প্রবাসে পরহিতকর্ম -৯৮

ইউরোপের পথে পথে

রীনা গুলশান

বিষন্ন হয়ে সুন্দরের দিকে এগিয়ে যাওয়া। সবার মনটাই কম বেশী খারাপ ছিল। আমি উপলব্দি করছিলাম, আমার ভাইয়ের মনটা কতটা খারাপ ছিল। কারণ দু’বছর আগে ভাইয়া একটা কুইক ভিজিটে আমেরিকা এসেছিলেন্ তারমধ্যও মাত্র ৫/৬ ঘন্টার জন্য নিউইয়র্ক থেকে আমাকে দেখতে এসেছিলেন।

যাইহোক আমাদের পরিকল্পনা ছিল আমরা ফ্রাঙ্কফুর্টে নেমে হোটেলে চলে যাব আর আমার ভাইজি তার বাসায় চলে যাবে। এবং পরে আমরা মিট করবো। আমার ভাগ্নি তিন্নিকে মোটেই আমারা বলিনি যে আমরা এমনকি জার্মানীতে আসবো। এমনিতে সে আমার ট্যুরের ছবি দেখেছিল ফেসবুকে। আমরা জার্মানীতে আসবো সে ভাবেনি। কারণ ২০১৭ সালে একবার গিয়েছিলাম। তাই ভেবেছে ওখানে যাবো না। আমরা ভেবেছিলাম ওকে সারপ্রাইজ দিব। কিন্তু মাহিন চুপি চুপি সব ফাঁস করে দিয়েছে। আমাদের ইউরো ট্রেন যখন ফ্রাঙ্কফুর্ট এর মেইন স্টেশনে থামলো তখন দারুণ উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। আমরা ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে নামবো, দেখি ট্রেনের মধ্যেই নাসির উঠে আমার ব্যাগটা ধরে সামনে হাঁটা শুরু করলো। আমরাতো হতভম্ব। এমনিতেই জানি, নাসিরের অজস্র গল্প। এতটা উদার এবং মহানুভব ছেলে আমি এই জীবনে খুব কমই দেখেছি। যাইহোক, সে সোজা আমাদের ব্যাগ, সুটকেস তার গাড়িতে তুললো। মাহিনকেও তার বাড়িতে যেতে দিল না। বললো, ‘তুই আবার তোর বাড়ি যাবি কেন? খালা যতক্ষণ আছে, তুইও থাকবি।’

রায়হানকে নিয়ে একটু প্রব্লেম হচ্ছিল। সে কখনো কারো বাসায় উঠে না। খুব অনকম্ফোর্ট ফিল করে। কিন্তু নাসিরের কাছে সবার সব কিছু ভেসে গেল।

রাতের জার্মানী দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম আমরা। স্টেশন থেকে খুব বেশী দূরে না নাসিরের বাসা। আমরা অল্প সময়ের মধ্যেই তার আলয়ে চলে এলাম। তিন তলায় তিন্নির এপার্টমেন্টে যেতেই জড়িয়ে ধরে হাসি-কান্না মিলিয়ে একাকার। ওকে শেষ দেখেছিলাম ১৯৯৮ সালে। তার কিছুদিন পর তিন্নি চলে গেল জার্মানীতে আর আমরা কানাডায়। এরপর আমরা দেশে যখন যাই, তিন্নির যাওয়া হয় না। আর তিন্নি গেলে আমাদের দেখা পায় না। তবে টেলিফোনে, ফেসটাইমে রেগুলার কথা হয়। আর মাহিনের সাথে তো তিন্নির রেগুলার দেখা হয়। নাসিরের সাথে তিন্নির বিয়ের পর থেকে এই পর্যন্ত নাসিরের প্রশংসা শুনতে শুনতে কান পেকে গিয়েছিল। আজ স্বচক্ষে দেখলাম। ওদের এক ছেলে এক মেয়ে। এসে সালাম দিল। ছেলেটা বাংলা ধরতে গেলে পারেই না। তবে মেয়েটা অনেকটা পারে।

ফ্রাঙ্কফুর্টে লেখকের সঙ্গে মাহিন ও তিন্নি

তিন্নি বাংলাদেশী স্টাইলে হরেক রকম খাবার বানিয়ে টেবিল ভরে রেখেছে। আমাদের খুলনার অনেক রকম ডিস ছিল। রায়হানের খুব মজা হলো। সে যেহেতু এসব রেগুলার খেতে পায় না। তাই বেশ আরাম করে খেল।

রাতে প্রায় ২/৩ পর্যন্ত চুটিয়ে আড্ডা হলো। তারপর সবাই ঘুমাতে গেলাম। তিন্নি আমি আর মাহিন এক সাথে ঘুমাতে গেলাম, সেখানে আবারো আড্ডা ৪টা পর্যন্ত। আবার ভোরে উঠে নামাজ পড়ে একটু ঘুমালাম। ৮/৯টার দিকে উঠলাম। দেখি তিন্নি পুরাই বাঙ্গালী স্টাইলে আটা সেদ্ধ করে রুটি বেলছে। আমি জলদি করে রুটি ভাজলাম। আর মাহিন আলু ভাজি করলো। কতদিন পর এই বাঙ্গালী নাস্তা। আমি বাড়িতে এগুলো করিনা বললেই চলে।

যাইহোক, খুব মজা করে রুটি আলুভাজি আর সুজির হালুয়া খেয়ে আমরা ৫ জন বের হলাম। তিন্নির বাচ্চারা বেশ বড়। ওরা আর সাথে গেল না। সকালে বাইরে বের হয়েই খুব অবাক হয়ে গেলাম। ওদের কন্ডো থেকে ৩০/৩৫ হাত দূরেই সাবওয়েতে প্রবেশ করার সিড়ি। এত কাছে? এখানে মোট তিনটে কন্ডো বিল্ডিং দেখলাম। সবার পার্সোনাল। তিন্নির কন্ডোটা বেশ প্রশস্ত। তিন বেডরূম, বেশ বড় লিভিং স্পেস।

আমরা এখন যাব Zeil এ। আমাদের টিকিট কাটতে দিল না। নাসির সবার টিকিট কাটলো। অন্য আর একটা দারুন জায়গাতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সারাদিন ওখানেই কেটে যাবে। তাই আমরা আর ওখানে গেলাম না। অন্য সব জায়গাতে অনেক বেশী দিন ঘুরেছি। বিশেষ করে বেলজিয়াম এবং সুইজারল্যান্ডে। এখন জার্মানী দেখার জন্য সময় কম। তাছাড়া এখানে ঘোরার তেমন আগ্রহ আমাদের কারোর ছিল না। কারণ এর আগেও আর একবার এসেছিলাম।

যাইহোক আমাদের পরিকল্পনা আজ ডাইরেক্ট সেন্টার এ (ডাউন টাউনে) গিয়ে ঘুরবো। যতদূর সম্ভব। তা নাহলে আগামী কাল বাকিটা। তারপর আবার মাহিনের বাসায় যেতে হবে। ও বলে রেখেছে।

আমাদের ৪৫ মিনিটের মত লাগলো Zeil এ যেতে। মজার ব্যাপার জার্মানীর ফ্রাঙ্কফুর্টের সেন্টার এর কাঠামো প্রায় ইংল্যান্ডের মত। গোট ডাউনটাউনের চারপাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ‘মাইন’ নদী। Zeil স্ট্রিটটা ১৪ সেঞ্চুরীতে এর নামকরণ হয়। এই স্ট্রিট ফ্রাঙ্কফুর্টের সেন্টারকে প্রদক্ষিণ করে আছে। ঠিক মাইন নদীর মত। ইউরোপের অন্য যত দেশে গেলাম, তার সাথে কোন মিলই নাই। তবে ইংল্যান্ডের সাথে কিছুটা মিল পেলাম। সবটা নয়। যাইহোক, সেন্টার (ডাউন টাউন) প্রায় সব জায়গাতেই (এমনকি নর্থ আমেরিকাতেও) একটাই মিল, আপনাকে হেটে হেটে সব কিছু দর্শন করতে হবে। আমি অলরেডী অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এবং খুব মজা পাচ্ছি যে যেহেতু ইউরোপের অন্যান্য দেশ ঘুরে সব শেষে এলাম জার্মানীতে। এখন আমি একটার সাথে আর একটার মিল খুঁজে পাচ্ছি। মাইন নদী (ইংরেজীতে অবশ্য লেখে Main এইভাবে) যদিও তারা উচ্চারণ করে ‘মাইন’ বলে। অসম্ভব সুন্দর। ওখানে বেশ বড় একটা শিপ নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখায়। আমাদের টরন্টোর হারভার ফ্রন্টের মত।

আমরা শিপে উঠবো কি উঠবো না, এটা নিয়ে বেশ তর্ক বিতর্ক চললো। আমার খুব একটা ইচ্ছা ছিল না। কারণ কানাডাতেও ৩/৪ বার উঠেছি। আমেরিকার স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখতে গেলেও আপনাকে এই জাহাজে উঠতে হবে। টিকিটের টাকাও কম না। আর নাসির খুব যন্ত্রণা করছে। আমাদের টাকা খরচাই করতে দিচ্ছে না। খুব এমবারেসিং। আফটারঅর জামাই মানুষ।

অবশেষে আমরা ঠিক করলাম ডাউন টাউনটা আগে হেটে হেটে দেখতে থাকি। আগামীকাল মল এ যাবো। প্রথমেই হাটতে হাটতে Romerberg এর দিকে চললাম। ওমা, এটা দেখি প্রায় ৭০ ভাগ ব্রাসেলস এর Centre এর মত। বিশাল বিশাল প্রাসাদ। তবে Romerberg এর প্রাসাদগুলো অসম্ভব কালারফুল।

আমরা অত্যন্ত আনন্দ চিত্তে, আনন্দমাখা ভবনগুলোর দিকে চললাম। (চলবে)

রীনা গুলশান, টরন্টো

gulshanararina@gmail.com