কানাডার রাজনীতিকরা জাতিগত ভোট টানবেন, কোনও একক দলের জন্য সেটা লাভজনক হবে কি?

এপ্রিল ৮, ২০১৯

ডানকান মিক্ইউ : ২০১০ সালে উইনিপেগের পৌর নির্বাচনে প্রথম ভোট দেওয়ার স্মৃতি স্পষ্টতই মনে করতে পারেন আবদিখাইর আহমেদ। শুধু তিনিই উত্তেজিত ছিলেন এমন নয়। তার সঙ্গে আরও অনেকে ছিলো।

আহমেদ বলেন, “আমি আমার পরিবারকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম। আমার বাচ্চাদেরসহ সবাইকে নিয়ে এসেছিলাম। সেটা ছিলো আমার জীবনের প্রথম ভোটদান।”

৩৯ বছর বয়সী এই উইনিপেগবাসী ২০০৩ সালে উদ্বাস্তু হিসাবে সোমালিয়া থেকে কানাডায় আসেন। এরপর কানাডার নাগরিক হিসাবে বৈধভাবে ভোটার হতে তার কয়েক বছর লেগে যায়। ভোট দেওয়ার ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুবই আগ্রহী।

আহমেদ বলেন, “এই দেশটি কোনদিকে যাবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আমার একটি দায়িত্ব আছে বলে অনুভব করি।”

এখন তিনি ইমিগ্রেশন পার্টনারশিপ উইনিপেগ নামে একটি সংগঠন চালান যেটি অভিবাসী ও উদ্বাস্তু হিসাবে আসা নবাগতদেরকে কানাডায় থিতু হতে সহায়তা করে। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার হিসাব অনুযায়ী উইনিপেগের বাসিন্দাদের মধ্যে এক-চতুর্থাংশই দৃশ্যমান সংখ্যালঘু। তবে তাদের সবাই সাম্প্রতিককালে আসা অভিবাসী নন।

কানাডার রাজনীতিতে এটা প্রচলিত ধারণা হয়ে উঠছে যে, অভিবাসীদের ভোট নির্বাচনে জোরালো প্রভাব রাখতে পারে।

কানাডার রাজনীতিতে এটা প্রচলিত ধারণা হয়ে উঠছে যে, অভিবাসীদের ভোট নির্বাচনে জোরালো প্রভাব রাখতে পারে। ছবি : ইমিগ্রেশন পার্টনারশিপ উইনিপেগ

আহমেদের মতে, নতুন বা পুরনো অভিবাসীরা হলো সম্ভাব্য ভোটারদের মধ্যে একটি শক্তিশালী অংশ।

তিনি বলেন, “তথাকথিত অভিবাসী ভোট নিজেদের পক্ষে টানার ব্যাপারটি বোধগম্য কারণ তারাই হলো ফলাফল নির্ধারণী ফ্যাক্টর।

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এবারের কেন্দ্রীয় নির্বাচনী লড়াই শুরু হলে কোন দলই নির্দিষ্ট কোনও জাতিগত গ্র“প বা ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ভোট একচেটিয়াভাবে বাগিয়ে নিতে পারবে না।

জনশ্র“তি নাকি বাস্তবতা?

কানাডার বড় সব দলই অভিবাসী ভোটারদের মন জয়ের জন্য সেই ১৯৬০-এর দশক থেকে প্রতিযোগিতা করে যাচ্ছে। ইউনিভার্সিটি  অব টরন্টোর রাজনীতি বিজ্ঞানের প্রফেসর ফিল ট্রিয়াডাফিলোপোলস এমন তথ্য জানান। তিনি বলেন, “সে সময় অভিবাসনের মূল সূত্রটা ছিলো ভিন্ন, কিন্তু এর অন্তর্গত গতিটা ছিলো একই। এটা হলো নগরভিত্তিক কানাডার ইতিবৃত্ত।”

২০১৯ সালের আসন্ন কেন্দ্রীয় নির্বাচনে টরন্টো ও ভ্যাঙ্কুভারের আসনগুলোকে বিবেচনা করা হচ্ছে মূল রণক্ষেত্র হিসাবে যা কোনও দলকে তুলে আনতে বা একেবারে শেষ করে দিতে পারে।

কিন্তু রাজনীতিকরা জাতিগোষ্ঠীগত ভোটারদের পক্ষে টানার চেষ্টা করছেন এমন শহর কেবল ওই দুটোই না।

কানাডার Global Affairs Institute এবং the Environics Institute  এর ফেলো এন্ড্রু গ্রিফিথ বলেন, ২০১৬ সালের আদমশুমারিতে উঠে আসা অভিবাসন ও জাতিগত-সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের তথ্য থেকে দেখা যায় যে, ২০১১ সালের চেয়ে এখন দৃশ্যমান সংখ্যালঘু অধিবাসীদের মধ্যে অনেক কানাডীয় কমিউনিটির সদস্যরাই বড় অংশ দখল করে আছে।

পার্লামেন্টের ৩৩৮টি কেন্দ্রীয় আসনের মধ্যে ৪১টি আসনে দৃশ্যমান সংখ্যালঘু সদস্যরাই সংখ্যাগুরু। অথচ পাঁচ বছর আগে এধরণের আসনের সংখ্যা ছিলো ৩৩টি।

