একজন দানবীরের গল্প

জসিম মল্লিক

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

৫.    ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনের পর পরবর্তী নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত তিনি তার প্রতিশ্রুতি কাজ নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন। মানিকগঞ্জের মানুষ যাতে সহজে তার সাথে দেখা করতে পারে সেজন্যে শ্যামলীতে একটি রাজনৈতিক কার্যালয় খোলা হয়েছিল। এই কার্যালয়টি আমিই খুঁজে বের করেছিলাম। এটি শ্যামলী সিনেমা হলের ঠিক পিছনেই অবস্থিত ছিল। ২৪/১-১ রিং রোডে ছিল এর ঠিকানা। দোতলায়। যাতে গাবতলী থেকে নেমেই এখানে আসা যায়। এই কার্যালয়টি ২০০১ সালের নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত বহাল ছিল।

রাজনৈতিক কারণে পারিবারিক জীবনে যাতে কোন ব্যঘাত না সে ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। ২০০১ এর নির্বচনের পূর্বে তার পরিবারের কেউ এমনকি তার অফিসের কোন লোকও তার রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলো না। ২০০১ সালে যখন তিনি দুটো আসন থেকে নির্বাচন করেন তখনই কেবল তার জ্যেষ্ঠ কন্যা আফরোজা খান নির্বাচনী প্রচারনার কাজে সহায়তায় এগিয়ে আসেন। মানুষ তাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে। এখন তিনি পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ।

শ্যামলীর কার্যালয়টির সময়সূচী ছিল বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত। আমি তখন ওয়ারী অফিস শেষ করে বিচিত্রা হয়ে শ্যামলী আসতাম। মাসে এই অফিসটির পিছনে প্রায় লাখ টাকা খরচ হয়ে যেতো। মানুষ খুব খুশী হতো স্বচ্ছন্দে তারা তাদের এমপির সাথে দেখা করতে পারতো বলে। অফিসটির জন্য তিন চারজন কর্মচারী নিয়োগ হয়েছিল। যখন সংসদ অধিবেশন চলতো তখন মুন্নু সাহেব নিজের অফিস শেষ করে যেতেন সংসদে তারপর আসতেন শ্যামলী কার্যালয়ে। অসুস্থতা ছাড়া কখনো শ্যামলীর কার্যালয়ে আসা বন্ধ হয়নি। প্রতিদিন গড়ে এই কার্যালয়ে শতাধিক ভিজিটর আসতো। তিনি সবার কথা শুনতেন। প্রয়োজনে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। লোকজনের আপ্যায়নের ব্যবস্থাও থাকতো। তিনি যদি দশ জনকে ডাকতেন মানুষ আসতো পঞ্চাশজন। কিন্তু কখনো কাউকে ফেরানো হতোনা। ২০০১ এর নির্বাচনের সময় থেকে ধানমন্ডির বাসভবন তার রাজনৈতিক কার্যালয় হিসাবে ব্যাবহৃত হয়েছে। এমনকি মন্ত্রী হওয়ার পরও।

তিনি যখন বিদেশ যেতেন তখনও শ্যামলীর কার্যালয় বন্ধ থাকতো না। আমি নিয়মিত অফিস খুলতাম। মানুষের দরকারগুলো নোট করে তাকে জানাতাম। তিনি বিদেশ বসেই সব নির্দেশ দিতেন। যে কোন সমস্যার এত অনায়াস সমাধান আমি কোনদিন কাউকে দিতে দেখিনি। তার মাথা এত দ্রুত কাজ করতো যে অবাক হয়ে যেতে হতো। যে সমস্যাকে পাহাড়ের মতো মনে হতো আমাদের কাছে সেটাকেই তিনি পানির মতো সহজ করে দিতেন। রজনীতিতে তাকে অনেক জটিল সমস্যার মুখোমুখী হতে হয়েছে অনেকবার। তার প্রতিপক্ষরা তাকে দমানোর অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোনবারই তারা সফল হয়নি। তিনি তার বুদ্ধিমত্তা আর সাহস দিয়ে সব কাটিয়ে উঠেছেন বার বার। তবে একথা নির্দ্বিধায় বলবো রাজনীতিতে তার যোগ্য মর্যাদা তিনি পাননি। তার সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। জাতিকে তার আরো অনেক দেওয়ার ছিল। তার পুরো জীবনটাই একটা সংগ্রাম মুখর। কোন কিছুই তিনি সহজে অর্জন করেননি। সব কিছুর পিছনেই রয়েছে এক একটা সংগ্রামের ইতিহাস। এত বৈচিত্রে ভরা মানুষের জীবন খুব কম হয়।

শ্যামলীর অফিসের একটা ছোট্ট ঘটনা বলি। সেটা ১৯৯৫ সাল হবে সম্ভবত। মন্নু সাহেবের ওপেন হার্ট সার্জারী হলো লন্ডনে। মানুষের সে কি আহাজারী! প্রতিদিন খবর নেওয়ার জন্য মানুষ শ্যামলী অফিসে ভীড় জমাতো। মানুষের কান্না দেখে আমি অবিভূত হয়ে গেলাম। মসজিদে মসজিদে তার জন্য দোয়া হলো। এটা শুনে অপারেশনের পর মুন্নু সাহেব এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলতে চাইলেন লন্ড থেকে। কৃতজ্ঞতা জানাতে চাইলেন ভালোবাসার। খবর পাওয়ার পর কয়েকশত লোক এসে উপস্থিত হলো শ্যামলী অফিসে। প্রায় দুই/তিন ঘন্টা সেদিন তিনি লোকজনের সাথে কথা বলেছিলেন।

দানবীর হারুণার রশিদ খান মুন্নু। ছবি : সংগৃহীত

৬.    ৯১ এর নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি হরিরামপুর সদরে নিজস্ব বাড়ি বানালেন। এলাকায় গেলে যাতে মানুষ সহজে তাকে পায় বা আপ্যায়িত হতে পারে এ মানসে তিনি বিশাল এক বাড়ি তৈরী করলেন। মাঝে মাঝে তিনি এখানে রাত্রী যাপনও করতেন। তখন দেখতাম সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত মানুষের ভীর লেগেই থাকতো। তিনি বিরামহীন মানুষের সাথে মিশতে পারতেন। একটা উৎসব লেগে থাকতো যতক্ষণ তিনি থাকতেন ততক্ষণ। বিশেষ করে প্রতিটা নির্বাচনের সময় একনাগারে অনেক দিন এখানেই থাকতেন। তার স্ত্রীও এ সময় তার সঙ্গী হতেন।

