“এ হাউজ নিয়ার গ্রেভইয়ার্ড”

জুলাই ১৭, ২০১৯

সালাহ উদ্দিন শৈবাল

বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আলো মরে গেছে। কিন্তু পুরোটা যায়নি। মায়া মায়া একটা আভা ছড়িয়ে আছে। বিছিয়ে আছে শহরের পথে পথে। আজকে তেমন ঠান্ডা ছিলো না। টরন্টোতে রোদ-বৃষ্টি এক সংগেই চলেছে সারাদিন। পালা করে। কিন্তু বাতাস ছিলো খুব বেশি। এখনো খুব একটা কমেনি বলেই মনে হচ্ছে। আমি গাড়ীতে বসেই টের পাচ্ছি। চলতি গাড়ীর জানালা-দরজা বন্ধ। তবু ঝাপটা টের পাচ্ছি।

হঠাৎ সাইড রোডটা নজড়ে পড়ল। কোন কারণ নেই। কোন বিশেষত্ব নেই। তবু চোখে পড়ল। এক লেনের বাঁকানো রাস্তা ভেতরে ঢুকে গেছে। আমার গাড়ীর গতি কমে গেলে। কেন জানি না মনে হলো মেইন রোড ছেড়ে….বাড়ীর ফেরার পথ ছেড়ে…ঢুকে যাই।

জানি না কোথায় গেছে পথটা। মোড়ে রাস্তার নাম লেখা আছে। অচেনা রাস্তার নামে কিবা আসে যায়।

আমি গাড়ী ঘুরিয়ে সরু পথে ঢুকে গেলাম। বিকেলের শেষ রোদে ঝিমিয়ে পড়া…নিরিবিলি লোকালয়। সারি সারি একতলা বাংলো রাস্তার দুইপাশে। সামনে এক ফালি করে বাগান আছে। সবুজ ঘাস আছে। ফুল ফুটেছে। মানুষ জন নেই! একজনও দেখা যাচ্ছে না। এই রকমই থাকে টরন্টোর নিরিবিলি নেইবারহুডগুলো। আমি ২০ কি.মি গতিতে গাড়ী চালাচ্ছি। রাস্তায় আর কোন গাড়ী নেই। মনে হচ্ছে গতি বাড়ালে এলাকার ঘুম ভেঙ্গে যাবে।

দুইবার বাঁক নিলো রাস্তা এবং শেষ বাঁকের পর আমার জন্য বিস্ময় উন্মোচিত হলো। পাকা রাস্তা শেষে হয়ে গেছে। অন্ধ গলি। সামনে একটু ঘাস….তারপর নুড়ি বিছানো পায়ে হাঁটা পথ শুরু। সেই পথ যে লোহার গেইট দিয়ে ঢুকে গেছে তার ওপাশে সারি সারি কবর!!

আমাকে এই ভর সন্ধ্যা বেলা ঘোরের মধ্যে টেনে আনা এই বিজন পথ শেষ হয়েছে একটা বিরাট কবরস্থানের মুখে এসে।

গাড়ী রাস্তার পাশে পার্ক করে নামতে হলো। শুধু কবরস্থান হলে আমি নামতাম না। গাড়ী ঘুরিয়ে চলে যেতাম। কিন্তু কবরস্থানের গা ঘেঁষে….গ্রেইভ ইয়ার্ডের ঠিক বাউন্ডারীর বাইরে অদ্ভুত সুন্দর একটা একতলা বাংলো। সামনে বাগান। ফুলে ফুলে ভরে আছে। জানালায় রংগিন পর্দা। দুলছে। যেন বিশাল এক মৃত এলাকার পাশে কি সগৌরবে দাড়িয়ে থাকা জীবন্ত এক প্রতিবাদ! আমাকে নামতে হলো।

হঠাৎ পেছনের উঠোন থেকে দুজন ঝকঝকে কিশোরী দৌড়ে বেরুলো। আমাকে দেখে একটু থমকালো। তারপর ‘হ্যালো’ বলে বাসার ভেতরে ঢুকে গেলে।

“তুমি আসলে কি দেখতে এসেছো? Graveyard নাকি a house near the graveyard?” ছবি : লেখক

পেছনে মাঝ বয়সী এক মহিলা। হাসিখুশী। বোঝা গেল এরা এই ‘ব্যতিক্রমী’ বাড়ীর বাসিন্দা। আমার কথা বলতে ইচ্ছে হলো।

অপরিচিত কারো সংগে কথা শুরু করতে আমার ঠিক এক মিনিট লাগে। অন্য পক্ষের উৎসাহ দেখলে সেটা অনেকক্ষন চালাতে পারি। আবার উৎসাহ কম দেখলে দ্রুত শেষ করতে পারি।

মহিলার সংগে কথা হলো। মহিলা ভেবেছিলেন আমি কোন কবরে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি। আমি শুধু বেড়াতে এসেছি শুনে…মজা করে বললেন..“তুমি আসলে কি দেখতে এসেছো? Graveyard নাকি a house near the graveyard?”

আমি হেসে দিলাম।

“দুইটাই।…না আসলে….একটা…তোমার বাড়ী…..Graveyard দেখার ইচ্ছা আজকে আর নাই।“

মহিলা আসলেই মিশুক। আমার কথা শুনে কফির আমন্ত্রণ জানালেন। আমরা বাড়ীর বারান্দায় চেয়ারে বসলাম। আমিসহ মোট চারজন। মহিলার দুই মেয়ে এসে জুঁটেছে। তার স্বামী তখনো ফেরেনি।

বারান্দা থেকে কবরস্থানের গেইট…কবর…পরিষ্কার দেখা যায়। সেখানে ততক্ষনে রাত নেমে গেছে। সরকারী বাতি জ্বলে উঠেছে।

ভদ্র মহিলা কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন…“বলো কি জানতে চাও?…..আমি জানি তোমার প্রথম কৌতুহল হলো….আমরা ভুত দেখি কিনা? তাই না?” বলেই সবাই এক সংগে হাসতে লাগলো। কিশোরী দুইজন খুব মজা করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

মহিলা শুরু করলেন-

“নাহ্‌….এই বাসায় আমরা আছি পাঁচ বছর…কোন ভুত দেখাতো দূরের কথা…কোন অলৌকিক শব্দ…হটাৎ দরজা-জানালা বন্ধ হয়ে যাওয়া…সিনেমায় যেমন দেখায়..তেমন কিছুই ঘটেনি…। আমরা বিকেলে বিকেলে সপরিবারে পার্কের পরিবর্তে ঐ কবরস্থানে হাঁটতে যাই। বাচ্চারা খেলে। কোন রহস্য নেই। কি তুমি হতাশ হলে?”

আমিও হেসে দিলাম। “আরে নাহ্‌….আমি ঠিক ভুত বা অশরীরির কথা ভেবে কৌতুহলী হইনি।…সবাইতো আর কবরস্থানের পাশে থাকে না…তাই ভাবলাম..একটু শুনি তোমাদের গল্প।“

“ঠিক বলেছো। আমরা এই বাড়ীটা সেই জন্যই কিনতে পেরেছিলাম। গোরস্থানের পাশের বাসাগুলোর দাম কম হয়। জানো তো? সবাই কিনতে চায় না। আমিও বেশ কম দামেই কিনেছিলাম। এরচেয়ে বেশি টাকা আমাদের ছিল না। প্রথম প্রথম অস্বস্থি হতো। এখন হয় না। সত্যি বলছি। খুব শান্ত এলাকা। নিজেদের মতো করে থাকা যায়। এই উইকইন্ডে বা কোন অকেশনে কিছু লোক আসে। মাঝে মাঝে মাটি খোড়ার শব্দ পাই। বুঝি আমাদের নতুন প্রতিবেশী আসছে। ব্যস্‌….। এই কবরস্থানের বয়স কিন্তু অনেক। প্রায় দুইশ বছর! অনেক প্রাচীন কবর আছে। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখি। কতো গল্প ছড়িয়ে আছে। এই…একটু..ভেতরে গেলেই তিনভাইয়ের কবর পাশাপাশি। এক সপ্তাহের মধ্যে তিনজনই মারা গিয়েছিলো। সেই আঠারো সালে। কলেরায়। কবরে লেখা আছে। বুক ভেঙ্গে যায়।”

মহিলা থামলেন। আমার কফি শেষ। আমি উঠে দাড়ালাম।

“যাই।”

মহিলা আমাকে এগিয়ে দিতে বারান্দা থেকে নামলেন। বাচ্চাগুলো কখন ঘরের ভেতরে চলে গেছে খেয়াল করি নি। ঝড়ো বাতাস এখনো থামেনি। রাত বলে ঠান্ডা বেড়েছে। আমি জ্যাকেটের চেইন লাগিয়ে দিলাম। পাশের কবরস্থানে তখন আলোর চেয়ে অন্ধকারই বেশি।

“জানো….এই বাড়ীটা যিনি তৈরী করেছিলেন তার নাম ছিলো ফ্লয়েড। স্কটল্যান্ড থেকে মাইগ্রেট করে এসেছিল কানাডা। এই এলাকার প্রথমদিকের অধিবাসী। এই বাড়ীতে তার চার সন্তান বড় হয়েছে। তারপর যে যার মতো চলে গেছে। সেই পুরনো গল্প। ফ্লয়েডের কবরও আছে এই গ্রেইভইয়ার্ডে। অবাক ব্যাপার না? যার বাড়ী সেও এই বাড়ীর কয়েক গজের মধ্যেই শুয়ে আছে এখনো। আমার ভালোই লাগে। মনে হয় ফ্লয়েড আমাদের দেখে-শুনে রাখছে। আমি ফ্লয়েডের বৌ মার্থার কাছ থেকে বাড়ীটা কিনি। সে এই বাড়ী বিক্রি করে শহরের বৃদ্ধনিবাসে চলে গিয়েছিলো। একা একা থেকে কি করবে? তারপর….তারপর…” মহিলা একটু থামলেন।

“এবার তোমাকে শেষ অবাককরা খবরটা দেব। গত বছর মার্থা আবার ফিরে এসেছে! যেমন আমাদের সবাইকে ফিরতে হয়। যতোদূরেই যাই তবু ফিরতে হয়। মার্থাও ফিরে এসেছে। তার স্বামীর পাশে এখানেই শুয়ে আছে!!”

শেষ কথাগুলো ভদ্র মহিলা…খুব আস্তে আস্তে বললেন। দূরাগত স্বরে বললেন। রহস্য করে বললেন। কেন বললেন? আমাকে বললেন? নাকি তার নিজের জন্য বললেন? নাকি সকল মানুষকে বললেন?

জানি না।

কথা শেষ করে মহিলা অজ্ঞাত কারনে দূর্বোধ্য এক হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তাকে আর আগের মতো হাসিখুশি মনে হলো না। অচেনা মনে হলো। অস্বাভাবিক মনে হলো। আমি দ্রুত গাড়ীতে বসে গাড়ী স্টার্ট দিলাম।

আমাকে লোকালয়ে ফিরতে হবে!

সালাহ উদ্দিন শৈবাল

টরন্টো