অবশেষে ‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’ নামক দাম্ভিকতার অবসান হতে যাচ্ছে অন্টারিওতে
খুরশিদ আলম
অন্টারিও’র ক্ষমতাসীন সরকার প্রাদেশিক সংসদে নতুন একটি বিল (বিল-১৪৯) উত্থাপন করেছে, যা পাস হলে অন্টারিও-তে চাকরি প্রার্থী পেশাজীবী ইমিগ্রেন্টদের সামনে থেকে বিরাট একটি বাধা দূর হবে। এই বাধাটি হলো ‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’। কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স না থাকলে নতুন আসা প্রফেশনাল ইমিগ্রেন্টদেরকে তাঁদের নিজ নিজ প্রফেশনের চাকরিতে প্রবেশের জন্য লাইসেন্স দেওয়া হয় না এবং চাকরিতে প্রবেশের সুযোগও দেওয়া হয় না।
উল্লেখ্য যে, কানাডায় চাকরির বিজ্ঞাপনে বহু বছর ধরে একটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়ে আসছে যার নাম ‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’। পেশাজীবী ইমিগ্রেন্টদেরকে উদ্দেশ্য করেই এই শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ কানাডায় চাকরি করতে হলে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রার্থীর কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স থাকতে হবে। কিরকম অদ্ভূত, উদ্ভট এবং অবাস্তব এক শর্ত! কানাডা যেন মর্ত্যলোকের কোন দেশ নয়, স্বর্গলোকের দেশ। এখানে যে কোন পেশায় কাজ করতে হলে মর্ত্যলোকের অভিজ্ঞতা কোন কাজে লাগবে না।
আর শুধু পেশাজীবীদের ক্ষেত্রেই নয়, এরকম শর্ত জুড়ে দেয়া হয়ে আসছে মিল-ফ্যাক্টরী বা হোটেল রেস্টুরেন্টের চাকরিতেও! সুপরিয়রিটি কমপ্লেক্স এর এক নগ্ন উদাহরণ এই কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স। আর সুপরিয়রিটি কমপেক্স যে প্রকৃত অর্থে ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স অর্থাৎ হীনমন্যতা তা তো আর ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না।
কথা হলো, একজন নতুন আসা ইমিগ্রেন্টকে যদি এখানে চাকরি করার সুযোগই না দেওয়া হয় তবে সে কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স পাবে কোথায়?
কানাডায় নতুন আসা ইমিগ্রেন্টদেরকে সুকৌশলে চাকরির বাজার থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য ‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’ নামক এই উদ্ভট প্রথার উদ্ভাবন হয়েছে বলে মনে করেন অনেক ইমিগ্রেন্ট। জেনোফোবিয়া (Xenophobia) বা ইমিগ্রেন্ট ভীতি প্রধানত কাজ করছে এর পিছনে। অহংবোধ বা দাম্ভিকতাও রয়েছে এই নীতির পিছনে। যেটা সুপরিয়রিটি কমপ্লেক্স। আর এর ভিক্টিম হলেন নতুন আসা ইমিগ্রেন্ট বিশেষ করে অশে^তাঙ্গ ইমিগ্রেন্টরা। আর যাঁদের নামের সঙ্গে ইসলাম, মোহাম্মদ, খান ইত্যাদি পদবি বা পরিচয় রয়েছে তাঁদের বেলায় একটি বাড়তি যন্ত্রণা রয়েছে। সেই যন্ত্রণা হলো, চাকরির ইন্টারভিউতে তাঁদেরকে ডাকা হয় কম।