তার সবকিছুতেই রয়েছে পরিকল্পনা ও রুচির ছাপ। তিনি যে বাড়িটি বানালেন সেটি ছিল সুন্দর দেখতে। টিনের দোচালা ঘর। আধুনিক সব সুযোগ সুবিধার সমন্বয় ঘটানো হয়েছিল। সেখানে গাছ গাছালি আর ফুলের বাগান করে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ তৈরী করলেন। দুর দুরান্ত থেকে মানুষজন আসতো এই বাড়িতে দেখা করতে। অনেক মন্ত্রী মিনিষ্টারও এই বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। পরবর্তীকালে গিলন্ডতে তিনি নিজে থাকার জন্য যে বাড়িটি বানিয়েছেন সেটি দেখার মতো। একশ বিঘা জায়গা নিয়ে বাড়িটি।

জীবনে তার সব কিছুতেই দেখেছি রুচি আর আভিজাত্যের পরিচয়। সৃষ্টিশীল মানুষেরা যে রকম হন তিনি সেরকম। তার পোশাক আশাক, জুতো, জামা, টাই, ঘড়ি তার অফিস, বাড়ি, গাড়ি সব কিছুই রুচিশিল। তিনি মানুষ হিসাবেও অত্যন্ত সৌখিন। পৃথিবীর সব দেশই প্রায় ভ্রমন করেছেন, প্লেনের দামী ক্লাসে চড়েছেন, থেকেছেন দামী দামী সব হেটেলে। পরেছেন মূল্যবান ঘাড়ি, টাই, স্যুট সবকিছু। কিন্তু তার মধ্যে দেখানেপনা ভাব কোনদিন ছিলনা। খুব সচেতন ছিলেন তিনি সব ব্যাপারে। তার স্মরণশক্তি বিস্ময়কর। তিনি একসাথে প্রায় পাঁচশত ফোন নম্বর মনে রাখতে পারতেন এক সময়। শুধু তাই নয় আরও অনেক ছোট খাট জিনিস মনে করে দিয়ে আমাদের তাজ্জব করে দিতেন।

প্রথম যখন তিনি নির্বাচনী প্রচারনায় নামেন তখন তাকে নিয়ে মজার মজার সব কৌতুহল ও আলোচনা দানা বাঁধছিল। এর আগে তিনি বেছে বেছে অনুষ্ঠানে যেতেন। সবাই তাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পায়নি। যার বেশীরভাগই ছিল স্কুল। দুষ্ট লোকেরা তখন প্রচার করলো যে তিনি এমপি হলে তার বাড়িতে কেউ দেখা করতে যেতে পারবে না। গেট দিয়ে দারোয়ানরা ঢুকতেই দেবেনা। হ্যান্ডশেক করে তিনি সাবান দিয়ে হাত ধোবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। পরবর্তীকালে দেখা গেলো তার বাড়ির দরজা সবসময়ই খোলা, আর তিনি হ্যান্ড শেক করেন সবার সাথে। তিনি যে অহংকারি না এটা আস্তে আস্তে জেনেছে মানুষ।

অন্য রাজনীতিবিদদের মতো তিনি ছিলেন না। তিনি বরাবর গতানুগতিকতার বাইরের একজন মানুষ। মানুষকে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি কোনদিন দেননি। মিথ্যে বলতেননা বা কাউকে তোষামোদী করতেন না বলে অনেকে বলতো তিনি রাজনীতি বোঝেন না। রাজনীতির নোংরা কূটকৌশল করতেন না। জনসভায় দাঁড়িয়ে কখনো মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেননি। বিরোধী রাজনীতিকে শ্রদ্ধা করতেন। কখনো কারো উপর প্রতিশোধের চিন্তা করতেন না। সত্য কথা বলতে কখনো পিছপা হননি। তিনি নিজদলীয় লোকদের খারাপ কাজেরও সমালোচনা করতে ছাড়তেন না। তিনি সব সময় বলতেন, ‘সত্যের জন্য জীবন গেলেও পরোয়া নেই’। তিনি যা বলতেন সোজা সাপটা বলে দিতেন। ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা কথা বলতেন না। আসলে তার কোন দুর্বলতা ছিলনা। কারো কাছে তার কোন দায়বদ্ধতাও নেই; সেজন্যই তিনি ছিলেন অকপট। কাউকে মিথ্যে তোষামোদ বা খুশী করার তার কোন দরকার নেই। তার এই আপাত: সরলতাকে কেউ কেউ পূজী করার চেষ্টা করেছে।। অনেকেই তাকে ফাঁকি দিয়ে কিছু পাওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু তিন সবই বুঝতেন, বুঝেও কিছু বলতেন না। এইভাবে তিনি রাজনীতির মানুষ চিনেছেন। তিনি বলতেন, ‘আমি মানুষকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখলেই বুঝতে পারি কে কেমন। কথাটা যে সত্য তার অনেক প্রমাণ আমি পেয়েছি। অনেকেই বন্ধুর বেশে এসে কিছু ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করেছে কিন্তু সেটা ছিল খুবই সাময়িক।

তার মধ্যে কিছু ঐশ্বরিক গুনাবলী ছিল বলে আমার মনে হতো। যেমন একটা উদাহরন দেই। মুন্নু সাহেবের প্রোগ্রাম কখনো প্রাকৃতিক কারণে বাতিল করতে হয়নি। দেখা গেলো আমরা ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়েছি, পথে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে, ঝড় বন্যা হচ্ছে কিন্তু অনুষ্ঠানে স্থলে পৌঁছে দেখলাম সব ঠিক ঠাক। বৃষ্টি থেমে রোদ উঠে গেছে। এরকম একবার নয় বহুবার হয়েছে। কেউ শেষ পর্যন্ত তার পথ আটকাতে পারেনি। যেই তার ক্ষতির চেষ্টা করেছে সেই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তাকে ফাঁকি দেওয়া অত সহজ ছিলনা। কিন্তু তিনি কখনো এসব নিয়ে উচ্চবাচ্চ্য করতেন না। তিনি বলতেন, ‘মানুষ আমাকে পা ধরে টানে আর আল্লাহ আমাকে চুল ধরে টানে। তার উত্থান কোন আকস্মিক ঘটনা না। তিনি উঠেছেন ধীরে ধীরে কিন্তু কোন ফাঁক নেই। তার উচ্চতার গ্রাফটা একই গতিতে উঠেছে। কখনো উঠেছে কখনো নেমেছে এরকম হয়নি কখনো। একলক্ষ প্রতিকুলতা পারি দিয়েই তিনি সফল একজনে পরিণত হতে পেরেছেন।

