আমার জীবনের নানা কথা

সাইদুল হোসেন

পোষা কুকুর ও আইসক্রিম

গতকাল দুপুরে একটা ওষুধ কিনতে গিয়েছিলাম আমাদের কমিউনিটি বিল্ডিংয়ের নিকটস্থ Plaza-তে একটা ফার্মেসীতে। সেখানে একটা আইসক্রিম শপও আছে।

ফার্মেসীতে ঢোকার আগে লক্ষ্য করলাম যে সেই আইসক্রিম শপের বাইরে এক চাইনীজ মহিলা তিনটা কুকুরের গলায় বাঁধা লীশ (leash) টেনে ধরে ওগুলোকে সামলাচ্ছেন, তার পাশে দাঁড়ানো ৬ থেকে ৮ বছর বয়সের ফুটফুটে সুন্দরী দু’টি মেয়ে কুকুর তিনটাকে ওদের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছে, এবং ওদের বাবা সুদর্শন এক ক্যানাডিয়ান ভদ্রলোক সেই আইসক্রিম শপের ভেতরে ঢুকছেন।

কুকুরের প্রতি মানুষের ভালবাসা। ছবি : ইউটিউব

ফার্মেসীর কাজ সেরে বের হয়ে দেখলাম যে সেই ভদ্রলোকের হাতে তিনটা icecream cone. সেগুলো তিনি পালাক্রমে কুকুরগুলোর মুখে তুলে ধরছেন এবং ওরা মনের আনন্দে লেজ নাড়াতে নাড়াতে সেই আইসক্রিম খাচ্ছে, অন্যটার দিকে মুখ বাড়াচ্ছে না। Very disciplined!

দৃশ্যটা বেশ মজার। তাই একটু দূরে দাঁড়িয়ে সেটা উপভোগ করতে করতে মহিলাটির দিকে লক্ষ্য করে বললাম, Lucky dogs indeed!

মহিলা হেসে দিয়ে বললেন, But not always. When they behave well, we give them ice cream as a treat. They are like our children..

শুনে বললাম, Thank you for your kindness towards these animals. Bye.

প্রতি উত্তরে মহিলা তার বাম হাতটা উপরে উঠিয়ে বললেন, Thanks. Bye.

-আগস্ট ১২, ২০২০

এক মহিলার একসংগে চারটি স্বামী

টরন্টোনিবাসী আমার এক বন্ধু ফোন করে জানালেন যে তার পরিচিত বয়ষ্ক এক লোক যিনি সর্বক্ষেত্রে সমাজে নারী ও পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করার অতি উৎসাহী সমর্থক, জানতে চেয়েছেন যে কোন নারীকে একই সংগে চারটি স্বামী গ্রহণ করার অধিকার আল্লাহ কেন দিলেন না, একজন পুরুষকে তো একসংগে চারটি স্ত্রী রাখার অধিকার দিয়েছেন? এই বিধান সমাজে নারী ও পুরুষের মাঝে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিরাট এক বাধার সৃষ্টি করেছে। আল্ল­াহ এমনটা কেন করলেন? আমার বন্ধু সেই প্রশ্নকর্তাকে তাৎক্ষণিক কোন উত্তর দিতে পারেননি। তাই তিনি একটা গ্রহণযোগ্য উত্তরের জন্য আমার শরণাপন্ন হয়েছেন।

আমার সেই বন্ধুকে বললাম যে এভাবে নারী-পুরুষে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গেলে প্রথমেই যে পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যাটার সৃষ্টি হবে সেটার সমাধানটা কি হবে সেটা সেই প্রশ্নকর্তাকে জিজ্ঞাসা করুন।

প্রশ্ন: চার স্বামীর এক স্ত্রী যখন একটা সন্তান প্রসব করবে তখন সেটার বাবা হবে তার কোন স্বামী? সেই বাচ্চাটা কাকে বাবা ডাকবে? পরিবারে ও সমাজে সেই বাচ্চাটা কার সন্তান বলে পরিচিত হবে?

[টীকা : এক সপ্তাহ পর বন্ধু আমাকে আবার ফোন করে জানালেন যে আমার প্রশ্নগুলো তিনি e-mail করে সেই প্রশ্নকর্তাকে জানিয়েছিলেন কিন্তু কোন উত্তর পাননি।]

আগস্ট ১৫, ২০২০

I Want to Enjoy My Life More Before I go

Donna. বয়স ৮৬ বছর। White Canadian lady. খুব হাসিখুশী স্বভাব, আমাদের এই কমিউনিটি বিল্ডিংয়ের বাসিন্দা, একাই একটা এপার্টমেন্টে থাকে। বয়সের ভারে নত, দেহের সর্বত্র চামড়া কুঁচকে গেছে, যৌবনে যাই ছিল স্বাস্থ্য-সৌন্দর্য্য বর্তমানে কিছুই অবশিষ্ট নেই। বার্ধক্য এবং arthritis-এ আক্রান্ত যন্ত্রণাময় জীবন। Walker-এর সাহায্য ছাড়া এক পা-ও হাঁটতে পারে না।

আমার দৈনিক নিয়মিত পনর মিনিটের হাঁটা শেষে বিল্ডিংয়ের সামনে গাছতলায় আসতেই চোখে পড়লো যে Donna সেখানে একটা concrete bench-এ একা বসে আছে, সামনে ওর walker-টা। আমি একটু দূরে আমার walker-এর সীটে বসতেই Donna প্রশ্ন করলো, তোমার পেছনের এপার্টমেন্টের বাসিন্দা Anne তিনদিন আগে হসপিটালে মারা গেছে, সেটা জানো কি? COVID-এ নয়, স্বাভাবিক মৃত্যু। বয়স ছিল ৮০ বছর।

শুনে বললাম, No, I didn’t know. May God bless her soul. তারপর যোগ করলাম, All of us will die one day. We have to remain ready for our call to meet God whenever He calls.

শুনে Donna একটু জোর দিয়েই বললো, No, I am not ready yet. I need some more time to enjoy my life before I go.

কোন মন্তব্য করলাম না। শুধু ভাবলাম : হায়! এই পৃথিবীর মোহের কি দারুণ আকর্ষণ! এই জরাজীর্ণ দেহ যার প্রতিটি পদক্ষেপ যন্ত্রণাময় সেই জীবন আরো উপভোগ করার জন্য কতই না আগ্রহ! Enjoy করার মত সামর্থ্য যার দেহে কিছুই অবশিষ্ট নেই সে আরো enjoy করতে চায়? আশ্চর্য!

তবে ওর চালচলনে একটা বিষয় ইতিপূর্বে লক্ষ্য করেছি যে COVID-পূর্ববর্তী দিনগুলোতে আমাদের বিল্ডিংয়ে যখনি কোন সামাজিক অনুষ্ঠান হতো, সেখানে নাচের বাজনা বেজে উঠা মাত্র এই Donna সবার আগে লাফ দিয়ে floor-এ নেমে তার কোমর দোলাতে শুরু করতো, অন্যান্যরা যোগ দিতো একে একে। ধারণা করি যৌবনে সে একজন ভালো dancer ছিল।

ডোনার লাইফকে এনজয় করার আগ্রহের অপর একটি দৃষ্টান্ত চোখে পড়েছিল অন্য একদিন।

সন্ধ্যার আগেআগে নিকটস্থ ফুড বেসিক্স্ সুপারমার্কেট থেকে কেনা কিছু গ্রোসারিজ হাতে নিয়ে আমাদের বিল্ডিংয়ের পেছনের Entrance দিয়ে ঢুকতে গিয়ে দেখলাম যে ৬-৭ জন সাদা বৃদ্ধা কেউ বেঞ্চে বসে এবং কেউবা নিজনিজ ওয়াকারের সীটে বসে গল্প করছে, এবং ওদের মাঝে ডোনাও উপস্থিত। লক্ষ্য করলাম যে ওর গায়ের সাদা T-shirt-টার বুকে লাল রংয়ের একটা circle-এর মাঝে বড় বড় অক্ষরে ছাপা রয়েছে BITCH # 1

সেটার দিকে আংগুল তুলে বললাম, Donna, I don’t like the BITCH word, it carries a very bad meaning.

জবাবে ডোনা বলল, But I don’t mind at all. I enjoy being BITCH #1.