আমরা জানি পাশ্চাত্য বিশ্বে জেনোফোবিয়া বা বিদেশীদের সম্বন্ধে অহেতুক ভয়ের একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে অনেক বছর ধরেই। কানাডাও এর বাইরে নয়। এখানে যাঁরা জেনোফোবিয়ায় ভুগেন তাঁদের ধারণা ইমিগ্রেন্টরা তাঁদের চাকরি কেড়ে নিচ্ছেন, বাসস্থান দখল করে নিচ্ছেন, সরকারী সুযোগ সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছেন এবং তাঁদেরকে সংখ্যালঘুতে পরিনত করছেন। কিন্তু এই ধারণা মোটেও সঠিক নয়। একটি কাল্পনিক ধারণার বশবর্তী হয়ে তাঁরা ইমিগ্রেন্টদেরকে ভাল চোখে দেখছেন না। এই গোষ্ঠির লোকদের মধ্যে যাঁরা হায়ারিং অথরিটি অর্থাৎ যাঁদের হাতে চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে তাঁরাই মূলত কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স এর বিষয়টি সামনে নিয়ে এসে একটা বিদ্বেষমূলক পরিস্থিতি তৈরী করে রেখেছে এতদিন ধরে।
আর এ কারণে দেখা গেছে গত দুই/তিন দশকের মধ্যে কানাডায় আসা ইমিগ্রেন্টদের সিংহভাই চাকরি পাননি তাঁদের নিজ নিজ পেশায়। এই পেশাজীবীদের মধ্যে আছেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, বিজ্ঞানীসহ আরো নানান পেশার লোক। নিজ নিজ পেশায় চাকরি না পেয়ে তাঁরা কেউ হয়েছেন পিজ্জা ডেলিভারী ম্যান, কেউ হয়েছেন ক্যাব ড্রাইভার, কেউ হয়েছেন মিল-ফ্যাক্টরীর দিন মজুর। যাঁদের সকালে চাকরি থাকে তো বিকেলের গ্যারান্টি নেই। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চলেনা। মাস শেষে বাড়ি ভাড়া দিতে গিয়ে বা অন্যান্য বিল পরিশোধ করতে গিয়ে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে হয়। পরের মাসে গিয়ে এক ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধ করতে গিয়ে আরেক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে হয়।
অন্টারিও’র “শ্রম, অভিবাসন, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী ডেভিড পিকিনি-ও বলেন, “বহু বছর ধরে কানাডায় বহু মানুষকে এমন সব চাকরির দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে যেখানে ক্যারিয়ারের বিকাশ এবং ভালো পদে উন্নতির সুযোগ খুবই সামান্য অথবা একেবারেই নেই। ওইসব চাকরির জন্য তাঁরা ওভার কোয়ালিফাইড। আমাদের নিশ্চিত করা দরকার যাতে এসব লোক ভালো বেতনসহ সন্তোষজনক ক্যারিয়ার পেতে পারে, যা পেশাজীবী কর্মীর ঘাটতি সামলে উঠতে সহায়ক হবে।”
তিনি আরো বলেন, “অন্টারিওতে নবাগতরা যখন অর্থবহ অবদান রাখার সুযোগ পায় তখন সবাই জিতে যায়।”
প্রকৃত অর্থে এই কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স এর বিষয়টি নতুন আসা ইমিগ্রেন্টদের জন্য শুধু আর্থিক ক্ষতির কারণই নয়, অপমানকরও এবং এর মাধ্যমে তাঁদের মানবাধিকারও লংঘন করা হচ্ছে। ইতিপূর্বে অন্টারিও হিউম্যান রাইটস কমিশনও এর নিন্দা জানিয়েছিল এবং তাদের নতুন এক পলিসিতে এই অভিমতও দিয়েছিল যে এটি নিশ্চিতভাবেই ইমিগ্রেন্টদের মানবাধিকার লংঘন। কানাডায় অন্টারিও হিউম্যান রাইটস কমিশনই প্রথম সংগঠন যারা এই ধরণের একটি বক্তব্য দিয়েছিল।
‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’ নামক শর্তটি যে কতটা অমানবিক আচরণ তা প্রতিটি পেশাজীবী ইমিগ্রেন্টই আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। বলা হয়ে থাকে যে, “কানাডা ইজ এ ল্যান্ড অব অপরচিউনিটি”। ধন দৌলত, সুখ শান্তি, নিরাপত্তা, দুশ্চিন্তাহীন নতুন জীবন ইত্যাদি সবই আছে কানাডায়। আছে আরো অনেক কিছু। একবার শুধু কানাডায় পৌঁছাতে পারলেই হয়। আর পিছনে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন নেই। শুধুই সামনে এগিয়ে যাওয়া। যাঁরা কানাডায় আসতে চান ইমিগ্রেন্ট হয়ে – এই হলো কানাডা সম্পর্কে তাঁদের ধারণা। এই ধারণা তাঁরা নিজের মন থেকে যে তৈরী করেন তা কিন্তু নয়। তাঁদেরকে এই স্বপ্ন দেখানো হয়। আর সেই স্বপ্নে বিভোর হয়েই অধিকাংশ লোক কানাডায় আসেন ইমিগ্রেন্ট হয়ে। দেশের মায়া, বাবা-মা, ভাই -বোন, আত্মীয়-বন্ধুদের মায়া ত্যাগ করে চলে আসেন সুদূর এই বৈরী আবহাওয়ার দেশ কানাডায়।
কিন্তু কানাডায় এসে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পেশাভিত্তিক চাকরি না পেয়ে তাঁদের মন ভাঙ্গতে সময় লাগে না। তখন অনেকেই মনে করেন তাঁরা বর্ণবাদের শিকার। সকল যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকার পরও নিজ পেশায় চাকরি না পাওয়ার কারণে তাঁরা অপমানিত বোধ করেন। তাঁদের প্রশ্ন, ‘আমরা যদি এখানকার চাকরিতে প্রবশে করার সুযোগই না পাই তবে ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’ কোথা থেকে পাবো? কানাডায় আসা একজন নতুন পেশাজীবী ইমিগ্রেন্টের ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’ নেই একথা সবাই জানেন। কিন্তু তারপরও তাঁদের কাছে কোন যুক্তিতে এবং কোন রহস্যজনক কারণে ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’ চাওয়া হয়?
উত্তর একটাই। সেটি হলো বর্ণবাদ। ইমিগ্রেন্টদের ভাষ্য, আমাদের গায়ের রঙ, আমাদের এথনিসিটি, আমাদের ধর্ম এ সবই ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে আমাদের চাকরি না পাওয়ার পিছনে। আর চাকরি যাতে দিতে না হয় সে জন্য এক উদ্ভট শর্ত তৈরী করে রেখেছে যার নাম ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’। এর মাধ্যমে কানাডিয়ান ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ইমিগ্রেন্টদের মানবাধিকার লংঘন করছে। তাঁদেরকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর মানুষ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। এমন কি যে সকল পেশাজীবী ইমিগ্রেন্ট কানাডায় এসে তাঁদের ডিগ্রি আপগ্রেড করেছেন বা নতুন কোন বিষয়ে ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা নিয়েছেন তাঁদেরকেও পেশাভিত্তিক চাকরি থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে ঐ ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’ নামক উদ্ভট শর্তের দোহাই দিয়ে। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, যে সকল অশ্বেতাঙ্গ ইমিগ্রেন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডিগ্রি ও দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞাতা নিয়ে কানাডায় আসেন তাঁদেরকেও ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’ নেই এই অজুহাত দেখিয়ে পেশাভিত্তিক চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। এ কারণে পেশাজীবী ইমিগ্রেন্টদের মেধা ও অভিজ্ঞতার অপচয় হচ্ছে বিপুল পরিমাণে।
চাকরি খাতে নবাগত অশে^তাঙ্গ ইমিগ্রেন্টরা নানাভাবেই বৈষম্যের শিকার হন। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, কানাডার অশ্বেতাঙ্গ ইমিগ্রেন্টরা চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বেশি বৈষম্যের শিকার হন। নয়টি দেশে পরিচালিত সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, জনবল নিয়োগে বিদ্বেষের দিক থেকে কানাডা প্রায় শীর্ষে!
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানী লিঙ্কন কুইলিয়ান ও তাঁর সহকর্মীরা বিভিন্ন শিল্পোন্নত দেশের চাকরিদাতা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মী নিয়োগের কিছু প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করেন। নিয়োগের আগে সাক্ষাৎকার প্রক্রিয়ায় চাকরি প্রার্থীদের সঙ্গে কিভাবে আচরণ করা হয় তা দেখার চেষ্টা করেন তাঁরা।
তাঁদের গবেষণার ফলাফলে কেউই বিস্মিত হননি। তাঁরা দেখেন, চাকরির সাক্ষাৎকারের জন্য অশ্বেতাঙ্গ প্রার্থীরা শ্বেতাঙ্গ প্রার্থীদের সমান ডাক পান না। বর্ণভিত্তিক ও জাতিগত সংখ্যালঘু গ্রুপগুলোর লোকদের প্রতি প্রায় সর্বব্যাপ্ত বৈষম্য দেখা যায়।
চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে অশ্বেতাঙ্গ ইমিগ্রেন্টরা বৈষম্যের শিকার হবার সম্ভাবনার দিক থেকে কানাডা ও যুক্তরাজ্য যৌথভাবে তৃতীয় অবস্থানে আছেন এবং এই দুই দেশে এর হার হলো ১১ শতাংশ। গবেষণায় দেখা যায়, আফ্রিকান, এশীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের বংশোদ্ভূত লোকেরা সমভাবে বৈষম্যের শিকার হন। অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদের ক্ষেত্রে বৈষম্য খুবই কম এমনকি অনেক সময় তা পরিসংখ্যানে উল্লেখ করার মতও নয়।
কানাডার শ্রমবাজারে আফ্রিকান, এশীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের বংশোদ্ভূত লোকদের উল্লেখযোগ্য অংশ বেকারত্বের অভিশাপে ভুগছেন এবং স্থানীয়দের চেয়ে মজুরিও কম পাচ্ছেন। গবেষকরা দেখেছেন বিদেশি দক্ষ ব্যক্তি যাঁদের নামের মধ্যে বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় স্পষ্ট, চাকরিদাতারা তাঁদেরকে খুব কমই সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকেন। বিদেশি নামের চেয়ে ইংরেজি বিশেষত ইউরোপীয় নামের গন্ধ আছে এমন প্রার্থীদের বেশি মাত্রায় সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়।
রিপোর্টে আরো দেখা গেছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইমিগ্রেন্টরা আসলে আরও দরিদ্র হয়েছে এবং যাঁরা ২০ বছরে বেশি সময় ধরে কানাডায় আছেন তেমন “দীর্ঘদিনের ইমিগ্রেন্টদের গড় আয় গত ৩৫ বছরেও বাড়েনি।”
আমরা আরো দেখেছি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক টরন্টোবাসীর জন্যই স্বল্প বেতন ও অনিশ্চিত কর্মসংস্থানের বিষয়টি দ্রুত জীবনধারার অংশ হয়ে উঠছে। এক হিসাবে দেখা গেছে টরন্টো ও তার আশপাশের ৪০ শতাংশ মানুষ তাঁদের চাকরির ক্ষেত্রে কোন না কোন ধরনের অনিশ্চয়তায় ভোগেন। আর ঝুঁকিতে থাকা সেইসব লোকেদের বেশিরভাগেরই নির্দিষ্ট পরিচিতি রয়েছে: তাঁরা হলেন ইমিগ্রেন্ট।
কানাডায় ইমিগ্রেন্টদের এই পরিস্থিতি হঠাৎ করে শুরু হয়নি। সুদীর্ঘ সময় ধরেই তাঁদেরকে বঞ্চিত করা হয়েছে নানান কৌশলে। ‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’ তার একটি অন্যতম উদাহরণ। তবে আশার কথা এই যে, শেষ পর্যন্ত এই অন্যায্য শর্তের পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। আগামী বছর শুরুর দিকে বিল-১৪৯ সংসদে পাশ হয়ে আইনে পরিনত হতে পারে। তখন চাকরির বিজ্ঞাপনে কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স এর শর্ত জুড়ে দেওয়া হবে বেআইনি। সরকারের একটি সংস্থা এই আইন মানা হচ্ছে কি না তা তদারকী করবে। চাকরি প্রার্থীরাও শ্রমমন্ত্রণায়ের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন যদি তাঁরা দেখেন কোন প্রতিষ্ঠান কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স এর শর্ত আরোপ করেছে।
