প্রবাসে তরুন প্রজন্মের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা : সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেমিনার অনুষ্ঠিত

এপ্রিল ১০, ২০১৭

বাবা মায়ের সঙ্গে ফাহমি। ছবি : ফাহমির মা সাবিনা রহমানের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

প্রবাসী কণ্ঠ : গত ৯ এপ্রিল টরন্টোতে বাংলাদেশ সেন্টার ও কমিউনিটি সার্ভিসেস এর উদ্যোগে প্রবাসে তরুন প্রজন্মের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতার বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেন্টারের নিজস্ব মিলনায়তনে শতাধিক অভিভাবকের এর উপস্থিতে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে তরুন প্রজন্মের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। আরো উপস্থিত ছিলেন সম্প্রতি ডিপ্রেশনের শিকার হয়ে ইহজগৎ ছেড়ে চলে যাওয়া সাবিত খন্দকারের বাবা সেলিম খন্দকার ও মা মিসেস খন্দকার।
উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি টরন্টোতে সাবিত খন্দকার ও ফাহমি অরিফ রহমান নামের দুই তরুন ডিপ্রেশনের শিকার হয় আত্মহত্যা করেন। বিষয়টি কমিউনিটিকে ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়ে যায়। প্রমিজিং এই দুই তরুনকে হারিয়ে তাদের বাবা-মায়ের পাশাপাশি কমিউনিটিতেও নেমে আসে গভীর শোকের ছায়া। এই পরিস্থিতিতে শোকের পাশাপাশি সবাই সচেতন হয়ে উঠার তাগিদও অনুভব করেন ভবিষ্যতে যেন এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই বক্তব্য রাখেন সাবিত খন্দকারের বাবা সেলিম খন্দকার। তিনি বলেন, গত প্রায় তিন মাস যাবৎই সাবিত কথা কম বলতো। কিন্তু সে এরকম কম কথা বলার ছেলে ছিল না। খুব কৌতুক প্রিয় ও মিশুক ছিল সে। আমার যে বড় ভাই, আমি যার সঙ্গে কথা বলতে একটু ভয় পাই, তার সঙ্গেও সাবিত ফান করতো। আমার সঙ্গে একটু দুরত্ব নিয়ে চললেও মা’র সঙ্গে সাবিতের যথেষ্ট সখ্যতা ছিল।

সেরকম একটি ছেলে হঠাৎ করে চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। কোথাও যেতে চাইত না।
জনাব সেলিম আরো বলেন, সাবিতের এই চলে যাওয়া আমাদের কমিউনিটির জন্য একটি ওয়েকআপ কল। তিনি বলেন, ডিপ্রেশন নিয়ে আমার আরো আগেই সতর্ক হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু ডিপ্রেশন বিষয়ে আমার কোন ধারণা ছিল না।
তিনি বলেন, লেখাপড়া বা অন্য কোন বিষয়ে ছেলেমেয়েদের উপর কখনো চাপ সৃষ্টি করা উচিত নয়। অন্যের সঙ্গে তুলনা করাও উচিৎ নয়। এটা একেবারেই ভুল।
জনাব সেলিম বলেন, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বাবা মা’র এমন ব্যবহার করতে হবে যাতে তারা ফিল করে যে, পরিবারই তাদের সবচেয়ে বড় নির্ভরতার জায়গা এবং বাবা-মা’ই তাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু। তারা যাতে লোনলি ফিল না করে সে বিষয়টির উপরও নজর রাখতে হবে। এরকম হলে ছেলেমেয়েরা যখন ডিপ্রেশন বা এরকম কোন সমস্যায় পড়বে তখন তারা সেটি বাবা-মা’র সঙ্গে শেয়ার করবে।
সবশেষে শেষে জনাব সেলিম কান্নাজড়িত কণ্ঠে সকলের কাছে তাদের ছেল সাবিতের জন্য দোয়া কামনা করেন। এই সময় দর্শক গ্যালারিতে বসা অভিভাবকদের অনেককেই অশ্রুসজল হয়ে উঠতে দেখা যায়।
আত্মহত্যার বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির এই অনুষ্ঠানে সদ্য আত্মহত্যাকরী আরেক তরুন ফাহমির বাবা আরিফ রহমান ও মা সাবিনা রহমানের আসার কথা ছিল। কিন্তু তারা এখনো মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছেন বলে অনুষ্ঠানে আসতে পারেন নি।

অনুষ্ঠানে তরুন প্রজন্মের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। পাশে দন্ডায়মান মাহবুব রেজা। ছবি : বিসিসিএস

অনুষ্ঠানে বয়স্কদের ডিপ্রেশনে ভোগার বিষয়টিও আলোচনায় আসে। এ বিষয়ের উপর বক্তব্য রাখেন শরীফুল ইসলাম। তিনি নিজেও একজন ডিপ্রেশনের রোগী ছিলেন এবং আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা দিয়েছিল তার মধ্যে। তিনি তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।
ডালিয়া নামের একজন অনুষ্ঠানে নিজের ডিপ্রেশনের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন সবাইকে সচেতন করার জন্য। তিনি ডিপ্রেশনের শিকার হন পরিবারিক সহিংসতার কারণে।
অনুষ্ঠানে ফারজানা বিন্দু নামের একজন মা তার নিজের ছেলের ডিপ্রেশনে ভোগার কথা শেয়ার করেন উপস্থিত দর্শকদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ছেলের সঙ্গে তার অত্যধিক সখ্যতা বিদ্যমান থাকার পরও কখন কিভাবে যেন সে বিষন্নতার শিকার হয়ে যায়।
তরুন প্রজন্মের প্রতিনিধি ফারীন অনুষ্ঠানে এক নাতিদীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। মানসিক রোগ বিষয়ের উপর তিনি টরন্টোতে লেখাপড়া করছেন। তিনি বিস্তারিতভাবে এই ডিপ্রেশনের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা কি ভাবে করা যায় সেই বিষয়ে বর্ণনা দেন। ‘LIGHT’ নামের একটি সংগঠনেরও তিনি উদ্যোক্তা যেটি অতি সম্প্রতি গঠন করা হয়েছে বাংলাদেশের ঐ দুই তরুণে আত্মহত্যার ঘটনার পর। এই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি ও তার সহযোগিরা ডিপ্রেশনে ভোগা রোগীদের পরামর্শ দান করবেন।
অনুষ্ঠানে তরুন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের আরো কয়েক জন কথা বলেন। তারা বলেন, তরুনদের সচেতন করে তোলার পাশাপাশি তাদের বাবা-মাকেও ডিপ্রেশন বিষয়ে সচেতন ও শিক্ষিত করে তুলতে হবে।
অনুষ্ঠানে অন্যান্য যারা বক্তব্য রাখেন তাদের মধ্যে ছিলেন- ডাঃ মিজানুর রহমান, লিটন কাজী, তৌহিদ নোমান, নাহার ঝর্ণা, আয়েশা, সরোয়ার চৈধুরী, নূরুল ইসলাম, মনির হোসেন, আবুল বাসার, অধ্যাপক আব্দুল আউয়াল, নাহিদ শরীফ, হাসিব, আক্তার আহমেদ, ডাঃ সায়েদা বারী, হাসিনা কাদের প্রমুখ।
বক্তাগণ সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেন ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে বাবা-মায়ের বন্ধুসুলভ সম্পর্ক গড়ে তোলাটা খুবই জরুরী এই প্রবাসে। আর ছেলে-মেয়েদের উপর যাতে অযথা মানসিক চাপ সৃষ্টি না হয় সে জন্য অপর কারো সঙ্গে তুলনা না করারও আহ্বান জানান তারা।
ডিপ্রেশন ও আত্মহত্যার বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিচালিত এই অনুষ্ঠানটির সার্বিক পরিকল্পনা,পরিচালনা ও উপস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন বাংলাদেশ সেন্টার ও কমিউনিটি সার্ভিসেস এর সহ-সভাপতি ড. মাহবুব রেজা।
মাহবুব রেজা বলেন, আজকের এই অনুষ্ঠানই শেষ অনুষ্ঠান নয়। আমরা আগামীতেও এ বিষয়ের উপর আরো অনুষ্ঠানের আয়োজন করবো।
(বিস্তারিত দেখুন আগামী সংখ্যায়।)

অনুষ্ঠানে উপস্থিত অভিভাবকগণ । ছবি : বিসিসিএস