গ্রিফিথ বলেন, “পার্টিগুলো যখন তাদের নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণ করে তখন তারা এসব হিসাব বিবেচনায় রাখে যাতে করে তারা এদেরকে আকৃষ্ট করার নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে। তবে অভিবাসী ভোটারদের মধ্যে দলীয় বিভক্তির বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে কিনা সেটি নির্ধারণ করা আরও কঠিন।

একসময় ধারণা করা হতো যে, নতুন কানাডীয়রা লিবারেল দলকে ভোট দেবে কারণ পিয়েরে ট্রুডো ১৯৬০-এর দশকে অধিক সংখ্যায় অভিবাসী আসার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তাদের জন্য কানাডার দরজা উন্মোচনের মাধ্যমে। কিন্তু গত এক দশকে সেই হিসাব অনেকটাই পাল্টে গেছে।

গ্রিফিথ বলেন, সাম্প্রতিক ভোটের হিসাব বলছে, কিছু জাতিগত গোষ্ঠী এখনও বিশেষ কোনও দলের প্রতি ঝুঁকে আছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় শিখ সম্প্রদায়ের কানাডীয়দের কথা যাদের মধ্যে লিবারেল ও এনডিপি দলকে ভোট দেওয়ার একটি ‘সাধারণ প্রবণতা’ আছে। অন্যদিকে রক্ষণশীল দলকে বেশি সমর্থন করে চীনা-কানাডীয়রা। তবে তিনি আরও বলেন, “আমাদের কখনই এমন ধারণা করা ঠিক হবে না যে, শিখদের সবাই একইরকম চিন্তা করে এবং একইভাবে কাজ করে। সেটা ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রেই হোক আর অন্য কোনও ক্ষেত্রেই হোক।

নবাগতদের ভোট দিতে উৎসাহিত করা

আহমেদ বলেন, উইনিপেগে পরিস্থিতি এমন ছিলো যে, নতুন অভিবাসীরা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে কিনা সেটাই নিশ্চিত ছিলো না। তিনি দৃশ্যমান সংখ্যালঘু ও নবাগতদেরকে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে কাজ করেছেন।

আহমেদ বলেন, “অনেক নবাগত তাদের নিজ দেশে কখনই ভোট দেননি অথবাএমন একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিলেন যেখানে নির্বাচন স্বচ্ছ ছিলো না। তাই তারা আসলে নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর আস্থাশীল ছিলেন না এবং সেকারণে ভোট দেওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে দেখতেন না।”

গত শরতের পৌর নির্বাচনে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে উদ্বাস্তু ও অভিবাসীদের উৎসাহিত করতে আহমেদের দল-নিরপেক্ষ সংগঠনটি “নাগরিকত্ব পেলেন, এবার ভোট দিন” শ্লোগান  নিয়ে একটি প্রচারণা কার্যক্রম পরিচালনা করে।

ইমিগ্রেশন পার্টনারশিপ উইনিপেগ বেশ কিছু পোস্টার ও ভিডিও প্রস্তুত ও বিলি করে যাতে কোথায় কীভাবে ভোট দিতে হবে সেই বিষয়গুলো তুলে ধরা হয় ১২টি বিভিন্ন ভাষায়। জাতিগত-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যাতে ওই বার্তা ছড়িয়ে দিতে কাজ করে সেবিষয়ের ওপরও তারা মনোযোগ দেয়।

আহমেদের ধারণা, অভিবাসীরা জোটবদ্ধ হয়ে ভোট দেয় না, তবে যদি তারা নিজেদেরকে বিশেষ কোন ইস্যুর লক্ষ্য হিসাবে মনে করে তাহলে তারা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সেই ইস্যুর জবাব দিতে পারে।

উদাহরণ হলো, ২০১১ সালে টোরি দল (রক্ষণশীল) যখন সিটিজেনশিপ সেরিমোনিতে নেকাব নিষিদ্ধ করার কিংবা “বর্বর সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড” সম্পর্কিত কথাবার্তা বলতে শুরু  করো তখন সেটার বিরুদ্ধে ভোট দিতে নবাগতরা উৎসাহিত হয়।

আহমেদ বলেন, “রক্ষণশীল দলের বার্তাটা ব্যাপকভাবে অভিবাসীবিরোধী বক্তব্য হিসাবে দেখা হয়।”

তার ভাষায়, “অতিশয় বর্ণবাদী কোন নীতি যেমন বর্বর সাংস্কৃতিক কর্মকা- সম্পর্কিত আইন বা কথাবার্তা অভিবাসী সম্প্রদায়কে জাগিয়ে তোলে যাতে তারা আসলে বলতে চায় যে, ‘আমরা আমাদের দেশে এগুলো বরদাশত করবো না।’”

এই বিষয়টি উল্লেখ করেন ট্রিয়াডাফিলোপাওলোসও। তিনি মনে করেন, অভিবাসী ভোটারদের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় কানাডায় ইউরোপ বা আমেরিকার মতো বিদেশিদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়েনি।

তিনি বলেন, “ (কানাডায়) জনসংখ্যা ও প্রাতিষ্ঠানিকতার বিষয়টি ওই ধরণের বিদ্বেষকে পরাস্ত করেছে।”

– সৈজন্যে : সিবিসি রেডিও