প্রবাসে পরহিতকর্ম -২৫

জুলাই ৯, ২০১৬

রীনা গুলশান ॥

সূর্য বেশ কিছুক্ষণ আগে বিদায় নিয়েছে রাতের অন্ধকারে। কিন্তু যাবার আগে আগে পৃথিবীর বুকে রেখে গেছে রক্তিম লালিম আভা। আস্তে আস্তে লালিম আভাগুলোও বিষন্নতায় ছেয়ে যাচ্ছে। তাকিয়ে ছিলাম সূর্যের বিদায়ের কারুকার্য গুলো দেখবার প্রত্যাশায়। রোজই দেখি… তবু সাধ মেটেনা। মনে হয় রোজ ই তার নিত্য নতুন খেলা। আজ অবশ্য অন্যান্য দিনের মত খুব মনোনিবেশ করতে পারছিলাম না। কারণ আজ আবিরের আবির রাঙা মুখটা দেখতে ভাল লাগছিল। নবনী’র কথা বলতেই আবিরের মুখের বিষন্নতা চলে গ্যালো এবং কিছুক্ষনের মধ্যে ফিরেও এলো। আবির বললো- যদিও বংশের ব্যাপারটি ছিল। তবু আমার খালার সাথে আমাদের মোটামুটি সদ্ভাব ছিল। তাছাড়া নবনী আর আমি একই স্কুলে পড়াতে ক্রমশই দু’পরিবারের সখ্যতা আরো গভীর হয়ে গ্যালো। যদিও নিজের খালা, তবু আমার মায়ের মধ্যে তার বোনের জন্য খুব ভালবাসা ছিল না। কিন্তু আমরা কাজিনরা ঐ সব পারিবারিক গন্ডগোলের বাইরে রয়ে গেলাম। আর এভাবেই কখন জানি নবনী ও আমি দুজন দুজনার মনের অনেক কাছাকাছি চলে এলাম, টেরই পাইনি। আমি তখন ক্লাস টেন এ পড়ি আর নবনী নাইনে পড়ে। সে-ই প্রথম আমাকে ভালবাসার  গানে ভরা একটা চিঠি দিয়েছিল। এবং সেই শুরু। যদিও আমার মনে মধ্যে যথেষ্ট ইতস্ত ভাব ছিল। কারণ আমি জানতাম আমার মা এখনও ওদেরকে হৃদয়ের মধ্যে গ্রহন করেনি। আস্তে আস্তে আমার ছোট ভাই দুটোও জানতে পেরেছিল। তারা অবশ্য নবনীকে পছন্দ করেছিল।

এরপর ঐ ফোন এলো। নবনীর ফোন। সে জানতে পেরেছিল আমি আমেরিকাতে যাবার চেষ্টা করছি। এবং আমার ভিজিটিং ভিসা হয়ে গিয়েছে। আমি ক্যানো তাকে জানাইনি…ইত্যাদি ইত্যাদি। নবনী তখন বিএ পাস কোর্সে পড়ছিল। কান্না কাটি শুরু করলো এবং বললো, যাবার আগে অবশ্যই বিয়ে করে যেতে হবে। আমি তখন দারুন ক্রাসের মধ্যে ছিলাম। কি করি? যাই হোক মেঝভাইটাকে দিয়ে মাকে বললাম। মাতো একদম না রাজী। যাই হোক আমি বাড়ি গিয়ে মাকে হাতে পায়ে ধরে রাজী করালাম। মা নানা বাড়ীতে বললো। তারাও সব নারাজ। কি আর করবো? তবু প্রায় সবার অমতেই (মনের মধ্যে) আসবার ঠিক ৪ মাস আগে ঘরোয়া ভাবেই বিয়ে হলো আমাদের। বেশ ধুমধাম করবার সামর্থ্য ছিল না। মা তার বিয়ের গহনা একসেট নবনীকে দিয়ে দিল। ঘরে বাইরে কোথাও সানাই বাজলো না। কোন ধুম ধারাক্কা হলো না। তবে আমার দুই ভাই খুব খুশী হলো। তার গায়ে হলুদে খুব হুল্লোড় করলো। কাদা মাখামাখি করলো পাড়ার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে।

মনের মধ্যে অজশ্র ঐক্যতান। থেমে থেমে হৃদয়ের অনু পরমানুতে সানাইয়ের এক মিহি সুর বিসমিল্লাহ খাঁ বাজিয়ে চলছেন। ভালবাসা পাবার আনন্দে বারবার চোখ ভিজে যাচ্ছে। জানিনা নবনীর কি অবস্থা।

আমেরিকা চলে যাব? তাই বলে কি মধুচন্দ্রিমা হবে না! তাকি হয়? আমার বড় ফুফু থাকেন সিলেটের সদরে। উনি বিয়েতে আসতে পারেননি। তবে উনার বাসায় যাবার নিমন্ত্রণ করেছে। মা’ও বললো, ঘুরে আয়। ফুফুর বাসায় বেড়ানোও হবে আবার তোদের ঐ যে কি বলে যেন ‘হানিমুন’ সেটিও হয়ে যাবে। সত্যিই এর পর নবনীকে নিয়ে সিলেটে গেলাম। সেখান থেকে দুই দিনের জন্য জাফলং এ গেলাম। উহ! একেবারে স্বপ্নের মত ছিল সেই দিন গুলো। আমিও ওর আবিষ্টতায় আচ্ছন্ন হলাম আমাদের সেই দিনগুলোতে।

আবির কি যে সুন্দর করে বলছিল। ঠিক এই সময় আমি নিজে নিজেই ভাবছিলাম… মানুষের এই সব বিমূর্ত দিন/রাত্রি ক্যান চিরদিন থাকে না? ক্যানো এই সব দিন/রাত্রির মধ্যে দুঃখের মাত্রা যোগ হয়? ক্যানো কান্না এসে কেড়ে নেয় সব সুখের মুহুর্তগুলো??

প্রায় ১৫ দিন সিলেটে ছিলাম। এর পর চলে এলাম ঢাকাতে। ঢাকায় প্রচুর কাজ  ছিল। সব একে এক গুছিয়ে নিলাম।

এর পর চলে এলো সেই দিনটি। যে দিনটি ছিল আমার অতি আকাংখিত দিন। আবার অনেক দুঃখের দিন। সব প্রিয় জন, প্রিয় মানুষ গুলোকে ছেড়ে কোথায় চলেছি? কে জানে? একদম অজানার উদ্দেশ্যে পারি দেওয়া। খুউব ভয় করছিল। আবার অনন্দও লাগছিল! আমার স্বপ্নের দেশে যাচ্ছি। মা খুুউব কাঁদছিল এয়ারপোর্টে। ভাই দুটোও আমাকে ছায়ার মতো ঘিরে ছিল। আর নবনী? সেই বেদনাহত… ব্যাথাতুর মুখখনা কি ভাবে ভুলি? আসবার ঠিক আগ মূহুর্তে মনে হলো যাব না… ধুর… আমেরিকা গিয়ে কি হবে? আমি এদের রেখে কি ভাবে থাকবো? অসহ্য এক কষ্টে বুকের মধ্যে নিষ্পেষিত হচ্ছিল। ইমিগ্রেশন ক্রস করার আগের মুহূর্তে নবনীকে একটু কাছে ডেকে কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম, ভাল থেকো। অনেক ভাল থেকো। ফোন করবো। আর আমাদের সব ভালবাসা মনে রেখো। নবনী কিছু বলছিল না। শুধু তার অশ্রুগুলো অবিরাম টুপটাপ ঝরে পড়ছিল তার বুকের উপর। শেষ মুহুর্তে বললো, পৌঁছেই ফোন দিও।

চলে এলাম আমেরিকাতে। নিউ ইয়র্কে।  আমার মায়ের এক চাচাতো ভাই থাকে বহুদিন ধরে। তার সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। উনি আমাকে এয়ারপোর্টে আনতে গিয়েছিল। খুউব ভাল মানুষ। উনি থাকেন ওজন পার্ক এলাকাতে। একটা বেজমেন্টে। ২টি ছোট্ট রূম, একটা লিভিং স্পেস। উনার দুই বাচ্চা। তবু মামা/মামী মুখ কালো করেনি আমাকে দেখে। মামা অনেক বেশী বয়সে বিয়ে করেছিল। উনার বয়স প্রায় ৫২। বাচ্চা ২টা – একটা ছেলে ও একটিা মেয়ে। ছেলে বড়, বয়স ১৩ এবং মেয়েটার বয়স ৯ বছর। এরা নিজেরাই বেশ স্বল্প পরিসরে থাকে। তার মধ্যে আমি এসে পড়লাম। খুব লজ্জা লাগছিল। মা মামীর জন্য একটা সুন্দর শাড়ী দিয়েছিল, আর নারকেলের নাড়–। মামী খুব খুশী হলো। ২ দিন মামা আমাকে আরাম করতে বললো। তবু বিকালের দিকে একটু আশে পাশে দেখতে বের হলাম মামাতো ভাই সৌনক’কে নিয়ে। তারপর এদিক সেদিক অনেক্ষণ ঘুরে একটি কলিং কার্ড কিনে বাসায় আসলাম। এরপর দেশে পালাক্রমে সবার সাথে ফোনে কথা বল্লাম।

পরদিন মামা আমাকে নিয়ে তার কর্মস্থলে গ্যালো। মামা একটা বাঙ্গালী মালিকানাধীন রেস্টেুরেন্টের বাস বয়। আমাকে নিয়ে মালিকের সঙ্গে দেখা করলো। মালিক বেশ ভাল মানুষ। আমার অভিজ্ঞতা ও সেফ এর সব সনদপত্র দেখলো। আমি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন সব রান্না জানি দেখে খুশী হলো। তবে নতুন এসেছি। একটু চিন্তিত হলো। তারপর বললো, আমি  আরো একটি রেস্টুরেন্ট করছি শীঘ্রই। সেখানে আমি প্রায় সব ধরণের খাবার এর অর্ডার রাখবো। ততদিন তুমি এখানে বর্তমান বাবুর্চির সহকারী হিসাবে কাজ করো। খাওয়া ফ্রি (তিন বেলাই), আর আমার রেস্টুরেন্টের উপরে থাকার ব্যবস্থা আছে, তুমি ইচ্ছা করলে থাকতে পারো। এছাড়া সপ্তাহে ২০০ ডলার দিব।

আমি খুবই অবাক হলাম। বলে কি ব্যাটা, সপ্তাহে ২০০ ডলার? এ তো এখানকার বেয়ারারাদেরও বেতন নয়। মামা আমাকে চোখের ঈশারা করলো- হ্যাঁ বলতে বললো। আমি প্রচন্ডÍ অনিচ্ছা সত্বেও হ্যাঁ বলালাম। পরে মালিক বললো, কাল থেকেই জয়েন করতে পারো। আমি হ্যা বলে সালাম দিয়ে বের হয়ে এলাম। মামাও আমার সাথে সাথে বের হয়ে এলো। তারপর আমাকে ছেলে ভুলানো মত বুঝালো – দ্যাখ আবির, তোর বর্তমানে কাগজ নেই। তুই যত বড় শেফই হোস সা কেন, তোকে কেউ চাকরী দিবে না। তাছাড়া এখানে তুই থাকার জায়গাও পাচ্ছিস, খাওয়াও ফ্রি। পকেটে ২০০ ডলার তো তোর পড়েই থাকবে। আপাতত আর কি চাস? আমি প্রায় ১৭ বছর ধরে এখানে কাজ করছি। সপ্তাহে ৪০০ ডলার করে পাই। আর মাঝে মাঝে টিপস পাই, তাও সবার সাথে ভাগ করে নিতে হয়।

বুঝলাম মামার সাথে কথা বলে বা তর্ক করে কোন লাভ নাই। ভাল করেই বুঝতে পারলাম মামা তার ঘাড় থেকে ভার নামাতে চাচ্ছে। অথচ এই মামাই যখন আমেরিকা এসেছিল, তার টাকায় কমতি পড়েছিল। আমার আব্বা সেই সময় বেচেঁ এবং সেই সময়ে টাকারও দাম ছিল। আমার আব্বা এই মামাকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছিল ধার হিসাবে। তবে মামা সেই টাকা কখনোই আর ফেরৎ দেয়নি।

আমি একাই বাড়ি ফিরে এলাম। মামী সব জিজ্ঞেস করলো। আমি সব বললাম। মামিকে খুব বিব্রত মনে হলো। মামী কেমন জানি নিজের মনেই বললো… আমি শুনেছি তোমার আব্বা ওর আসবার সময় ১০ হাজার টাকা দিয়েছিল। আর ও সেই টাকা আজ পর্যন্ত ফেরত দেয়নি। আরো কিছু দিন অন্য কোনখানে খুঁজে দেখতে পারতো।

ঠিক আছে মামী … আমার কাগজপত্র নাই।

কাগজপত্র এখানে কজনেরই বা আছে? তোমার মামারই তো… সে জন্যইতো দেশে যেতে পারে না।

ওরে বাপস্ বলে কি মামী। প্রচন্ড বিস্ময়ে আমি যেন পাথর হয়ে গেলাম। মামা এসেছে প্রায় ১৯ বছর। এখনো কাগজপত্র নাই! ঈস… এ কোন দেশে আসলাম?

