নিকাবের কাছে হারপার সরকারের আবারো পরাজয়

অক্টোবর ৯, ২০১৫

প্রবাসী কন্ঠ ডেস্ক : নিকাব নিয়ে বিতর্ক শেষ হচ্ছে না কানাডায়। বিষয়টি এখন হয়ে দাড়িয়েছে রাজনৈতিক ইস্যু। হারপার সরকার নিকাবের ঘোর বিরোধী অন্যদিকে প্রধান দুই বিরোধী দল বলছে নিকাব পরা নিয়ে তাদের কোন আপত্তি নেই।

উল্লেখ্য যে, গত ৬ ফেব্রুয়ারী ফেডারেল আদালত তার রায়ে বলেন, নাগরিকত্ব লাভের জন্য শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে কাউকে তার মুখের পর্দা উন্মোচন করতে বলাটা “অবৈধ”। সরকার এ বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করতে পারে না। আদালত অবিলম্বে এই আইন প্রত্যাহার করার জন্য ফেডারেল সরকারকে নির্দেশ দেন এবং নিকাব বিষয়ে সরকারের করা আইনের বিরুদ্ধে মামলাকারী জুনেরা ইসহাক যাতে মুখের পর্দা অপসারণ না করেই শপথ নিতে পারেন সেই ব্যবস্থা করারও নির্দেশ দেন। তবে ফেডারেল সরকার ইচ্ছে করলে এই রায়ের বিরুদ্ধে ফেডারেল আপিল কোর্টে আপিল করতে পারে এবং আপিলে রায় যদি ফেডারেল সরকারের পক্ষে যায় তবে জুনেরা ইসহাককে হয় মুখমন্ডল উন্মোচন করতে হবে অথবা নাগরিকত্ব ছাড়াই এ দেশে বসবাস করতে হবে। অবশ্য ফেডারেল আপিল কোর্টের পর সুপ্রিম কোর্টের  আরেকটি ধাপ রয়েছে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবার জন্য। হারপার সরকার এখন সেই সুপ্রিম কোর্টের স্বরণাপন্ন হতে যাচ্ছে।

মামলাকারী জুনেরা ইসহাক

উল্লেখ্য যে, বর্তমান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জেসন কেনি ইমিগ্রেশন বিষয়ক মন্ত্রী থাকাকালে মুসলিম নারীদের নাগরিকত্বের শপথ গ্রহণের সময় নেকাব পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন ২০১১ সালে। পরবর্তীতে তিনি এ বিষয়ে টুইটারে স্ট্যাটাস দেন। টুইটারে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘আমার বিশ্বাস, নাগরিকত্বের শপথ গ্রহণকারীদেরকে শপথ নিতে হবে প্রকাশ্যে, তাদের মুখমন্ডল অনাবৃত থাকতে হবে।’’ তিনি ঐ স্ট্যাটাস দেন যখন শপথ অনুষ্ঠানে নেকাব নিষিদ্ধ করার বিষয়টি নিয়ে ফেডারেল সরকারের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা চলছিল।

বর্তমানে মিসিসাগায় বসবাসরত জুনেরা ইসহাক নামের একজন পাকিস্তানী মহিলা ওই নিষেধাজ্ঞার কারণে রক্ষণশীল দলের সরকারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন। তিনি তখন যুক্তি দেখান যে, তার ধর্মবিশ্বাসকে ধারণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ওই নিষেধাজ্ঞা তার অধিকারের সনদ লংঘন করেছে।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর ফেডারেল আপিল কোর্ট সরকারের করা আপিলকে আমলে না নিয়ে ফেডারেল কোর্টের আগের রায়কেই বহাল রেখে বলেন, সরকার কর্তৃক নিকাব নিষিদ্ধ করার আইন বেআইনী। একই দিনে বেঞ্চের তিন বিচারক বলেন, তারা চাচ্ছেন বিষয়টির যেন দ্রুত নিষ্পত্তি ঘটে যাতে করে মামলাকারী জুনেরা ইসহাক নাগরিকত্ব গ্রহণ করে আসন্ন নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন।

ইতিপূর্বে ইমিগ্রেশন মন্ত্রী ক্রিস আলেকজান্ডারের মুখপাত্র কেভিন মেনার্ড অবশ্য বলেছিলেন, কানাডায় যাঁরা নতুন নাগরিক হিসেবে শপথ নিবেন তাঁরা তাঁদের মুখায়বব শপথ অনুষ্ঠানে সর্বসমক্ষে প্রদর্শন করতে বাধ্য। তিনি বলেন, এটি একটি সাধারণ কান্ডজ্ঞানের বিষয় যে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে নিজের মুখ ঢেকে রাখাটা ন্যায়সঙ্গত নয়।

এদিকে নেকাবের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের অবস্থানের সমালোচনা করেছেন লিবারেল দলের প্রধান নেতা জাস্টিন ট্রুডো। তিন বলেন, সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কাজ করার সময় যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ। তিনি আরো বলেন, সরকার বা অন্য যে কোন নেতা যখন সংখ্যালঘুদের কোন অধিকারকে নিয়ন্ত্রিত বা সীমিত করতে চাইবে তখন তার পিছনে জোড়ালো কারণ বা যৌক্তিকতা থাকতে হবে।

এনডিপি নেতা টম মুলকেয়ারও নিকাবের বিরুদ্ধে নন। তার ভাষ্য হলো, নাগরিকত্ব লাভের সময় পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য নিকাব উন্মোচন করার পক্ষে তিনি। তবে শপথগ্রহন অনুষ্ঠানের সময় নিকাব উন্মোচন করার কোন প্রয়োজনীয়তা তিনি দেখেন না।

উল্লেখ্য যে, কানাডার চার্টার অব রাইটস এন্ড ফ্রিডম এ ধর্মীয় স্বাধীনতাকে গুরুত্বসহকারে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। জুনেরা ইসহাক সেই স্বীকৃতির দোহাই দিয়েই সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, ইসলাম ধর্মের সঙ্গে নেকাবের যে কোন সম্পর্ক নেই সেই কথাতো ইসলামী চিন্তাবিদরাই বলছেন।

তাহলে জুনেরা যে দাবী করছেন তার ধর্মীয় স্বাধীনতা লংঘিত হয়েছে- সে দাবীর পিছনে যৌক্তিকতা কোথায়?

সরকার ফেডারেল আপিল কোর্টের রায়ে সন্তুষ্ট হয়নি। তাই এবার সুপ্রিম কোর্টে আপিল করবে যেটা শেষ আশ্রয়স্থল। তবে সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টি নিয়ে শুনানীতে বসবে কি না সেই সিদ্ধান্ত নিতে আরো তিন মাস সময় লেগে যাবে। আর যদি শুনানী শুরু হয় তবে সুপ্রিম কোর্টের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত পেতে সময় লেগে যাবে আরো বেশ কয়েক মাস।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের কুইবেক প্রতিনিধি ডেনিস লিবেল বলেন, সরকার এ বিষয়ে কোন ঝুঁকি নিবে না। আসন্ন নির্বাচনে জয়ী হলে কনজারভেটিভ পার্টি পার্লামেন্টে এ বিষয়ে বিল তুলবে এবং একশত দিনের মধ্যে নিকাব নিষিদ্ধ করার আইন পাশ করাবে যাতে করে শপথ গ্রহনের সময় কেউ নিকাব পড়তে না পারে।

ফেডারেল কনজারভেটিভ পার্টি কর্তৃক নিবাক নিষিদ্ধের অনুপ্রেরণাটি আসে মূলত কুইবেক প্রভিন্সের তথাকথিত “চার্টার অব ভ্যালুস” থেকে। এই চার্টার অব ভ্যালুস কুইবেক প্রভিন্সে প্রবর্তন করতে চেয়েছিল পার্টি কুইবেকো যাতে বলা হয়েছিল- সরকারী অফিস আদালতে কেউ ধর্মীয় পোষাক, প্রতীক বা চিহ্ন পরিধান করতে পারবে না। এটি স্পষ্টতই মুসলমান সম্প্রদায়কে টার্গেট করে করা হয়েছিল। বিষয়টি তখন ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয় এবং ২০১৪ সালে প্রভিন্সিয়াল নির্বাচনে পার্টি কুইবেকোর পরাজয়ের জন্য এই চার্টার অব ভ্যালুসকেই কারণ হিসেবে মনে করা হয়। কিন্তু পরাজিত হলেও নিকাবসহ মুসলমানদের হিজাব ও অন্যান্য ধর্মীয় পোষাকের বিরুদ্ধে পার্টি কুইবেকোর সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভ এখনো রয়ে গেছে। বিশ্লেষকগণ মনে করছেন এই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েই ফেডারেল কানজারভেটিভ পার্টি নিকাব ইস্যুতে এখনো স্বপ্ন দেখছে কুইবেকের বেশীরভাগ আসন দখল করার জন্য।

এদিকে এই নিকাব ইসুতে ফেডারেল  সরকার মামলায় জড়িয়ে এ পর্যন্ত ২৫৭,০০০ ডলার খরচ করে ফেলেছে। আগামীতে এই খরচ আরো বাড়বে। অন্যদিকে নিকাব ইস্যুতে কানাডিয়ানদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। ঠড়ী চড়ঢ় খধনং নামের একটি সংস্থা পরিচালিত জরীপে দেখা গেছে ৭২% কানাডিয়ান নিকাবের বিরুদ্ধে। মাত্র ১৯% কানাডিয়ান বলেছে নিকাবের ব্যাপারে তাদের সমস্যা নেই। এটি সাধারণ জনগণের মতামত। আর রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে এই চিত্র অন্যরকম। ব্লক কুইবেকো এবং কনজারভেটিভ পার্টির সদস্য/সমর্থকরা এর ঘোরতর বিরোধী। তাদের বিরোধীতার মাত্রা যথাক্রমে ৯৬% ও ৯২% । কিন্তু এনডিপি লিবারেল ও গ্রীন পার্টির সদস্য/সমর্থকদের মধ্যে নিকাবের বিরোধীতাকারীর সংখ্যা কম। এদের মাত্রা যথাক্রমে ৬২%, ৫৭% ও ৫১%।

গত মে মাসে একই ইস্যুতে পরিচালিত ফোরাম রিসার্চ নামের একটি সংগঠনের করা জরিপে দেখা গেছে, কানাডীয় নাগরিকদের দুই-তৃতীয়াংশই নাগরিকত্ব দানের অনুষ্ঠানে নারীদের মুখ ঢেকে রাখার বিরোধী। পরিচালিত ওই জনমত জরিপে দেখা যায়, জরিপে অংশ নেয়া ৬৭ শতাংশ মানুষ নেকাব পরার বিরোধী। অন্যদিকে এক-চতুর্থাংশেরও কম ২২ শতাংশ নেকাব পরার পক্ষে এবং ১০ শতাংশ মানুষ সিদ্ধান্তহীন।

সর্বমোট ১,৩৭০ জন প্রাপ্তবয়স্ক কানাডীয় জরিপে অংশ নেন।

আঞ্চলিকভাবে এই ধরণার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মানুষ ছিলো কুইবেকে। সেখানে ৮৭ শতাংশ মানুষ নাগরিকত্বের অনুষ্ঠানে নেকাব পরার বিরোধী। সবচেয়ে কম বিরোধী মানুষ হলেন আটলান্টিক প্রদেশে। সেখানে ৫৪ শতাংশ লোক এই ধারণার বিরোধিতা করেছে। অন্টারিওতে বিরোধিতা করেছে ৬৩ শতাংশ মানুষ।

তবে ৫৭ শতাংশ কানাডীয় মনে করেন, নেকাব নারীর জন্য নিবর্তনমূলক, ২৪ শতাংশ তেমন মনে করেন না। আর ১৯ শতাংশের এ বিষয়ে কোনও মতামত নেই।

ফোরামের রিসার্চ প্রেসিডেন্ট লোরনে বোজিনফ এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা একথা বলতে পারি না যে, নেকাব বিষয়ক বিতর্ক লিবারেলদের ক্ষতির কারণ হয়েছে, তবে এটি স্পষ্টতই রক্ষণশীলদের জন্য সহায়ক হয়নি। কানাডীয়রা যদিও একমত যে, নাগরিকত্বের অনুষ্ঠানে নেকাবের কোনও স্থান নেই তবু তারা এটিকে নিজেদের জন্য বা অন্যদের জন্য আক্রমণাত্মক মনে করে না।”

বোজিনফ আরও বলেন, নেকাব ইস্যুটি কেবল গুটিকতক কানাডীয় নারীর মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব ফেলেছে কিন্তু এই শরতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ফেডারেল নির্বাচনে এটি একটি পার্শ্ব বিষয় হিসাবেই থাকবে।