৭.   আমি জীবনে আর একজন দ্বিতীয় মানুষ দেখিনি যে সময়কে এতখানি মূল্য দেয়। আজ উত্তর আমেরিকায় বসে অনুভব করছি সময়ের মূল্য কতখানি। যেটা তিনি অনেক আগেই বুঝেছিলেন। অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছেন। তিনি আর দশজন রাজনীতিকের মতো ছিলেন না। তারা সময়কে তেমন গুরুত্ব দিতেন না। এলাকায় কোন প্রোগ্রাম দশটায় থাকলে মন্ত্রী বা নেতারা যেতেন দু’ তিন ঘন্টা পর। এটাই নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। লোকজন এতেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটালেন মুন্নু সাহেবে। তিনি দশটার প্রোগ্রামে দশটা বাজার পাঁচ মিটি পূর্বে যেতে শুরু করলেন। প্রথম প্রথম এমন হয়েছে আমরা অনুষ্ঠানস্থলে গিয়ে দেখি লোকজন স্টেজ বাঁধা ছাদা করছে। আমরা গিয়ে হাজির। উদ্যোক্তাদের দেখা সাক্ষাত নেই। একটা বিব্রতকর অবস্থায় পরে যেতো লোকজন। পরে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়। আমার বারো বছরের অভিজ্ঞতায় খুব কমই দেরী করে কোথাও যেতে দেখেছি। লোকজন এরপর জেনে যায় তার সম্পর্কে। তারাই এরপর পূর্ব থেকেই তৈরী হয়ে থাকতো। কখনো দেরী হওয়াটা ছিল নিতান্তই আকস্মিক। এজন্যে তিনি ক্ষমা চেয়ে নিতে ভুল করতেন না। তিনি সবসময় বলতেন, ‘কারো সময় নষ্ট করার অধিকার আমার নেই। আমার জন্য কারো এক মুহূর্ত নষ্ট হোক তা আমি চাইনা’।

যত দুরের প্রোগ্রাম হোক না কেনো তিনি চেষ্টা করেছেন সময় মতো পৌঁছাতে। এজন্যে তিনি হাতে সময় নিয়ে বের হতেন। এব্যাপারে কোন এক্সকিউজ ছিলনা। কখনো আমার দেরী হলে মহা টেনশনে পড়ে যেতাম। জানি তিনি বেশীক্ষণ অপেক্ষা করবেন না। গিয়ে হয়ত দেখি তিনি গাড়িতে বসে আছেন। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ড্রাইভার রেডি। এমন হয়েছে হাতে সময় কম, খাওয়ার সুযোগ হয়নি। কখনো প্লেটে অর্ধেক খাবার রেখেই আমাদের ছুটতে হয়েছে। তার স্পীডের সাথে পারাই ছিল দুষ্কর। অনেক দিন রাস্তা থেকে আমরা বিস্কুট এবং কলা কিনে খেয়েছি। প্রায়শই আমরা খাবার সাথে করে নিয়ে গিয়েছি। গাড়িতে বসেই আমরা আমাদের খবার সেরে ফেলতাম। আমাদের মেনু ছিল চিকেন স্যান্ডউইচ এবং ফ্রুটস।

অনেক সময় ইঞ্জিন বোটে করে আমরা বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে গিয়েছি বা হেলিকপ্টারে করে গিয়েছি কোথাও, আমাদের দেরী হয়নি কখনো। খাবার দাবার আমরা ঢাকা থেকেও নিয়ে যেতাম অনেক সময়। অন্তত পঞ্চাশজন খেতে পারে এরকম খাদ্য আমাদের সাথেই থাকতো। এক্ষেত্রে আমাদের মেনু হতো চিকেন খিচুরী। খাবারের কোনদিন সর্ট পড়তে শুনিনি। রোজার মাসে মুখরোচক সব ইফতারি তৈরী হতো। এমন হয়েছে আমরা স্পীডবোটে করে রিলিফ ওয়ার্ক করছি। চারিদিকে বন্যার অথৈ জলরাশি। দাঁড়ানোর জায়গা নেই। আমরা বোট বসেই ভাসতে ভাসতে খাওয়া সারছি। এমন হয়েছে এক একদিন আমাদের দশ বারোটি যায়গায় যেতে হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেরী হয়নি কখনো। সময়ের মূল্য বুঝতেন তিনি।

৮.   আমার মাধ্যমে মিডিয়ার সাথে তার চমৎকার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। জনসংযোগের চাকুরী বলে আমাকে সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতে হয়। আমার জন্য কাজটা সহজ ছিল। এজন্য যা কিছু করনীয় সবকিছু করার এক্তিয়ার আমার ছিল। এসব ব্যাপারে তিনি ছিলেন উদার। তিনি আমাকে কখনো কোন কিছুর জন্য প্রেসার ক্রিয়েট না করলেও আমি নিজে থেকেই একটা তাগিদ অনুভব করতাম। এই ঔচিত্তবোধ তিনিই আমার মধ্যে জাগরুক করে দিয়েছিলেন। তাই সবসময়ই আমি নতুন কিছু করার তাগিদ অনুভব করতাম। মানুষ তাকে জানুক এই ভাবনাটা আমার মধ্যে কাজ করতো। তার মতো মানুষ বড় প্রয়োজন আমাদের। এই লেখার মধ্যে অতিরিক্ত ভাবাবেগ কাজ করছে বলে মনে হতে পারে। কথাটা সত্য। আমি একটু আবেগপ্রবন।

সংবাদপত্রে তার সংবাদ ছাপা হতো প্রায় নিয়মিত। তিনি যে কভারেজ পেতেন অনেক মন্ত্রীও তা পেতেন না। এক একদিন এমন হয়েছে দশ বারোটি পত্রিকায় একসাথে তার একই সংবাদ ছাপা হয়েছে। সংবাদপত্র ছাড়াও রেডিও টেলিভিশনেও তার সংবাদ থাকতো। জনসংযোগের চাকুরী করলেও আমি বরাবর সংবাদপত্রের সাথে যুক্ত থেকেছি। লেখালেখি আমার প্যাশন। সাপ্তাহিক বিচিত্রা এবং সাপ্তাহিক ২০০০ আমার কাজের ক্ষেত্র। আমার প্রিয় শ্রদ্ধেয় সম্পাদক শাহদত চৌধুরী আজ আর নেই যার সাথে আমি প্রায় ২৩ বছর কাজ করেছি। মুন্নু সাহেবের সাথে তাদের একটা পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। শাহদত ভাইও আমার চাকুরীর জন্য তখন সুপারিশ করেছিলেন। সংবাদপত্রের সাথে জড়িত থাকা এবং জনসংযোগের চাকুরী দুটোই আমি একসাথ করতে পেরেছিলাম এজন্যে। ক্রিয়েটিভ কাজকে তিনি অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং উৎসাহ দিতেন।

শুধু সিনিয়র সাংবাদিক বা সম্পাদকই নয় জুনিয়ররা সাংবাদিকরাও তাকে পছন্দ করতেন। তার যেকোনো অনুষ্ঠানে ঢাকার সাংবাদিকরা হামেশাই যেতেন যারা সবাই প্রায় আমার বন্ধু ছিল। মানিকগঞ্জ প্রেস ক্লাব থেকে শুরু করে সাংবাদিকরা নানাভাবে উপকৃত হয়েছে। আমি নিজেই এটা করতাম দ্বায়িত্ব নিয়ে।

এছাড়া যে কোনো প্রয়োজনে মিডিয়া জগতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। একবার একজন স্পোর্টস জার্নলিস্ট মারা যাওয়ায় তার এক সন্তানের লেখাপড়ার জন্য এক বছরে ৬০ হজার টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এরকম ঘটনা অনেক আছে। সাংবাদিকদের প্রতি তার শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম। সিনিয়র সাংবাদিক, সম্পাদকরা তাকে খুবই পছন্দ করতেন। আমার প্রেসক্লাবের মেম্বারশিপ হয়েছিল তার সময়েই।

এ প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা উল্লেখ করছি। ১৯৯৭ সালের ঘটনা হবে। আওয়ামীলীগ তখন ক্ষমতায়। কিছু চক্রান্তকারী ধামরাইয়ে মুন্নু সিরামিকে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, লুটপাট করলো। মুন্নু  সাহেব তখন লন্ডন। এই ঘটনায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হলো দেশে বিদেশে। ওয়ার্ল্ডব্যাংক ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া জানাল। তার নির্দেশে সেদিন বিকেলেই আমরা প্রেস কনফারেন্স করলাম প্রেসক্লাবের ভি আই পি লাউঞ্জে। অভাবনীয় ব্যাপার ঘটলো। প্রায় আশিজন সাংবাদিক সেদিনের সেই কনফারেন্সে উপস্থিত হয়েছিল। সেদিন সাংবাদপত্র যেভাবে এই অন্যায়ের বিরোধিতা করেছিল তা বিস্ময়কর। শেয়ার কেলেংকারীর সময়ও আমরা প্রেসক্লাবে একবার প্রেস কনফারেন্স ডাকলাম। তখনও এমনই হয়েছিল।

৯.   আজকে যে মুন্নু শিল্প গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে তা একদিনে হয়নি। এই যে এক এক করে গড়ে উঠেছে মুন্নু সিরামিক বা মুন্নু ফেব্রিক্সের মতো বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান তার পিছনে রয়েছে তার দীর্ঘ দিনের শ্রম নিষ্ঠা আর পরিশ্রম। মুন্নু সাহেবকে ‘সেলফ্ মেইড ম্যান বলা হয়ে থাকে। মাত্র ৭৫ টাকা দিয়ে তিনি তার ব্যবসা জীবন শুরু করেন। মুন্নু আর্ট প্রেস তার জীবনের প্রথম নিজস্ব ব্যবসা। তারপর থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে তিনি ব্যবসার সাথে জড়িয়ে আছেন এবং একটার পর একটা শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। বিদেশে দেশের মুখ উজ্জল করছেন, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে হাজার হাজার মানুষের। তিনি যখন যে ব্যবসায়ই হাত দিয়েছেন সেটাতেই সোনা ফলিয়েছেন। তার দুরদর্শীতার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে।

তার শেয়ার হোল্ডাররা তাকে খুবই ভালোবাসতেন। দীর্ঘ একযুগ আমি তার কোম্পানীর প্রতিটা এনুয়াল জেনারেল মিটিং-এ থেকেছি। মিটিং শেষে দেখতাম সাধারণ শেয়ার হোল্ডাররা তার সাথে ছবি তোলার জন্য হুমরি খেয়ে পরতো। তিনি যে লভ্যাংশ দিতেন তাতে কখনো কোন শেয়ার হোল্ডারকে অসন্তোষ প্রকাশ করেতে দেখিনি। বরং শেয়ার হোল্ডাররা তাকে দোয়া করতো। তার কুশলী এন্টারপ্রেনারশীপের জন্য তারা ভূয়শী প্রশংসা করতো। এটা বাংলাদেশের প্রাইভেট সেক্টরে খুবই বিরল ঘটনা। বাংলাদেশের মন্ত্রীরা বিদেশে দেশের শিল্প বাণিজ্যের কথা উঠলে উদাহরণ হিসেবে মুন্নুর কথা বলে সবসময়।

তিনি একজন পরিশ্রমী মানুষ। কোন কিছুই তার সহজে অর্জিত হয়নি। একজন একক মানুষ হিসাবে তার অর্জন অসাধারণ। তিনি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। ছাত্র হিসাবেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী অর্জনের পর চাকুরীর দিকে না যেয়ে ব্যবসার প্রতি মনোনিবেশ করেন। শুরুর দিকে তাকে একাই সব কিছু করতে হয়েছে। তার মুখেই শুনেছি তিনি একটানা ষোল বছর প্রতিদিন আঠারো ঘন্টা কাজ করেছেন। পরিনত বয়সেও তিনি প্রতিদিন ষোল ঘন্টা করে কাজ করতেন। তাকে একজন তরুনের সাথে তুলনা করা যেত অনায়াসে। তারুন্যের সব উদ্যম তাঁর মধ্যে দেখতে পাওয়া যেত বৃদ্ধ বয়সেও। নিজের অফিস, রাজনীতি সবকিছুই চলতো সুচারু রুপে। শুধু শিল্প প্রতিষ্ঠানই নয় তিনি গড়ে তুলেছেন একাধিক স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদ, আশ্রয়কেন্দ্র।

এছাড়াও মানিকগঞ্জের এমন কোন এলাকা নেই যেখানে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদ্রাসা, ক্লাবে তার দানের স্পর্শ নেই। শুধু মানিকগঞ্জই নয় এর বাইরেও চট্টগ্রাম, বরিশাল, টাঙ্গাইলের বিভিন্ন যায়গায় তার দান রয়েছে। আমি নিজেও কয়েকবার আমার এলাকার মসজিদের জন্য তার কাছ থেকে ডোনেশন নিয়েছি। তার সাথে ঘুরেছি বিভিন্ন যায়গায়। হাজার হাজার মাইল পারি দিয়েছি তার সাথে। যেখানে ডাক পরেছে সেখানেই ছুটে গেছেন কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো রিক্সায়, কখনো হোন্ডার পিছনে চড়ে, কখনোবা নৌকায়। সংসদ সদস্য হিসাবে প্রতিবছর তিনি অনুদানের জন্য যা যা পেতেন তার প্রতিটি কনা সাহায্য হিসাবে দিয়ে দিতেন। এলাকার এমন কোন মসজিদ মাদ্রাসা বা ক্লাব নেই যেটা একাধিকবার অনুদান পায়নি। এমন কোন গরীব মানুষ ্েনই যে খালি হাতে ফিরেছে। বাই রোটেশন করে অনুদান দেয়া হতো। একচোখা কোন নীতি পছন্দ করতেন না। সমবন্টনের নীতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন।

তার মধ্যে অনেক সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ব্যাপার আমি দেখেছি, দেখে বিমোহিত হয়েছি। আজকের দিনে মানুষ কিভাবে নিজেকে এতটা পারফেক্ট রাখতে পারে তা ভেবে অবাক হয়েছি। তিনি কোরাণ স্ন্নুাহ্ মাফিক চলার চেষ্টা করতেন। মানুষকে কোন ভাবেই ঠকানোর কথা তিনি ভাবতে পারেতেন না। তার সাথে যারা ব্যবসা করেন তারাও থাকেন সন্তুষ্ট কারণ তাদের পাওনা চেক পেতে কোনদিন দেরী হয়নি। আমার বারো বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি কোনদিন আমাদের বেতন পেতে একদিনও দেরী হয়নি। যদি কখনো মাসের ১ তারিখ অফিস বন্ধ থাকতো তাহলে আগের দিন বেতন দিয়ে দেওয়া হতো। এই নিয়ম আজ চল্লিশ বছর ধরে চলছে। কোন দুর্বিপাকেও এর অন্যথা হয়নি।

আমাদের মন্ত্রী, এমপিদের লাখ লাখ টাকা টেলিফোন বিল আজও পাওনা আছে। তারা মনে করে এটা তাদের না দিলেও চলে। জনগনের পয়সায় ফুর্তি করতে তারা আনন্দ পায়। কিন্তু তিনি এসব অনিয়মকে অপছন্দ করতেন। তার সংসদ সদস্য হিসাবে টেলিফোন বিল দিতে কখনো একদিনও দেরী হয়নি। তিনি কোন দিন ডিফলন্টার হননি। আমাদের প্রতি কড়া নির্দেশ ছিল এসব ব্যাপারে সচেতন থাকার।

এজন্যে যে কোন কাজ আমরা সহজে করতে পেরেছি। আমাদের কখনো কোন কিছুর জন্য প্রভাব খাটাতে হয়নি। মানুষ তার নাম শুনেই কাজ করে দিত। আমরা গর্ববোধ করতাম যখন কোন সরকারী অফিসে ঘুষ ছাড়াই আমাদের কাজ হয়ে যেতো। যখন যেখানে গিয়েছি তার প্রতি মানুষের মধ্যে শ্রদ্ধা দেখেছি। আমরাও যথেষ্ট গুরুত্ব পেতাম। এলাকার কাজের জন্য আমাকে নানা যায়গায় যেতে হতো। প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে শুরু করে মন্ত্রী, এমপি, ডিসি, টিএনও সর্বত্রই তার সততার জন্য আমাদের গুরুত্ব দেয়া হতো। আমি খুবই এনজয় করতাম এসব। গভীর জীবনবোধ, মানবিক গুনাবলী, ন্যায়পরনতা এবং সততার জন্যই তিনি এভাবে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পেরেছেন।

১০.   রাজনীতিবিদ হিসাবেও তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি আর দশজন তথাকথিত রাজনীতিবিদদের মতো ছিলেন না। রাজনৈতিক বেশ্যাপনাকে তিনি মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন। এজন্যে তার সাথে অনেক তথাকথিত ডাকসাঁইটে রজানীতিকের বনিবনা হতোনা। আদর্শের লড়াইয়ে অনেকের সাথেই তার ফাইট হতে দেখেছি। একবার একজন ডাকসাইটে রাজনীতিবিদ ও মন্ত্রী তার নির্বাচনের খরচের জন্য তার কাছে পঁচিশ লাখ টাকা চাইলেন। সেই রাজনীতিবিদ একজন ধনী মানুষ। টাকা তিনি তাকে দেননি। তিনি বলতেন ‘আমি টাকা তাকেই দেই যার নেই। তিনি বলতেন, ‘যার আছে তাকে দেয়াতো অন্যায়। এই ধরণের আদর্শের লড়াই তাকে প্রতি নিয়ত করতে হয়েছে।

রাজনীতিকে পূঁজি করে ফায়দা লোটার বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি।। তিনি রাজনীতি করেছেন জনগণের জন্য। রাজনীতি তাকে কিছুই দিতে পারেনি বরং তিনি দিয়েছেন অনেক। তিনি একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক। দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে যারা কাজ করে তাদের সাথে তিনি কখনো ছিলেন না। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নিলেও মুক্তিযোদ্ধাদের নানা ভাবে সাহায্য করেছেন। এ কথা ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম সহ অনেকেই জানেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তার অসীম শ্রদ্ধা দেখেছি। তিনি যখনই সুযোগ পান তাদের জন্য করেন। মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের তিনি মনে প্রানে ঘৃণা করতেন। তিনি তার নীতি থেকে কখনো বিচ্যুত হননি।

বিভন্ন সময় বিভিন্ন দলের রাজনীতিবিদদের তার স্মরানাপন্ন হতে দেখেছি। তিনি চেষ্টা করেছেন তাদের সহযোগিতা করার। বিরোধী রাজনীতির প্রতি তিনি কখনো প্রতিহিংসাপরায়ন ছিলেন না। আমি দেখেছি তার দল যখন ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তিনি কখনো বিরোধীদের প্রতি কোন শাস্তিমূলক কিছু করেন নি অথচ তারাই যখন ক্ষমতায় ছিল তার দলের প্রতি প্রতিহিংসা পরায়ন ছিল। তার কর্মীদের তিনি নিরুৎসাহিত করেছেন প্রতিহিংসাপরায়ন হতে। এজন্য বিরোধীরাও তার মহানুভবতায় মুগ্ধ হতো। যদিও বাংলাদেশের রাজনীতি প্রতিহিংসার রাজনীতি। ঘৃণার রাজনীতি। তিনি করেছেন

উল্টো। এজন্যেই অনেককে বলতে শুনেছি মুন্নু সাহেব রাজনীতি বোঝেনা। তিনি তখন বলতেন, ‘ওই রাজনীতি আমি বুঝতেও চাইনা যে রাজনীতি ঘৃণার আর প্রতিহিংসার। যে রাজনীতি মানুষকে কষ্ট দেয় সে রাজনীতি আমি করতে চাইনা। রাজনীতি আমার ব্যবসা না। এজন্যেই আমি প্রতিষ্ঠিত হয়ে রাজনীতিতে এসেছি। অন্য অনেকের মতো রাজনীতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়নি’।

রাজনীতিকদের হঠকারীতার কথা তিনি সব সময় বলতেন। ‘তারা জনসভায় দাঁড়িয়ে যা বলে তা বিশ্বাস করেনা। বলে একটা করে আরেকটা। পার্লামেন্টের মতো প্রবিত্র জায়গায় দাঁড়িয়েও তারা মিথ্যে বলে’। তাকে পার্লামেন্টে সবসময় জনগনের কথা বলছেন। এলাকার উন্নয়নের কথা বলছেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘দেখবে কোন রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়েরাই দেশে পড়াশুনা করেনা। সাধারণ মানুষেরা সন্তানেরা আন্দোলন করে গুলি খায় আর তারা তার ফল ভোগ করে। আমরা তাদের ব্যবহার করে ক্ষমতায় গিয়ে ছুড়ে ফেলে দেই’। তিনি সবরকম অসততার বিরুদ্ধে ছিলেন। এই নিয়ে তার মধ্যে অনেক যন্ত্রনা ছিল। তিনি বলতেন ‘আমার জীবন দিয়ে হলেও যদি দেশটাকে ভালো করা যেতো তাহলে তাই করতাম। কিন্তু সেটা তো হচ্ছেনা’।

তাকে রাজনীতিতে প্রথম থেকেই নিজদলীয় কতিপয় রাজনীতিকদের বিরোধীতা মোকাবেলা করে চলতে হয়েছে। তিনি রাজনীতিতে আসেন এটা কেউ কেউ চায়নি। কারণ তার মতো সৎ লোক রাজনীতিতে এলে কারো কারো জন্য অসুবিধা হয়ে যায়। তারা তার বিরোধিতা করতে থাকে। এ নিয়ে তাকে অনেকবার বিরোধে জড়ানো হয়েছে। তিনি সাহসিকতার সাথে সব মোকাবেলা করেছেন। এসবের সুযোগও নিয়েছে অনেকে। বিরোধিতায় ইন্ধন যুগিয়ে অনেকেই ফায়দা লুটতে চেয়েছে। সেটা উপর থেকে নিচ পর্যন্ত।

রাজনীতির কূট কৌশল তিনি প্রথম প্রথম ভালো বুঝতেন না। এটার সুযোগ নিয়েছে অনেকে। তিনি সবসময় সহাবস্থান চাইতেন। কোন ঝগড়াঝাটি না করে সম্মিলিতভাবে এলাকার উন্নয়ন চাইতেন। কিন্তু সেটা বার বার বাধাগ্রস্থ হয়েছে। অনেক সমস্যা মোকাবিলা করে তাকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেতে হয়েছে। এক্ষেত্রে মানুষের স্বার্থপরতা দেখে তিনি হতবাক হতেন। শুধু জনগনের ভালোবাসাই ছিল তার সম্বল। যে কোন দুর্যোগে জনগণই তার পাশে থেকেছে।

রাজনীতির পুরষ্কার তিনি পেয়েছেন। তবে তার যোগ্যতা ছিল অন্য অনেকের চেয়ে বেশী। আমাদের দেশে ভালো লোকের মূল্যায়ন হয় কম। সততার তেমন কোন দাম নেই। তারপরও তিনি প্রতিবার এমপি হয়েছেন, দলের জেলা সভাপতি হয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন। ২০০১ এ তিনি মানিকগঞ্জের দুটো আসন থেকে নির্বাচিত হন। এরপর মন্ত্রী হন। আমার মনে আছে যেদিন মন্ত্রীসভার শপথ হয় সেদিন তার সাথে আমি বঙ্গভবন গিয়েছিলাম। সেটাও একটা স্মরনীয় মুহুর্ত বৈকি। মন্ত্রী হওয়ার পর দেখেছি তার বিনয়। তিনি সর্বান্তকরনে চেষ্টা করেছেন কিছু করার। এক্ষেত্রেও তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। তাকে কাজ করতে বাধা দিয়েছে স্বার্থান্বেষীরা। কিন্তু তিনি কখনো তার আদর্শ বিসর্জন দেননি। কারো কাছে মাথাও নত করেননি। এটাই তার বৈশিষ্ট। এটাই তাকে ভিন্ন মানুষে পরিণত করেছে।

১১.   তিনি একজন মিষ্টভাষী মানুষ। কথা বলেন যুক্তি দিয়ে। যুক্তিতে তাকে কেউ হারাতে পারতো না। মিথ্যেকে তিনি অপছন্দ করেন। তিনি যখন অলোচনার টেবিলে বসেন বা জনসভায় বক্তৃতা করেন তখন মানুষ তার কথা শুনতো মন্ত্রমুগ্ধের মতো। বড় বড় আমলাদের তার জীবনদর্শন বা তার সততায় মুগ্ধ হয়ে যেতে দেখেছি। জনসভায় তিনি কোনদিন লিখিত বক্তৃতা বলতেন না। যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলার এক অসাধারণ ক্ষমতা তার ছিল। তিনি কখনো হারতে শেখেন নি। পরাজয় কাকে বলে তার অভিধানে নেই। এজন্যই তিনি যেকোন কাজে সফল হয়েছেন।

