রায়ারসনের মূর্তি উপড়ে ফেলা হলো

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক, ০৬ জুন, ২০২১ : রবিবার সন্ধ্যায় টরন্টোর কেন্দ্রস্থলে এক সমাবেশের পর কানাডায় আবাসিক স্কুল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অন্যতম স্থপতি এগারটন রায়ারসনের মূর্তি ভাঙ্গচুর করে উপড়ে ফেলা হয়। খবর সিবিসি নিউজ  এর।

নগরকেন্দ্রে ওই সমাবেশের আয়োজন করা হয় গত ২৭ মে Tk’emlúps te Secwépemc- প্রথম জাতিসত্ত্বার এক ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে। ঘোষণায় বলা হয়, ভূ-গর্ভে কর্মক্ষম রাডার ব্যবস্থার এক বিশেষজ্ঞের পরিচালিত সমীক্ষার প্রাথমিক উদ্ভাবনে আভাস পাওয়া গেছে যে, ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার কামলুপস-এ পাওয়া দেহাবশেষ একটি সাবেক আবাসিক স্কুলের জায়গায় কবর দেওয়া ২১৫ শিশুর দেহাবশেষ হতে পারে।

তখন থেকে আদিবাসী প্রফেসর ও শিক্ষার্থীরা ইউনিভার্সিটির নাম ও ক্যাম্পাস থেকে রায়ারসনের ভাষ্কর্য অপসারণের দাবি জানিয়ে আসছেন। কানাডার আবাসিক স্কুল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় রায়ারসনের ভূমিকার কারণে এই দাবি ওঠে।

মূর্তিটি কীভাবে উপড়ে ফেলা হয়েছে জানা যায়নি, তবে টুইটারে পোস্ট করা এক ভিডিওতে দেখা যায়, এর গায়ে দড়ি বাঁধা রয়েছে এবং সেটি যখন ধসে পড়ছে তখন জনতা উল্লাস করছে।

টরন্টো পুলিশ বলছে, ঘটনার বিষয়ে তারা সচেতন এবং এ নিয়ে তদন্ত করা হবে।

গত ৬ জুন টরন্টোর কেন্দ্রস্থলে এক সমাবেশের পর কানাডায় আবাসিক স্কুল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অন্যতম স্থপতি এগারটন রায়ারসনের মূর্তি ভাঙ্গচুর করে উপড়ে ফেলা হয়। (ক্রিস গারগুস/সিবিসি)

এটি হলো ন্যায়বিচারের সামান্য অংশ

সিবিসি নিউজের সঙ্গে আলাপকালে ক্রি (Cree) উপজাতির (মধ্য কানাডার বিস্তৃত অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসী উপজাতিগুলির একটি) একজন সদস্য ক্রেইগ সেন্ট ডেনিস বলেন, এই মূর্তি উপড়ে ফেলার ঘটনা ‘একটি গোটা জাতির মর্মযাতনা উপসমের সূচনা চিহ্নিত করছে।’ ক্রেইগ সেন্ট ডেনিস-এর দাদা একসময় আবাসিক স্কুলে ছিলেন।

তিনি বলেন, ‘১৮০০ সাল থেকে কী ঘটেছে এবং কীভাবে আবাসিক স্কুল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয় সে বিষয়ে আমরা যাতে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারি সেজন্যে এই মূর্তি নামিয়ে ফেলাটা গুরুত্বপূর্ণ।’ 

টরন্টোর পশ্চিমে ওকভিলিতে অবস্থিত শেরিডান কলেজের ছাত্র দিশানি ফেরনান্দো বলেন, অনেক আগেই এই মূর্তি নামিয়ে ফেলা উচিত ছিল।

‘এই ভাষ্কর্য বর্ণবাদের প্রতিনিধিত্ব করে। রায়ারসন ইউনিভার্সিটির উচিৎ ছিল অনেক আগেই স্বেচ্ছায় এটি নামিয়ে ফেলা। কিন্তু সেটি তারা করেনি।’

ফেরনান্দো বলেন, ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য এটি হলো ন্যায়বিচারের এক সামান্য অংশ কিন্তু এটুকুই যথেষ্ট নয়। এটি নিছক সূচনামাত্র।’

রবিবার পূর্বাহ্নে ২১৫ শিক্ষার্থীর প্রতি সম্মান জানাতে হাজারও মানুষ টরন্টোতে সমাবেশ করে। এই শিশুদের কামলুপস-এর ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের জায়গায় কবর দেয়া হয় বলে ধারণা হচ্ছে। এক সমীক্ষার প্রাথমিক ফলাফলের ভিত্তিতে এমন ধারণা করা হচ্ছে। 

এই বিক্ষোভ কর্মসূচির আগে টরন্টো পুলিশ এক টুইটার বার্তায় শান্ত থাকার আহবান জানায়।

‘আমরা স্বীকার করি যে, সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর একটি বেদনাদায়ক প্রভাব রয়েছে, কিন্তু আমরা ভাঙ্গচুর/সহিংসতা বরদাশত করতে পারি না। উপস্থিত সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ঘটনাস্থলে পুলিশ অফিসাররা থাকবেন এবং প্রয়োজন হলে তদন্ত/আইন বলবৎ করবেন।’

বিকেলের সমাবেশে অন্টারিও বিধানসভা চত্বরে জনগণ বক্তাদের বক্তৃতা শোনে এবং পুবদিকে হেঁটে ইউনিভার্সিটিতে যায়। মূর্তিটি সেখানেই। তারা ঢোল  বাজায় এবং গান গায়। ওই পর্যন্ত মূর্তিটি দাঁড়িয়েই ছিলো।

গত সপ্তাহে মূর্তিটির গায়ে লাল রঙ মাখিয়ে কিছুটা ভাঙ্গচুর করা হয়। মূর্তির পায়ের কাছে লোকেরা শত শত জোড়া জুতা রেখে দেয়। এটি ছিলো কামলুপস ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে যারা প্রাণ হারিয়েছে তাদের স্মরণে।

কামলুপস-এর ঘটনা উদ্ঘাটনের পর ইউনিভার্সিটির আদিবাসী শিক্ষার্থীরা অন্যসব শিক্ষার্থী, অনুষদ, ও সাবেক শিক্ষার্থীদের প্রতি আহবান জানায় যাতে তারা তাদের ই-মেলে, রিজিউমিতে ও অন্যান্য যোগাযোগে রায়ারসন নামটি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকে। এর পরিবর্তে এটিকে এক্স ইউনিভার্সিটি বলে উল্লেখে করার জন্য সবার প্রতি আহবান জানানো হয়।     

মূর্তি ভূপাতিত হবার আগে এক টুইটার বার্তায় ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ জানায়, ‘কামলুপসের কাছে ২১৫ আদিবাসী শিশুর দেহাবশেষ আবিষ্কারের ঘটনায় আমাদের সমাজ যে দুঃখ ও বেদনা অনুভব করছে আমরা তার অংশীদার এবং স্বীকার করি যে, চলমান এবং ভবিষ্যৎ পুনর্মিলনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

এতে আরও বলা হয়, রায়ারসনের উত্তরাধিকার পরীক্ষা করে দেখার জন্য একটি টাস্কফোর্স গটন করা হয়েছে। এটি সমাজের সদস্যদের কাছ থেকে তাদের বক্তব্য গ্রহণ করবে এবং আগামী শরৎকালীন সেমিস্টারের আগে চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করবে। সেই রিপোর্টে মূর্তি ও ইউনিভার্সিটির নাম বিষয়ে সুপারিশ থাকবে।

রায়ারসনের শত শত প্রফেসর বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম পাল্টানোর দাবি জানালেন


টরন্টোর রায়ারসন ইউনিভার্সিটির শত শত প্রফেসর এবং অন্যান্য অনুষদ সদস্য এই প্রতিষ্ঠানটির নাম পাল্টানোর দাবি সংবলিত একটি চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। ক্যাম্পাস থেকে এগারটন রায়ারসনের মূর্তি উৎখাতের ঠিক পরের দিনই তারা এই চিঠিতে স্বাক্ষর করলেন। খবর সিবিসি নিউজের। রিপোর্ট করেছেন আলী রাজা।
তিনজন অ্যাসোসিয়েট ডিনসহ প্রায় ৩৪৫ জন প্রফেসর এক চিঠিতে স্বাক্ষর দিয়েছেন যাতে লেখা হয়েছে, ‘রায়ারসনকে স্মরণ করা বন্ধের এখনই সময়। এই চিঠি হলো ইউনিভার্সিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কমিউনিটির লোকেরা একই রকম দাবি জানিয়ে আরও যে কিছু আবেদন জমা দিয়েছেন তারই একটি। এধরণের খোলা চিঠি লিখেছেন ইউনিভার্সিটির স্টাফরা, আদিবাসী অনুষদ এবং আদিবাসী শিক্ষার্থীরা।
রবিবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরিয়ে আনো বলে উল্লেখিত এক সমাবেশের পর এগারটন রায়ারসনের মূর্তি উৎখাত করা হয়। সমাবেশে হাজারও মানুষ যোগ দেন। তারা টরন্টোর কুইন্স পার্ক থেকে গোল্ড স্ট্রিট পর্যন্ত মিছিল করে যান।
ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার কামলুপ-এ পুরনো একটি আবাসিক স্কুলের জায়গায় কবর দেওয়া ২১৫ টি আদিবাসী শিশুর দেহাবশেষ পাওয়া গেছে বলে প্রকাশিত খবরের প্রেক্ষিতে এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
এগারটন রায়ারসনকে কানাডার আবাসিক স্কুল ব্যবস্থার রূপকারদের অন্যতম একজন বলে গণ্য করা হয় এবং সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ইউনিভার্সিটির স্টাফ ও শিক্ষার্থীরা তার মূর্তি অপসারণ ও ইউনিভার্সিটির নাম পাল্টানোর দাবি জানিয়ে আসছে।
একই দাবি জানিয়ে পেশ করা নিজেদের চিঠিতে প্রায় ২০০ কর্মকর্তা-কর্মচারিও স্বাক্ষর করেন। সেইসঙ্গে আদিবাসী অনুষদ ও শিক্ষার্থীরা তাতে স্বাক্ষর দেয়।
অনুষদের পক্ষ থেকে দেওয়া চিঠিতে এমন দাবি জানিয়ে উপসংহার টানা হয় যে, ‘এগারটন রিয়ারসনের মূর্তি চিরতরে সরিয়ে ফেলা হোক’ এবং ‘ইউনিভার্সিটির নতুন নামকরণ করার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করা হোক।’
রবিবারের ঘটনার পর এক বিবৃতিতে ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট ও ভাইস-চ্যান্সেলর মোহামেদ লাচেমি বলেন, ‘মূর্তিটি পুনঃস্থাপন বা প্রতিস্থাপন করা হবে না।’

নাম পরিবর্তন, মূর্তি অপসারণের বিষয় টাস্ক ফোর্সের বিবেচনাধীন
এই প্রতিষ্ঠানে এগারটন রায়ারসনের অবস্থান নিয়ে ক্রমবর্ধমান বিতর্কের প্রেক্ষাপটে ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ টাস্কফোর্স গঠন করেছে এবং তাদেরকে ইউনিভার্সিটির নাম, এই প্রতিষ্ঠানে এগারটনের উত্তরাধিকার এবং ক্যাম্পাসে তার অন্যান্য স্মারক সম্পর্কে পুনর্বিবেচনার এখতিয়ার দিয়েছে।
লাচেমি লিখেন, ‘টাস্কফোর্সের কাজ এখন অন্য যে কোনও সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
২০২০ সালের নভেম্বরে যাত্রা শুরুর পর টাস্ক ফোর্স ইউনিভার্সিটির স্টাফ, অনুষদ ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করেছে এবং ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সভা করছে।
২০২১ সালের শরৎকালের মধ্যে গ্রুপের সুপারিশমালা তৈরি হবে এবং ইউনিভার্সিটির
প্রেসিডেন্টের কাছে পেশ করা হবে। গ্রুপের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ততদিন পর্যন্ত টাস্কফোর্স ‘তার মেয়াদকালে জমা দেয়া সব আবেদন পুক্সক্ষানুপুক্সক্ষভাবে পর্যালোচনা করবে এবং একইসঙ্গে নতুন বিবৃতি, দরখাস্ত এবং পদক্ষেপ গ্রহণের যে কোনও আহবানের বিষয়গুলিও বিবেচনায় নেবে।”
এদিকে, কতিপয় শিক্ষার্থী, স্টাফ ও অনুষদ তাদের দাপ্তরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই ইউনিভার্সিটির উল্লেখ করতে ‘এক্স-ইউনিভার্সিটি” বলে উল্লেখ করতে শুরু করেছে।

রায়ারসন জার্নালিজম স্কুল তার প্রকাশনার নতুন নামকরণ করবে আবাসিক স্কুল ব্যবস্থায় ওই নামের ব্যক্তিটির ভূমিকার কারণে

রায়ারসন ইউনিভার্সিটির জার্নালিজম বিভাগ বলেছে, তারা সেই সব শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের দুটি প্রকাশনার নাম পরিবর্তন করবে যারা অনুভব করে যে, আবাসিক স্কুল ব্যবস্থার ‘ভয়ংকর উত্তরাধিকার’ প্রকাশনার শিরোনামে রায়ারসনের নাম ব্যবহার অব্যাহত রাখা অত্যধিক বাড়াবাড়ি। খবর দ্য কানাডিয়ান প্রেস এর।

বিভাগের এক বিবৃতিতে বলা হয়, তারা রায়ারসন রিভিউ অব জার্নালিজম নামের সাময়িকী এবং দ্য রায়ারসন পত্রিকার নাম পরিবর্তন করবেন। এগারটন রায়ারসনের প্রসঙ্গ সরিয়ে ফেলার জন্যই এটা করা হবে।

জার্নালিজম বিভাগ বলেছে, এগারটন রায়ারসন ‘নিঃসন্দেহে’ আবাসিক স্কুল ব্যবস্থার অন্যতম স্থপতি।

রায়ারসনের ভাষ্কর্যে ‘তাদের খনন করে তুলে আনো” এবং ‘২১৫’ লেখাসহ লাল রঙ এবং প্রতিবাদী দেওয়ালচিত্রে ছেয়ে ফেলার একদিন পর এই বিবৃতি দেওয়া হয়। ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার কামলুপস-এ পুরনো আবাসিক স্কুলের জায়গায় যে ২১৫টি শিশুর দেহাবশেষ পাওয়া গেছে তাদের প্রতীক হিসাবে ভাষ্কর্যের আশেপাশে কয়েক জোড়া জুতাও রেখে দেয়া হয়। স্কুল অব জার্নালিজম বলেছে, প্রকাশনার মাস্টহেডের নতুন নামকরণ ও এর নকশা করার ব্যাপারে অদিবাসী সৃজনশীল ব্যক্তিদের যুক্ত করার প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদেরকে যুক্ত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী শরৎকালের মধ্যে ম্যাগাজিন ও পত্রিকার নতুন নামকরণ করাই তাদের উদ্দেশ্য বলে জানিয়েছে স্কুল অব জার্নালিজম।