ভাইরাস অর্নিথিসাইরাস: সময়ের ঘেরাটোপ

হাসান জাহিদ

পরদিনই এলো মেয়েটা। জলজ্যান্ত একটা প্রায়-যুবতী মেয়ে ওর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। অভীক তাকে ঘরে বসাল। এই প্রথম কোনো অপরিচিত যুবতী একটা মেয়ে ওর মুখোমুখি বসল। অভীক নির্লিপ্ত দৃষ্টি মেলে দেখল ডালিয়াকে। তারপর কফি বানিয়ে নিয়ে এলো দুজনের।

ডালিয়া কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, “চমৎকার, আমি দুধ মেশানো কফি খাই কিন্তু কালো কফি যে এত স্বাদের হতে পারে, বুঝিনি।”

“এখন বলুন আপনার গল্প, বলছিলেন নিজের কথা বলবেন।”

“হ্যাঁ, বলব, তার আগে বলুন আমি দেখতে কেমন।”

“আমি মেয়েদের বিষয়ে অনভিজ্ঞ, তাছাড়া কাব্যিটাব্যি আমার তেমন জাগে না। আমি কবিতা গল্প উপন্যাস তেমন পড়িনি। ননফিকশন কিছু পড়েছি।”

“তবু বলুন আমি দেখতে কেমন।”

“বেশ। টিপিক্যাল বাঙালি মেয়ে, কালো এলোচুল। মায়াময় চাহনি। শ্যামলা, হালকা-পাতলা গড়ন।”

মেয়েটি হাসল। বলল, “যতটা বেরসিক ভেবেছিলাম আপনি তা নন, কাব্যিও আছে, পাস করেছেন আপনি। আচ্ছা, আমার কথা বলি…।”

মেয়েটি তার ক্লেদাক্ত জীবনের কথা বলল। হাজব্যান্ড এই দেশে আসতে চায়নি শেকড় ছেড়ে। এসেছিল সন্তানের মায়ায়। একদিন সে বাসা ছেড়ে চলে যায়। পরে শুনেছিল সে নিজ দেশে ফিরে গেছে।

দুইহাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল ডালিয়া।

“হুম। খুব দুঃখজনক।”

“তারপর আর যোগাযোগ নেই। নিজেকে অপরাধী মনে হলো। সে শেকড় ছেড়ে এইদেশে আসতে চায়নি; আমিই জোর করে তাকে এনেছি।”

অভীক মনোযোগ দিয়ে শুনে বলল, “বেদনাদায়ক।”

মেয়েটি মিনতি করে বলল, “আমাকে গ্রহণ করো তুমি, নইলে আমাকে বেশ্যা হয়েই বাকি জীবন কাটাতে হবে।”

“কী জানো, আমি সংসারী নই, উড়নচণ্ডী, আমার চালচুলোর ঠিক নেই। কোনো নারী আসেনি আমার জীবনে। আর আমি বুড়ো হয়ে গেছি। তুমি এখনও কমবয়সী।”

“আমি যৌবন পার করতে যাচ্ছি, আর তুমি তোমার যৌবন শুরু করবে, নতুনভাবে। তোমাকে আমি গড়ে তুলব মনের মতো করে।”

“তা হয় না। আমি আমার জীবনটাকে ছাঁচে ফেলতে পারিনি কেনোদিন। আমি পারব না ডালিয়া।”

“তাহলে প্রেমিক হও।”

উদাস চোখে জানালার (ফোকরের) বাইরে তাকায় অভীক।

“আমি তোমাকে বলেছি, প্রেম কী আমি বুঝিনি; বুঝলে আমার জীবনে যে ছায়ার মতো প্রেম এসেছিল, তাকে আমি অনুসরণ করতাম।”

ডালিয়া চুপ হয়ে গেল। নীরবতা গ্রাস করল দুই মানব মানবীকে। মেয়েটি বলল, “তুমি সত্যিই রহস্যে ঘেরা।”

অভীক হাসল।

“তুমি নিষ্ঠুর।”

মেয়েটি যেতে উদ্যত হয়। তাকে কেমন ভগ্ন, আশাহত ও ক্রন্দসী আর একইসাথে ঋদ্ধ মনে হলো। নীরবে চলে গেল মেয়েটি।

…বিদ্যুৎচমকের মতো একটা দৃশ্য উঁকি দিল মনে। ওর নাম ডালিয়া নয়, ওর নাম প্রকৃতি। ওর প্রথম প্রেম।

এই জীবাণু সময়টা মানুষকে ঘরবন্দি করে যেমন প্রকৃতিকে ফিরিয়ে এনেছে তেমনি প্রকৃতি ওর দুয়ারে এসে ঘুরে গেছে। ধন্যবাদ, টাইম ম্যাশিন।

“তুমি আমার বুকের ভেতর বসে রিয়েলটাইম মনিটরিংয়ের কাজ করছো।” অভীক নিজেকেই শোনাল।

প্রকৃতি। একটা শ্যামলা-শুটকো মেয়ে, সামান্য কোঁকড়ানো চুল, বয়সেও অনেক ছোটো, চুলের গোছা কপালের ওপর টানটান হয়ে থাকত লাল ব্যান্ড লাগানোর কারণে। দুইচোখে কাজল কালো মায়া, আর সব মিলিয়ে ওকে দেখতে ভারী আদুরে ও মিষ্টি লাগত।

প্রকৃতি বলেনি কেন? আসলে প্রকৃতি বলে না কিছু। বুঝে নিতে হয়। তাই। কিন্তু মানুষ যখন সীমা অতিক্রম করে, তখন কানে কানে কিছু বলে যায়। ওর ফেসবুকে এতটা দিন ঘাপটি মেরে বসে ছিল প্রকৃতি। কেন সে খেয়াল করেনি?

আসলে ওর একটা সময় ছিল, সেই সময়টা অযত্নে-অলক্ষ্যে চলে গেছে। তা আর ফিরে পাবার নয়। অভীক ফোন করল।

“তুমি পরিচয়টুকু দাওনি কেন?”

“আমি কতবার পরাজিত হবো? অতীতে ফিরিয়ে দিলে আমাকে, ফেসবুকে চিনতে পারলে না। এমনকি কাছে গেলাম, তা-ও তুমি চিনতে পারলে না।”

“ঘাট হয়েছে আমার। ভুল বুঝতে পেরেছি।”

“একটা মধুর অতীতকে গলা টিপে মেরে ফেলে এখন ভুল বুঝতে পারছো? তুমি কি ভুল বুঝতে পেরেছ একথাটা বলার জন্য আমাকে ফোন করেছ?”

অভীক উত্তর খুঁজে পেল না। কিছুক্ষণ পর সে বলল, “তুমি আসো প্রকৃতি, আমরা টাইম ম্যাশিনে চড়ে তোমার আমার অতীতে ফিরে যাব। তোমার মনে আছে, শ্যাওলা ধরা নিচু দেয়ালের ওপারে দাঁড়িয়ে তুমি হাসতে, কানে ফুল গুঁজতে গুঁজতে? কোথাও থেকে যেন হাসনোহানার সুবাস আসত?”

ফোনের অপরপ্রান্তে কাচভাঙা হাসিতে ভেঙে পড়ল প্রকৃতি। হাসি থামেই না। কিছুক্ষণ পর প্রকৃতি বলল, “তুমি নির্লজ্জ, কাপুরুষ। তুমি কাল্পনিক কোনো প্রাণী, মহাশূন্যে উড়ে বেড়াও উপগ্রহের মতো, তুমি আর ফিরতে পারবে না স্বাভাবিক জীবনে। তোমার অধঃপতন হয়েছে। আমি তোমার দ্বারে আর আসতে পারব না। আমি ফিরে গেছি পুরোনো পেশায়।”

আবার শব্দ করে হেসে ফোন কেটে দিল প্রকৃতি।

১১

অভীক চুল কাটাতে বের হয়েছিল। দূর থেকে দেখল একটা সেলনে কাচের ভেতর থেকে লাল লেখা স্ক্রল করছে। লেখা ছিল: ইউনিসেক্স সেলন। ‘উই আর কেøাজড আনটিল ফারদার নোটিস।’ কাছে এসে সে নোটিসটা পড়ল।

অভীক একদৃষ্টে চেয়ে থাকে আকাশের দিকে। শহরটার নীল আকাশে ধূসর-সাদা মেঘের অলস অনিশ্চিত ঘুরাঘুরি। এই সেলন-রাস্তা-ছুটন্ত গাড়ি, চারপাশের ইমারত, এমনি কোনো পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল আগে কখনও; সব যেন তার চেনা। আগের কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি। কানের কাছে কেউ বলল, দেজা ভু।

                অভীকের ফোন বেজে ওঠে। সে পকেট থেকে ফোন বের করে বলল, “হ্যালো।”

                “আমি প্রকৃতি। তুমি কোথায় আছো, টাইম ম্যাশিনে?”

                “নিজেই জানি না কোথায় আছি। তুমি কিছু বলবে?”

“বলতে তো চাই, কিন্তু কীভাবে শুরু করব, বুঝতে পারছি না; আমি গুছিয়ে কিছু বলতে পারি না।’

                “আমার কাছে গুছিয়ে বলতে হবে না।”

                “হুম। আমি তোমার সাথে কাটাতে চাই বাকিটা জীবন।”

                “আমি ক্ষয়িত, ভ্যাগাবন্ড আর উচ্ছৃঙ্খল।”

                “টাইম ম্যাশিন তোমাকে গ্রাস করেছে; আমি জানি তুমি গোছানো স্বভাবের। তুমি যা ভয় পাচ্ছ তা অহেতুক ভয়। তুমি আমি …।             

                “তোমাকে বলেছিলাম আমি অশুভ পথে নেমে গেছি আবার, আমি নামিনি।”    

“ভালো, বেশ ভালো।”

                “তুমি কি আমাকে উপহাস করছো?”

                “আমি নিজেকেই উপহাস করি, ধীক্কার দিই নিজকে।”

                “তুমি মনে হয় বাইরে কোথাও; হয়তো টাইম ম্যাশিনে চড়ে অন্য কোথাও গেছ, মনটাও তোমার ভালো নেই। পরে কথা বলব।” প্রকৃতি ফোন কেটে দিল।

১২

অভীক ফিরে আসে। বাইরে ঠাণ্ডা ছেনালী হাওয়া, ঘরের ভেতর আদিম ইঁদুরেরা ওর পায়ের কাছ দিয়ে চকিতে চলে যায়। প্রকৃতির কথাগুলো ভেতরে অনুরণন তোলে, মনে হয় যুগ যুগ আগে বলা কথাগুলো যেন সুদূর অতীত থেকে ভেসে আসছে ইথারে। কোথায়, কোন্ এক অতীতের পাণ্ডুর মহামারীর সময়ের সাথে এই ব্যপ্তমান বর্তমানের একই রূপ, একই ডাইমেনসন।

দুই মাস পর।

অভীক সন্ধ্যায় তার বেইজমেন্ট কক্ষে ধূমপান করছিল আর বই পড়ছিল। রাসেল হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে বলল, “শুনেছেন মার্কহাম স্ট্রিটে একটা ভালুক নেমে এসেছে?”

“শুধু একটা ভালুক!” অভীক রাসেলের দিকে তাকিয়ে তিরস্কারের ভঙ্গিতে বলল, “ভ্যাম্পায়ার, কায়োটি, শেয়াল, এমনকি চীনা কুংফু যোদ্ধারাও টরোন্টোর রাস্তা দখলে নিয়ে নাচতে শুরু করবে।”

অভীক নতুন সঙ্গী পেয়েছে। রাসেল তার নাম। ছাত্র, এবং সে পিজা ডেলিভারির কাজ করে। অলি চলে যাওয়ার পর, রাসেল, যাকে অভীক আগে চিনত, এখানে এসে তার সাথে থাকতে শুরু করে।

রাসেল অভীককে জিজ্ঞাসা করল, “এটা কি সত্য যে আপনি এবং অলি ভাই বাড়ির মালিক দম্পতিকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন? আপনি বেইজমেন্টের ভিতরে আবার ধূমপান করছেন, যদিও মালিক আপনাকে এবং অলি ভাইকে ভিতরে ধূমপান করতে নিষেধ করেছিলেন।”

অভীক হেসে বলল: “সত্যি, আমাদের একটা পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে তাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়ার প্ল্যান না।”

রাসেল কৌতূহল নিয়ে অভীকের দিকে তাকাল, “পরিকল্পনাটি কী ছিল?”

