আহমেদ হোসেনের প্রামাণ্যচিত্র “নিঃসংগ বাতিঘর”

এক আলোকিত মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন

মনিস রফিক

নীরব নিস্তব্ধ সাগর পাড়ে মাথা উচু করে গভীর একাকীত্বের মাঝে জেগে থাকে যে বাতিঘর তা পথ দেখায় দীর্ঘ পথে পথে ফেরা ক্লান্ত সব নাবিকদের। মানুষের চিরাচরিত ধর্ম হচ্ছে অজানার পথে ছুটোছুটি করা, নতুনত্বের স্বাদ নেয়া আর সামনে এগিয়ে চলা। মানুষের এই সামনে এগিয়ে চলায় সব সময়ই প্রয়োজন পড়ে কোনো এক পথ প্রদর্শকের যিনি তার জীবনটা বিলিয়ে দেন তার আশে পাশের মানুষদের সুন্দর আগামীর জন্য। এই সুন্দর আগামী নিহিত থাকতে পারে কখনো অর্থনৈতিক মুক্তিতে, কখনো মানবিক ভালোবাসায় আবার কখনো সাংস্কৃতিক চেতনায়।

কানাডার টরন্টো শহরে প্রায় ৫৩ বছর ধরে বাস করা মহাদেব চক্রবর্তী একজন এমনই এক বাতিঘর যিনি নিজ সংস্কৃতি ও ভাষাকে ভালোবেসে জীবনভর কাজ করে গেছেন এক মহাবৃক্ষের মতো। এ বৃক্ষটি এমন এক বৃক্ষ যার ছায়াতলে অবলীলায় জিরিয়ে নেয়া যায় আর চিনে নেয়া যায় আপন শেকড়কে। ১৯২৭ সালের ২৫শে ডিসেম্বর ভারতের উত্তর প্রদেশের বেনারসে জন্ম নেয়া মহাদেব চক্রবর্তীর পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশের নাটোরের দুয়ারী গ্রামে। বাবা ছিলেন গ্রামের স্কুলের হেড পন্ডিত। বাবা তার মায়ের মৃত্যু-পূর্ব প্রশান্তি ও অক্ষয় শিবলোক প্রাপ্তির জন্য সেই যে কাশী গমন করেছিলেন তারপর ধীরে ধীরে সেই পরিবারটি কাশীতেই অবস্থান শুরু করে দেয়। সেই সূত্রে মহাদেব চক্রবর্তীর সেখানেই জন্ম, বেড়ে উঠা আর পড়াশুনা। মহাদেব চক্রবর্তী বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে প্রথম বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স পাশ করে ১৯৬৩ সালে ভারতের পারমানবিক শক্তি কমিশনে কিছুদিন কাজ করার পর কানাডায় চলে আসেন। কানাডায় এসে মূলত তিনি শিক্ষকতা পেশার সাথে নিজেকে জড়িত রাখেন। আজীবন নিষ্ঠাবান এই মানুষটি তার জীবনের সব চেয়ে প্রগাঢ় প্রেমে যে কাজটি করেছেন তা হচ্ছে, কানাডায় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে পরম মমতায় সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। নিজের জীবনের সঞ্চিত সব অর্থ আর মাঝে মধ্যে বিভিন্ন মানুষের কাছে হাত পেতে অর্থ সংগ্রহ করে তিনি যে তহবিল তৈরী করেছিলেন তা দিয়ে তিনি টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা নিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। আমাদের এ বিষয়টা ভাবলেই তার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে। আমরা যখন সবাই জাগতিক দৌড়ে ছুটে চলছি তখন এই মহান মানুষটি নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি নীরবে একাএকি যে পরম প্রেমের ফেরী করে বেড়িয়েছেন তা আমাদের বিস্মিত করে।

জুলাই ৯, ২০১৬  “নিঃসংগ বাতিঘর” এর শুটিং দৃশ্য। (বাম থেকে) চলচ্চিত্র নির্মাতা আহমেদ হোসেন, ক্যামেরাম্যান আসগর কাজী ও মহাদেব চক্রবর্তী।

অস্তমিত সূর্যের দিকে তাকিয়ে আলোকিত ভোরের স্বপ্ন দেখা এই মানুষটিকে নিয়ে টরন্টোর বাঙ্গালিদের অতি প্রিয় সাংস্কৃতিক মুখ আহমেদ হোসেন নির্মাণ করেছেন “নিঃসংগ বাতিঘর” প্রামাণ্যচিত্র। আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অংগনের পরিচিত মুখ এবং নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের অগ্রণী যোদ্ধা আহমেদ হোসেন সাধারণের কাছে নাটক ও কবিতার মানুষ হিসেবে পরিচিত হলেও সেই কিশোর বয়স থেকেই ঢাকায় চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন করেছেন বলিষ্ঠভাবে।

টরন্টোর প্রবাস জীবনে আহমেদ হোসেন তার প্রথম প্রামাণ্যচিত্রের বিষয় নির্বাচনে যে মননশীলতার পরিচয় দিয়েছেন তাতে প্রমাণ হয় তিনি আগাগোড়া একজন সুন্দর মনের সংস্কৃতিবান মানুষ যিনি সব সময় স্মরণ করতে চান তার অগ্রজদের আলো হাতে পথ দেখানো এক স্বাপ্নিক সময়কে। “নিঃসংগ বাতিঘর” প্রামাণ্যচিত্রে মহাদেব চক্রবর্তীর চিত্রায়ণ তাকে অন্তপ্রাণ বাংগালিদের কাছে আগামী দিনগুলোয় এক অনাবিল শ্রদ্ধার আসনে থাকতে সাহায্য করবে।

বাংলা ভাষা বর্তমান পৃথিবীর সপ্তম তম আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে, প্রায় পয়ত্রিশ কোটি মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। তারপর ১৯৯৯ সালে আমাদের ২১শে ফেব্রুয়ারীকে ধরে বছরের সেইদিনকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করেছে। কিন্তু এরপরো এটাতো সত্য, বর্তমানের অভিভাসনের যুগে অধিকাংশ ভাষা তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলছে। আমাদের কানাডার দিকে তাকালে, এটা স্পষ্ট হয়ে যায়। কানাডায় বাংগালী অভিবাসীদের কয়জন উত্তরসূরী বাংলা ভাষায় কথা বলা বা লেখা চালিয়ে যেতে পারবে, তা বলা খুবই কঠিন। তবে পরিমাপ করলে এটা যে একেবারে নীচের দিকে চলে আসবে, তা আশংকা করা যায়। “নিঃসংগ বাতিঘর” এর মহাদেব চক্রবর্তী এমন একজন আলো হাতে চলা মানুষ যিনি নিজের শেকড় থেকে আমাদের বিচ্যুত না হওয়ার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন আর যিনি আমাদের বারে বারে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন আমরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেনো মায়ের ভাষার পতাকা আমাদের উড্ডীন রাখতে হবে পরম মর্যাদার সাথে। এ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে এমন এক চেতনার মানুষকে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করে আহমেদ হোসেন এক মহা মানবিক আর মহা সাংস্কৃতিক চেতনায় এগিয়ে এসে আমাদের ইতিহাসের দায়ভার থেকে কিছুটা মুক্তি দিয়েছেন।

নব্বুই ছুই ছুই বয়সের একজনকে ক্যামেরার সামনে এনে শুটিং করানো খুব সহজ একটা ব্যাপার নয়, তারপর তিনি যদি লোকচক্ষুর আড়ালেই থাকতে ভালোবাসেন। কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাতা এই কিছুটা দুঃসাধ্য সাধন করে ক্যামেরার সামনে এমন এক মহৎ প্রাণকে এনে তার মুখ দিয়ে তার জীবন, দর্শন আর চেতনার কথা বলিয়ে নিয়েছেন। “নিঃসংগ বাতিঘর” প্রামাণ্যচিত্রে মহাদেব চক্রবর্তী বলে গেছেন তার বিশ্বাসের কথা, তার বেড়ে উঠার কথা আর তার পরিবারের দারিদ্রের কথা। তিনি সব কিছুই বলে গেছেন খুবই সরল ও সহজ ভংগিমায়। তার এই সহজ কথন শুনে আমাদের বারবার মনে হয় আমরা আমাদের অতি কাছের ঘনিষ্ঠ প্রিয় মানুষের কাছে তার জীবনের কাহিনি শুনছি। প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা আহমেদ হোসেন এখানেই তার ইতিহাসের প্রামাণ্যকরণের যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তা দর্শকদেরকে খুব সহজেই মহাদেব চক্রবর্তীর কাছাকাছি নিয়ে যায়।

প্রামাণ্যচিত্রের শুরুতেই আমরা দেখি বালিশে হেলান দেয়া চোখ বন্ধ করে থাকা অশীতিপর মহাদেব চক্রবর্তীকে আর ওভার ভয়েসে বিদ্যুত সরকারের লেখা আর কবি আসাদ চৌধুরীর পঠনে মহাদেব চক্রবর্তীকে নিয়ে কিছু শব্দমালা। এই শব্দমালা আর শব্দপঠনের এক প্রগাঢ় শক্তি আছে, যে শক্তি খুব সহজেই মহাদেব চক্রবর্তীর সাথে দর্শকদের এক করিয়ে দেয়।

মহাদেব চক্রবর্তী আমাদের জানিয়ে দেন ‘রিলিজিয়ন’ আর ‘ধর্ম’ এক নয়। একটা আবদ্ধ পুকুর বা হ্রদের মতো আর একটা স্রোতবহা নদীর মতো যা মানুষকে অনুসন্ধিতসু করে তোলে নতুন নতুন বিষয় জানতে। রিলিজিয়ন আর ধর্মের কথা বলতে গিয়ে তিনি চলে যান সাংখ্য, বৌদ্ধ, হিন্দু আর জৈন ধর্মে। তার এই বলে চলার শুরুতেই দর্শক লক্ষ্য করে মহাদেব চক্রবর্তীর হাতে ধরা ভাই গিরীশচন্দ্র সেনের কোরান শরীফের বাংলা অনুবাদ। জীবন, দর্শন আর ধর্ম নিয়ে কথা বলতে বলতে তিনি যখন শেষ পর্যায়ে চলে আসেন তখন তিনি চলে যান প্রাচীন রোমান সভ্যতার সেনেকার কথায় যিনি বলেছিলেন, রিলিজিয়ন সাধারণ মানুষকে বশে রাখার হাতিয়ার যা আমরা যুগে যুগে অসংখ্য জীবনের বিনিময়ে অনুধাবন করেছি।

মহাদেব চক্রবর্তীর মহা ক্যানভাসিক জীবনের এক চিলতের ওপর আলো ফেলে তার রোশনি দর্শকদের দেখিয়েছেন নির্মাতা আহমেদ হোসেন। আর তাতেই আমরা আলোকের পথে ধাবিত হওয়ার স্বপ্ন দেখি এক আলোর ছোয়ায়। সব শেষে যখন আমরা জানতে পারি, ৫৩ বছর কানাডায় বসবাস করার পরও এ দেশের নাগরিক হবার জন্য বৃটেনের রাণীর নামে শপথ নিবেন না বলে তিনি এখনো কানাডার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন নি। তখন তার প্রতি তাকানো আমাদের চোখ অন্যরকম হয়ে যায়। এমন তথ্য জেনে স্বভাবতই আমাদের মনে হয় এমন প্রবল সংকল্পের হ্রদয়ের মানুষের পক্ষেই স্বম্ভব নিজ ভাষা ও নিজ সংস্কৃতির জন্য এমন পরম প্রেমের সাথে কাজ করা।

বলা হয়, প্রামাণ্যচলচ্চিত্র নির্মাতাদের সমাজের প্রতি এক বিশেষ দায়ভার থাকে। আহমেদ হোসেন তার প্রথম প্রামাণ্যচলচ্চিত্র নির্মাণ করে শুধু তিনি নিজেই সেই দায়ভার থেকে নিজেকে মুক্ত করেন নি, বরং সমাজের অন্যান্য সংবেদনশীল ও মননশীলদেরও একজন নিঃসংগ বাতিঘর এর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ইতিহাসের দায়ভার থেকে আমাদের সবাইকে মুক্তি দিয়েছেন।

“নিঃসংগ বাতিঘর” প্রামাণ্যচিত্রে ক্যামেরায় কাজ করেছেন আসগর কাজী। এর সংগীত ও সম্পাদনায় ছিলেন যথাক্রমে তানজির আলম রাজিব ও এনায়েত করিম বাবুল। সুব্রত কুমার দাস করেছেন এর ইংরেজি সাব টাইটেল।

টাইটেল কার্ডের সাথে সাথে আশিক ওয়াহেদ আসিফের ভরাট কন্ঠে ‘আরো আলো, আরো আলো, এ নয়নে প্রভু ঢালো’ রবীন্দ্র সংগীতটি আমাদের অতি অল্প সময়ের জন্য হলেও একেবারে শান্ত আর স্তব্ধ করে দেয়। তখন আমরা সহজেই উপলব্ধি করি, আমাদের অন্তরের ভিতরের পরম শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ধেয়ে চলে এক আলোকিত মানুষের হ্রদয় পানে, যিনি হচ্ছেন আহমেহ হোসেনের প্রামাণ্যচিত্র “নিঃসংগ বাতিঘর” এর মহাদেব চক্রবর্তী।

মনিস রফিক

টরন্টো