পরের দিন ভোরেই আমার ২টা স্যুটকেস এবং হ্যান্ডব্যাগটা নিয়ে রওনা দিলাম। যাবার সময় মামা নির্বিকার দাড়িয়ে ছিল (তার আজ ডিউটি ছিল না)। কিন্তু মামী আমার হাত ধরে বললো, ছুটির দিনে চলে আসবে…মামীকে ভুলে যাবেনা… আল্লাহ পাক তোমাকে লক্ষ্যে পৌঁছে দিক।

চলে এলাম রেস্টুরেন্টে। ‘বিরিয়ানী হাউস’ এ। মালিক বেশ সাদর অভ্যর্থনা  করে বললো, নাস্তা খাও। আমি বললাম, না আমি খেয়েই এসেছি। আর নাজিমুদ্দিন সাহেব (মালিক) আমাকে ভেতরে নিয়ে সবার সাথে আলাপ করিয়ে দিল। সবাই খুব খুশী মনে হ্যান্ডশেক করলো। একজন বেশ মুখ গোমরা করে শুধু সালাম দিল। পরে শুনলাম উনিই এখানকার হেড কুক, হান্নান সাহেব।

পরে নাজিমুদ্দিন সাহেব একটা হালকা পাতলা ছেলেকে (নাম বললো-দীপক সেন) ডেকে বললো, আবিরকে থাকবার জায়গাটি দেখিয়ে দাও।

ওকে স্যার… আসেন ভাইজান।

খুব হাসিখুশ ছেলেটা। রান্না ঘরের পেছন দিয়ে একটা সরু হলওয়ে দিয়ে নিয়ে কাঠের একটা সিড়ি কোথা থেকে এনে লাগালো (অনেকটা লেডারের মতন)। সেই সিড়ি বেয়ে আমরা উপরে উঠলাম। উপরে উঠেই সোজা হয়ে দাড়াতেই মাথা ঠুকে গ্যালো…

করেন কি ভাই… সোজা হয়েন না। এখানে সোজা হওন যায় না। বলেই হা হা করে হাসলো… যেন অত্যন্ত আনন্দের একটা খবর দিল।

আমিতো অসম্ভব আশ্চার্য হয়ে প্রথমে ব্যাপারটি বুঝবার চেষ্টা করলাম। দেখলাম অনেকটা গ্রামের বাড়িতে ঘরের মাঝখানের উপরে চাতালের মত থাকে, তাতে সব খাদ্য চাল, ডাল, মুড়ি ইত্যাদি রাখা হয়, ঠিক ঐ ধরনের একটা কামরা মতন- ১০/১২ ফিট লম্বা হতে পারে। পরপর সব বিছানা পাতা। এখন ফোল্ড করা। রাতে যার যার বিছানা সোজা করে ঘুমিয়ে পড়ে।

দীপক সেন এবার গড়গড় করে বললো, ঐ কোনার দিকে আপনার বিছানা পাতেন। বিছানা নাই? অসুবিধা নাই। গতমাসে একজন চলে গেছে। ওর বিছানাটা পড়ে আছে। ওটাতেই আপনি শোবেন। ১২টার মধ্যেই উপরে উঠতে হবে। ওয়াশরুমের কাজ কাম সেরে আসতে হবে নিচে থেকে। আবার সকাল ৭টার মধ্যে নিচে সিড়ি লাগলে, নিচে গিয়ে সব কাজ সেরে আসবেন। রাতে ওয়াশরুমের কোন কাজ কাম করা যাবেনা। হা হা, ডায়াবেটিসের রোগী হলে প্রব্লেম হা হা।

আমি এবারে চুপচাপ বসে পড়লাম। হায় আল্লাহ, এ কোথায় এসে পড়লাম? মামা সবই জানতো… তবু এই নরকের মধ্যে আমাকে ঠেলে দিল। এতটুকু মায়া হলো না? তাইতো মামীর খুুউব মন খারাপ ছিল! বারবার বলছিল, ছুটিতে চলে এসো।

হঠাৎ কি যে হলো, দু হাটুর মধ্যে মাথা দিয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেল্লাম। বুক ভাঙ্গা কান্না… এ কান্নার কোন নাম নাই… এ হতাশা… গ্লানি এবং পরাজিত সৈনিকের কাঁন্না… (চলবে)

রীনা গুলশান

কবি ও লেখক

টরন্টো।

gulshanararina@gmail.com