অভীক পুরো গল্পটি বলল এবং তার আর অলির পরিকল্পনা খুলে বলল। শুনে রাসেল একচোট হেসে নিল।

অভীক হাসল কিন্তু পরের মুহূর্তে বিষাদগ্রস্ত কন্ঠে বলল, “ওকে খুব মিস করি। সে আমাদেরকে ছেড়ে চিরতরে চলে গেল।”

“আপনি কি মনে করেন প্রকৃতি আমাদের কাছে ফিরে এসেছে, নাকি সে প্রতিশোধ নিচ্ছে।”

“প্রতিশোধ নিচ্ছে; প্রকৃতি ফিরে আসেনি। এসব বিক্ষিপ্ত ঘটনা; রাস্তায় লোকজন কম, তাই নিকটবর্তী ঝোপঝাড় বা গুহায় হাইবারনেটেড প্রাণীরা বেরিয়ে আসছে। এটা প্রকৃতির প্রত্যাবর্তন নয়; প্রকৃতি মানুষের অনেক অপকর্ম সহ্য করেছে, বিশেষ করে শিল্পবিপ্লবের শুরু থেকে মানবসৃষ্ট বিধ্বংসী কার্যকলাপের কারণে।”

অভীক বলে যায়: “আমি একটা কথা বলি, প্রকৃতি চিরকাল থাকবেÑযে আকারে-প্রকারে হোক না কেনÑপাতাবিহীন গাছ, অথবা পর্যাপ্ত গাছের আচ্ছাদনবিহীন বন। বাস্তুতন্ত্র থাকবে, কিছু উল্লেখযোগ্য উপাদানের অভাব থাকবে, তবে এটি থাকবে; গাছের ডালে পাতা ফলানোর দায়িত্ব মানবজাতির।”

১৩

রাতে খাওয়ার সময় রাসেল বলল, “প্রকৃতি ফিরে এসেছে, এই ভাইরাসের প্রয়োজন ছিল।”

“আমাদের কিছু পরিবর্তন দরকার ছিল, এটাই ঘটছে,” অভীক উত্তর দিল, “তবে আমাদের একটি কম ক্ষতিকারক ধরনের ভাইরাসের দরকার ছিল, এটি মারাত্মক যেহেতু এখনও পর্যন্ত কোনো কার্যকরী ভ্যাক্সিন আবিষ্কৃত হয়নি।”

“শিগগিরি আপনি ভ্যাক্সিন পাবেন, এবং এটি ক্যানেডা থেকে শুরু হবে।”

“আমাদেরকে অবশ্যই আশাবাদী হতে হবে। আচেবে ইগবোল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন, ইগবো ভাষায় একটি প্রবাদ আছে: ‘যেখানে কিছুর পতন হয়, সেখানে অন্য একটা কিছু দাঁড়িয়ে যায়।”

“আচেবে?”

“চিনুয়া আচেবে, একজন নাইজেরীয় লেখক, তাঁর উপন্যাস ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’ বিশ্ববিখ্যাত হয়ে ওঠে। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। একটি অসভ্য দেশে আমার পতন হয়েছিল, এবং এখন আমার উত্থান হয়েছে টরোন্টোতে।”

“ভালো কথা, আপনি আমাকে বলেছিলেন যে আপনি কুকুরের মাংস খেয়েছেন এবং আপনি সর্বদা আতঙ্কে ছিলেন, এবং নিখোঁজ ছেলেটিকে আর কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেন? কী ঘটেছিল সেখানে?”

“আমি একদিন তোমাকে বলব একদিন।”

***

সেইরাতে অভীক খুব মাথাব্যথায় ভুগতে শুরু করে। সে একটি পেইনকিলার গলাধঃকরণ করে বিছানায় গিয়েছিল। এক পর্যায়ে ঘুমিয়েও পড়ে, কিন্তু ভয়ে আবার জেগে উঠল, অভীক ঘামতে শুরু করে। বাকি রাত সে উদ্বেগ এবং অস্থিরতায় অতিবাহিত করল। সে স্লিপওয়াকারের মতো ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, এবং  একটা ভয় তার কাছে ফিরে এলো আবার।

