কানাডায় ইসলামোফোবিয়া : মুসলমানদের উপর আক্রমন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে
জুলাই ৯, ২০১৬
॥ খুরশিদ আলম ॥
গত ১২ জুন যুক্তরাষ্ট্রের অরল্যান্ডোতে অবস্থিত সমকামীদের একটি ক্লাবে হামলা চালিয়ে ৪৯ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছেন এক যুবক যার নাম ওমর মতিন। তিনি একজন মুসলমান যুবক। একই স্থানে একই সময় আরেকজন যুবক ঐ হামলা থেকে ৭০ জনকে বাঁচিয়েছেন যার নাম ইমরান ইউসুফ। ইমরান ইউসুফ নামটি দেখে মনে হতে পারে তিনি একজন মুসলমান। কিন্তু না, তিনি আসলে একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী যুবক। ভয়াবহ এই হত্যাযজ্ঞের পর এই দুই যুবকের একজন গণধিক্কারে ধিকৃত হয়েছেন আরেকজন প্রশংসার বন্যায় ভাসছেন।
ইমরানের সাহসিকতা ও মানবতাবোধের কাহিনী এখন লোকের মুখে মুখে ঘুরছে। পুলিশ জানিয়েছে, ইমরান নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই রাতে কমপক্ষে ৭০ জনের প্রাণ বাঁচিয়েছেন হামলার স্থান থেকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করে। ঐ ৭০ জনের পালায়ন নিশ্চিত করার পর ইমরান নিজে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। এর চেয়ে বড় বীরত্বের কাহিনী আর কি হতে পারে?
বলা হয়ে থাকে ইসলাম শান্তির ধর্ম, ধর্মের নামে মানুষ হত্যা ইসলাম সমর্থণ করে না। বরং চরম শাস্তিযোগ্য অপরাধ ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করা। সম্প্রতি বাংলাদেশের এক লাখ আলেমের সই করা এক ফতোয়া প্রকাশ করা হয়েছে যাতে বলা হয়, “সন্ত্রাস হারাম ও অবৈধ। একইভাবে আত্মহত্যা ও আত্মঘাতও ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। এমনকি আত্মহত্যাকারীর জানাজা পড়াও ইসলামে বৈধ নয়। নারী, শিশু, বৃদ্ধ, দুর্বল-যারা যুদ্ধে শরিক নয়, সে ধরনের মানুষকে হত্যা করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এমনকি যুদ্ধকালীনও তা জায়েজ নয়। অমুসলিমদের উপাসনালয়ে হামলা করা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম ও অবৈধ এবং এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ধর্মের নাম করে যারা মানুষ হত্যা করবে, তারা জাহান্নামে যাবে।” জমিয়তুল উলামার চেয়ারম্যান ও দেশের বৃহত্তম ঈদগাহ কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার খতিব ফরীদ উদ্দীন মাসউদ সম্প্রতি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলন করে এ ফতোয়া প্রকাশ করেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের যে, একশ্রেণীর মানুষ সেই ইসলাম ধর্মের নাম করে দেশে দেশে নিরীহ মানুষ হত্যা করে আসছে। আর এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ হত্যাযজ্ঞ পরিচালিত হলো যুক্তরাষ্ট্রের অরল্যান্ডোতে। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ইতিহাসে ৯/১১ এর পর এতটা ভয়াবহ জঙ্গী হামলা হয়নি। হত্যাযজ্ঞ যিনি চালালেন তিনি জন্মসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রেরই নাগরিক। তার বাবা মা অবশ্য আফগানী। নির্মম ঐ হত্যাযজ্ঞের পর ওমর মতিনের পিতা সাদিক মতিন ঐ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি এনবিসি নিউজকে বলেছেন, এ হামলার সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি আরো বলেছেন, সম্প্রতি মতিন মিয়ামিতে দুজন পুরুষকে চুম্বনরত অবস্থায় দেখতে পায়। তা নিয়ে সে খুব ক্ষুব্ধ ছিল। কিন্তু মতিন যে এমন হামলা চালাবে সে বিষয়ে তার পরিবার অবগত ছিল না। তার ভাষায়, এ হামলায় সারা আমেরিকার মতো আমরাও শোকাহত। অন্যদিকে মতিনের সাবেক স্ত্রী সিতোরা ইউসুফি বলেছেন, মতিন ছিল মানসিক ভারসাম্যহীন। তার আচরণ ছিল হিংস্র। সে তাকে বার বার প্রহার করেছে। সিতোরা আরো জানান, মতিন খুব ধর্মভীরু ছিল।
কিন্তু মতিন সম্পর্কে আবার এই তথ্যও আছে যে তিনি ধর্মভীরু হলেও নিজেই একজন সমকামী ছিলেন। সমকামীদের যে ক্লাবে তিনি হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যা করেছেন সেই ক্লাবে তিনি প্রায়ই যেতেন। সেখানে বসে তিনি মদ্যপানও করতেন। সমকামীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে তিনি তাদের বিভিন্ন অ্যাপও ব্যবহার করতেন।
এফবিআই কর্মকর্তারা বলেন, ওমরের বয়স ২৯ বছর। সে ইসলামী উগ্রপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। তবে এ হামলা অভ্যন্তরীণ না আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস তা পরিষ্কার হতে পারেনি এফবিআই। এফবিআই কর্মকর্তারা ২০১৩ সালে তাকে দুবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তবে এফবিআইয়ের রাডারে থাকলেও মতিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘টেরোরিজম ওয়াচ লিস্টে’ ছিল না। ফলে সে সহজেই আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার সক্ষমতা অর্জন করে। হত্যাযজ্ঞের ঘটনার পর পুলিশ ঘটনাস্থলেই ওমর মতিনকে হত্যা করে।
উল্লেখ্য যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছরই বন্দুক সন্ত্রাসে প্রাণ হারান হাজার হাজার মানুষ। সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন এর হিসাব মতে ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুকের গুলিতে প্রাণ হরিয়েছেন ৩৩,১৬৯ জন। ঐ দেশটিতে এরকম মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের ঘটনা অহরহই ঘটছে। আর এগুলো ঘটাচ্ছে মার্কিনীরাই। নিজেরাই নিজেদের গুলি করে মারছে। গত বছর ১৭ জুন সাউথ ক্যারোলিনায় কৃষ্ণাঙ্গদের একটি চার্চে (Charleston church ) শ্বেতাঙ্গ এক যুবক এলোপাথারী গুলি চালিয়ে ৯ জনকে হত্যা করেন। তার আগে ২০১২ সালের ১৪ ডিসেম্বর কানেকটিকাটে এক এলিমেন্টারী স্কুলে অতর্কিতে গুলি চালিয়ে ৬ থেকে ৭ বছরের ২০ জন শিশুকে হত্যা করা হয়। ঐ ঘটনায় ৬ জন স্কুল স্টাফও নিহত হন। এরকম ঘটনা প্রতি বছরই ঘটছে গোটা যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেটি সামাল দিতে পারছে না দেশটির অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কারণে। আমেরিকার ন্যাশনাল রাইফেল এসোসিয়েশন বরাবরই ঐ দেশটিতে অস্ত্র নিয়ন্ত্রনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আসছে। আর এরা এতই ক্ষমতাশালী যে কেউ তাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারছে না। বরং উল্টো নেপথ্যে থেকে এই এসোশিয়েশন আমেরিকার রাজনীতিকেও নিয়ন্ত্রণ করে অনেকটাই। অন্যদিকে রক্ষণশীল রিপাবলিকানরাও অস্ত্র নিয়ন্ত্রনের বিপক্ষে! আর তারই পরিনতি প্রতি বছরের ঐ মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞসমূহ।
কিন্তু অরল্যান্ডোর সমকামী ক্লাবে সাম্প্রতিক হত্যাযজ্ঞটি ঘটনো হয়েছে ইসলাম ধর্মের নাম করে। আমাদের উৎকন্ঠার বিষয়টি ঐখানেই। ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী মুসলমানদের মধ্যে চাপা আতঙ্ক বিরাজ করে আসছে যদিও মার্কিন মুসলমান নেতৃবৃদ্ধ এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন এবং স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষ মুসলমানদের আতঙ্কিত না হতে বলেছেন।
অন্যদিকে অরল্যান্ডোর ঘটনার পর কানাডার মুসলমানদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে চাপা আতঙ্ক। ইতিপূর্বে আমরা লক্ষ্য করেছি প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার পর পরই কানাডায় কয়েকটি মসজিদে হামলা চালানো হয়েছিল। হিজাব পরিহিতা কয়েকজন মুসলমান মহিলার উপর চালানো হয়েছিল আক্রমণ। অরল্যান্ডোর মর্মান্তিক হামলার পর এবারও কানাডায় মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষী হামলার ঘটনা ঘটছে। কুইবেক সিটিতে মসজিদের সামনে শুকরের মস্তক রেখে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে, লন্ডন অন্টারিওতে হিজাব পরিহিতা এক মহিলার উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে।
তবে এগুলো বাহ্যিক আক্রমণ। নীরবে বা গোপনে যে আক্রমণ চলে সেটিতো আর চোখে দেখা যায় না। সেই আক্রমণ চালানো হয় নানারকম বর্ণবাদী, বিদ্বেষী ও বৈষম্যমূলক আচরণের মাধ্যমে। এই আক্রমণ চলে নীরবে নিভৃতে। প্রকাশ্য আক্রমণকে প্রতিহত করা সহজ। কিন্তু গোপন আক্রমণ প্রতিহত করা খুবই কঠিন। আর মুসলমানদের বিরুদ্ধে এই গোপন আক্রমন কানাডায় দিনে দিনে বাড়ছে বই কমছে না।
কানাডায় মুসলিম বিদ্বেষ বা মুসলিমদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ অবশ্য রাজনৈকিভাবেও করা হয়। যেমন কনজারভেটিভ পার্টি তাদের রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে মুসলমানদের সম্পর্কে এটি ‘জুজুর ভয়’ তৈরী করে আসছিল অনেক অগে থেকেই। আর সে কারণেই দেখা গেছে গত তিন বছরে কানাডায় মুসিলম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে দুই গুন।
হাফিংটন পোস্টের এক খবরে জানা যায় গত ২০১৪ সালে কানাডায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে মোট ৯৯ টি বিদ্বেষমূলক অপরাধের ঘটনা নথিবদ্ধ করা হয়েছে পুলিশের খাতায়। ২০১২ সালে এরকম ঘটনা ঘটে ৪৫ টি। ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিম এর কমিউনিকেশন ডিরেক্টর আমীরা এলফাবাবী হাফিংটন পোস্টকে বলেন, কানাডায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক অপরাধ দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুলিশের হিসাব অনুযায়ী এই বৃদ্ধির হার দ্বিগুন। কিন্তু আমাদের ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিম এর হিসাব অনুযায়ী এই বৃদ্ধির হার তিনগুণ। তিনি বলেন, বহুল আলোচিত জঙ্গী হামলাসমূহ এবং এর পাশাপাশি জঙ্গী সংগঠনগুলো কর্তৃক বাগাড়ম্বরপূর্ণ উক্তি এই বিদ্বেষ ছড়ানোর পিছনে হয়তো আংশিকভাবে কাজ করছে।
আর এবার অরল্যান্ডোর ঘটনার পর কানাডায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ আবারো মাথা চড়া দিয়ে উঠেছে। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। তাছাড়া কনজারভেটিভ পার্টিকে একক ভাবে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এই দোষের দায় ভার অনেটা মুসলমানদের উপরও বর্তায়। আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি কানাডায় পার্লামেন্ট ভবনে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, দুই জন সেনা সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে, ভিয়া রেল সেতু উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, ১৮ জন মুসলিম যুবক কর্তৃক কানাডার পার্লামেন্ট ভবনসহ আরো গুরুত্বর্পূর্ণ কয়েকটি ভবন বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, বোরখা/নিকাব নিয়ে অতি বাড়াবাড়ি হয়েছে। এবং এগুলোর পিছনে যারা কাজ করেছেন তারা সবাই মুসলমান অথবা কনভার্টেড মুসলমান। একটা দেশের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ কখনোই এ জাতীয় সন্ত্রাসী হামলা বা হামলার পরিকল্পনাকে মেনে নিতে পারেন না। কানাডাও তার ব্যতিক্রম নয়।
উপরে বর্ণিত হামলাগুলো যারা করেছেন বা হামলার পরিকল্পনা যারা করেছেন তারা সবাই হোমগ্রোন টেররিস্ট। অরল্যান্ডোর ঘটনাও ঘটিয়েছেন হোমগ্রোন এক টেররিস্ট। আর কানাডায় এই হোমগ্রোন টেররিস্টদের মধ্যে আছেন আমাদের প্রবাসী বাংলাদেশীদের কয়েকজন সদস্যও! এদের সন্ত্রাসী কর্যক্রম অবশ্য কানাডার বাইরে পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু বদনামটা হচ্ছে কানাডায়।
ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি টরন্টো এলাকা থেকে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত চার কিশোর মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটে (আইএস) যোগ দিয়েছে। কানাডার সিবিসি টিভির অনলাইনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। এই চার বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত তরুন হলো -তাবিরুল হাসিব, আবদুল মালেক, নূর ও আদিব। তাবিরুল হাসিব টরন্টোর মনার্ক পার্ক কলেজিয়েট স্কুল থেকে পাশ করে। স্কুলে সে খেলাধূলায় বেশ সক্রিয় ছিল। পরবর্তীতে সেন্টেনিয়াল কলেজে ভর্তি হয়।
আবদুল মালেক এর বাবা জানান, তার ছেলে কখনো পাবলিক স্কুলে পড়াশুনা করেনি। সে টরন্টোতে বরাবরই মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছে।
কানাডায় জন্ম নেয়া চার কিশোরের সবাই স্কুলছাত্র। তাদের বয়স ২০ বছরের নিচে। এ ঘটনায় তাদের বাবা-মা উদ্বিগ্ন।
২০১২ সালে এই চার কিশোর প্রথম নিখোঁজ হয়। অভিভাবকরা বিষয়টি টরন্টো পুলিশকে জানান। পরে পুলিশ জানতে পারে, আইএসে যোগ দিতে আবু মুসলিম নামের এক তরুনের সঙ্গে ওই চার কিশোর কানাডা ছেড়েছে।
নিখোঁজ হওয়ার এক সপ্তাহ পর অভিভাবকরা জানতে পারেন তাদের সন্তানরা তখনো সিরিয়ায় প্রবেশ করেনি। তারা লেবাননে অবস্থান করছে। পরে তারা লেবাননে গিয়ে বুঝিয়ে ছেলেদের কানাডায় ফিরিয়ে আনেন। জব্দ করা হয় তাদের পাসপোর্ট।
২০১৪ সালের ৬ জুলাই চার কিশোর টরন্টো থেকে আবার নিখোঁজ হয়। এবার তারা মোহাম্মদ আলী নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে তুরস্কের উদ্দেশে টরন্টো বিমানবন্দর ছাড়ে। পরে ইস্তাম্বুল থেকে টুইটারে বার্তা দেন মোহাম্মদ আলী। এতে সিরিয়ায় প্রবেশ করার পথ জানতে চান তিনি।
এ ঘটনায় ওই চার কিশোরের বাবা-মা হতাশ ও উদ্বিগ্ন ছিলেন। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এই চার জঙ্গী তরুন এখন কোথায় কি অবস্থায় আছেন তা আমাদের জানা নেই। তবে কমিউনিটির কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন এই বলে যে, আবদুল মালেক নামের বাংলাদেশী ঐ তরুনকে তার বাবা-মা প্রচলিত স্কুলে না পাঠিয়ে কি উদ্দেশে মাদ্রাসায় পাঠিয়েছিলেন?
এদিকে সর্বশেষ খবরে জানা যায় কানাডা প্রবাসী ও কানাডার নাগরিক আরেক বাংলাদেশী তামিম চৌধুরী বর্তমানে আইএস এর হয়ে বাংলাদেশে জঙ্গী কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। গত এপ্রিলে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট-এর মুখপাত্র বলে পরিচিত ‘দাবিক’ ম্যাগাজিনে শেখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ নামের এক ব্যক্তিকে আইএসের বাংলাদেশি শাখার প্রধান বলে পরিচিত করা হয়। সম্প্রতি সেই হানিফ সম্পর্কেই নতুন তথ্য দিয়েছে কানাডার দৈনিক ন্যাশনাল পোস্ট। পত্রিকাটিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আবু ইব্রাহিম আল হানিফের প্রকৃত নাম তামিম চৌধুরী। তিনি একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিক। এক সময় অন্টারিওর উইন্ডসর শহরের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। ন্যাশনাল পোস্টের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, গত মার্চে কানাডিয়ান সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের পরিচালক জানিয়েছেন, বিদেশের মাটিতে সন্ত্রাসবাদ চালাতে কানাডার প্রায় ১৮০ জন উগ্রপন্থী দেশ ছেড়েছেন। এছাড়া ৬০ জন কানাডীয় দেশে ফিরেছেন এবং কানাডা ছাড়তে চাওয়া আরও বেশ কয়েকজনকে পুলিশ ঠেকাতে পেরেছে।
