেখেছ। শুচিতা সহ্য করতে না পেরে কেঁদে ফেলে। পরদিন শোনা গেছে যে গয়না গার্বেজ কনটেইনারের নিচে পেয়েছে, গত রাতে এ নিয়ে ঘরে মহা হুলুস্থল। আরতি বলে, তুমি হয়তো মনের ভুলে নিচে ফেলে দিয়েছ। শুচিতা বলে, মা, তুমি শুধু শুধু কেন আমাকে সন্দেহ করছ?

সুমিতও তার মায়ের পক্ষ নিয়ে বলে, হয়তো ভুলে তুমি সিঙ্ক পরিষ্কার করতে গিয়ে ফেলে দিয়েছ। শুচিতা এ কথা শুনে বলে, তুমিও আমাকে অবিশ্বাস করলে?

শুচিতা কেঁদে কেঁদে বলে, তোমরা আমাকে এতটুকুই বিশ্বাস করো?

সে সুমিতকে বলে, আমি সকালে ঘুম থেকে উঠে কাজে চলে যাই, তুমি বা তোমরা একটু ঘরটাও পরিষ্কার করো না। কিচেন সিঙ্ক ভর্তি থালাবাসন, তোমরা খেয়ে আমার জন্য রেখে দাও। তোমরা কি আমাকে এই ঘরের চাকরানি মনে করো?

সুমিত বলে, আমার মা-বাবা, ভাইবোন দেশে কোনো দিন কিচেনের কাজ করেনি, এসব কাজ চাকরবাকর করে। রান্না ও থালাবাসন পরিষ্কার করার কোনো অভ্যাস আমাদের নেই। আমার মা-বাবা ও ভাইবোন তোমার কাজ পছন্দ করে না। শুচিতা চোখের পানি ফেলে। সুমিত, আরতি, কমল, ভাইবোনেরা কেউ একটি সান্ত্বনার কথাও তাকে শোনায় না।

এই করে তাদের কলহের সংসারে এক নবজাতক ছেলের জন্ম নেয়। নবজাতক শিশুর জন্মের আগে শুচিতা মেটারনিটি লিভ নিয়ে তার মা-বাবার ঘরে চলে যায়। সুমিত ও তারা মা-বাবা হইচই শুরু করে, তাদের নাতিকে নিয়ে শুচিতা নিজের খেয়াল খুশিমতো মা-বাবার সঙ্গে থাকে। শুচিতা বলে, আমি ও আমার শিশুকে এ সময় কে দেখবে?

তোমরা কোনো দিনও আমার বা আমার শিশুর ময়লা কাপড় পরিষ্কার করবে না। কাজেই আমার মা-বাবা একমাত্র ভরসা; যারা আমার দুর্দিনে দেখাশোনা করবে।

শুচিতার বাবা-মা বলে, তোমার শ্বশুর-শাশুড়ি এবং ছেলেমেয়ে দুই কামরার বাসায় থাকে, ছয়জনের জন্য একটা ওয়াশরুম, তুমি এই ছোট্ট শিশুকে নিয়ে কোথায় থাকবে?

তুমি এখানে থাকো, তুমি ও তোমার শিশুর স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। তুমি ওই বাসায় গেলে ওদের রান্না করে খাওয়াতে হবে। তুমি ও ছোট্ট শিশু অসুস্থ হয়ে পড়বে।

একদিন বিকেলে সুমিত তারা মা-বাবা ও ভাইবোনকে নিয়ে এসে শুচিতা ও তারা মা-বাবার সঙ্গে তর্ক করে যে ওরা শুচিতাকে আলাদা থাকার জন্য পরামর্শ দিচ্ছে। প্রিতম ও আভা বলে, শুচিতা অসুস্থ, ছোট বাচ্চা, তাদের দেখাশোনা দরকার, ওকে তোমাদের ছোট্ট বাসায় দেওয়া যায় না। আমরা দেখাশোনা করব, ও সুস্থ হলে বাসায় ফেরত যাবে।

পর্ব: ৩

সুমিত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শুচিতা ও ধ্রুবকে নিয়ে দেশের বাড়ি ইন্ডিয়া বেড়াতে যাবে। গত ৮ বছর আমি দেশ থেকে এ দেশে লেখাপড়া করতে এসেছি, আর দেশে যাইনি। লেখাপড়া শেষ করে কাগজ বানানো, মা-বাবা এবং ভাইবোনকে ভিজিটর ভিসা দিয়ে এনেছি। আত্মীয়স্বজনদের অনেকে বলে, ধ্রুব ও শুচিতাকে নিয়ে গিয়ে ঘুরে আসতে। শুচিতা বলে, এই ছোট বাচ্চা নিয়ে আমি কোথাও যাব না। এ নিয়ে শুচিতা ও সুমিত তর্ক করে। শেষে সিদ্ধান্ত হয় যে সুমিত শুচিতা ও সুমিতের মা-বাবাকে নিয়ে একবার আলবার্টা, কানাডা বেড়াতে যাবে, ওখানে তাদের কিছু আত্মীয়স্বজন আছে এবং তারা দেখতে চায়। সুমিত বলে, আমার ভাইবোনরা যেতে পারবে না, ছোট্ট গাড়িতে পাঁচজনের বেশি জায়গা হবে না। শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বড় গাড়ি নিয়ে সবাই যাবে এবং এক সপ্তাহ থেকে চলে আসবে। শুচিতা সুমিতের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ঠিক আছে, আমি বাচ্চা নিয়ে যাব।

ওরা এক সপ্তাহ আলবার্টা থেকে আত্মীয়স্বজনকে দেখাশোনা করে মন্ট্রিয়েল ও টরন্টো হয়ে ঘুরে আসবে। শুচিতা সুমিত ও শ্বশুর-শাশুড়ির সন্তুষ্টির জন্য এই লম্বা জার্নি করতে রাজি হয়।

আলবার্টায় লম্বা জার্নি, অনেক জায়গায় লোকজনের সঙ্গে দেখাশোনা করে শেষে মন্ট্রিয়েল এসে এক রাত থেকে পরদিন টরন্টো এসে এক দিন থেকে অটোয়া যাওয়ার পথে সুমিত গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করে। এই কয়েক দিনের জার্নি, সুমিত ক্লান্ত হয়ে অনেক জোরে এক্সিলারেট করে কড়া ব্রেক দিয়ে অ্যাকসিডেন্ট করে। সুমিত ও কমল ড্রাইভার এবং পাশের সিটে ছিল, মারাত্মকভাবে মাথায় ব্যথা পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে এবং পেছনে তারা মা ও ভাইবোন আঘাত পায়। শুচিতা হাতে ও মুখে আঘাত পেয়েছে, ছোট বাচ্চা শিশু সিটে থাকায় বিনা আঘাতে বেঁচে যায়।

সামনের ট্রাক স্লো গতিতে চালাচ্ছিল। সুমিতের গাড়ির অনেক স্পিড ওভারটেক করতে গিয়ে ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। পেছন থেকে গাড়ি এসে তাকে ধাক্কা দিলে সে গাড়িতেও প্যাসেঞ্জার আঘাত পায় এবং দুই গাড়ি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুলিশ রিপোর্টে দেখা গেছে, সুমিতের ভুলের জন্য এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।

দুই গাড়ির প্যাসেঞ্জারদের স্থানীয় হাসপাতাল কিংস্টনে নেওয়া হয়। সুমিত ও তার বাবা কমল দুদিন পর জ্ঞান এলে বলে, আমাদের কী হয়েছিল?

সুমিতের মা আরতি সুমিতকে বলে, তুই গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করেছিস। সে বলে, কীভাবে অ্যাকসিডেন্ট করেছি?

সে কিছুই স্মরণ করতে পারছে না এবং বারবার জিজ্ঞেস করে মা, কীভাবে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে? আরতি, শুচিতা এবং ওর ভাইবোন ফার্স্ট এইড ট্রিটমেন্টের পর রিলিজ হয়। শুচিতা বাসায় তার মাকে টেলিফোন করে এই দুর্ঘটনার খবর দিলে শুচিতার মা চিৎকার করে কেঁদে বলে, তুই ও বাচ্চা কী ভালো আছিস?

সে বলে, আমরা পেছনের সিটে ছিলাম, আমি আঘাত পেয়েছি এবং ভাগ্যক্রমে ধ্রুব ভালো আছে। তবে সুমিত ও আমার শ্বশুর কমল বড় ধরনের আঘাত পেয়েছে, এখনো সম্পূর্ণ জ্ঞান ফিরে আসেনি, বাকিরা আঘাত পেয়েছে, তবে বিপজ্জনক না। শুচিতার বাবা শুচিতাকে বলে, আমি কী ধরনের সাহায্য করতে পারি?

শুচিতা বলে, তুমি হার্টের রোগী, কোনো পেরেশানি করবে না। হাসপাতাল সবকিছু ব্যবস্থা করবে এবং আমরা অটোয়া চলে আসব।

শুচিতা ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলে বলে, তোমার স্বামী ও শ্বশুরের অবস্থা এ মুহূর্তে বলা যাবে না, বাকিরা রিলিজ হয়েছে। শুচিতা বলে, তোমরা কি রোগীদের অটোয়া পাঠাতে পারবে?

ডাক্তার বলে, ৪৮ ঘণ্টা না গেলে আমরা কিছু বলতে পারব না। ডাক্তার এক্স-রে করার পর রিপোর্ট দিয়ে বলে, তোমার স্বামীর অপারেশন লাগবে এবং আমরা এখানে কোনো অপারেশন করতে পারব না; বরং ওদের অটোয়া হাসপাতালে পাঠিয়ে দেব আমাদের রিপোর্টসহকারে। তোমার শ্বশুর কমল সম্পর্কে অটোয়া হাসপাতাল বলবে।

৪৮ ঘণ্টা হাসপাতালে রাখার পর ওদের প্যারামেডিক দিয়ে অটোয়া পাঠিয়ে দেয়। অটোয়া রোগীরা যাওয়ার পর সুমিতকে ব্রেইন অপারেশন করে এবং তার শ্বশুরকে হাসপাতালে রেখে দেয়। শুচিতার বাবা প্রিতম ও তার মা হাসপাতালে এসে ওদের দেখে অনেক দুঃখ করে। বলে, ভগবানের কৃপায় তোমরা বেঁচে আছ। এর জন্য আমরা অনেক আশীর্বাদ করেছি। প্রিতম রাতে রোগীর ডিউটি করতে চাইলে শুচিতা বলে, তোমার শরীরের যে অবস্থা, তোমার রাত জেগে ডিউটি করার কোনো প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া এখানে ২৪ ঘণ্টা ডাক্তার ও নার্স থাকে, বাইরের লোক থাকার দরকার পড়বে না। তুমি বরং নিজের শরীরের সুস্থতার দিকে দেখো। আমরা যারা সুস্থ আছি, রোগীর সেবা যত্ন করব। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রিতম সবার জন্য খাওয়া নিয়ে আসে এবং বিকেলে আবার খাওয়া নিয়ে আসে। এভাবে এক মাসের অধিক সময় সুমিত ও কমল হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে বাসায় আসে।

এক বছর শুচিতা মেটারনিটি লিভে থাকার পর কাজে যোগদান করে এবং তার ছেলের অযত্ন হবে ভেবে সে মা-বাবার সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে সুমিতকে বলে, তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমি ধ্রুবকে নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে থাকব। আমি তোমাদের সঙ্গে থাকলে তোমার ও ধ্রুবর দেখাশোনার অসুবিধা হবে। এতে সুমিত অসুন্তষ্ট হলে শুচিতা বলে, তুমি সম্পূর্ণ ভালো হলে আমি আলাদা বাসা নেব। তুমি বরং তোমার মা-বাবা, ভাইবোনকে নিয়ে থাকো। মাঝেমধ্যে এখানে এসে থাকতে পারবে। তুমি শারীরিক দিক থেকে এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠোনি। তোমার নিজের চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন। সুমিত অনেক আপত্তি করাতে সে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে কিছু দিন তাদের সঙ্গে থেকে দেখবে।

শুচিতা তার মা-বাবার সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেয় যে কিছু দিন ওদের ওখানে থেকে অফিস করবে। সে তার ছেলেকে নিয়ে ওখানে রেখে অফিস করতে যায় এবং ফিরে এসে দেখে ছেলের যে ডায়াপার সকালে পরানো হয়েছে, বিকেল পর্যন্ত কেউ পরিবর্তন করেনি এবং ছেলেকে কেউ গোসল বা ঠিকমতো খাবার দেয়নি। কাজের পর শুচিতাকে ঘরে এসে ছেলের ডায়াপার পাল্টাতে হয় এবং ঘরের কাজ আগের মতো করতে হয়। শুচিতা আরতিকে বলে, আমি নিজেও অসুস্থ, তা ছাড়া কাজ করি। আমি আগের মতো রান্নার কাজ করতে পারব না। তোমরা ধ্রুবর ডায়াপার পর্যন্ত পাল্টাও না। ও কীভাবে সারা দিন এক ডায়াপারে থাকে। সে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে। সে দুই-তিন দিন থাকার পর একদিন বাসায় গিয়ে মা-বাবাকে বলে, আমি চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওদের সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। কাজেই আমি এই উইকেন্ডে বাসায় চলে আসব। সে এ নিয়ে তার বান্ধবী মনিকার সঙ্গে আলাপ করে। তারা বলে, তুমি এ নিয়ে সুমিতের সঙ্গে কথা বল না কেন?

শুচিতা বলে, আমি সুমিতকে বলে কোনো লাভ হবে বলে মনে করি না। তথাপি তোমরা যখন বলছ, আমি এ নিয়ে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখব।  (চলবে)

নজরুল ইসলাম