Then OK. Enjoy being a bitch, বলে আমি দরজাটা খুলে বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢুকে গেলাম।

আগস্ট ৩১, ২০২০

বয়ফ্রেন্ড

আমাদের এই সিনিয়র্স বিল্ডিংয়ে আমাদের next door neighbour ছিলেন গত এক বছর ধরে আশির উপরে বয়সের ইন্ডিয়ান পাঞ্জাবী এক বৃদ্ধা বিধবা হিন্দু মহিলা। যন্ত্রণাদায়ক ক্যানসারে ভুগছিলেন বহুদিন ধরে। তার এক মেয়ে তার দেখাশুনা করতো। একবার তো বটেই কখনো কখনো মেয়েটি দিনে দু’বারও আসতো  মায়ের নানা প্রয়োজন মেটাতে। মহিলার এক ছেলেও আসতো, রাত কাটাতো যখন মহিলার রোগযন্ত্রণা বেড়ে যেতো।

মেয়েটি, অজন্তা ওর নাম, খুবই ভদ্রনম্র। দেখা হলেই হাই আংকল, হাই আন্টি বলে সম্বোধন করতো আমরা স্বামীস্ত্রীকে। ওর মায়ের খবর দিতো, নিজের পরিবারের খবর দিতো। সদাব্যস্ত থাকতো মায়ের সেবায়- গ্রোসারি, রান্না, লন্ড্রি, ডাক্তার, ফার্মেসী সবই ছিল ওর দায়িত্ব। বলতো, ‘মায়ের একমাত্র মেয়ে আমি, বড় ভাই অস্ট্রেলিয়াতে। আমি ও আমার ছোট ভাইটা মায়ের দেখাশুনা করি। বাবা মারা গেছেন বহুদিন আগে। আমাদের একমাত্র গুরুজন হচ্ছেন মা। ছোট ভাইটা তো ওর কাজকর্ম-সংসার নিয়ে ব্যস্ত। আমি ছাড়া মাকে দেখার অন্য কেউ নেই। মা মরে গেলে তো মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করার মত আমাদের আর কেউ থাকবে না। কিন্তু মা বড় কষ্টে আছেন, আমরা কোনই সাহায্য করতে পারছি না, ক্রমশঃ দুর্বল হয়ে পড়ছেন। ভগবানের ইচ্ছা,’ বলে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়তো।

অজন্তার নিজের কথা আমার স্ত্রীর কাছে :

‘আমার দুই ছেলে, কোন মেয়ে নেই। আমি তো সাধ্যমত আমার মাকে সেবা করে যাচ্ছি, কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে আমি যখন দুর্বল-অসহায় হয়ে পড়বো তখন আমাকে দেখবে কে? আমার তো কোন মেয়ে নেই!’

মাঝে মাঝে ওর ছোট ভাইটাকে সংগে দেখতাম বটে কিন্তু ওর স্বামীকে কোনদিন দেখিনি। তবে একদিন ওর পাশে বসা থাকা এক যুবককে দেখিয়ে অজন্তা আমাকে বলেছিল, ‘আমার বয়ফ্রেন্ড, আংকল। মুসলিম। ওর নাম আরমান।’ এই খবরটা আমি ঘরে এসে স্ত্রীকে জানালাম। মনে একটু খট্কা লাগলো।

আজ বিকাল ৭টায় অজন্তা এসে হাজির আমাদের দরজায়। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর টিশু পেপার দিয়ে ঘনঘন চোখ মুছছে। জিঞ্জাসা করলাম, ‘কি ব্যাপার, অজন্তা?’

সে আমার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আজ সকাল ৮টায় মা মারা গেছেন আমার হাতে হাত রেখে। মৃত্যুটা বড়ই কষ্টের ছিল। মায়ের ডেডবডিটা একটা cremation house-এ রেখে এসেছি, চারদিন পর funeral. আমরা মা-হারা হয়ে গেলাম!’ সে কি কান্না!

জিঞ্জাসা করলাম, ‘বড় ভাইকে অস্ট্রেলিয়াতে খবর দিয়েছ?’ বললো, ‘দিয়েছি।’

‘তোমার ছেলেরা কোথায়?’ জানতে চাইলাম। বললো, ‘ওরা Dominion Republic -এ (Caribbean Island) রেস্টুরান্ট খুলেছে, ওখানে বিজনেস করে। খুবই ব্যস্ত ওরা।’

প্রশ্ন করলাম, ‘ওদের বয়স কত?’

বললো, ‘বড়টার ২৬, ছোটটার ২৩ বছর।’

‘তোমার হাজব্যান্ড?’ আমার স্ত্রী জানতে চাইলেন।

অজন্তা ঃ ‘২০১৩ সনে আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। আমি একা।’

তারপর আমাকে উদ্দেশ করে বললো, ‘আংকল, সেদিন যে লোকটাকে দেখিয়ে আপনাকে বলেছিলাম যে সে আমার বয়ফ্রেন্ড বর্তমানে সেই আরমান ছাড়া এজগতে আমার আর কেউ নেই।’ এটা শুনে আমার স্ত্রী জানতে চাইলেন, ‘তুমি কি ওকে বিয়ে করবে?’