বিদেশীরাও তাকে খুব সম্মানের চেখে দেখতো। বিদেশী ডেলিগেট বা বাংলাদেশে বিদেশী এম্বাসাডররা যখন তার আতিথ্য গ্রহণ করতেন বা তার ফ্যাক্টরী ভিজিটে আসতেন তখন দেখতাম তাদের চোখে মুখে মুগ্ধতার ছাপ। বাংলাদেশে যে এত সুন্দর করে ফ্যাক্টরী পরিচালনা করা সম্ভব এটা দেখে তারা মুগ্ধ হতেন। একবার আমেরিকা, সুইডেন, স্পেন সহ বেশ কয়েকটি দেশের এম্বাসাডররা এলেন মুন্নু সিরামিকের ফ্যাক্টরী ভিজিটে। আমিও সেদিন উপস্থিত ছিলাম। ভিজিট শেষে এক ব্রিফিং-এ তারা মুন্নু সিরামিক ফ্যাক্টরীর পরিবেশকে একটি ফুলের বাগানের সাথে তুলনা করলেন।

তিনি একজন প্রকৃতি প্রেমিকও বটে। তার নিজস্ব বাসভবন, ফ্যাক্টরী প্রাঙ্গন সর্বত্রই এমন একটা পরিবেশ তৈরী করেছেন যে, যে যখনই এসেছে মুগ্ধ হয়েছে। চারিদিকে গাছ গাছালি আর বাহারি ফুলের সমাবেশ ঘটাতেন সর্বত্র। অনেকের মুখেই এসবের প্রশংসা শোনা যেতো। একজন সম্পূর্ণ মানুষের সবগুলি গুনাবলীই তার মধ্যে আমি খুঁজে পাই। রুচিশীল আর পরিমিতবোধের মানুষ পৃথিবীতে জন্মায় অল্প। যে অল্প কয়েকজন মানুষ আছেন তিনিও তাদের একজন। তার সব কিছুতেই রয়েছে সৌন্দর্য্যের এক অপরূপ সমন্বয়। তার পোশাক পরিচ্ছদ, চলা ফেরা সবকিছুতে রুচির ছাপ রয়েছে। টাকা হলেই সবাই রুচিশীল হতে পারেনা, হতে পরেনা আধুনিক মানুষ। তিনি আপদমস্তক একজন আধুনিক মনের মানুষ। কোন ধরণের কুসংস্কার বা ধর্মান্ধতা নেই তার মধ্যে। ধর্মভীরু মানুষ হয়েও তার মধ্যে আধুনিকতার ছোঁয়া সর্বত্র।

তিনি সংস্কৃতি মনস্ক মানুষ। পড়াশুনার প্রতি প্রবল ঝোঁক। এজন্য তার স্টাডি রুমে গড়ে তুলেছিলেন বইয়ের লাইব্রেরী। সেখানে নানা ধরনের বইয়ের সংগ্রহ ছিল। যেকোন কালচারাল অনুষ্ঠানে আগ্রহ নিয়ে যেতেন। যারা ভালো পারফর্ম করতো তাদের উৎসাহ দিতেন এবং পুরস্কৃত করতেন। সংগীতের প্রতিও ঝোঁক ছিল। ব্যস্ততার মধ্যেও যখন গাড়িতে যেতেন পুরনো দিনের গান শুনেন। ভালো ভালো বিশেষ করে পলিটিকাল ছবি দেখেন।

তার জীবন যাপন খুবই ডিসিপ্লিন্ড। সাধারণত: তিনি আর্লি ঘুমান এবং আর্লি জাগেন। এই নিয়মের ব্যতিক্রম বেশী ঘটতে দেখিনি। সময়মত খাওয়া দাওয়াও তার নিয়মের একটি। খাওয়া দাওয়ায় তিনি অত্যন্ত পরিমিত। স্বল্পাহারী। বাঙ্গালী খাবারই তার পছন্দের। তার ফ্যাক্টরী প্রাঙ্গনে সব ধরণের সব্জী এবং পুকুরে মাছের চাষ হয়। ঝাল জাতীয় খাবার তার পছন্দের। দেশীয় পিঠা পায়েস এগুলো তিনি পছন্দ করেন। একজন প্রকৃত বাঙ্গালীর সবগুলো গুনাবলীই তার মধ্যে দেখতে পেতাম আমি। ঘরে তিনি সবসময় সাদা পাজমা- পাঞ্জাবী পরিধান করতেন। অফিসে স্যুট। মনে আছে একদিন হঠাৎ লন্ডন থেকে তার ফোন। তিনি জানতে চাইলেন আমার জন্য কি আনবেন। আমি খুবই বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। এরকম ঘটনা অনেক আছে। শুধু আমিই নই তিনি যাদেরকে পছন্দ করতেন তাদের এসব জন্যই করতেন। তিনি সবসময় বলতেন ‘দেয়ার মধ্যে যে আনন্দ তার কোন তুলনা হয়না’। তিনি যা কিছু করতেন নি:স্বার্থভাবেই করতেন। তিনি কোনদিন বিনিময় প্রত্যাশী ছিলেন না। তিনি ঋণী হতে পছন্দ করতেন না।

১২.  আমার কাছে শিল্পপতি মুন্নুর চেয়ে মানুষ মুন্নু অনেক বড় ছিল। আমার এই লেখার মাধ্যমেও মানুষ মুন্নুকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। সবটুকু হয়ত পারিনি। ব্যক্তিগতভাবে আমি উচ্চাভিলাষী নই। টাকা পয়সার প্রতি আমার কোন লোভ নেই। সুন্দরভাবে বেঁচে থাকাটাই আমার কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। আমি তাকে শ্রদ্ধা করতাম যতটা না ‘বস’ হিসাবে তার চেয়েও বেশী মানুষ হিসাবে। এজন্য আমাদের মধ্যে চমৎকার একটা বোঝাপড়ার সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। তিনি কি চান সেটা যেমন আমি বুঝতে চেষ্টা করতাম তেমনি তিনিও আমাকে কাজ করার সুযোগ দিতেন। কাজ করার স্বধীনতা আমার ছিল। আমাকে তিনি বুঝতে পারতেন বলে আমার বিশ্বাস ছিল।

আজকে এতদিন পর এই লেখা লিখছি একটা তাগিদ থেকে। মনের তাগিদ। না হলে কত জন আসে কত জন চলে যায়, এটাই পৃথিবীর নিয়ম, এটাই বাস্তবতা। আমি নিজেও প্রবাসী। আমারও ব্যস্ত জীবন। আমি আমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় তার সাথে পার করেছি, ক্যারিয়ার গড়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল সময়টা। আমার সময়কালটাকে ‘আনন্দ-বেদনার কাব্যে’র সাথে তুলনা করা যায়। তার সাথে আমার সান্নিধ্যের সময়টাকে আমি আনন্দের সময় হিসাবে দেখি। বাকী সময়টাকে আনন্দ ও বেদনার মিশ্রণ।

আগেই বলেছি মানুষকে খুশী করা পৃথিবীর কঠিন কাজের একটি। সেই কাজটিই আমাকে করতে হতো সবসময়। মুন্নু সাহেবের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে যেয়ে কখনো কখনো আমাকে রুঢ় হতে হয়েছে, যেটা ছিল আমার স্বভাবের বিরুদ্ধ। তাই সব মানুষকে আমি খুশী করতে পারিনি। আমি দেখেছি মানুষের চাওয়ার কোন শেষ নেই। তিনি যেমন দিতেন অকাতরে তেমনি মানুষের চাহিদাও বেড়ে গিয়েছিল কয়েকগুন।

আমার সম্পর্কে তার কাছে মাঝে মাঝে অভিযোগ যেতো। মুন্নু সাহেব এই নিয়ে আমাকে তেমন কিছু বলেন নি। কারণ তিনি মনুষ্য চরিত্র ভালোই জানতেন। তিনি বলতেন ‘আমি যে এত করছি আমাকেও কতজন কত কি বলে’! তখন আমি মনে জোর পেতাম। আমার পরিস্থিতি তিনি বুঝতে পারতেন। আমি অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করতাম এটাই সম্ভবত আমার ক্রটি হিসাবে দেখা হতো। এসব কারণে আমার মানসিক শান্তির বিপর্যয় ঘটেছিল। আমি সহজে অন্যায়ের সাথে আপস করতে চাইতাম না। আমি কখনও কোনো সুবিধাও নেইনি। এই অঞ্চলের মানুষের প্রতি আমার একটা মমতা জন্মে গিয়েছিল। মানিকগঞ্জের প্রতিটা ধুলিকনার সাথে আমি মিশে গিয়েছিলাম। সাধারণ মানুষেরা আমাকে ভালোবাসতো। আমি যখন চাকুরি ছেড়ে দেই তাদের অনেকের চোখে আমি পানি দেখেছি।

যাইহোক মানুষতো আর ফেরেশতা না। দোষে গুনে মানুষ। দিন ছাড়া যেমন রাত্রি ভালো লাগেনা বা অন্ধকার ছাড়া আলো তেমনি মানুষও ক্রুটিমুক্ত নয়। মুন্নু সাহেবের মানবিক গুনাবলী ছিল এতবেশী যে ছোট খাট ক্রটি চোখ এড়িয়ে যেতো; যেটা কারো জন্য ক্ষতির কারণ হয়নি। তিনি একটু জেদী ছিলেন বটে কিন্তু সেটা আদর্শগত কারণে। সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে যেয়ে সহজে আপসের রাস্তায় হাঁটেননি। পূর্বাপর ফলাফলের তোয়াক্কা করেননি। তার নিজস্ব বিশ্বাস থেকে তাকে সহজে ফেরানো যায়নি। তাকে দিয়ে কোন অন্যায় কাজ করানো যায়নি। আমার সম্পর্কে কত কথা শুনতে হয়েছে তাকে, তারপরও তিনি কোনদিন তেমন আমলে নেননি। আমি চাকুরী ছেড়ে দেই এটাও চাননি। বরং বলেছিলেন, ‘আমি যতদিন আছি তুমিও থাকবে’। তিন এরকমই মানুষ।

তিনি যখন একা থাকতেন তখন মন খুলে অনেক কথা বলতেন। মাঝে মাঝে শিশুর মতো হয়ে যেতেন। মনে হতো তাকে বোধহয় চিনি না। আবেগপ্রবন এক মানুষ। এই রূপ দেখার ভাগ্য সবার হয়না। সবসময় গাম্ভীর্যের খোলসে নিজেকে বন্দী রাখা যায় না। একদিন তিনি আমাকে বললেন, ‘আচ্ছা জসিম, আমি এত টাকা দিয়ে কি করবো! একজন মানুষের আর কত লাগে’! এই ধরনের কথা কেউ বলতে পারে আমি কল্পানাও করতে পারিনা। আমি উত্তরে বল্লাম, আপনিতো মানুষের জন্য অনেক করছেন, আরো করেন।

সেটা ছিল ১৯৯৬ সাল। অসহযোগ আন্দোলন চলছে। আমি প্রতিদিন মহাখালী থেকে ধানমন্ডি আসি পায়ে হেঁটে। কোন কাজকর্ম নেই। সব স্থবির। দু’জনে বসে বসে যত রাজ্যের কথা বলি। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হয়। দেশ নিয়ে তিনি সারাক্ষণ অস্থির থাকতেন। প্রায় একমাস একরকম অস্থিরতা ছিল দেশ জুড়ে। এই সময়টায় তাকে অনেক কাছ থেকে দেখেছি। মাঝে মাঝে যখন হরতাল হতো বা শ্যামলী অফিসে তিনি প্রায়ই আগে ভাগে চলে আসতেন, আমরা দু’জন বসে কথা বলতাম বা কথা ছাড়াই নীরবে সময় পার হতো।

একজন মানুষ কখনো কখনো মন্ত্রী, এমপি বা শিল্পপতি ছাড়াও সে একজন শুধুই মানুষ। সেই মানুষটিকে আমি দেখেছিলাম। তিনি চির জাগরুক থাকুন মানুষের অন্তরে এবং মৃত্যুর পরও যুগে যুগে।

জীবানন্দের ভাষায় বলতে হয়-

“আমি চলে যাব, তবু সমুদ্রের ভাষা

র’য়ে যাবে, তোমার পিপাসা

ফুরাবে না, পৃথিবীর ধূলো, মাটি তৃণ

রহিবে তোমার তরে, রাত্রি আর দিন।

র’য়ে যাবে, র’য়ে যাবে তোমার শরীর-

আর এই পৃথিবীর মানুষের ভীড়।”

জসিম মল্লিক

টরন্টো / jasim.mallik@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *