কলমবাজি
সাইদুল হোসেন
ভূমিকা
আমি গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা, আত্মউন্নয়ন (Self-help/self-development) এবং ইসলাম ধর্ম নিয়ে গবেষণামূলক লেখা লিখে চলেছি সেই ১৯৯২ সন থেকে। বইয়ের পাবলিকেশনের শুরু ২০০৪ সন থেকে। আজ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২৩টি। নূতন ৯টি বই প্রকাশনার অপেক্ষায় আছে।
আমার প্রকাশিত গল্প ও প্রবন্ধ বইয়ের সংখ্যা চার। পঞ্চমটি “আমার জীবনের নানা কথা” টরন্টো থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় মাসিক ‘প্রবাসী কণ্ঠ’ ম্যাগাজিনে online-এ publish হচ্ছে এবং সংগে hard copy-ও বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।
বর্তমান বইটির নাম দিয়েছি “কলমবাজি” কারণ ক্রমাগত কলম চালনা আমাকে intellectually and physically alive and alert রাখতে সাহায্য করে। বয়স হয়ে গেছে ৯০ বছর। শরীর দুর্বল হচ্ছে ক্রমেই। Ageing process-টাকে তো থামিয়ে রাখা যায় না। তাছাড়া আছে arthritic pain কোমরে ও দুই হাঁটুতেই। হাঁটাচলা খুবই কষ্টকর, walker-এর সাহায্য ছাড়া হাঁটতে পারি না। চব্বিশটি ঘন্টা বেদনাময় জীবন। তথাপি লিখে চলেছি, active থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, কারণ মরার আগে আমি মরতে চাই না।
আমার জীবন যেমন দীর্ঘ, আমার অভিজ্ঞতাও তেমনি নানা বৈচিত্র্যে পূর্ণ। জীবন আমার শিক্ষক, বই-পত্রপত্রিকা, movie-Internet-TV তেমনি আমার শিক্ষক নানাবিষয়ে। আমার জীবনের বহু অভিজ্ঞতার কথা আমি বলেছি পূর্ব প্রকাশিত আমার পাঁচটি গল্প-প্রবন্ধের বইতে। আশাকরি সর্বশেষে রচিত “কলমবাজি”-ও নিরাশ করবে না পাঠককূলকে। তবে মনে বড় ভয় যে এই বইটার রচনায় সমাপ্তি টেনে এর প্রকাশিত রূপটা দেখে যাওয়ার মত হায়াত মিলবে কি না। যাই হোক, আল্লাহ মালিক।
আমার লেখালেখি ও বইয়ের troublefree printing and publication-এর জন্য আমি গভীর কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা জানাই টরন্টোনিবাসী দুই উদার হৃদয় স্বামীস্ত্রীর প্রতি। আমির জামান ও নাজমা জামানের সদাসর্বদা হাসিমুখে সাহায্য-সহযোগিতা না পেলে আমি কখনো এতদূর এগিয়ে আসতে পারতাম না। আল্লাহ তাদের উপর রহমত করুন।
বিনীত
সাইদুল হোসেন
মিসিসাগা, ক্যানাডা
ডিসেম্বর ২০২২
(এক)
জিস্কো না দে খুদাতালা,
উস্কো না দে সাকে আসফ্উদ্দৌলা।
[আল্লাহ যাকে দেন না, তাকে
আসফ্উদ্দৌলাও দিতে পারেন না।]
এই মজাদার গল্পটা আমি ১১৬ বছর আগে (১৯০৬ খৃঃ) কলকাতা (ইন্ডিয়া) থেকে প্রথম প্রকাশিত একটা বিরাট সাইজের [১৬৪০ পৃষ্ঠা] বাংলা ডিক্শনারী থেকে সংগ্রহ করেছি। (১৬০৪ পৃষ্ঠা)