উত্তরে অজন্তা বললো, ‘In all probability yes, auntie. I am only 48 now. I want to live a happy life.’

শুনে আমার মনের বয়ফ্রেন্ড সংক্রান্ত খট্কাটা দূর হয়ে গেল।

সেপ্টেম্বর ৭, ২০২০

আজব সাওয়ালঃ আপ হিন্দি কিউ নেহী জানতে?

১৯৭১-এর আগে পাকিস্তানী আমলে আমাদের করপোরেশনে বাংগালী ও বাংলা ভাষা বিদ্বেষী পশ্চিম পাকিস্তানী উর্দুভাষী উপরওয়ালা এবং সহকর্মীরা অহরহই প্রশ্ন করতো, “তুমি উর্দু বল না কেন?” অথবা “তুমি উর্দু শেখনি কেন?”

উত্তরে যদি বলতাম, “তুমি আমাদের বাংলা ভাষা শিখেছ কি?”

ওরা একবাক্যে জবাব দিতো, “তোমাদের বাংলা ভাষাটা খুবই জটিল, সহজ নয়- বড়ী মুশকিল জুবান হ্যায় বাংলা, আসান নেহী।” উপরওয়ালা হলে ঘৃণাভরে বলতো, “বাংলা তো কাফের হিন্দুকা জুবান হ্যায়।” (বাংলা তো কাফের হিন্দুদের ভাষা।)

পশ্চিম পাকিস্তানীদের ঘৃণা বা অবহেলার হেতুটা বুঝি, বাংগালী-অবাংগালী রাজনৈতিক রেষারেষিটাও বুঝি, কিন্তু কোন ইন্ডিয়ান বৃদ্ধ যখন ক্যানাডার মাটিতে দাঁড়িয়ে উদ্ধত স্বরে প্রশ্ন করে, “আপ হিন্দি কিউ নেহী জানতে?” তখন অবাক না হয়ে পারা যায় না। ঘটনাটা ছিল এরকম।

আমি এবং আমার স্ত্রী সরকারী একটা সিনিয়র্স রেসিডেন্সে বাস করি। সাদা-কালো-বাদামী রংয়ের, বহু ধর্মের, বহু দেশের ভাষাভাষী দেড়শ নারীপুরুষের বাসস্থান আমাদের এই ছ’তলা বিল্ডিংটা। সব বুড়োবুড়ি। সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, প্রায় সবাই walker অথবা scooter -এর সাহায্য নিয়ে চলাফেরা করে। সামাজিকতা এলিভেটরে উঠতে-নামতে অথবা Lobby-তে দেখা হলে হাই-হ্যাল্লোতেই সীমাবদ্ধ। একে অন্যের এপার্টমেন্টে যাওয়া-আসা বা গল্প করার দৃষ্টান্ত তেমন চোখে পড়ে না।

বাসিন্দাদের মাঝে বাংলাদেশী একমাত্র স্বামীস্ত্রী আমরা দু’জনই। জ্যামাইকান আছে, ইন্ডিয়ান আছে, চাইনীজ আছে, মিডল ইস্টের এরাবও আছে। আর সাদারা তো আছেই, ওরাই ৮০%। সেই ইন্ডিয়ানদের একজন একদিন আমাকে প্রশ্ন করলো (সে তার scooter-এ বসা) : আপ হিন্দি জানতে হ্যায়? [আপনি কি হিন্দি জানেন?]

আমি হাসিমুখে ইংরেজীতে বললাম, “খুবই কম। কথাবার্তা চালানোর মত নয়। আমি ইন্ডিয়ান নই, আমি বাংলাদেশী। হিন্দি আমাদের ভাষা নয়, আমাদের ভাষা বাংলা।” [যদিও হিন্দি-উর্দু দু’টি ভাষাতেই আমি কথা বলতে পারি।]

আমার জবাব শুনে বৃদ্ধ খুব রেগে গেল। বললো (হিন্দিতে): “বাংলাদেশ তো ইন্ডিয়ারই অংশ ছিল। হিন্দি ইন্ডিয়ার ভাষা। তুমি হিন্দি শেখনি কেন?”

অভদ্র, অবান্তর প্রশ্ন। তথাপি হাসিমুখেই বললাম (ইংরেজীতে): “বাংলা ভাষাটা ইন্ডিয়ার ভাষাগুলোর মাঝে প্রধান একটা ভাষা, হিন্দির ঠিক পরই তার স্থান। তোমাদের ওয়েস্ট বেংগল স্টেইটের ১০০ মিলিয়ন লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। তুমি কি সেই বাংলা ভাষাটা জানো?”

