ইরানে বেশি সংখ্যক নারীকে কেন মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়?
২০০০ সাল থেকে পরবর্তী ২২ বছরে কমপক্ষে ২৩৩ জন নারীর মৃত্যুদণ্ডের কার্যকর করা হয়েছে
৪ অগাস্ট ২০২২ : অধিকার কর্মীদের মতে, ইরানে মৃত্যুদণ্ডের উন্মাদনা চলছে।
“খুনের জন্য ইরানে কোন কারাদণ্ড নেই। যে নিয়ম আছে সেটা হলো, হয় আপনাকে ক্ষমা করা হবে অথবা মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে,” এ কথা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ইরানিয়ান মানবাধিকার সংগঠন আব্দর রহমান বোরোমান্ড সেন্টারের নির্বাহি পরিচালক রয়া বোরোমান্ড।
তবে ইরানের চেয়ে বেশি যেসব দেশে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় সেখানেও এতো বেশি সংখ্যক নারীর মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়না বলে তথ্য দিচ্ছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। গত ৪ অগাস্ট বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের এক সংবাদে এ তথ্য তুলে ধরা হয়।
প্রাপ্ত তথ্য জানা যায়, গত জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহেই অন্তত ৩২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে ইরানে এবং এর মধ্যে তিন জন নারীও আছে। এসব নারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো তারা তাদের স্বামীকে হত্যা করেছেন।
বিবিসি আরো জানায়, আব্দর রহমান বোরোমান্ড সেন্টারের হিসেবে, গত সপ্তাহে খুন হওয়া তিন নারী ছাড়াও আরও ছয় নারীর মৃত্যুদণ্ড হয়েছে বছরের প্রথম ছয় মাসে।
এটা সত্যি যে মৃত্যুদণ্ড যাদের দেয়া হয়, তাদের বড় অংশই পুরুষ। কিন্তু এই ৯ নারী সেই সংখ্যাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
বোরোমান্ডের হিসাব অনুযায়ী ২০০০ সাল থেকে পরবর্তী ২২ বছরে কমপক্ষে ২৩৩ জন নারীর মৃত্যুদণ্ডের কার্যকর করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০৬ জনকে খুনের দায়ে আর ৯৬ জন অবৈধ মাদক সংক্রান্ত অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।
ইরানে বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্কের বিরুদ্ধে কঠোর আইন রয়েছে। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত মহিলাদের একটি ক্ষুদ্র অংশকে বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্কের কারণে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে বলেও মনে করা হয়।
বোরোমান্ডের মতে, মৃতুদন্ডের মাত্র পনের শতাংশের ঘটনা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়। বাকীটা অন্য রাজনৈতিক বন্দী কিংবা সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ফাঁস হওয়া তথ্য থেকে জানা যায়।
দেশটির আইনি প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করতে পারেনা। তবে একমাত্র ভিকটিমের পরিবার পারে কাউকে ক্ষমা করতে।
ইরানে অধিকারকর্মী হিসেবে কাজ করার অপরাধে আতেনা দায়েমি নামের একজনকে সাত বছর কারাগারে কাটাতে হয়েছিলো। তিনি বিবিসিকে জানান, নারীরা বন্দি থাকার সময় মৌলিক সুবিধা কম পান এবং অনেক সময় তাদের প্রহার করা হয়। তিনি আরো বলেন, কোর্ট প্রসিডিংসও অনেক সময় নারীর বিরুদ্ধে থাকে কারণ বিচারক ও আইনজীবীরা প্রায় সবাই পুরুষ।
ইরানের আদালতে আসামিকে একজন আইনজীবী দেয়া হয়। তবে তারা খুব একটা আইনি সহায়তা দেন না বলে বলছেন দায়েমি।
বর্তমানে নরওয়েতে বসবাসকারী ইরানের সাংবাদিক আসিয়ে আমিনি বিবিসিকে বলেন ইরানের আদালত থেকে বিবাহ বিচ্ছেদ পাওয়া বলতে গেলে অসম্ভব। তিনি আরও বলেন, নারীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে এমন কিছু মামলা তিনি খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন । তার মতে, দেশটির আইনি কাঠামোই সমস্যার মূল কারণ।
“দেশটির আইন অনুযায়ী বাবা বা দাদা পরিবারের প্রধান। তারাই বিয়ে সহ নারীদের যে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন ” আর এর মানে হলো এই নারীকে জোর করা হতে পারে বা তিনি পারিবারিক সহিংসতার শিকার হতে পারেন।
যেসব নারীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, প্রায়শই তারা অভিভাবকের সমর্থন হারান। কারণ অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন থাকেন ‘পরিবারের সম্মান’ নিয়ে।
এই অবস্থায় কিছু নারী সহিংসতার শিকার হতেই থাকেন, বলছিলেন আমিনি।
আর কিছু ক্ষেত্রে নারীরা তখন স্বামীদের হত্যার চিন্তা করেন।
আদালতে অনেক ক্ষেত্রে নারীরা স্বীকার করেছেন যে তারা খুন করেছেন বা খুনের সহায়তা করেছেন। কিন্তু তারা সবাই এটাও বলেছেন যে সহিংসতার বিরুদ্ধে তাদের কেউ সহায়তা করলে তারা এ ধরণের অপরাধ করতেন না।
ইরানের আইনী কাঠামো এতটাই পুরষবন্ধব যে, একবার দেখা গেছে ধর্ষণের শিকার এক কিশোরীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। বিচার পাওয়ার পরিবর্তে এই কিশোরীর বিরুদ্ধে বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্কের অভিযোগ আনা হয়েছিল এবং বিচারক নিজেই ওই কিশোরীর গলায় রশি পরিয়ে দেন।
বিবিসির খবরে বলা হয়, মৃত্যুদণ্ড বিরোধী অধিকার কর্মী নারগেজ মোহাম্মদী একটি ভিডিও পোস্ট করেছিলেন যেখানে তিনি মৃত্যুদণ্ডের বর্ণনা দিয়েছিলেন । ওতে বলা হয়, সেখানে দণ্ড প্রাপ্ত নারীর পুত্র তার মায়ের মৃত্যুদন্ডের সময় পায়ের নীচে থাকা টুল লাথি দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিলেন। – সূত্র : স্বামীনাথান নটরাজন / বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস