‘শুচিতা’

(কানাডার দৈনন্দিন বাস্তবতার দিকে লক্ষ্য রেখে কাল্পনিক এই উপন্যাস ‘শুচিতা’। লিখেছেন কানাডা প্রবাসী নজরুল ইসলাম। )

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

রাস্তায় বের হয়ে শুচিতা এবং ধ্রুব একটা ট্যাক্সি নিয়ে ঘরের দিকে রওনা দিয়ে কিছুদূর যেতেই দেখে সুমিত একটা মহিলাকে নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। শুচিতা এই মহিলাকে এর আগে কখনো দেখেনি; হয়তো তাদের কোনো আত্মীয় দেখতে এসে বাইরে নিয়ে এসেছে। হঠাৎ ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে কথা বলতে গেলে ওরা হয়তো খারাপ কিছু মনে করতে পারে। তাই শুচিতা কিছু না বলে বাসায় চলে আসে।

ভাগ্যিস ধ্রুব ওই দিকে খেয়াল করেনি, নতুবা বাপ্পি, বাপ্পি বলে চিৎকার করত এবং আরেক কাহিনি হতো, তা ছাড়া ট্যাক্সিওয়ালা এক ইন্ডিয়ান, সে অনায়াসেই ওদের কথোপকথন বুঝে নিত এবং আমি লজ্জা পেতাম। শুচিতা রাগে বিড়বিড় করতে করতে বাসায় চলে আসে। বাবা প্রিতম এবং আভা বলে, কেমন দেখলে প্রদীপের নতুন সংসার?

মা, সে মোটামুটি গুছিয়েছে।

কী খেলে?

মা, ও ডাল, চাল, টমেটো ও সবজি দিয়ে খিচুড়ি রান্না করেছে। আভা শুনে বলে, ছেলেটা এখানে ভালো ছিল, এখন কত না কষ্ট হচ্ছে। শুচিতা বলে, না মা, ও ভালোই আছে এবং সে যেকোনো অবস্থায় খাপ খাইয়ে চলতে পারে। প্রিতম বলে, ওর বাড়ির অবস্থা ভালো ছিল না, অনেক কষ্ট করে মানুষ হয়েছে। সব পরিবেশে সে খাপ খাইয়ে চলতে পারে। যারা ঘাত-প্রতিঘাতে মানুষ হয়, তারা সচরাচর পরিশ্রম করতে শেখে। কাজেই সে জানে যে কোনো অবস্থায় নিজেকে মিলিয়ে চলতে। দেখবে ও রাতারাতি দাঁড়িয়ে যাবে, বাড়ি-গাড়ি করা তো তার জন্য বড় কিছু না।

শুচিতা সুমিতকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করে তুমি কোথায়?

সুমিত বলে, কেন আমি বাসায়?

তুমি বাসায়! তোমার বাবা কমলকে দাও তো আমি একটু কথা বলব।

কী কথা বলবে?

আমার দরকার আছে। আমি এখন দিতে পারব না। শুচিতা টেলিফোন রেখে দিয়ে বাসায় টেলিফোন করে এবং কমল টেলিফোন উঠিয়ে বলে, শুচিতা, তুমি কেমন আছ?

আমি ভালো আছি, সুমিতকে একটু দেবেন কী?

সুমিত বাসায় নেই। শুচিতা টেলিফোন রেখে দিয়ে পুনরায় সুমিতকে টেলিফোন করে বলে, আমার সঙ্গে তুমি মিথ্যা কথা কেন বললে?

শুচিতা বলে, তুমি তো বাসায় নেই এবং আমি তোমাকে রাস্তায় দেখেছি এবং আর একজন মহিলার সঙ্গে। সুমিত টেলিফোন রেখে দেয়।

রাতে সুমিত টেলিফোন করে শুচিতাকে বলে, তুমি আমাকে আর একজন মহিলার সঙ্গে দেখে জ্বলেপুড়ে মরলে, তুমি সারা দিন প্রদীপের সঙ্গে ওঠাবসা করো এবং আমার কেমন লাগে তা কী একবারও চিন্তা করেছ?

শুচিতা বলে, প্রদীপ আমার খুড়তুতো ভাই, তুমি কী বলো, মাথা ঠিক আছে তোমার?

আমার মাথা ঠিক আছে, তুমি প্রদীপের সঙ্গে পরকীয়া করো, ঠিক বলছি না?

তোমার মাথা ঠিক নেই, আমি তোমার মতো যারা নোংরা কথা বলে, তাদের সাথে কথা বলতে চাই না।

সুমিত বলে, তুমি কোত্থেকে আসতে ছিলে আমাকে দেখলে রাস্তায় আর একজন মহিলাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম?

তোমার এত কথা জানার দরকার নেই এই বলে শুচিতা ফোন রেখে দিয়ে লাইট অফ করে ঘুমিয়ে পড়ে।

পরদিন শুচিতা অফিসে গিয়ে তার বান্ধবী মনিকাকে আগের দিনের সব কাহিনি বললে মনিকা বলে, সুমিতের মাথা ঠিক নেই, সে কিছুদিন আগে আজিজকেও তোমার এবং প্রদীপকে কেন্দ্র করে অনেক কথা বলেছে। তুমি দুঃখ পাবে সে জন্য কিছুই বলিনি। আমার মনে হয় না সুমিতের সঙ্গে তোমার কোনো রকম মিল হবে, তোমার মা-বাবা কী বলে?

আমার মা-বাবা বলে, এটা তোমার জীবন, এ নিয়ে কিছু বলতে চাই না। শুচিতা, তুমি ভুল একবার করেছ, এবার বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নেবে। শুচিতা বলে, ওরা সরল মানুষ আমাকে কোনো কিছু জোর করে বলতে চায় না।

মনিকা বলে, তোমার এক বছর বয়সের ছেলে আছে, এ অবস্থায় তুমি ছাড়াছাড়ি (ডিভোর্স) করলে আর একটা বিয়ে করা সম্ভব হবে কী?

যাকেই বিয়ে করো সে হয়তো তোমাকে করুণা করতে আসবে। কিছু দিন হয়তো ভালো থাকবে, তার পরে তোমাকে প্রতিনিয়ত খোঁটা দেবে এবং বলবে, ভালো হলে তোমার কেন ডিভোর্স হলো?

তুমি খারাপ ইত্যাদি ইত্যাদি, তখন এসব সহ্য করে সংসার করতে হবে, নতুবা আর একবার ডিভোর্স নিতে হবে। সুমিত তোমার প্রথম স্বামী এবং স্টুডেন্ট লাইফ থেকে চেনে। তোমাদের অনেক দিন ভালো সম্পর্ক ছিল। তার পরিবারের জন্য ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছে। এটার জন্য তার মায়ের গোঁড়ামি, ধর্মান্ধতাই একমাত্র দায়ী। এরা দেশে পূজা-পার্বণ করে মানুষের নমস্কার/আদাব কুড়িয়েছে এবং মানুষ কতভাবে কষ্ট করে তার মর্যাদা দিতে শেখেনি। আমি আজিজকে দিয়ে সুমিতের সঙ্গে কথা বলব, দেখব ওর সঙ্গে তোমার যে ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছে, কতটা নিরসন করা যায়।

মনিকা, তুমি যা যা বলছ আমি কী বুঝি না?

কিন্তু সুমিতের মা আরতি যেভাবে কথা বলে, এতে একত্রে সংসার করা কঠিন। ওর বাবা কমল কিছুটা নমনীয়। তার সঙ্গে আমার সমস্যা হয় না। সুমিত তার মাকে ভয় পায় যে জন্য সব সময় চুপ থাকে। কিছু বললে আরতি ওকে দশটি কথা শুনিয়ে দেয়। সে এমনও বলে আমার ছেলে ধ্রুবকে দিয়ে দিতে, ওরা আমাকে চায় না।

তুমি তোমার ছেলেকে কেন দেবে?

না, আমি ওকে দেব না, আমার মা-বাবা ওকে অনেক আদর করে এবং তারা ওকে ছাড়া থাকতে পারবে না। আমি আমার ছেলের জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি আছি।

মনিকা বলে, নিজের ছেলে কে হাতছাড়া করে। আমি আজিজকে বলে দেখতে পারি। ও মাঝেমধ্যে সুমিতের সঙ্গে কথা বলে।

পরদিন আজিজ সুমিতকে ডেকেছে ওর সঙ্গে ম্যাকডোনাল্ড কানাডা রেস্টুরেন্টে চা খেতে। আজিজ সুমিতকে অ্যাকসিডেন্টের পর কয়েকবার দেখেছে তা-ও হাসপাতালে। এর মধ্যে সুমিত অনেকখানি শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গেছে। সে ঠিকভাবে কথাও বলতে পারে না। সুমিত বলে, ওর সব সময় মাথাব্যথা থাকে এবং সে জন্য তাকে হাই পাওয়ার পেইন কিলার খেতে হয়। সে অনেক দিন থেকে চাকরিচ্যুত, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। কথা বলে এবং তাতে মনে হয় যেন সে জীবনের অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছে।

চোখের পাওয়ার অনেকটা কমে গেছে এবং মোটা পুরো গ্ল­াস ব্যবহার করে। মাথার চুল অর্ধেকের মতো নেই, দেখলে মনে হয় সে ৫০ বছর বয়সের লোক। ওর অবস্থা দেখে দুঃখ করা ব্যতীত তেমন কিছু বলার ইচ্ছে হয় না। দুজনে দুইটা বার্গার এবং কোল্ড ড্রিংক নেওয়ার পর কফি অফার করলে সুমিত নিষেধ করে। সুমিত বলে, আমি কপি এবং ড্রিংক করা বন্ধ করে দিয়েছি।

অনেক সময় বসে এ কথা-সে কথা বলার পর সুমিত নিজ থেকে শুচিতার কথা উঠিয়ে বলে, শুচিতা স্বার্থপরের মতো আমাকে অবজ্ঞা করে তার বাবার বাসায় চলে গেছে। ওর চাকরি নেই এবং অশান্ত মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে আমি শুধু বললাম তুমি আলাদা বাসা নিয়ে থাকতে পারবে কী?

সে বলে, মা-বাবা এবং ভাইবোন আমার ওপর নির্ভরশীল। আমি ওকে বুঝিয়ে বললাম, তোমার সুখ-শান্তির দিক বিবেচনা করে এক দিক ত্যাগ করা দরকার। শুচিতা এবং তোমার অতি আদরের ছেলে এই মুহূর্তে তোমার কাছে থাকলে, তুমি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে বলে আমি মনে করি।

ওকে এর বেশি কিছু বলতে ইচ্ছে করেনি, সুমিত বাসে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে এবং আমাকে বলে, তুমি চলে যাও আমি বাসে আস্তে আস্তে বাসায় পৌঁছাব। আমি বললাম, তা হয় না, তোমাকে নামিয়ে দেব এই বলে ওকে ড্রাইভ দিয়ে বাসায় পৌঁছাতে দেরি হলে মনিকা রাগ করে এবং বলে, তোমার এত দেরি?

আমি মনিকাকে বুঝিয়ে সবকিছু বলায় সে বলে, ঠিক আছে।

মনিকা বলে, সুমিত কি আলাদা বাসা নেবে?

সে বলে, মা-বাবা তার ওপর নির্ভরশীল, কাজেই সে বাসা নেবে বলে মনে হলো না। মনিকা বলে, শুচিতার সুমিতের মা-বাবা ভাইবোনের সঙ্গে থাকা সম্ভব না।

তা ছাড়া সুমিতের তো কোনো রোজগার নেই, সে উরংধনরষরঃু তে আছে। এ দেশের সরকার অসুস্থ লোকদের কোনো রকমে বাঁচার জন্য যে পয়সা দিয়ে থাকে, তা দিয়ে তো আর বাসা ভাড়া নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে চলা যায় না। যেখানে সংসারে এত অশান্তি, শুচিতাই বা কেন ওদের জন্য ত্যাগ করবে?

তাহলে এখন কী হবে বলে সুমিত মনে করে?

সুমিত হয়তো মনে করে শুচিতা বাসাভাড়া এবং সংসার চালাবে। কিন্তু সুমিতের মা আরতি নিম্নবর্ণ ও উচ্চবর্ণ ব্যাধিতে ভুগছে, শুচিতাকে সামাজিকভাবে দূরে সরিয়েছে, তাতে কোনো সুফল আসবে বলে মনে হয় না। সুমিতের বাবা কমল যদিও শুচিতাকে পছন্দ করে, কিন্তু আরতির সামনে সমাজ এবং জাত গেল, জাত গেল এই অভিযোগের জন্য দাঁড়াতে পারছে না। আমি এর কোনো সঠিক সমাধান খুঁজে পাচ্ছি না।

আজিজ বলে, শুচিতা এবং প্রদীপকে নিয়ে সুমিত যে সন্দেহ করে মনিকা তুমি কী বলতে পারো, এটা কতটুকু সঠিক?

এটা সম্পূর্ণ বানোয়াটি কথা, এর কোনো ভিত্তি নেই। প্রদীপ দেশে থাকাকালে শুচিতার বাবা প্রিতম শুচিতাকে বিয়ে দিয়ে প্রদীপকে এখানে আনতে চেয়েছিল। কিন্তু শুচিতা সুমিতকে ভালোবাসে সে জন্য এই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। আমাদের ইন্ডিয়া এবং অন্যান্য দেশের লোকজন সব সময় চায় নিজের ছেলেমেয়েকে দেশে বিয়ে দিয়ে আত্মীয়স্বজনকে সাহায্য করা। কিন্তু সব ক্ষেত্রে এটা সম্ভব হয় না, যেমন শুচিতা।

পরে প্রদীপ নিজের চেষ্টায় ইমিগ্রেশন নিয়ে অটোয়া তাদের বাসায় উঠেছে। এই বিদেশের বাড়িতে ইমিগ্রেশন নিয়ে সবাই প্রথম দিকে নিজস্ব আত্মীয়স্বজনের বাসায় ওঠে। এখন সে নিজে চাকরি ও থাকার ব্যবস্থা করে সরে পড়েছে। প্রদীপ শুচিতার খুড়তুতো ভাই, তার বেশি আর কিছুই আমি জানি না।

পরদিন অফিসের একফাঁকে মনিকা শুচিতাকে বলে, কাল আজিজ সুমিতের সঙ্গে কথা বলেছে। সুমিত অসুস্থ, সে এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেনি। সে মা-বাবাকে ছেড়ে তোমাকে নিয়ে আলাদা বাসা নেওয়া সম্ভব না বলে জানিয়েছে। শুচিতা বলে, তুমি বলো সুমিত অসুস্থ, কিন্তু আমি তাকে অন্য এক মহিলার সঙ্গে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছি।

মনিকা বলে, তুমি কী নিশ্চিত যে সে কোনো মহিলা নিয়ে প্রেম ও ঘোরাঘুরি করে?

তা তো বলতে পারি না, আমি গাড়ি নিয়ে আসতেছি এবং আমার সঙ্গে ধ্রুব ছিল যে জন্য দাঁড়াইনি।

মনিকা বলে, এমনও তো হতে পারে, সে কোনো পরিচিত মহিলার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছে আর তুমি তাকে দেখে সন্দেহ করছ।

পর্ব: ৫

সুমিত মা-বাবা এবং ভাইবোনদের ভিজিটর ভিসা দিয়ে এনে রেফিউজি হিসেবে দরখাস্ত করলেও কেস শুনানিতে দরখাস্ত বাতিল করে দিয়ে বলে, তোমাদের কেসের কোনো যুক্তিসংগত ভিত্তি, সত্যতা নেই, তবে ব্যক্তিবিষয়ক সততার ভিত্তিতে আবেদন করার সুযোগ চেয়ে চেষ্টা করে দেখতে পারো। এতে আরও বলা হয়েছে যে তোমরা গত দুই বছরে এ দেশে এসে কোনো কাজ করোনি, শুধু সরকারি ভাতা নিয়ে সংসার চালিয়েছ। তোমরা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছ যে এ দেশে থাকার যোগ্যতা অর্জন করলে, সরকারকে ট্যাক্স পে করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে। সুমিত অসুস্থ, কমল, আরতি সোশ্যাল ভাতা নিয়ে কোনো রকমে দুবেলা রুটি রোজগারের ব্যবস্থা করে চলছে এবং তাদের ছেলেমেয়ে সুলতা ও সুব্রত ১৮ বছরের নিচে, স্কুলে যায়।

কোর্ট থেকে বের হয়ে কমল সুমিতকে বলে, আমি দেশে ভালো ছিলাম, তুমি প্রলোভন দিয়ে আমাদের এখানে এনে ঝামেলায় ফেলেছ। দেশে আমি পূজা-পার্বণ করে ভালো সময় কাটাতাম। আমি ঠাকুর বংশের লোক, আমার বাবা মহেশ ঠাকুরের জমিজমা, দালানকোঠা, পুকুর ভরা মাছ, গোলা ভরা ধান, বাগানে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পিয়ারা, কলা সবই আছে। আমাদের বাগানে মৌমাছি, সারা বছর আমরা খাঁটি মধু পাই। জমির সরিষা ঘানিতে খাঁটি তেল করে ঘরে রেখে দিয়ে সারা বছর খাই। বাজার থেকে একমাত্র কাপড়, লবণ, চিনি ও সামান্য এটা-সেটা কিনতে হয়। দেশে আমরা অনেক সুখে আছি। আমাদের গরু, হাঁস, মুরগি সবই আছে, আমরা ডিম, দুধ ঘরে পাই। বাড়ির আঙিনায় কাঁচকলা, পাকা কলা, সবজি সবই পাই। আমাদের কিসের অভাব?

কমল বলে, আমি বংশানুক্রমে ব্রাহ্মণ এবং সারা বছর পূজা-পার্বণ করে এটা-সেটা নিয়ে ঘরে আসি। পূজা ও অন্যান্য উৎসবাদী থেকে আনা মিষ্টি আমার ঘর থেকে কখনো শেষ হয় না। তুমি কেন আমাদের পরামর্শ দিয়ে এখানে এনে বসিয়ে রেখেছ?

সুমিত বলে, বাবা, কাগজ হলে মা এবং তুমি দেশে চলে যাবে, সুব্রত ও সুলতা এখানে থাকবে। কমল বলে, তুমি যে গ্রাউন্ড দেখিয়েছ, এতে কোনো দিনও কাগজ হবে না, অযথা এখানে সময় নষ্ট করা। ওরা কীভাবে রিপোর্ট বের করেছে, তোমার বিয়ের নিমন্ত্রণ দেখিয়ে আমাদের এখানে এনে কাগজের জন্য দরখাস্ত করিয়েছ, আমাদের রেফিউজি হিসেবে দরখাস্ত করার কোনো গ্রাউন্ড নেই। এরা দেশ থেকে সব রিপোর্ট এনেছে, তুমি কাকে উকিল ধরেছ, সে উল্টাপাল্টা কেস লিখে দিয়েছে?

দেশে আমার ভাই প্রসন্ন এই সুযোগে গ্রামের পূজা-পার্বণ ও জমিজমা নিজের নামে করিয়ে নেবে।

বাবা, এটা কি মগের মুল্লুক যে সে চাইলেই আমাদের জমিজমা নিয়ে যাবে?

আরতি বলে, সুমিত, তুমি জানো না, তুমি পড়াশোনার জন্য বিদেশে চলে এসেছো, দেশের পরিস্থিতি নিয়ে তোমার কোনো ধারণা নেই। দেশে সবকিছুই দুই নম্বরি। সেটেলমেন্ট জরিপ এলে একজনের জমি অন্য একজনের নামে উঠিয়ে দিয়ে চুপ করে বসে থাকে। কয়েক বছর পরে বলে এই জমি আমার, এ ছাড়া গোপনে গোপনে আরও কত রকম সমস্যা করে। তুমি এবং আমরা ছেলেমেয়েদের নিয়ে এ দেশে এসেছি, ওরা দেখো গিয়ে বাড়ির সবকিছু দখল করে বসে আছে। প্রসন্ন এবং তার ছেলেরা মনে করে ভগবান ওদের সুযোগ দিয়েছে, ওরা এখন সবকিছুর মালিক।

সেদিন আমাদের প্রতিবেশী বাসুদেব চিঠি দিয়ে জানিয়েছে যে তোমার কাকা প্রসন্ন জমিজমার কাগজপত্র নিয়ে তহশিল এবং উপজেলা এসি ল্যান্ডের অফিসে ছোটাছুটি করছে। হয়তো দেখবে আমাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করবে। তা ছাড়া আমরা দুজন দেশে একা গেলে তোমার কাকার ছেলেরা আমাদের ঘরে ঢুকতে দেবে কি না, তাও সন্দহ। এমনকি রাতের অন্ধকারে আমাদের মেরে পুকুরে কচুরিপানার নিচে বস্তা বেঁধে লুকিয়ে রেখে বলতে পারে, ওরা কোথায় গেছে, জানি না।

মা, কাকা কি এত খারাপ লোক?

হ্যাঁ, সুমিত, তুমি জানো না, সে ভালো কিছু করতে পারেনি, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করতে দেয়নি, তবে খারাপ পরামর্শ দিয়ে মানুষের পেছনে লাগানোর ব্যবস্থা করছে। আমাদের লোকজন নেই, সব সময় গাছের আম, নারকেল, কাঁঠাল, লিচু, আনারস এবং পুকুরের মাছ ধরে নিয়ে যায় এবং ফিরেও আমাদের দিকে তাকায় না। জোর যার মুল্লুক তার এটাই দুনিয়ার নিয়ম চলছে।

সুমিত, তোমার মনে নেই, তুমি ওদের সঙ্গে স্কুল গিয়েছ, তোমাকে স্কুলে রেখে নৌকা নিয়ে চলে এসেছে। আমরা তোমাকে না দেখে চিৎকার করে বলি, এই বর্ষার দিনে সুমিত কী করে আসবে?

শেষে হেডমাস্টার রহিম সাহেব তোমাকে এনে দিয়ে গিয়েছেন এবং পরদিন থেকে আমরা আর তোমাকে ওদের সঙ্গে স্কুল পাঠাইনি।

তোমার এসব মনে নেই?

মা, মনে আছে, তবু আমরা বিদেশে থাকি, আমাদের সঙ্গে ওদের অনেক তফাত, ওরা মূর্খ, পড়াশোনা করেনি আর আমরা পড়াশোনা করেছি, আমাদের সঙ্গে ওদের কোনো দিনও মিল হবে না। এই ছোট্ট জিনিসকে বড়ো করে দেখলে জীবনে আমরা কিছুই করতে পারব না।

সুব্রত ও সুলতা বলে, দাদা, তুমি ঠিকই বলছ।

মা, তুমি কি চাও আমরা বিদেশ ছেড়ে দিয়ে দেশে গিয়ে ওদের সঙ্গে ঝগড়া, মারামারি করি?

না, তা বলি না, তবে মনের দুঃখে এসব বলি।

সুলতা বলে, মা, তুমি শুচিতার সঙ্গে যে আচরণ করছ, ওটা ঠিক হয়নি। ওটা তোরা ঠিক বুঝোসনি, শুচিতা বেশি দেমাগী এবং সবকিছুতেই বেশি বাড়াবাড়ি করে। ও প্রকাশ্যে আমাকে বলেছে, আমরা গ্রাম্য ভূত, আচার-আচরণ শিখিনি। ওর বংশের সঙ্গে আমাদের কোনো দিন কি মিল হতে পারে?

শুচিতার পূর্বপুরুষ মুচি এবং বাবা শিপে খালাসির কাজ করত। প্রিতম ও আভা এ দেশে এসে ফ্যাক্টরিতে কাজ করে কোনো রকমে জীবন শেষ করেছে, একমাত্র শুচিতাকে পড়াশোনা করিয়ে আমার ছেলের পেছনে লাগিয়েছে। সুলতা বলে, মা, ওসব জাত-বংশ নিয়ে যারা বড়াই করে, ওরা স্রেফ মূর্খ লোক। মা, জাত-বংশে না, কাজে মানুষ বড় হয়। দুনিয়ায় যত বড় বড় লোক দেখো, ওরা কঠোর পরিশ্রম করে বড় হয়েছে। তোমরা এ দেশে এসে সরকারি ভাতা খাও, কেস দিয়ে কাগজ বানাতে চেষ্টা করছ, আর ওদিকে বলো বড় বংশের লোক।

তোমরা কি মূর্খ লোক?

সুলতা, তোর এত বড় সাহস আমার সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করিস? থাকগে মা, আর তর্ক করব না, তোমার জাত-বংশের দেমাগে একটা সংসার ভেঙে যাচ্ছে।

তুমি কি একবারও ভেবে দেখছ?

হ্যাঁ, ভেবে দেখছি।

ভাইয়া বোকা মানুষ, তোমার সামনে কোনো কথা বলে না, তুমি কি ভাইয়ার মুখের দিকে একবারও তাকিয়ে দেখছ, সে কোন সুখে আছে?

সুমিতের সংসারের অশান্তির ব্যাপারে আমি কী করলাম, তোরা খামাখা আমাকে দোষারোপ করিস। শুচিতা নিজ থেকে আমাদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে।

মা, তুমি কী দেখছ, আমাদের বাসায় একটা সুন্দর বিড়াল আছে, এটা সব সময় তোমার আমার পায়ে-পায়ে হাঁটে। বিড়ালটা আমাদের আদর পায় বলে কাছাকাছি ঘোরে এবং সব সময় মিউ মিউ করে। তুমি এটাকে দু-চারবার তাড়িয়ে দেখবে, ওটা আর তোমার কাছে আসবে না। মানুষও এ ধরনেরই, তুমি সব সময় সমালোচনা করবে, মেজাজ দেখিয়ে কথা বলবে, দেখবে ও আর তোমার ধারেকাছেও আসবে না। এমন লোক আছে, যারা খল স্বভাবের, হয়তো দুই-চার দিন বাহাদুরি নেয়, তাদের মানুষ এড়িয়ে চলে, এরা ভেতরে-ভেতরে এসব লোককে খারাপ চোখে দেখে।

বাহ্ তুই অনেক কথা শিখছিস তো? মা, আমি তোমাকে সব সময় দেখি রাগারাগি করে কথা বলো। বাবা তত রাগ করে না।

আরতি বলে, তোরা সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধে দল বেঁধেছিস, এই বলে সে দুই চোখের জল মোছে। সুমিত এতক্ষণ চুপ থেকে বলে, মা, সুলতা যা বলে তা কিছুটাও বটে। শুচিতা এবং তার মা-বাবা তোমার সম্পর্কে নানা কথা বলে, কিন্তু বাবা সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলে না।

বাহ্! তোরা যদি আমাকে পছন্দ না করিস, আমাকে মা বলে ডাকিস না। আমাকে বরং টিকিট কেটে দে, আমি দেশে চলে যাই। আমি তোদের জন্য কী কিছু করিনি?

মা, তোমার সঙ্গে আমরা কেউ ঝগড়া করতে চাই না। আমি শুচিতাকে বহুদিন থেকে ভালো বেসেছি। তাকে বিয়ে করেছি, আমি এক ছেলের বাবা হয়েছি, এখন আমি শ্যাম রাখি না কুল রাখি- এ অবস্থায় আছি। আমি তোমাদের সামলাতে পারছি না, আবার শুচিতাকেও।

সুমিত অনেক দিন থেকে বেকার, কিছু শর্টকোর্স করতেছিল, তাও শেষ পর্যন্ত স্টপ করে দিয়ে ঘরে চুপটি মেরে বসে আছে।

কমল বলে, তুমি একা একা বসে কী সব ভাবছ?

সুমিত চোখ লাল করে কমলের দিকে তাকিয়ে কোনো কথার জবাব দেয় না।

কমল বলে, আমি এবং আরতির কানাডা থাকার কোনো দরকার নেই। আমাদের টিকিট কেটে দাও, আমরা দেশে চলে যাই। সুমিত বলে, তোমরা দুজন দেশে গেলে ইমিগ্রেশন কেস হালকা হয়ে যাবে, সুব্রত ও সুলতার জন্য সমস্যা হবে এবং ওদের দেশে চলে যেতে হবে। সুলতা বলে, আমি এবং সুব্রত যত সমস্যায় পড়ি না কেন, দেশে ফেরত যাব না। সুমিত বলে, মানবীয় কারণে তোমাদের কেস চলছে, সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত হুট করে কিছু করা ঠিক হবে না।

কমল বলে, কাগজ হলে একবার গিয়ে বাড়িঘর, জমিজমা ঠিক করে কাউকে দেখাশোনা করার জন্য রেখে আসব। আরতি বলে, আমাদের এখানে আর আসার দরকারই বা কী?

সুমিত বলে, নাগরিকত্ব না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের এখানে থাকতে হবে। পরে তোমরা ইচ্ছা করলে দেশে চলে যেতে পারো এবং যখন ইচ্ছে আসতে পারবে।

কমল বলে, কবে আমরা কেস পাব, তারপর নাগরিকত্ব?

তিন মণ তেলও পুড়বে না, রাধাও নাচবে না। সে অনেক দিনের ব্যাপার। দেশে আমরা যা খেয়েছি, এখানে তার কিছুই পাচ্ছি না। এখানে আমাদের কে চেনে?

সুমিত বলে, এখানে নিকটে কোনো মন্দির নেই, তা ছাড়া আমাদের কোনো গাড়ি নেই। সুশীল আংকেল মাঝেমধ্যে তোমাদের মন্দিরে নিয়ে যেত, সেও আজকাল আসে না। কমল বলে, সুশীল নিজের রেস্টুরেন্ট ব্যবসা, সে সপ্তাহে সাত দিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

বিকেলে অধরা আন্টি রেস্টুরেন্ট থেকে যাওয়ার পথে কিছু খাবার ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসে ঘরের দরজা নক করে। সুলতা গিয়ে দরজা খুলে বলে, আদাব, আন্টি আসেন। অধরা অনেক ধরনের খাবার রেস্টুরেন্ট থেকে এনে টেবিলে রেখে দিয়ে বলে, আজ কয়েক দিন আসা হয়নি। গাড়ি নষ্ট, ঠিক করতে কয়েক দিন সময় লেগেছে। আরতি বলে, গাড়ি তো নতুন মনে হয়। না, পাঁচ বছরের পুরোনো গাড়ি। এটা-সেটা সব সময় ঠিক করতে হয়। এ কথা-সে কথা বলে জিজ্ঞেস করে শুচিতা ও তার ছেলেকে অনেক দিন দেখছি না। আরতি বলে, শুচিতা আমাদের পছন্দ করে না, সে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে।

ওমা, এ কী কথা! (চলবে)

নজরুল ইসলাম