বৃটিশ আমলে উত্তর ভারতের অযোধ্যা (Oudh in English, হিন্দি, উর্দু) স্টেইটের বিখ্যাত দানবীর নবাব ছিলেন আসফ্উদ-দৌলা (১৭৪৮-১৭৯৭) তাঁর কাছে প্রার্থনা জানালে কেউ খালিহাতে ফিরে না, এই ছিলো জনশ্রুতি।
একদিন নগর পরিদর্শনকালে নবাব শুনতে পেলেন যে একজন ভিক্ষুক উচ্চস্বরে বলে যাচ্ছে : জিস্কো না দে খুদাতালা, উস্কো দে সাকে আসফ্উদ্দৌলা। জিস্কো না দে খুদাতালা, উস্কো দে সাকে আসফ্উদ্দৌলা … অর্থাৎ আল্লাহ যাকে কিছু দেন না, আসফ্উদ্দৌলা তাকে দিতে পারেন।
একথা শুনে নবাব সেই ভিক্ষুককে অন্য কোন এক সময় তাঁর সংগে দেখা করতে নির্দেশ দিলেন।
নির্দেশমত ভিক্ষুক নবাবের সংগে দেখা করতে গেলে তিনি তার হাতে একটা তরমুজ তুলে দিলেন। এতে সে খুব অসন্তুষ্ট হলো : “নবাব আমাকে এই সাধারণ একটা তরমুজ মাত্র দিলেন!” তাই মনের দুঃখে সে বাজারে গিয়ে সামান্য মূল্যে সেটাকে বিক্রি করে চানা ভাজা কিনে খেল।
পরদিন নবাব লোক পাঠিয়ে সেই ভিক্ষুককে তাঁর দরবারে ডেকে এনে জানতে চাইলেন তরমুজটা দিয়ে সে কি করেছে। ভিক্ষুক সেই তরমুজটা বিক্রি করে চানা ভাজা খেয়েছে শুনে নবাব খুব মর্মাহত হয়ে বললেন : “আরে হতভাগা, তুই করেছিস কি? তরমুজটার ভেতরে আমি যে তোর জন্য কিছু মণিমুক্তা লুকিয়ে রেখেছিলাম যাতে বাকি জীবন আর তোকে ভিক্ষা করতে না হয়!”
নবাবের কথা শুনে ভিক্ষুক তো মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। হায়, এ কি করে বসেছি আমি!
নবাব তখন সেই ভিক্ষুককে আদেশ দিলেন : এখন থেকে তুমি বলবে, “জিস্কো না দে খুদাতালা, উস্কো না দে সাকে আসফ্উদ্দৌলা”, অর্থাৎ আল্লাহ যাকে না দেন, তাকে আসফ্উদ্দৌলাও দিতে পারেন না।
জুন ১, ২০২২
(দুই)
“এক সফ্মে খা-ড়ে হুয়ে হ্যায়
মাহমুদ ও আয়াজ,
না রাহে কোঈ বান্দা
না কোঈ বান্দানেওয়াজ।”
কোন উর্দু কবির কবিতার অংশ এটা জানি না। এটা আমি শুনেছিলাম আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে বাংলাদেশে (ঢাকা) এক পীর সাহেবের মুখে। তিনি ছিলেন মূলতঃ অবাংগালী, উর্দুভাষী, তবে বাংলাভাষাটা তিনি ভালোই বলতে পারতেন, সংগে যদিও প্রচুর উর্দু শব্দ থাকতো।
এই কাহিনীটা গজনীর সুলতান মাহমুদকে কেন্দ্র করে রচিত। ইতিহাস বলে যে সুলতান মাহমুদ ১০০০ থেকে ১০২৬ খৃষ্টাব্দের ভেতরে ১৭ বার উত্তর ভারত আক্রমণ করে সেখানকার হিন্দু রাজ্যগুলোকে হত্যা ও লুটপাট করে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। সেই যুগে গজনী আফগানিস্তানের একটি শক্তিশালী ও ধনবান স্বাধীন রাজ্য ছিল। ১০৩০ খৃষ্টাব্দে সুলতান মাহমুদ মারা যান। তাঁর বাবার নাম ছিল সবুক্তগীন (Sabuktagin), তিনি ছিলেন একজন Turkish nobleman.
এবার মূল কাহিনীতে আসা যাক। সুলতান মাহমুদ গজনী যদিও একজন মুসলিম ছিলেন, কিন্তু তিনি নামায-রোজার ব্যাপারে ছিলেন উদাসীন। মসজিদে নিয়মিত যেতেন না। তাঁর সভাসদদের মাঝে “আয়াজ” নামে একজন উত্তম মুসলিম ছিলেন। এবং তিনি ছিলেন খুবই বুদ্ধিমান ব্যক্তি। সুলতান মাহমুদ তাকে খুব ভালোবাসতেন, এবং তাই তিনি আয়াজের নানা আবদারও সহ্য করতেন।
একদিন সুলতান মাহমুদ জরুরী বার্তাসহ আয়াজকে কোন একখানে পাঠালেন। বহু সময় চলে গেল, কিন্তু আয়াজ কোথায়?
অধৈর্য হয়ে সুলতান মাহমুদ তাঁর কিছু অনুগামীকে সংগে নিয়ে সেই ঠিকানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। মাঝপথে দেখা গেল এক মসজিদের বারান্দায় আয়াজ দাঁড়িয়ে আছে। খুব ক্রুদ্ধস্বরে সুলতান মাহমুদ তাকে বেরিয়ে আসতে আদেশ করলেন। কিন্তু আয়াজ বললো, “বাদশাহ! আমি আপনার ডাকে সাড়া দিয়ে এখন মসজিদ ত্যাগ করতে পারবো না কারণ আপনার চেয়েও বহুগুণ শক্তিশালী এক বাদশাহ আমাকে মসজিদের ভিতরে যেতে আদেশ করেছেন।”
সুলতান মাহমুদ রাগতঃস্বরে জানতে চাইলেন, “কে সেই বাদশাহ?”
বিনীত স্বরে কুর্নিশ করে আয়াজ বললো, “তিনি হচ্ছেন আল্লাহ যিনি জগতের সৃষ্টিকর্তা, আদেশদাতা, যিনি আপনারও সৃষ্টিকর্তা, প্রভু!”
আয়াজের কথা শেষ হতেই সুলতান মাহমুদ তাঁর সর্বদেহে কাঁপুনী অনুভব করতে লাগলেন, তাঁর অপরাধবোধ তাঁকে ভীত করে তুললো। আর কথা না বাড়িয়ে তিনি মসজিদের ভেতরে ঢুকে গেলেন, একই জায়নামাজে, একই সারিতে (সফ-এ) দাঁড়িয়ে দু’জনে একসংগে আসরের সালাত আদায় করলেন- তিনি বাদশাহ [বান্দানেওয়াজ] রইলেন না আল্লাহর সামনে, এবং আয়াজও সুলতান মাহমুদের বান্দা বা দাস রইলো না। দু’জনই একে অন্যের সমান হয়ে গেলেন, দুজনই আল্লাহর বান্দা হয়ে গেলেন।
এই ঘটনাটা খুব মশ্হুর (বিখ্যাত) হয়ে গেল। বহু শতাব্দী পর কোন এক উর্দু কবি সেটাকে কবিতার আকারে জনসমক্ষে প্রচার করলেন :
“এক সফ্মে খা-ড়ে হুয়ে হ্যায়
মাহমুদ ও আয়াজ,
না রাহে কোঈ বান্দা
না কোঈ বান্দানেওয়াজ।”
জুন ৮, ২০২২
(তিন)
প্রথম মানব আদমের সৃষ্টি
[মুসলিম সুফীদের কল্পনা ও বর্ণনা। নিতান্তই কাহিনী। কুরআন-হাদীস দ্বারা সমর্থিত নয়। তবুও কাহিনীটা আমি শোনাচ্ছি এই জন্য যে এতে প্রচুর শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। SHEM FRIEDLANDER লিখিত WHEN YOU HEAR HOOFBEATS THINK OF A ZEBRA বইটি থেকে সংগৃহীত (Pages 24 and 135) Printed in India. Year of printing not indicated. Publishers: Mazda Publishers, their address not printed.]
আল্লাহ মাটি ও পানির একটা mixture থেকে নবী আদমকে সৃষ্টি করলেন। এই mixture বা কাদাটাকে আল্লাহ্ চল্লিশ বছর ধরে ডলাইমলাই করলেন। এর ৩৯টি বছর আদম অশেষ বেদনা-যন্ত্রণা সহ্য করলেন, একটি মাত্র বছর তিনি কিছুটা শান্তিতে কাটালেন কারণ তখন তাঁকে পূর্ণ মানুষের রূপ দেয়া হয়ে গেছে।
আল্লাহ আদমকে বুঝতে দিলেন যে তাঁর দেহটা আল্লাহ কাদামাটি থেকে তৈরী করেছেন একমাত্র তাঁর ইচ্ছাতে (Will of Allah), এবং আরো বুঝতে দিলেন যে আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই বদ্লানো যাবে না। (পৃঃ ১৩৫)
এবার ২৪ পৃষ্ঠাতে কি বলা হয়েছে দেখুন।
আদম যখন তার পূর্ণ দেহ পেলেন, তাঁকে তাঁর ডানদিকে তাকাতে নির্দেশ দেয়া হলো। সেখানে তিনি দেখতে পেলেন তিনটি আলো [three lights]. তিনি প্রথম আলোকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার নাম কি? তুমি কোথায় থাক?”
“আমি হচ্ছি বুদ্ধি (Intelligence), আমি তোমার মাথায় থাকি”, জবাব দিল সে।
দ্বিতীয় আলোটিকে প্রথমটার মতই প্রশ্ন করলে সে জবাব দিলো, “আমি হচ্ছি বিবেক (Conscience), আমি তোমার চোখে বাস করি।”
তৃতীয় আলোটা এতোই উজ্জল যে আদম হাত দিয়ে তাঁর চোখের দৃষ্টিকে আড়াল করে আগের মতই প্রশ্ন করলেন, “তুমি কে? কোথায় থাক তুমি?”
আলো বললো : আমি দয়া-ক্ষমা-করুণা (Compassion), আমি তোমার হৃদয়ে (অন্তরে) বাস করি।”
এবার আদম তাঁর বামদিকে তাকালেন। সেখানে দেখতে পেলেন তিনটি অন্ধকার (darkness). প্রথম অন্ধকারকে প্রশ্ন করলেন, “তোমার নাম কি?”
সে বললো, “আমি হচ্ছি ঔদ্ধত্য, অযথা গর্ব (Arrogance), আমি তোমার মাথায় বাস করি।”
“অসম্ভব”, বললেন আদম, “সেখানে তো বুদ্ধি (Intelligence) বসবাস করে!”
“আমি সেখানে প্রবেশ না করা পর্যন্ত। যখন আমি মাথায় প্রবেশ করি তখন বুদ্ধি সেখান থেকে নির্বাসনে যায়,” বললো Arrogance.
দ্বিতীয় অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আদম তাকে প্রশ্ন করলেন, “তুমি কে?”
সে জবাব দিলো, “আমি হচ্ছি Insatiable Ambition (সর্বদা অতৃপ্ত উচ্চাকাংখা/ লোভ), আমি তোমার চোখে বাস করি।”
“কিন্তু সেখানে তো Conscience (বিবেক) বাস করে,” বললেন আদম।
“না, আমি যতক্ষণ ওখানে থাকি ততক্ষণ সে সেখানে থাকে না”, জানালো Ambition.
“এবার বলতো তুমি কে?”, তৃতীয় অন্ধকারকে প্রশ্ন করলেন আদম।
সে জবাব দিলো, “আমার নাম হচ্ছে ঈর্ষা (Envy), আমি তোমার হৃদয়ে (অন্তরে) বাস করি।”
“আমার হৃদয়ে (অন্তরে) তো দয়া-মায়া (Compassion) বাস করে,” বললেন আদম।
ঈর্ষা (Envy) তখন মৃদু হেসে বললো, “আমি যখন হৃদয়ে প্রবেশ করি তখন Compassion (দয়া-মায়া) সেখান থেকে দূরে সরে যায়।”
আশা করি পাঠক উপরের dialogue-এর বাণী হৃদয়ংগম করতে পেরেছেন।
জুন ১৫, ২০২২
(চার)
সন্ধ্যা এক, কাহিনী অনেক
[আমার ২০২২ সনের ডায়েরী থেকে]
গতকাল আমাদের একটা wedding reception-এ যেতে হয়েছিল। সেই ঘটনাটাকে কেন্দ্র করে একদিনে আমার কিছু অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিচ্ছি।
১) স্যুট পরে যেতে হবে। তাই closet খুলে ভেতরে ঝুলানো স্যুটের খোঁজ করলাম। একটা মাত্র স্যুট পাওয়া গেল। স্যুটের কোটের ভেতরের পকেটে হাত দিতেই অনুভব করলাম যে সেখানে মোটা একটা এনভেলাপ রয়েছে। সেটা বের করে এনভেলাপটা খুলে দেখলাম যে ২০০৯ সনে ঠিক এমনি একটা অনুষ্ঠানে (25th wedding anniversary) আমার লিখিত ভাষণ সেটা। সংগে সংগে প্রমাণ হয়ে গেল যে অনুষ্ঠান শেষে ঘরে ফিরে সেই যে স্যুটটা খুলে রেখেছিলাম, গত ১৩ বছরে আর সেটা আমি গায়ে দিইনি!
২) কোটের বুক পকেটে সুন্দর একটা দামী কলম ঝুলছে। সেটা দিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। সেটার কালি শুকিয়ে গেছে।
৩) প্যান্টটা পরতে চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না কারণ আমার বর্তমান কোমরের ঘের প্যান্টের ঘেরের চেয়ে দু’ইঞ্চি বেশী। অন্য ব্যবস্থা করতে হলো।
৪) আমি ড্রাইভ করি না। সুতরাং বরপক্ষ (আমাদের host) Uber-কে ডেকে ওদের ট্যাকসিতে আমাদের যাওয়া-আসার ব্যবস্থা করলেন। ধন্যবাদ। রাত সাড়ে ১১টায় বাসায় ফিরলাম।
৫) একটা হোটেলের Banquet Hall এ অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেখানে ঢুকে আমাদের জন্য reserve করা টেবিলে বসালেন বরের বাবা স্বয়ং। আমরা স্বামীস্ত্রী দু’জন ছাড়া আর কেউ নেই। চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখলাম – অতিথি সংখ্যা দু’শো ছাড়িয়ে যেতে পারে। অকল্পনীয় ব্যয়সাপেক্ষ আয়োজন। বর-কনে দুপক্ষ মিলেমিশে ব্যবস্থা করে থাকলে দুপক্ষের জন্যই সহজসাধ্য হবে খরচের ভারটা বহন করতে। ভাবলাম আমি।
৬) কিছুক্ষণ পর চারজনের একটি দল এসে আমাদের টেবিলে আসন গ্রহণ করলো। মা-বাবা, তাদের বিবাহিতা কন্যা ও তার স্বামী। কন্যাটি দামী শাড়ি-ব্লাউজ, গলায়-কানে ও দু’হাত ভরা সোনার গয়নাতে আলো ছড়াচ্ছে।
অল্পক্ষণ পরই আলাপ প্রসংগে জানা গেল যে মা-বাবা ও কন্যা বাংলাদেশী তবে কন্যার বরটি পাকিস্তানী, উর্দুওয়ালা। Quebec ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনাকালীন দু’জনের পরিচয়, প্রেম ও বিয়ে। Husband বাংলা জানে না, একটু একটু করে শিখছে তবে তার শাশুড়ি বাংলা শিখতে খুবই আগ্রহী, মেয়েটি নিজেই জানালো আমাকে। স্বামীস্ত্রীর মাঝে medium of communication হচ্ছে English.
৭) হ্যাট মাথায় মুখে কিছু দাড়িওয়ালা ছোটখাটো এক বয়স্ক ব্যক্তি অন্য এক টেবিল ছেড়ে উঠে এসে “আসসালামু আলাইকুম সাইদভাই” বলে দু’হাত মিলিয়ে “আপনি কেমন আছেন? সব ভালো তো?” জিজ্ঞাসা করলেন। তাকে মোটেই চিনতে পারলাম না, তবুও বললাম, “ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
তিনি নিজের জায়গায় ফিরে গেলেন।
কয়েক মিনিট পর হিজাবী এক মহিলা এসে তার পাশে বসলেন। তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে গেল যে আরে ইনি তো মুসলিমুদ্দীন ভাই, Sheridan Centre এ Ladies Fashion Dress Store -এর মালিক! ইতিপূর্বে তাকে কোনদিন দাড়ি এবং মাথায় হ্যাট পরা অবস্থায় দেখিনি। তাই তাকে একেবারেই চিনতে পারিনি।
উঠে গিয়ে বললাম, “মুসলিমুদ্দীন ভাই, দুঃখিত। দাড়ি ও হ্যাট মাথায় আপনাকে একটু আগে মোটেই চিনতে পারিনি। এখন আপনার ওয়াইফকে আপনার পাশে দেখে আপনাকে চিনতে পারলাম। দাড়ি রাখলেন কবে থেকে? মাথার হ্যাটটা নামিয়ে ফেলুন, আপনার পূর্ব পরিচিত চেহারাটা আবার দেখি।”
“হেঁ হেঁ হেঁ” করতে করতে তিনি মাথা থেকে হ্যাটটা নামিয়ে নিলেন। বললাম, “এইবার আপনাকে চিনতে পেরেছি।”
৮) বহুক্ষণ বসে থেকে হাঁটুতে ও কোমরে ব্যথা লাগছিল। তাই উঠে walker-টাতে ভর দিয়ে একটু হাঁটার উদ্দেশ্যে পাশের টেবিলের ফাঁকা জায়গাটাতে গিয়ে দাঁড়ালাম। এমন সময় মুখ কালো দাড়িতে ঢাকা দু’টি যুবক এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছ, দাদা?”
আমি তো ওদের দাদা ডাক শুনে অবাক! কে এরা?
প্রশ্ন করলাম, “কে তোমরা? তোমাদের নাম বল। তোমাদের বাবা-মা কে?”
দু’জনেই আমাকে দু’দিক থেকে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বললো, “আমি জামাল”, “আমি কামাল।” তারপর ওদের বাবা-মার নামও বললো। চিনলাম। বলে কি? এই সেদিনের ছোট ছোট বাচ্চা দু’টি আজ মস্ত মস্ত দুই দাড়িওয়ালা youngmen? আমারই সামনে দাঁড়িয়ে আছে!
বললাম, “এবার তোমাদের চিনতে পেরেছি। তোমাদের বয়স তো বড় জোর ১৮-২০ বছর হবে। অথচ কত বড় হয়ে গিয়েছ তোমরা, দেখেও বিশ্বাস হচ্ছে না! কিন্তু এই বাচ্চা বয়সে মুখভরা দাড়ি কেন রেখেছ? Is it a fashion or are you serious about it?”
দু’জনেই সমস্বরে জবাব দিল, “Not fashion, Dada, we are very serious about it”
তারপর জামাল জানালো যে ওর বয়স ১৯, এবং কামালের বয়স ২৩ বছর। আরো জানালো যে কামাল ইউনিভার্সিটির লেখাপড়া শেষ করেছে এবং ওর নিজের আর বাকি আছে দু’বছর।
সবই ঠিক আছে কিন্তু এই কচি বয়সে ওদের দাড়ি রাখার জন্য উদ্বুদ্ধ করলো কে? এই অন্ধ তালেবানী শিক্ষা কে দিলো ওদের এই মুক্তচিন্তার দেশ ক্যানাডার মাটিতে? ওদের বাবার মুখে তো দাড়ি নেই। কার বা কা’দের প্রভাবে এমনটা হলো?
৯) নিমন্ত্রিতদের মাঝে সাদা-কালো-বাদামী-চাইনীজ সব ধরনের লোকই আছে। দলবদ্ধ হয়ে তারা appetizer খাচ্ছে অথবা গল্প করছে।
এমন সময়ে শোনা গেল আযান, ঘড়িতে দেখলাম যে মাগরিবের নামাযের সময় হয়েছে।
দেখতে দেখতে Banquet Hall-এর এক কোনায় কিবলামুখী হয়ে বহু নারীপুরুষ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেলো, কেউ একজন ইমাম হয়ে নামায শুরু করে দিলো। কেউ কেউ নিজনিজ চেয়ারে বসেই নিয়ত করে বুকে দু’হাত বেঁধে নিলো। দেখলাম আমার ওয়াইফও এক পাশে দাঁড়িয়ে নামায শুরু করে দিলো। অভূতপূর্ব দৃশ্য! নামায শেষ হলো। লোকেরা আগের মতোই Hall-এর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো।
আমার ওয়াইফকে জিজ্ঞাসা করলাম, “নামাযের আগে ওযু করতে পেরেছিলে? ওযু ছাড়া তো নামায হয় না।”
সে জবাব দিলো : “না, ওযু করিনি। তায়াম্মুম করেছিলাম। তাছাড়া উপস্থিত মহিলাদের বলতে শুনলাম যে ওযু ছাড়াও নামায হয়, অসুবিধা নেই।”
এটা আমার কাছে একটা নূতন খবর বটে!
১০) বহু বছর পর দেখা হলো আহাদের সংগে। ওর বয়স ৩৮-৪০ বছর হবে। প্রশ্ন করলো, “কেমন আছেন, খালুজান?”
বললাম, “ভালোই আছি।” ওর সংগে সাজাগোজা এক বয়স্কা মহিলা। জানতে পারলাম যে এই মহিলা আহাদের তৃতীয় স্ত্রী, আগের দুই স্ত্রীকে নানা কারণে একের পর এক তালাক দিতে হয়েছে। প্রথম স্ত্রীর গর্ভের ১৮ বছর বয়সের এক ছেলেও আছে আহাদের।
প্রয়োজনের তাগিদে আহাদ তৃতীয়বার বিয়ে করেছে সমবয়স্কা এক divorcee মহিলাকে যার ১৮ এবং ২০ বছর বয়সের দু’টি ছেলেও আছে।
সবই শুনলাম। আজব দুনিয়া!
১১) আমাদের ডানদিকের টেবিলে বসেছে দুই পরিবারের লোকজন। একটি পরিবার চোখে পড়ার মত আকর্ষণীয়। স্বামী ইন্ডিয়ান, স্ত্রী অপূর্বসুন্দরী [আমার দৃষ্টিতে] এক ক্যানাডিয়ান মহিলা, সংগে তাদের মায়ের মতোই স্বাস্থ্য-সৌন্দর্যময় দু’টি সন্তান- মেয়েটির বয়স ১০-১১ বছর এবং ছেলেটির বয়স ৬-৭ বছর। যেমন সুন্দরী মা, ঠিক তেমনি সুন্দর তার দুই সন্তান। ঘাড় ফিরিয়ে বারবার ওদের দেখি। সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহরই প্রাপ্য।
জুন ১৯, ২০২২ (চলবে)
সাইদুল হোসেন। মিসিসাগা