উল্লেখ্য যে, কয়েক মাস আগে কানাডায় নতুন আসা প্রকৌশলীদের যোগ্যতার মাপকাঠি থেকে ‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’ নামক শর্তটি বাদ দিয়েছে ‘প্রফেশনাল ইঞ্জিনিয়ার্স অন্টারিও’ নামক নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। প্রকৌশলীদের চাকরির বাঁধা দূর করার লক্ষ্যই এই আইন করা হয়েছে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশিক্ষণ পাওয়া প্রকৌশলীদেরকে অন্টারিওতে লাইসেন্স পেতে এখন থেকে আর কানাডিয়ান ওয়ার্ক এক্সপিরিয়েন্স লাগবে না। প্রদেশের শ্রমমন্ত্রী গত ২৩ মে এ কথা বলেন। তিনি এটিকে “গেম চেঞ্জার” বা পুরো দৃশ্যপট পাল্টে ফেলার মত একটি পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেন।
২০২১ সালের অক্টোবরে অন্টারিও নতুন একটি আইন প্রবর্তন করেছিল যেখানে বলা হয় নিয়ন্ত্রিত কিছু পেশায় কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স এর শর্ত আরোপ করা যাবে না। এই আইনের অধীনে রয়েছে স্থপতি, হিসাবরক্ষক ও ইলেক্ট্রিশিয়ানসহ স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত নয় এমন ৩০টির বেশি পেশা ও ট্রেড। বিভিন্ন পেশা ও ট্রেড এর নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে ‘প্রফেশনাল ইঞ্জিনিয়ার্স অন্টারিও’ প্রথম ঐ আইন মান্য করে কানাডায় নতুন আসা প্রকৌশলীদের যোগ্যতার মাপকাঠি থেকে ‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’ নামক শর্তটি বাদ দিয়েছে।
‘নিউকামার উইমেনস সার্ভিস টরন্টো’র নির্বাহী পরিচালক সারা অসল্যা এই পরিবর্তনকে সাধুবাদ জানিয়েছেন এই বলে যে, আন্তর্জাতিকভাবে প্রশিক্ষিত পেশাদাররা যেসব অন্যায্য পদক্ষেপের মুখে পড়েন সেগুলি অপসারণের পক্ষে সমর্থনকারীদের জন্য এক “বিশাল বিজয়”। তিনি বলেন, “অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাও এই অন্যায্য কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স-এর শর্ত অপসারণের জন্য কাজ করবে এটা দেখার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি।”
কানাডায় এই ‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’ এর পীড়ন বা অত্যাচার সুদীর্ঘ সময় ধরেই চলে আসছে। অনেক সমালোচনা ও দাবীর পরও নীতিনির্ধারকদের টনক নড়েনি। ফলে এতদিন ধরে কানাডায় আসা উচ্চ শিক্ষিত ও দক্ষ ইমিগ্রেন্টরা তাঁদের সর্বোচ্চ অবদান রাখতে পারছেন না এ দেশের অর্থনীতিতে। অন্যদিকে কানাডার অর্থনীতিও বঞ্চিত হচ্ছে তার পাওনা থেকে।
এখন যত দ্রুত এই ‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’ নামক খামখেয়ালী ও উদ্ভট শর্তের বেড়াজাল থেকে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও চাকরি দাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বেরিয়ে আসতে পারবে ততই তা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে। ইমিগ্রেন্টদের শিক্ষা ও কর্মদক্ষতাকে তাচ্ছিল্য করে, তাঁদেরকে ডিসকোয়ালিফাইড করে কোন পক্ষই লাভবান হবে না। ‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’ নামক এই দাম্ভিকতা বা আত্মম্ভরিতা ঔপনিবেশিক যুগের মনমানসিকতা। আধুনিক যুগে এটি বেমানান ও নিন্দনীয়।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