ইরানে হিজাব বিরোধী তীব্র আন্দোলন : মৃতের সংখ্যা ২২০

কানাডায় প্রবেশ করতে পারবেন না ইরানের উর্ধতন কর্মকর্তারা : ইসলামিক রেভ্যুলেশনারী গার্ড কর্মকর্তারাও এই নিষেধাজ্ঞার আওয়াতায় পড়বেন

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : অক্টোবর ৩০, ২০২২ : ইরানে পুলিশি হেফাজতে থাকা অবস্থায় ২২ বছর বয়সী কুর্দি তরুণী মাসা আমিনির  মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি দেশজুড়ে গড়ে উঠেছে হিজাব বিরোধী তীব্র আন্দোলন। ছয় সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলা ওই আন্দোলনে এ পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে ২২০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা এই তথ্য জানায়।

ইরানে হিজাব বিরোধী আন্দোলনকারীদের প্রতি সমর্থন জানাতে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো গত ২৯ অক্টোবর অটোয়ায় এক মিছিলে যোগ দেন। ছবি : জাস্টিন তাং/দি কানাডিয়ান প্রেস

বিক্ষোভ প্রতিবাদ এবার এতটাই জোরদার হয়ে উঠেছে যে, দেশটিকে বহু বছরের মধ্যে এবার এক মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। বিবিসি জানায়, আমিনির বিরুদ্ধে হিজাব সম্পর্কিত নিয়ম ভঙ্গের অভিযোগ তুলেছিলো পুলিশ। তবে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছ তার মৃত্যু হয়েছে স্বাস্থ্যগত কারণে। কিন্তু ওই তরুণীর পরিবার ও বহু ইরানি নাগরিকের বিশ্বাস যে আটক অবস্থায় মারাত্মক প্রহারের কারণেই আমিনির মৃত্যু হয়েছে।

বিক্ষোভকারীরা বলছেন তারা যদি এখনই এর বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ান তাহলে একদিন তাদেরও একই ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে।

উল্লেখ্য যে, বিশ্বে বহু দেশে নারী সমাজ যখন এগিয়ে চলছে সামনের দিকে তখন ইরানে চলছে তাদেরকে দমিয়ে রাখার নানান অপকৌশল। এর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে রাষ্ট্রিয় ক্ষমতা এবং সরকারের বিশেষ পুলিশ বাহিনী যার নাম ‘গাতে-ই এরাদ’ বা ‘নীতি পুলিশ’। এই নীতি পুলিশের কাজ হলো রাস্তায় বা অন্যকোন প্রকাশ্য স্থানে ইরানের নারীরা যথাযথভাবে হিজাব পরছেন কি না এবং শরীরের ভাজ দেখা যায় এমন কোন পোষাক পরছেন কি না তার উপর নজর রাখা। যদি কেউ ঠিকমত হিজাব না পরেন এবং পোষাক ছাপিয়ে শরীরের ভাজ লক্ষণীয় হয়ে উঠে তবে তার উপর নেমে আসে নীতি পুলিশের নির্যাতনী স্টিম রোলার। ফলে ইরানী নারীরা ঘরের বাইরে সারাক্ষণই থাকেন এক আতঙ্কের মধ্যে।

গত ২৪ সেপ্টেম্বর টরন্টোর মেল লাস্টম্যান স্কোয়ারে ইরান সরকারের বিরুদ্ধে এবং হিজাব বিরোধী আন্দোলনকারীদের পক্ষে সমাবেশ করেন কানাডা প্রবাসী ইরানীরা। ছবি : এএফপি ভায়া গেটি ইমেজ

ইরানের শরিয়া আইন অনুযায়ী, নারীদের মাথা ও চুল ঢেকে রাখা বাধ্যতামূলক। তাঁদের এমন লম্বা ও ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হবে, যাতে শরীরের গঠন বোঝা না যায়।

অথচ ইরানে প্রায় চার দশক আগে ঠিক এর উলটো চিত্র ছিল । নারীরা পশ্চিমা ফ্যাশনের পোশাক পরত। সেই সময় ক্ষমতায় ছিলেন পহলভি রাজবংশের রাজা শাহ মোহাম্মদ রেজা। নারীদের স্বাধীনতা ছিল তখন। কিন্তু আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ যুগ শুরুর পর থেকেই স্বাধীনতা হারায় ইরানী নারীরা।

এদিকে ইরানের বর্তমান পরিস্থিতির কারণে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো গত ৭ অক্টোবর বলেছেন, ইরান সরকারের উর্ধতন নীতিনির্ধারক ও কর্মকর্তারা এবং ইসলামিক ইসলামিক রেভ্যুলেশনারী গার্ড কর্মকর্তারা কানাডায় প্রবেশ করতে পারবেন না। তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে ইসলামিক ইসলামিক রেভ্যুলেশনারী গার্ডের প্রায় অর্ধেক সদস্যই কানাডায় প্রবেশের অনুমতি পাবেন না যাদের সংখ্যা প্রায় দশ হাজার। এবং এই নিষেধাজ্ঞা হবে স্থায়ী।

উল্লেখ্য যে, ইরানে কয়েক সপ্তাহ আগেও যারা ঘর থেকে বের হওয়ার আগে নিজেদের সাজগোজ বিশেষ করে হিজাব ও গায়ের মূল পোষাক ঠিকঠাক আছে কি না তা একাধিকবার বার পরীক্ষা করে দেখতেন তারাই এখন রাজপথ কাপাচ্ছেন খোলা চুল বাতাসে উড়িয়ে। প্রকাশ্যে পুড়িয়ে ফেলছেন হিজাব। পুলিশের সামনেই তারা হুঙ্কার দিয়ে বলছেন হিজাব আইন মানিনা, স্কার্ফ পরবো না।

কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর থেকেই ইরানে বিক্ষোভের আগুনে পুড়ছে এই হিজাব পরিধানের আইনটি। এই আইনের জন্ম হয় ইসলামিক বিপ্লবের পর ১৯৭৯ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির এক ডিক্রি জারি মাধ্যমে। সে সময়ও ফুঁসে উঠেছিল নারী সমাজসহ প্রগতিশীলরা। কিন্তু আইনটি রোধ হয়নি। বরং দিনে দিনে তা আরো জেঁকে বসেছে ইরানের মাটিতে। আইনটি প্রয়োগের জন্য গড়ে তোলা হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কট্টর শাখা ‘নৈতিকতা পুলিশ বা নীতি পুলিশ’। তাদের নজরদারীর কারণে ইরানের নারীরা ঘরের বাইরে সর্বক্ষণই থাকেন আতঙ্কিত অবস্থায়। কারণ আইন লঙ্ঘন করলেই প্রকাশ্যে জবাবদিহিতা, জরিমানা চাওয়াসহ যে কোন নারীকে গ্রেফতার করতে পারে নীতি পুলিশ।

ইকনমিস্ট পত্রিকা জানায়, আমিনির মৃত্যুতে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এবার বিক্ষোভ বেশি ছড়িয়ে পড়েছে ইরানে। বহু বছর ধরে আয়াতুল্লাহ খামেনির ‘স্বৈরাচারী’ শাসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদী আন্দোলন হচ্ছে এবার। তরুণদের সঙ্গে বয়স্করাও অংশ নিয়েছেন আন্দোলনে। কুর্দিসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুরাও অংশ নিচ্ছেন এতে। তবে এখন পর্যন্ত নারীরাই সবচেয়ে সাহসিকতা দেখিয়েছেন এবারের আন্দোলনে।

ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার সামাজিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক -আমিন সেইকাল সম্প্রতি প্রকাশিত তার  এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ‘ইরান সরকার হয়তো অনির্দিষ্টকালের জন্য বিক্ষোভ দমন করে রাখতে পারবে না। কারণ, দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৬৫ শতাংশ নাগরিক হলো তরুণ বয়সের এবং এই তরুণেরা শাসকদের বিপ্লবী বাগ্মিতা এবং ধর্মতান্ত্রিক হুকুমে বিরক্ত। তারা অধিকার, স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা, উন্নত জীবনযাত্রা এবং তাদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী সরকার চায়। ক্ষমতাসীন ধর্মীয় নেতা এবং তাদের সমর্থকেরা অর্থনীতির শৃঙ্খলায় যে অব্যবস্থাপনার সৃষ্টি করেছে, তা অধিকাংশ নাগরিককে ক্রমবর্ধমানভাবে হতাশাগ্রস্ত, মরিয়া, ভীত এবং ক্ষুব্ধ করছে।’

অধ্যাপক আমিন অবশ্য এক কথাও বলেন, ‘চলমান আন্দোলনে বিদ্যমান ইসলামি শাসনব্যবস্থা উৎখাতের সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু ইরানিদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ইতিহাস রয়েছে। ’

আর এই নীতি পুলিশের হাতেই সম্প্রতি গ্রেফতার হয়েছিলেন মাহসা আমিনি। ‘যথাযথ নিয়ম’ মেনে হিজাব না পরার অভিযোগে তাকে আটক করেছিল ‘নীতি পুলিশ’। আটকের পর ‘নীতি পুলিশের’ হেফাজতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে তেহরানের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৬ সেপ্টেম্বর আমিনির মৃত্যু হয়।