বিশ্ব মানবিক দিবস

১৯ আগস্ট জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্ব মানবিক দিবস। প্রতি বছর এই দিনে সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হয়। মানবসেবায় যারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন দিবসটিতে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।

দিবসটির উদ্ভব এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একজন মানবিক ব্যক্তির নাম। তিনি হলেন সেরগিও ভিয়েরা দ মেলো। জাতিসংঘের মানবিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ব্রাজিলের কূটনীতিক এই মহান ব্যক্তি ৩৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে মানবসেবা করে গেছেন। এই ধারাবাহিকতায়ই ২০০৩ সালের ১৯ আগস্ট জাতিসংঘের তরফ থেকে তিনি আরও ২২ জন সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইরাকের বাগদাদে গিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেখানে এক বোমা হামলায় মৃত্যু হয় সেরগিও এবং তাঁর দলের সদস্যদের।

১৯ আগস্ট জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্ব মানবিক দিবস। প্রতি বছর এই দিনে সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হয়। ছবি : pwonlyias.com

মৃত্যুর আগে প্রায় তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সেরগিও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যারা যুদ্ধে সব হারিয়েছেন তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন মানবসেবার ব্রত নিয়ে। কোনো বৈরী বা প্রতিকূল পরিস্থিতিই তাঁকে তাঁর ব্রত থেকে টলাতে পারেনি।

সেরগিও ও তাঁর সহকর্মীদের আত্মত্যাগের সেই মহানব্রত যাতে থেমে না যায় সে জন্য তাঁর ও তাঁর সহকর্মীদের মৃত্যু দিনটিকে জাতিসংঘ কর্তৃক বিশ্ব মানবতা দিবস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরপর ২০০৯ সালের ১৯ আগস্ট থেকে বিশ্ব মানবতা দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। 

ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই মানব ইতিহাসের প্রায় সবটাই কেবল যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাস। শাসন, শোষণ আর মানুষ হত্যার কাহিনীই দখল করে আছে গোটা ইতিহাস। সে কারণে প্রশ্ন উঠে, বিশ^ সত্যিকার অর্থে কতটুকু মানবিক?

পৃথিবীতে মানব ইতিহাসের এমন কোন প্রজন্ম নেই যারা যুদ্ধ দেখেনি, গণহত্যা দেখেনি, মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ দেখেনি। স্বৈরশাসন, শোষণ, নির্যাতন, গুম, খুন, ধর্ষণ, বিনা বিচারে আটক, বাকস্বাধীনতা হরণসহ আরো অনেক কিছুই তাঁরা দেখেছে। নিজের দেশে না হলেও অন্য দেশে দেখেছে। এবং আরো দুঃখজনক বিষয় হলো, এসব যুদ্ধবিগ্রহ আর অন্যায় অত্যাচারের যাঁরা নায়ক তাঁদের প্রায় কারোরই কোন বিচার হয়নি। ক্ষমতার জোরে, অর্থের জোরে বা কূটকৌশল অবলম্বন করে তাঁরা বরাবরই পার পেয়ে গেছে শাস্তির হাত থেকে।

আজকে মানুষের মানবিকতা কতটা ভূলুণ্ঠিত হয়ে আছে তার এক জ¦লজ্য্যন্ত প্রমাণ ফিলিস্তিনীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। বিশ্ববাসীর চোখের সামনেই ফিলিস্তিনে ঘটে চলছে গণহত্যা। আর গোটাবিশ্ব অসহায়ের মত তাকিয়ে দেখছে নেই নির্মমতা। কোন বিচার নেই, নেই প্রতিকার! 

বাংলাদেশে অতি সম্প্রতি যে হত্যাকান্ডগুলো ঘটেছে তার বিচারও কি পাবে ভুক্তভোগীরা? হত্যাকান্ডের যে নায়ক তাকে কি বিচারের সন্মুখীন করা যাবে? সম্ভবত না। এভাবেই যুগ যুগ ধরে মানবিকতা ভূলুণ্ঠিত হয়ে আসছে দেশে দেশে।

উইকিপিডিয়ার এক তথ্যে বলা হয়, আজকে সারা বিশ্বে কমবেশি তেরো কোটি মানুষ কেবল মানবিক সহায়তার উপর ভর করে বেঁচে আছে। এদের যদি এক সাথে দলবদ্ধ করে পৃথিবীর কোন স্থানে আশ্রয় দেওয়া হয়, তাহলে সেটি পৃথিবীর দশম জনবহুল দেশ হিসাবে পরিগণিত হবে।

আরো লক্ষণীয় যে, যুদ্ধ ছাড়া ব্যক্তিস্বার্থ ও তুচ্ছ কারণেও বিশে^র প্রায় সব প্রান্তেই মানবতা লঙ্ঘিত হচ্ছে।

এরকম পরিস্থিতিতে বিশ্ব মানবতা দিবস আমাদের মানবিক সহায়তার অপরিহার্যতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। জাগ্রত করে মানুষের মানবতাবোধকে। বিশ্বের নানা প্রান্তের সংঘাত, দুর্যোগ, সংকটময় পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা দেয়। বিশ্ববাসীকে উৎসাহিত করে সমতা, ন্যায়বিচার, শৃঙ্খলা এবং মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও এর প্রসারের ব্যাপারেও।

এবারের বিশ্ব মানবিক দিবসে আমরা ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের সর্বত্র মানবিক সহায়তা কর্মীদের মানবিক কর্মকান্ডের প্রতি অভিবাদন জানাই। তাঁদের যে নিস্বার্থ আত্মদান এবং বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যে দৃঢ় প্রত্যয়, তা একদিকে যেমন অনুপ্রেরণাদায়ক অন্যদিকে তা প্রশংসারও দাবীদার। মানবতার সেবার জন্য তাঁদেরকে জানাই আমাদের সাধুবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *