লীলা মজুমদার একশো বছরের উত্তরাধিকার

দীপক বণিক ॥

আমাদের দেশে ‘শতায়ু হও’ বলে আশীর্বাদ করা হয়ে থাকে। বাঙ্গালী লেখক লেখিকাদের মধ্যে মাত্র দুজন এই একশ বছরের আয়ু স্পর্শ করেছেন। নীরদ চন্দ্র চৌধুরী এবং লীলা  মজুমদার। তবে শত বর্ষের কাছাকাছি আয়ুতে পৌঁছালে অনেক ক্ষেত্রেই সুখের চেয়ে দুঃখ বেদনাই বেশী থাকে। নীরদ চৌধুরী প্রায় পুরো সময়টাকেই লেখা পড়ার কাজে লাগিয়েছিলেন। কিন্তু লীলা মজুমদার শেষের প্রায় এক দশক বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভূগছিলেন। শেষ পর্যায়ে তিনি কর্যত চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়েছিলেন। স্মৃতিও ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল কয়েক বছর আগে থেকেই। ২০০৭ সালের ৫ই এপ্রিলে কলকাতার একটি নার্সিং হোমে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। একশটি জন্মদিন তাঁর জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছিল অনেক কিছু, বিনিময়ে দিয়েছিল বিরল একটি বি¯তৃতি। একশ বছরের বি¯তৃতি। লীলা মজুমদারের প্রয়াণ বস্তুত একটি শতাব্দীর মৃত্যু। শতবর্ষে পৌঁছে তাঁর কলম চলেনি, কিন্তু ওই আশ্চর্য তিন অংক – ১০০ প্রতীকের মতো জেগে থেকেছে তাঁর জীবনে। তাঁকে জড়িয়ে গোটা বঙ্গ জীবনই  ছড়িয়ে গিয়েছে সেই আভা। একশ বছরের আভা। সেই বিরল মাইল ফলকটি ছুঁয়ে আসলে মৃত্যুকেই হারিয়ে দিয়েছেন লীলা মজুমদার। সতরাং শতবর্ষ পূর্ণ করে তাঁর প্রস্থান দুঃখের নয়। তবু একজন মানুষের থাকা না  থাকার মধ্যে তফাৎ থাকেই। লীলা মজুমদার ছিলেন, এখন আর তিনি নেই। এর মধ্যে একটা বড় শূণ্যতা আছে।

উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর ছোট ভাই প্রমোদারঞ্জনের কন্যা, তাই সাহিত্যের চর্চা রক্তের ভিতরেই ছিল। তিনি মাত্র ১৩ বছর বয়সেই ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় গল্প লেখা দিয়ে হাতেখড়ি শুরু করেন। উৎসাহদাতার নামটিও স্মরণীয়। জেঠতুত ভাই সুকুমার রায়। তত দিনে শিলং এ লরেটো কনভেন্টের পর্ব শেষ হয়েছে। তারপর সেন্ট জনস ডায়সিসেশন স্কুলে ভর্তি হলেন তিনি। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে øাতকোত্তর পাঠ শেষ করেন। তিনিই প্রথম বঙ্গালী মহিলা যিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করেন। ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্রী হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে। একটা ব্যাপার লক্ষ্যনীয় যে,  রায় চৌধুরীর পরিবার এবং ঠাকুর পরিবার যেন যুক্তি করেই বেছে নিয়ে ছিলেন দুটি পৃথক ক্ষেত্র। ঠাকুর পরিবার মাতিয়ে দিলেন নাটকে, গানে এবং বয়স্ক পাঠ্য রচনায়, আর রায় চৌধুরী পরিবার ভার নিয়েছিলেন বাংলায় শিশু সাহিত্বের প্রতিষ্ঠায়।  ভাবতে অবাক লাগে,সুকুমার রায়ের মতন দুরন্ত প্রতিভাবান কবি শুধু শিশু -কিশোরদের জন্য রচনায় সীমাবদ্ধ রইলেন। সে কি শুধু ছোটদের প্রতি ভালবাসাবশত? যদিও শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রতিটি লেখাই সার্বজনীন। সত্যজিত রায় ও রয়ে গেলেন কৈশরের দিকে। তাঁর লীলাপিসি সম্পর্কেও সেই কথা বলা যায়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ডেকে পাঠালেন। বিশ্বভারতীতে, ইংরেজীর শিক্ষক হিসাবে শুরু হলো কর্মজীবন। বেশী দিন থাকলেন না। ফিরে এলেন কলকাতায়। পড়ানো শুরু করলেন আশুতোষ কলেজের মহিলা বিভাগে। সেই চাকরীও দ্রুত ফুরোল। শুরু হলো স্বাধীন সাহিত্যচর্চা। দীর্ঘ দুদশক সে ভাবে কাটিয়ে লীলা মজুমদার যোগ দিলেন আকাশবানীতে প্রযোজক হিসাবে। সেই কাজ চললো টানা সাত আট বছর এবং তার পর থেকে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত আর কোন চাকরী করেননি। সম্পাদনা করেছেন ‘সন্দেশ’, আর লিখেছেন নিজের কথা নিজের মতো করে। তার মধ্যে বিয়ে হয়েছে সুধীর কুমার মজুমদারের সঙ্গে। পুত্র রঞ্জন এবং কন্যা কমলা জন্ম নিয়েছে, কিন্তু গৃহকর্ম সামলেও তিনি কলমকে ছুটি  দেননি কখনো। এই সুদীর্ঘ কর্মযোগে তিনি ভেঙ্গে দিয়েছেন গৃহকোনে লুকিয়ে থাকা তথাকথিত বঙ্গ নারীর মিথ।

লীলা মজুমদার বাংলা সাহিত্যের বৃহত্তর পরিসরকে এড়িয়ে বাচ্চাদের বেছে নিলেন তাঁর পাঠক-পাঠিকা হিসাবে। তিনি অবশ্য বড়দের জন্য রচনা করেছেন কয়েকটি গ্রন্থ। কিন্তু সেদিকে যেন তাঁর তেমন একটা মন ছিল না। তবে রায় চৌধুরীর পরিবারের অন্য লেখক লেখিকাদের সঙ্গে লীলা মজুমদারের একটি বড় তফাৎ আছে। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অনেক আধুনিক এবং শব্দ ব্যাবহারে তিনি যথেষ্ট সাহস দেখিয়েছেন। তাঁর  লেখাগুলির মধ্যে সংলাপ এমনি জীবন্ত ও স্বাভাবিক যে মনে হয়, সারা জীবন ধরে তিনি পাড়ার দুষ্টু ছেলেদের সঙ্গেই মিশেছেন। আসলে তা তো হবার নয়। কতটা তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তি থাকলে এটা সম্ভব তা তিনি প্রমান করে গেছেন। এ ভাবে কাজের মধ্যেই নিজস্ব, শান্ত একটা স্বর জাগিয়ে রেখেছেন। সবার মঝে মূলত শিশু সাহিত্যিক হিসেবেই খ্যাতি, কিন্তু সারা জীবনই মেনেছেন সি এস লুইসের কথা- ‘এ গুড চিলড্রেনস বুক ইজ দ্যাট হুইচ এ্যান এডাল্ট ক্যান এনজয়।’ কালি কলম এবং পরিনত একটা মন নিয়ে ছোটদের  মনোরাজ্যে ডুব দিয়েছিলেন। তাই গুপির গুপ্তখাতা, হলদে পাখীর পালক, কিংবা পদিপীসির বর্মি বাক্স এর মতো বিস্ময়কর সব লেখা জন্ম নিয়েছে। ছোটদের লেখা তো বটেই, যখন বড়দের জন্যও কলম ধরেছেন তিনি, সেই øিগ্ধ হিউমার বিচ্ছুরিত হয়েছে লেখার শরীর থেকে। তাই পাকদন্ডী হোক, কিংবা ‘আর কোনখানে’, বা রান্নার বই, লীলা মজুমদারের কলাম স্বভাবসিদ্ধ প্রসন্নতা হারায়নি কখনো। তাঁর সমস্ত রচনার মধ্যে তিনটি বই সবচেয়ে উললেখযোগ্য বলা যায়। এদের মধ্যে ‘পদীপিসীর বর্মি বাক্স’ ভীষন জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এর অনেক সংলাপের মধ্যে একটি সংলাপ সবার মুখস্ত বলা যায়। ‘চুপ! চোখ ইজ জ্বল জ্বলিং’। সত্যজিৎ রায় এই বইটিকে  চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। কোন কারণে তা সম্ভব হয়নি।

 ‘দিনে দুপুরে’ পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, এ তো আমাদেরই গল্প। উনি জানলেন কি করে? কোন রচনা সম্পর্কে  পাঠকদের কতখানি আপন আপন বোধ খুব ক্ষেত্রেই দেখা যায়। তার আত্মচরিত ‘পাকদন্ডী ও একটি অসাধারণ বই। তথ্যে আর তত্বে আছে ভরপুর। কিন্তু কোথাও নেই অহমিকা। ঋৃজু ও সাবলিল ভাষা, তাতে আগাগোড়া মিলে øিগ্ধ রস।  আর একটি লেখায় জানিয়েছিলেন, ‘নিজেদের নিজত্ব হারালে যে আমাদের কিছুই থাকবে না, সুর্যমূখী। এই আমার শেষ কথা’। সারা জীবন ধরে এই নিজস্বতাটুকু আগলে রেখেছিলেন তিনি। সুতরাং সেই অর্থে, তার জীবন বৃত্তন্ত একশ বছরেরর নিজস্বতার ইতিহাস। একবার এক বৈঠকী আড্ডায় লীলা মজুমদারের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে ছোট্র একটা  ঘটনার অবতারনা করেছিলেন সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি কোন একটা উৎসব উপলক্ষ্যে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন। দুটি অপরিচিত ছেলেমেয়ে এসে বললো, লীলা মজুমদার একবার আপনাকে দেখা করতে বলেছেন। শুনে তিনি বেশ অবাক। লীলা মজুমদার কেন ডাকবেন আমাকে? সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তখন তিনি ‘সন্দেশ’ পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক। সত্যজিৎ রায়ের চিঠি নিয়ে মাঝে মধ্যে সে পত্রিকায় দু’একবার লিখেছেন- কোন লেখায় কি কিছু ভুল হয়েছে? শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে  একটা চেয়ারে তিনি বসেছিলেন। তার লেখায় যত মজা ও রঙ্গরস থাকে মুখের ভাবে কিন্তু তার কিছুই নেই। বরং একটু কঠোর ভাব, ভ্রু কোঁচকানো। তাঁর পায়ে হা দিয়ে প্রণাম করার পর তিনি বললেন, শোন, তুমি গল্প উপন্যাস কবিতা লেখো টেখো, তা আমি কিছুই পড়িনি। তবে তুমি ছোটদের জন্য কিছু লেখালেখি করছে দেখে খুশী হয়েছি। সব লেখকদেরই শিশু সাহিত্যের সেবার জন্য খানিকটা সময় দেওয়া উচিৎ। আর শোন, এইসব লেখার মধ্যে যেন খুনোখুনি, রক্তারক্তি বেশী এনোনা। অবশ্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সারা জীবন উনার নির্দেশ মেনে চলার চেষ্টা করেছেন। শুধুমাত্র একশ ছোয়া বাঙ্গালী নয়, লীলাদেবীর জীবন পটে শতবর্ষের একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে।  ১৯০৮ থেকে ২০০৭- এই সেঞ্চুরী জানাবে, এই কালপর্বে জড়িয়ে আছে দুটি শতাব্দী। বিশ এবং একুশ। কিন্তু বাঙ্গালীর জীবন বৃত্তান্ত যারা জানেন, তারা বুঝবেন এই সময়টুকুর ভিতরে কী বিপুল পাল্টেছে বাংলা ও বাঙ্গালী। লীলা মজুমদারের শতকজোড়া জীবন যেন এক আয়না। সেই দর্পনে সময়ের বিবর্তন, কিংবা সময়ের পাল্টে যাওয়ার ছবি ভেসে উঠেছে। আয়নাটি ছোট, কিন্তু তার মধ্যেই জেগে আছে একশ বছরের উত্থান পতন। সেই একশ বছরের মধ্যে বাঙ্গালীর ঘরকন্না আছে। বাঙ্গালীর বিশ্বরূপ দর্শণও আছে। যে বাঙ্গালী ঘর এবং বাহির, দেশ আর বিদেশকে মিলিয়েছিল নিজস্ব শিক্ষায়, গত একশ বছর ধরে সেই বৃহৎ বাঙ্গালীরই প্রতিমূর্তি লীলা মজুমদার। কোন অন্তিম সংস্কারেই একশ বছরের দীর্ঘ সৃষ্টিশীলতা ফুরায়না। শতায়ুর আলো এক সময় নিভে যায়, কিন্তু একশ বছরের একটি মৃত্যু মাইলফলকের মতো জেগে থাকে জনজীবনে। সুতরাং একশ বছর ছুঁয়ে একটি যাত্রা শেষ করলেন লীলা মজুমদার। সেই সংগে থেকে গেল বেশ কিছু অসামান্য বই। একটি একশ বছরের উত্তরাধিকার।