আগের মতই রাগান্বিত কণ্ঠে সে জবাব দিলো (হিন্দিতে), “নাহি!”

Uneducated, ignorant, uncultured একটা লোক। ওর সংগে কথা বলে সময় নষ্ট করা নির্বুদ্ধিতা। তথাপি হাসিমুখেই বললাম, Look, gentleman, your attitude is very objectionable. You don’t want to learn my language yet you want me to speak in your language. This is rude, unfair, indecent. Learn to respect others.”

কথাগুলো বলে আমি আমার গন্তব্যের দিকে পা বাড়ালাম।

সেপ্টেম্বর ২২, ২০২০

বোবা কাহিনী

(এক)

গত আগস্ট মাসে টরোন্টোনিবাসী আমার ছোট ভাই আকবর তার একটা অভিজ্ঞতার কথা আমাকে এভাবে বর্ণনা করল।

কোমরের X-Ray করাতে একটা Diagnostic Clinic এ গিয়েছিলাম এক সপ্তাহ আগে। দেখলাম, ক্লিনিকের রিসেপশানে বসা এক যুবক [চেহারা-সুরত দেখে মনে হলো সে একজন স্প্যানীশ স্পীকিং সাউথ আমেরিকান] চেয়ারে বসে তার সামনে একটা stroller-এ ঘুমন্ত সুন্দর একটি শিশুর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ছ’ফুট দুরত্বে রাখা অন্য একটি চেয়ারে বসলাম। এমন সময় diagnostic room-এর ভেতর থেকে একটি মেয়ে (এসিসটেন্ট) এসে যুবকটিকে জানালো, “তোমার ওয়াইফ তো বোবা, কথা বলতে পারে না। তুমি ওখানে গিয়ে আমাকে বুঝিয়ে বল তার কি চাই।”

একথা শুনে যুবক stroller-টা ঠেলেঠেলে সেই মেয়েটির সংগে ভেতরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর সে ফিরে এলে আমি তার একটু কাছে আমার চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে বললাম, “তোমার এই বাচ্চাটি তো খুব সুন্দর। কিন্তু তোমার ওয়াইফ কি সত্যিই deaf and dumb? আমি একজন professional writer. তুমি যদি বিষয়টা একটু খুলে বল, তাহলে সেটাকে ভিত্তি করে একটা ষ্টোরি লিখে পাবলিশ করতে পারি।

আমার লেখার মাধ্যমে তাদের কাহিনীটা বহু পাঠক-পাঠিকা জানতে পারবে এই সুযোগটা সে ছাড়তে চাইলো না। বললো, Thank you. Here is our story.

আমি একজন ইউনিভার্সিটি গ্র্যাজুয়েট। তখন মাঝামাঝি ধরনের একটা জব করতাম। দায়-দায়িত্ব বা কোন পিছুটান ছিল না। তবে আমি বেশ কিছুটা ইমোশনাল প্রকৃতির মানুষ বটে।

একদিন একটি মেয়েকে একটা বাস স্টপে দেখতে পাই। একা। বেশ আকর্ষণীয়া সুন্দরী। চাইলাম গল্প জমাতে, যুবকদের যা স্বভাব। কাছে গেলাম, হাই-হেল্লো বললাম।  সে নির্বিকার। ফিরে এলাম।

দিন কয়েক পর আবার ওর সংগে সেই বাস স্টপেই দেখা। একা। এগিয়ে গেলাম। হাসি মুখে হাই-হ্যাল্লো বললাম। সে নির্বাক। জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি কথা বলছ না কেন?” একটা কিছু বল।

আমার নাম স্টেফান।

মেয়েটি তখন হাত-মুখ-চোখ নেড়ে অংগভংগী করে জানালো যে তার কাছে না যাওয়াই উত্তম কারণ সে বোবা এবং কালা। Useless. সুতরাং আমার পেছনে সময় নষ্ট করো না বলে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আমি তখনকার মত বলে চলে এলাম।

কিন্তু একটা ভাবনা ক্রমেই মনটাকে কুরেকুরে খেতে লাগলো : এমন সুন্দরী-স্বাস্থ্যবতী এবং বুদ্ধিমতী একটা মেয়ের জীবনটা দুঃখেকষ্টে কাটবে শুধু সে একজন deaf and dumb (বোবা ও কালা) বলে? কিন্তু সেজন্য সে তো মোটেও দায়ী নয়। বন্ধু-বান্ধবদের সংগে আলোচনা করলাম। সবাই একবাক্যে বললো ঃ “দূরে থাক্।” মা-বাবার সংগে আলোচনা করলাম। তারা বললো : “চল্ তোকে পাগল চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাই।”

স্বীকার করি সবাই আমার মংগলকামী, শুভাকাক্সক্ষী, ওরা আমার ভালো চায়, কিন্তু মনের পাখি যে ওই মেয়ের খাঁচায় বন্দী হওয়ার জন্য ছটফট করছে! Common sense deserted me, an irrational emotion overwhelmed me! কোন কিছুই আর ভালো লাগে না। চোখে সর্বক্ষণ ভাসে সেই মুখ যার নামটা পর্যন্ত জানি না, পরিচয় বা ঠিকানা তো দূরের কথা। কিন্তু ওর পিছু ছাড়লাম না।

অবশেষে বারবার কাকুতিমিনতি করে ওর বাসায় নিয়ে যেতে রাজী করালাম। ওর বাবা-মার সংগে কথা বললাম। শোনলাম deaf and dumb school এ পড়াশোনা করেছে, একটা চাকরিও করে। তাই সে রোজরোজ ঐ বাস স্টপে যায়।

“সে যা হোক, বহু চেষ্টাচরিত্র করে ওকে এবং ওর মা-বাবাকে রাজী করিয়ে ওকে বিয়ে করলাম, সে আজ চার বছর আগের কথা। আমার এই নির্বোধ আচরণের জন্য বন্ধুরা ক্ষুদ্ধ হয়ে দূরে সরে গেছে; অসন্তুষ্ট ও রাগান্বিত হয়ে মা-বাবা আমাকে পরিত্যাগ করেছে। বিরাট-বিশাল ক্ষতি, তবে আমার ওয়াইফ তার ভালোবাসা দিয়ে সেই ক্ষতিটাকে পূরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। I am happy.”

তারপর stroller-এ ঘুমন্ত শিশুটাকে দেখিয়ে বললো, “আমাদের প্রথম সন্তান। কন্যা। মায়েরই মত মিষ্টি হয়েছে। বয়স দশ মাস। ওয়াইফ আবারো প্রেগন্যান্ট। ছেলে না মেয়ে খোঁজখবর নিইনি আজো, গড যা দেবেন তাতেই আমরা খুশী।”

কথা শেষ হতে হতে ওর ওয়াইফের এক্স-রে করার কাজও শেষ। আমার দিকে ডানহাতটা বাড়িয়ে দিয়ে হ্যান্ডশেইক করতে করতে মাথাটা একটু নুইয়ে শ্রদ্ধা-প্রদর্শনের মত ভংগী করে বললো, Thank you for listening to our story. Bye.”

তারপর সে stroller-টা ঠেলতে ঠেলতে পেছনে তার ওয়াইফকে নিয়ে ক্লিনিক থেকে বের হয়ে গেল।”

অকটোবর ৩, ২০২০

(দুই)

গত রবিরারে একটা ছোট ছেলের জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এসে ওয়াইফ আমাকে এই গল্পটা শোনালেন-

যে বাচ্চাটার জন্মবার্ষিকী পালন করা হলো ওর মায়ের বড় খালার তিন সন্তানের মাঝে একটি ছেলে ছিলো বোবা। ধনী পরিবার। তাই ঢাকাতে কোন একটা deaf and dumb school-এ ওকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে লেখাপড়া শেখালেন তারা। বড় হয়ে একটা কাজও জোগাড় করে নিলো সে।

ছেলের বয়স ২৩-২৪ বছর হওয়ার পর ওর বাবা-মা খুঁজেপেতে একটা বোবা মেয়ের সন্ধান পেলেন তাদেরই সমমর্যাদার কোন এক পরিবারে। দুপক্ষের সম্মতিক্রমে দুই বোবা ছেলেমেয়েকে বিয়ে করিয়ে দিলেন। একেএকে ওদের তিনটি সন্তান জন্মালো- দু’টি ছেলে, একটি মেয়ে। আশ্চর্যের বিষয় হলো এই যে ঐ তিনটি সন্তানই normal হলো, বোবা বা কালা নয়! ওরা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করেছে, বর্তমানে সবাই চাকরিরত।

শেষ খবর হলো এই যে ছেলেটির আমেরিকানিবাসী বড় বোন তার বোবা ভাই ও তার বোবা ওয়াইফকে ওদের তিন সন্তানসহ আমেরিকাতে immigration-এর জন্য sponsor করেছে। কাগজপত্র processed হয়ে গেছে।

আমার আপন ভুবন

আমার আপন ভুবন। আমার আপন জগৎ। আমার হৃদয়ের অতি গভীরে সন্তর্পণে লুকিয়ে আছে সেই জগৎ। আলোকিত। উজ্জ্বল আলোতে ঝলমল!

কে বাস করে সেজগতে?

আমি। আমি বাস করি সেখানে।

একা? না, আরো বহুজন বাস করে সেখানে। জীবিত এবং মৃত বহুজন সমাগমে পূর্ণ সেই স্থান কিন্তু নেই সেথা কোন কোলাহল। সেখানে বিরাজ করে শুধুই নীরবতা।

বহুজনের আনাগোনা অথচ নীরব? কি করে সম্ভব?

খুব সহজ, কারণ ওখানে কেউ সশরীরে বাস করে না। সেজগতের বাসিন্দারা তো স্মৃতি মাত্র। ওরা কায়াহীন, শুধু ওদের মুখগুলো আমার মানসপটে দৃশ্যমান; ওদের কথা, হাসিকান্না শুধু আমিই শুনতে পাই, দেখতে পাই। কিন্তু টের পাই আদিম ষড়রিপু-কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্যের-সদা উপস্থিতি ও তাদের প্রভাব আমার উপরে।

কি ঘটে সেখানে?

আমার চিন্তাভাবনা, আমার সফলতা ও বিফলতা, আমার আশা-আকাক্সক্ষা, আনন্দ-দুঃখ-বেদনা, মান-অভিমান-অভিযোগ, প্রেম-ভালোবাসা-ঘৃণা সব ওখানে বাস করে কিন্তু ওরা লড়াই করে না। তাই সেখানে নেই কোন শব্দতরংগ, আছে শুধু নীরবতা। সেটা হচ্ছে আমার অনুভূতির জগৎ, আমার হস্ত-পদ-মুখ-সম্বলিত দৈহিক, বাহ্যিক দৃশ্যমান জগৎ নয়। সেই মনোজগৎ আমার চরিত্রটাকে, মনুষ্যত্বটাকে, মানসিকতাটাকে গড়ে তুলে। সে দিনরাত সক্রিয়, সে ঘুমায় না। সদাজাগ্রত। তবে কখনো কখনো আমাকে স্বপ্ন দেখায়- ভয়ের, আশার।

আর জাগিয়ে তুলে, সক্রিয় করে তুলে আমার বিবেকটাকে। সচেতন করে তুলে আমাকে আমার চরিত্রের দোষ-ত্রুটিগুলো সম্পর্কে, নিরুৎসাহ করে অপরের ছিদ্রান্বেষণ করা থেকে। সে আমাকে শেখায় আমি যেন ষড়রিপুর দাস হয়ে নিজের চরিত্রটাকে কলংকিত না করি, নীতিহীন একটা জীবন যাপন না করি যাকে সমাজ ঘৃণা করে।

আমার সেই আপন ভুবনে অবিরাম একটা আলোড়ন, একটা ভাংগা-গড়ার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে যার প্রভাব আমার ব্যবহারে ও আচার-আচরণে প্রতিফলিত হয়। আমি বদলে যাই। কখনোবা নিরাশায় ভুগি, চারপাশের সবকিছুই মনে হয় তুচ্ছ, অর্থহীন। কারো সংগে অবাঞ্ছিত ব্যবহার করে বসি, লজ্জিত হই, ক্ষমা চাই। অনুশোচনায় ভুগি।

দৃশ্যমান এবং শ্রুতিগোচর পরিবেশের ঘটে যাওয়া নানা খবর ও ঘটনা যার আমি একজন দর্শক অথবা শ্রোতা, আমার মনকে আনন্দে অথবা বেদনায় আন্দোলিত করে। কখনোবা হয়ে পড়ি চঞ্চল, নূতন একটা কিছু করার প্রেরণা অনুভব করি তখন। হয়ে পড়ি উদার।

চোখ বোজলে অতীতে দেখা, কথা-বলা পরিচিত সব মুখের মিছিলের ভিড়ে কখনোবা হারিয়ে যাই আমি। এমনটাও ঘটে যে যাকে খুঁজি তাকে কাছে পাই না, দেখা হয় সেই সব মুখের সংগে যাদের মুখোমুখি আমি হতে চাই না নানা কারণে- অতীতে ঘটে যাওয়া তিক্ত, দুঃখময় কোন স্মৃতি মনটাকে বিষন্ন করে তুলে অথবা জ্বালার সৃষ্টি করে। সেসব আমি ভুলে থাকতে চাই।

কিছু স্মৃতিকে, কিছু মুখকে আমি জাগ্রত অবস্থায় বারবার মনের আয়নায় প্রতিফলিত করতে চাই কারণ তারা আমার হৃদয়কে প্রশান্ত করে, সুখের-আনন্দের আবেশে ভরে তুলে, আমি তখন আমার জাগতিক সব দুঃখ-বেদনা ভুলে যাই, অজান্তেই দু’হাত বাড়াই সেই মুখগুলোকে কাছে টেনে এনে বুকে চেপে ধরতে, অতীতের সেই উষ্ণ পরশটা আবার ফিরে পেতে, অনুভব করতে। বড়ই আনন্দময় মূহুর্ত সেগুলো আমার জীবনে। বহুমূল্যবান স্মৃতি মনের মণিকোঠায় সুরক্ষিত কিন্তু তারা তো ধরাছোঁয়ার অতীত। তাই ইচ্ছা বা বাসনাটা অপূর্ণ থেকে যায়, ফলে হতাশ হই।

আমার আপন ভুবনের বাসিন্দাদের মাঝে কিছু আছে মৃত যাদের দেখা পাওয়া আর সম্ভব নয়। আর আছে যারা জীবিত, যাদের বাস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এবং এরাও ধরাছোঁয়ার বাইরে। তৃতীয় দলের চরিত্রগুলো আমার চারপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে, ওদের সংগে আজো দেখা-সাক্ষাৎ হয়, কথাবার্তাও হয়, কিন্তু ওদের ঘিরে অতীতের কিছু স্মৃতি, তিক্ত এবং মধুর, আমার হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে যা আমাকে আনন্দ দেয়ার পাশাপাশি বেদনার অশ্রুও ঝরায়।

বয়স ক্রমেই বাড়ছে, এখন আমি ৮৯ বছরের এক বৃদ্ধ, অচলপ্রায় দেহ, তবে মন-মস্তিষ্ক সক্রিয়। আল্ল­াহর কাছে নানা ত্রুটির জন্য অপরাধী আমি। অপরাধী আমি কিছু মানুষের কাছেও নানা কারণে। আমি তো মানুষ, ভুলত্রুটির উর্ধে নই। স্মৃতির ভান্ডারে নূতন অনেক কিছুই জমা হচ্ছে দিনেদিনে, চাই বা না চাই, ফলে আমার আপন ভুবনের বিস্তৃৃতিটা আরো বাড়ছে। সেখানে আমার নিজের ভুলত্রুটির ইতিহাসও জমা হচ্ছে, সেগুলোরও সম্মুখীন হচ্ছি আমি, বেদনার ভারে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি আমি, হারাচ্ছি মানসিক শান্তি। আমার আপন ভুবন আজ আমার জন্য এক কারাগার যাতে আমি বন্দী মৃত্যু এসে মুক্তি না দেয়া পর্যন্ত।

আবার এটাও ভাবি যে মৃত্যুই কি মুক্তিদাতা? মৃত্যুর পর কি আর কিছুই নেই? ভয় পাই কারণ সেই জগৎটা তো অজ্ঞাত, অজানা। কি অপেক্ষা করছে সেখানে আমার জন্য? আলো না অন্ধকার? কে বলতে পারে? এই দুশ্চিন্তাটা তো অন্য কারো সংগে share করা যায় না, তাই দুর্ভাবনাটাও কাটে না।

অন্য ধরনের ভাবনাও মনে জাগে কখনো কখনো। মনের মালিক সব মানুষেরই তো তাদের নিজস্ব একটা আপন ভুবন রয়েছে, ওরাও তো নিশ্চয়ই আমারই মত তাদের স্মৃতিতে বিচরণশীল সুখ-দুঃখের দোলায় দুলছে। আমি তবে এত ভয় পাচ্ছি কেন? নাকি আমরা সবাই একই নৌকার যাত্রী একই দুর্ভাবনার বোঝা বয়ে চলেছি অজ্ঞাতের পানে?

অকটোবর ১০, ২০২০

(সমাপ্ত)

সাইদুল হোসেন। মিসিসাগা