এই হোমগ্রোন টেররিস্টদের মধ্যেই দেখা যায় কেউ কেউ হঠাৎ কোন অপকর্ম করে বসেন আইএস বা অন্যকোন জঙ্গী সংগঠনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্ররোচনায়। যেমনটা দেখেছি অরল্যান্ডোর ওমর মতিনকে। তবে হঠাৎ কোন কান্ড করে বসলেও এর প্রস্তুতি চলে অনেক আগে থেকেই। আর এই প্রস্তুতি চলাকালীন সময়টাতেই কোন ব্যক্তির আচরণ ও গতিবিধিতে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। এই পরিবর্তনটা প্রাথমিকভাবে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দৃষ্টিগোচর হয় না সাধারণত। হওয়ার কথাও নয়। পরিবর্তনটা সবচেয়ে আগে যারা টের পান তারা ঐ ব্যক্তির পরিবারের সদস্য বা ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব। তাই এ ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে দায়িত্বটা বর্তায় আত্মীয়-বন্ধুদের ঘারেই। তাদেরই উচিৎ ঐ ব্যক্তিকে বুঝিয়ে বিপথগামী না হতে সাহায্য করা। প্রয়োজনে কোন ধর্ম বিশেষজ্ঞের কাছে তাকে নিয়ে যেতে হবে এবং বুঝাতে হবে যে, “ইসলাম শান্তির ধর্ম, ধর্মের নামে মানুষ হত্যা ইসলাম সমর্থণ করে না। ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করা চরম শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সন্ত্রাস হারাম ও অবৈধ। অমুসলিমদের উপাসনালয়ে হামলা করা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম ও অবৈধ এবং এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ধর্মের নাম করে যারা মানুষ হত্যা করবে, তারা জাহান্নামে যাবে।” পাশাপাশি তাকে রাজনৈতিকভাবেও সচেতন করে তুলতে হবে। তাকে বুঝাতে হবে যে, জঙ্গীবাদ বা সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে কোন দেশ বা অঞ্চলবিশেষের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করা যায় না।
আমরা জানি, বৈষম্যের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা আছে প্রায় এক তৃতীয়াংশ কানাডীয় মুসলিমের। সম্প্রতি পরিচালিত একটি জরীপ থেকে এই তথ্যই আমরা পাই। জরীপটি চালিয়েছে এনভাইরনিকস ইন্সিটিউট নামের একটি সংস্থা। জরীপে দেখা যায় ৩০% মুসলিম বলেছেন গত ৫ বছরে তারা তাদের ধর্ম বা এথনিসিটি অথবা কালচারের কারণে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। কানাডায় সাধারণভাবে বৈষম্যের শিকার হওয়ার হারের চেয়ে মুসলমানদের বৈষম্যের শিকার হওয়ার এই হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেশী। আর সে কারণে মুসলিমদের সামনে এখন এই বৈষম্যে শিকার হওয়ার বিষয়টি প্রধান ইস্যু হয়ে দাড়িয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, সাধারণভাবে ৬২% কানাডিয়ান মুসলমান বেশ উদ্বিগ্ন বৈষম্যের এই বিষয়টি নিয়ে। অন্যদিকে ৭২% যুবক বয়সী মুসলমান বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। আর কানাডায় যাদের জন্ম সেই সকল মুসলমানদের মধ্যে ৮৩% উদ্বিগ্ন বৈষম্যের বিষয়টি নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের অরল্যান্ডোতে যে হত্যাযজ্ঞ পরিচালিত হলো, তার জের ধরে কানাডায় মুসলমানের প্রতি বৈষম্য ও সন্দেহ এবার আরো বৃদ্ধি পাবে সন্দেহ নেই।
কিন্তু তারপরেও পাশ্চাত্যে অন্যান্য দেশের তুলনায় কানাডার মুসলমানগণ এখনো অনেক ভাল অবস্থানে আছেন। উপরে উল্লেখিত বৈষম্যের এই চিত্র সত্বেও এনভাইরনিকস ইন্সিটিউট পরিচালিত জরীপে দেখা গেছে কানাডার ৮৪% মুসলিম মনে করেন পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশে মুসলিমদের প্রতি যে আচরণ করা হয় সেই তুলনায় তারা কানাডায় ভাল আছেন।
এই ভাল থাকার পরিবেশটি যাতে আরো বেশী মাত্রায় ভাল করা করা যায় সে ব্যাপারে যতœশীল হতে হবে কানাডায় বসবাসরত প্রতিটি মুসলমানেরও।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কন্ঠ