তার জন্মভূমিতে তার আত্মীয়রা এমনকি জানতেন না যে তার কী হয়েছিল বা কেন সে নিখোঁজ হয়েছিল। একমাত্র অভীক বুঝতে পেরেছিল যে, ছেলেটির মস্তিষ্ক-মাংস-কিডনি-যকৃত-অণ্ডকোষ এমনকি তার লিঙ্গও খবিশগুলোর পেটে চলে গিয়েছিল, যারা নির্জন গলির শেষ মাথায় ওৎ পেতে থাকত। হয়তো তার হাড়গুলি তাদের রান্নাঘরের আবর্জনা বা বিনে স্থান করে নিয়েছিল।

অভীক ঘরে পায়চারি বন্ধ করল। সে বিছানায় বসে সিগারেট ধরাল। আর গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। ভাবছিল, এটা কি সত্য যে সে একটি লজে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছিল, যেখানে একটি সরু গলি ছিল, যা দেখতে ছিল বিশ্রামরত একটা আজদাহা কালো বিষাক্ত সাপের মতো।

১৪

এক ছুটির দিনে অভীক উন্মুখ হয়ে ছিল বাইরে যাওয়ার জন্য। এক রবিবার, এবং রবিবারটি রবিসমৃদ্ধ রোদেলা দিন ছিল, সে আর রাসেল ব্লাফারস পার্কে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।

                তারা জঙ্গলের কিনারায় একটি বেঞ্চে বসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করে।

রাসেল বলল “আপনার কাছে শুনে আমিও কিছু কিছু পড়লাম।”

“কী?”

“দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে জাপানিজদের ল্যাবরেটরি সম্পর্কে। অবাক ও হতাশ করার মতো ব্যাপার, জাপানিজদের মতো সুুসভ্য জাতির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন শাসক, সেনাবাহিনি ও নীতিনির্ধারকগণ কতটা নিষ্ঠুর ছিলেন।

ইউনিট ৭৩১ ছিল জৈবিক এবং রাসায়নিক অস্ত্র উৎপাদনের জন্য জাপানি রয়্যাল আর্মির পরিচালিত গোপন গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এটি দ্বিতীয় সিনো-জাপান যুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ছিল। জৈবিক বা রাসায়নিক অস্ত্র তৈরির জন্য এই বিশাল পরীক্ষাগারে মানুষ ছিল পরীক্ষার উপকরণ।”

অভীক নিবিষ্টচিত্তে ওই পারের জঙ্গলে কিছু দেখছিল, তার দৃষ্টি অনুসরণ করে রাসেলও দেখল।

একটি হরিণ দম্পতি এবং একটি শাবক জঙ্গলের কিনারায় হাঁটছে ধীর গতিতে।

“সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে চমৎকার প্রাকৃতিক সব উপাদান দিয়ে আশীর্বাদ করেছেন, কিন্তু আমরা অকৃতজ্ঞ। আমাদের তাঁর করুণা প্রার্থনা করা উচিত।”

“আমি মনে করি, এই মহামারীর সময়ে প্রার্থনা করাই সেরা নিরাময়কারী।” রাসেল বলল।

“শুধুমাত্র মহামারীর সময়ে নয়, সর্বদা। তুমি যখন খুশি হও তখন তাঁর কাছ থেকে করুণা চাও, এবং যখন তুমি অসুখি হও তখনও তার ভিখ মাগো।”

“শাবকটাকে দেখো, এর বয়স কত হতে পারে?” অভীক রাসেলকে জিজ্ঞাসা করল।

“আমার কোনো ধারণা নেই।”

“বড়জোর দুই বা তিন দিন। সে এখনও টলোমলো। এখন তুমি, এটাকে ধরো এবং ফ্রিজিং পয়েন্টে রাখো, আর দেখো যে মরতে এর কত সময় লাগে।”

“আপনি এমন কিছু করতে পারেন না।”

“আধুনিক মানুষ এটা করেছে, কিন্তু কোনো হরিণ শাবক নিয়ে নয়; তিনদিনের মানুষের  বাচ্চাদের দিয়ে এমন নিরীক্ষা চালানো হয়েছিল।”

“আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। এটা কোথায় হয়েছিল? কারা করেছে?” রাসেলকে হতভম্ব দেখাল, সে অভীকের মুখের দিকে তাকাল।

“এটা একটা ল্যাবরেটরিতে ঘটেছিল। শুধু পরীক্ষার জন্য। এটি একটি নমুনা ছিল, একটি পরীক্ষায় তিনদিনের মানবশিশুকে হিমায়িত হয়ে মরতে কত সময় লেগেছিল তা নথিভুক্ত করা হয়েছিল।”

অভীকের বর্ণনা রাসেলকে নির্বাক করে দিয়েছিল। তারা বেঞ্চ ছেড়ে কিছু সময়ের জন্য একটি সরু খাল বরাবর হাঁটল।

“এটা কোথায় হয়েছিল?” রাসেল জিজ্ঞাসা করল। অভীক থামল, এবং বলল, “চলো ফিরে যাই, সূর্য অস্ত যাচ্ছে।”

“হ্যাঁ, কিন্তু এই নারকীয় ঘটনা কোথায় ঘটেছিল?”

“ইউনিট ৭৩১ নামে একটি গবেষণাগারে।”

“আমি বুঝতে পেরেছি।” রাসেল বলেছিল, “আমি এটি নিতে পারছি না।”

“কিছু পরীক্ষাকে  ‘psychopathically sadistic, with no conceivable military application’ বলে বর্ণনা করা হয়েছিল।” অভীক বলল।

***

সময় বয়ে চলে।

একদিন রাতে সে ঘুমাতে গেল, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ধীর হয়ে গেছে বলে তার মনে হলো, এবং তারপর হঠাৎ সে বহু ওপর থেকে ধাক্কা খাওয়ার মতো দ্রুত পতন অনুভব করল। সে পড়ছিল…।

সে কি শামিমের মাংস খেয়েছিল! যেদিন শামিম নিখোঁজ হয়ে যায় এবং সন্ধ্যায় ফিরে আসেনি, সেদিন সন্ধ্যায় লজের রাঁধুনি তাকে এবং অন্যান্য অতিথিদের প্রচুর মাংস পরিবেশন করে। রাঁধুনিকে খুশি দেখাচ্ছিল এবং বলেছিল যে এটি একটি বন্য হরিণের মাংস যা তারা জঙ্গলে শিকার করেছিল।

সে এবং অন্যান্য অতিথিরা সমস্ত মাংস খেয়ে ছিল; ভিন্ন স্বাদের মাংস খেয়ে লজবাসীরা পয়সা উশুল করেছিল। হররোজ কুত্তার মাংস কত আর ভালো লাগে।

লজ মালিকের কি নির্জন গলির অদ্ভুত লোকদের সাথে সংযোগ ছিল?

অভীক চেতনা হারায়।

১৫

কোয়ারেন্টাইন থেকে অভীক ফিরে এসে অভীক লেটারবক্সে তার নামে আসা একটা নোটিস পেলÑবাড়িওয়ালার কাছ থেকে বকেয়া ভাড়া পরিশোধের নোটিস। তারা ভ্যাঙ্কুভার থেকে পত্র পাঠিয়েছেন।

হাসপাতালে এবং কোয়ারেন্টাইনে থাকার সময় প্রকৃতি ফোনে ঘনঘন খোঁজ নিত তার। তাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিল; দূর থেকে তার সাথে কথা বলেছিল।

      “রাসেল, আমি মনে করি যে ক্যানেডার ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে লেখা উচিত আমার। মহামারী থেকে আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো, আমার ভেতরে সৃষ্ট নতুন শৈল্পিক উপলব্ধি।”

“ভালো সিদ্ধান্ত, আপনার ইংরেজি ভালো, এবং আপনি এই দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিষয়ে একজন স্নাতক। রাতে আমি এখানে থাকব; কাল আমার ডিউটি নেই। আমি ফার্স্ট ন্যাশনস সম্পর্কে জানতে চাই। আপনি তো এই বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন।”

“আমার কিছু লেখা স্থানীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।”

“কী বিষয়ে লিখেছিলেন?”

“শেষ লেখাটা ছিল ক্যানেডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী স্যার জন এ ম্যাকডোনাল্ডের কিংস্টনের রিডো স্ট্রিটের ঐতিহাসিক বাড়ি সম্পর্কে।”

“ঐতিহাসিক স্থান ছাড়াও ক্যানেডার কোন্ দিকগুলো আপনাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে? আমি জানি আপনি প্রকৃতিকে প্রকৃতিকে ভালবাসেন।”

“ক্যানেডীয় জাতিসত্তা, বহুসংস্কৃতিবাদ, আদিবাসী মানুষ। এবং ইনুইট, মেটিস আর ফ্র্যাঙ্কোফোন। আমি গোড়া থেকেই শুরু করবÑক্যানেডায় ফরাসি, ইংরেজ এবং অন্যান্য জাতি যারা বিভার পশম ও চামড়া শোষণের জন্য এসেছিল, এবং কীভাবে তারা একটি মিশ্র সাংস্কৃতিক মোজাইক গঠন করেছিল যার সাথে যুক্ত হয়েছে তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক সময় বিশ্বজুড়ে অভিবাসীদের আগমন।”

অভীক কয়েক মুহূর্তের জন্য থামল এবং সিগারেট ধরাল।

“শোনো, প্রত্যেক মানুষেরই একটা গল্প আছে, যা তিক্ততা, উপভোগ, কষ্ট এবং রোমাঞ্চের মিথস্ক্রিয়া। তবে আমার গল্প পাঠকদেরকে অবমাননার গল্প বলবে। আমার বইয়ের দ্বিতীয় অংশে অবমাননার রূপ-অনুভূতি তুলে ধরবে।

ক্যানেডার প্রাথমিক ইতিহাসে, শ্রমিকরা, বিশেষ করে ১৯০০এর দশকের শুরুতে ক্যানেডিয়ান প্যাসিফিক রেলওয়ে নির্মাণের সময় প্রথমদিকের বসতকারী চিনা শ্রমিকরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ক্যানেডায় পৌঁছানোর পর, ১৫০০০ চিনা শ্রমিকসহ অনেক অভিবাসী শ্রমিক খারাপ জীবনযাপন এবং বেতন বৈষম্যের শিকার হন। তারা দমনের শিকার হয়েছিলেন এবং তারা সামান্য বেতনের জন্য কঠোর পরিস্থিতির সম্মুখীন হন।

ইতিহাসবিদদের মতে, তারা অনেক কষ্ট ভোগ করেছিলেন এবং প্রায় ৬০০ চিনা মারা যান।

ফার্স্ট ন্যাশনসও এর ব্যতিক্রম নয়; ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তারা অনেক কষ্ট ভোগ করেছিলেন। অনেক চুক্তিতে এবং মৌখিকভাবে তাদের আশ্বাস দেয়া হয়েছিল যে তাদের অধিকার সংরক্ষণ করা হবে, কিন্তু এটি কখনও বাস্তবায়িত হয়নি।” 

রাসেল বলল, “আপনি জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছেন।”

অভীক নিঃশব্দে রান্নাঘরে গিয়ে কফি নিয়ে এলো। সে রাসেলের হাতে কফি তুলে দিয়ে তার কফি নিয়ে একটা চেয়ারে বসল।

অভীক বলল, “আমি ‘আলু’ শব্দটি দিয়ে আমার লেখাটা শুরু করব, এটা কীভাবে আগাবে বলে তোমার মনে হয়?”

“আলু?” রাসেল হেসে বলল, “বাংলাদেশে এটা সবচেয়ে সস্তা সবজি, আর বাংলাদেশে আলু নিয়ে অনেক কৌতুক আছে।”

“গোটা পৃথিবীটাই তো একটা কৌতুক। ঈশ্বর আমাদের সাথে ঠাট্টা করছেন। তিনি শিকারি এবং আমরা শিকার।”

                “আলু কেন? আপেল কেন নয়?”

“না, আপেল না। আপেল সমস্ত দুর্যোগের মূল কারণ। ইভ আপেল খেয়েছিলেন এবং ঈশ্বর আদম ও ইভকে পৃথিবীতে নিক্ষেপ করেছিলেন। ইভ যদি আপেল না খেতেন, আমরা স্বর্গে থাকতাম। নিউটন মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব আবিষ্কার না করলে, একজন অশিক্ষিত ব্যক্তি যে বেগমপাড়ায় তার স্ত্রী বা স্ত্রীগণদের রেখেছে, সে এত ‘মাধ্যাকর্ষণ’ দেখাত না,” অভীক উত্তেজিত হয়ে উঠল, “বেগমপাড়ায় অনেক মাধ্যাকর্ষণ রয়েছে।”

“হ্যাঁ, ঠিক।” এবার রাসেল উত্তেজিত হয়ে বলল, “একদম ঠিক।”

“আমার সেটিং হবে হিউরন কাউন্টি, যেখানে আমি দুটি পরিবারকে চিনিÑআইরিস এবং স্কটিশ বা স্কচ। আলুর দুর্ভিক্ষের সময় তাদের পূর্বপুরুষরা এখানে এসেছিলেন। তারা প্রথম এখানে এসেছিলেন খালি হাতে। ইংরেজরা তাদের কালো ভেড়ার গল্প নিয়ে এখানে বসতি স্থাপন করেছিলেন, এবং কিছু ক্ষেত্রে সম্পত্তিবঞ্চিত হয়ে বা আর্থিক অবস্থা পড়ে যাওয়ায় কিংবা গোপন প্রণয়ের পরিণতিতে পরিযায়ী হয়েছিলেন তারা।”

১৬

এক বছর পর।

সারাবিশ্বে টিকা উদ্ভাবিত হচ্ছিল, বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতের টিকা মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছিল। কিছু টিকা কাজ করেছে, কিছু করেনি। কেউ কেউ অ্যান্টিবডি তৈরি করবেÑটিকা নেয়ার ফলে, ডাক্তার এবং বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন।

***

সাসকাচুয়ানের অচিহ্নিত হৃদয় বিদীর্ণ করা গণকবর সম্পর্কে সিবিসিতে সংবাদ কান্ট্রিস্টাইলের বাঙালি আড্ডাটা মুখ থুবড়ে পড়ে। 

হাসিব বলল, “এটি মানবতাবিরোধী বড় অপরাধ। ভাবতে কষ্ট হয় যে, দক্ষিণ সাসকাচুয়ানের একটি প্রাক্তন আদিবাসী আবাসিক স্কুলে ৭০০টিরও বেশি অচিহ্নিত কবর আবিষ্কৃত হয়েছে।”

“আদিবাসীদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অনেক দিক অভীক ভাই তার লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন।” মামুন বলল “আশ্চর্যজনক বিষয়।”

“কী?” হাসিব তাকাল মামুনের দিকে।

“অভীক ভাই এতসব জানতেন কীভাবে? আদিবাসীরা যে কতটা অত্যাচারিত হয়েছে অতীতে, সেসব তথ্যে ভরপুর পুরো একটি অধ্যায় উনি আমাকে পড়ে শুনিয়েছিলেন।”

***

২৩ জুন, ২০২০।

গজগজ করে অভীক এগিয়ে গেল আয়নার সামনে। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজের গালেই ঠাপ্পর মারতে ইচ্ছে হলো। দিনদিন চেহারাটা কেমন বুড়িয়ে যাচ্ছে।

                সড়াৎ করে পেছনে তাকাল সে, কে যেন পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। সে ফের আয়নার দিকে চোখ মেলে নিজের গালে হাত বুলিয়ে খোঁচাদাড়ির স্পর্শ নিল।

                এবার আয়না ওকে চুম্বকের মতো টানতে লাগল।

                “এ কীরে বাবা, টাইম ডিস্টর্শন নাকি স্পেস টাইম কন্টিনামের খেলা?” সে টাশ্ শব্দে আয়নার সাথে বাড়ি খেল এবং উল্টোদিকে পড়ে গেল।

                জ্ঞান ফিরে অভীক অনুভব করে তার ভেতরে যেন সুনামির প্রবাহ বইছে। সে উপলব্ধি করে সে কোভিড-১৯এ আক্রান্ত। কেউ নেই এই বাড়িতে। রাসেল চলে গেছে আলবার্তাটাতে একটা চাকরি যুগিয়ে। বৃদ্ধ দম্পতি গেছেন ভ্যাঙ্কুভারে।

                “এটাই বাকি ছিল।” বিড়বিড় করে বলল অভীক।

অভীক আরও কিছু বলেছিল বিড়বিড়িয়ে, বিধবা বাড়িটা শুধু সে কথা শুনেছিল। (সমাপ্ত)

হাসান জাহিদ

টরন্টো

আশির দশকের গল্পকার। কানাডায় তিনি সাংবাদিকতা ও কালচার অ্যান্ড হেরিটেজ বিষয়ে গ্রাজুয়েট।