নিভৃতে
রীনা গুলশান
ফাবিয়ান মেইন গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ভাবলো, বুড়োটা হঠাৎ যাবার দিনই সকালে ডেকে পাঠালো কেন? একটু চিন্তায়ই পড়ে গেল। বুড়োটা যা মুডি, আবার ছুটিটাই না বাতিল করে দেয়! বসের রুমের ভেতরে ঢুকতে যেয়েও হঠাৎ একটা হালকা কান্নার শব্দে ফাবিয়ান থমকে গেল, হ্যাঁ বসের গলাও পাচ্ছে- সেই সাথে একটা মহিলার কান্না। কে কাঁদছে? বেশ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে চাপা স্বরে কাঁদছে! ফাবিয়ান কিছুটা নিঃশব্দে দরজার পাশে চলে এলো। বেশ কিছুটা কৌতুহল অনুভব করছে। যদিও এটা খুব গর্হিত। তবুও কৌতুহল দমন করতে পারছে না। শুনলো এ্যান্থনির কণ্ঠ-
: দ্যাখো বোকার মত কেঁদো না। কতবার বলেছি তোমাকে, নৈ:শব্দের কান্না, শব্দ, ভালোবাসা কেউ বুঝতে পারে না। কথা বল, মুখ ফুটে কিছু বল। বলবে নাতো। শুধু কাঁদবে। আর বোকার মত নিজেকে টর্চার করবে?
: কিভাবে বলবো বস? ওতো শোনার মত কোনই সুযোগ আমাকে কখনোই দিল না!
: অবশ্যই দিয়েছে, তুমি হলে গাধার গাধা! সুযোগ সব সময় হাতে আসে না। মাঝে মধ্যে সুযোগ করেও নিতে হয়!
: কিন্তু বস! সিসিলিয়ার ব্যাপারটা খুব আকস্মিক ছিল! আমি বোঝবার বা কিছু বলবার আগেই ওরা লিভিং টুগেদারে চলে গেল!
: হু! তাতো যাবেই। ঐ ধরনের মেয়েদের কাজই হলো ভালো ভালো ছেলেগুলোর মাথাগুলো চিবিয়ে ঘাড়ে চড়ে বসা। দ্যাখো এখন তার ফল বুঝছে। তাইতো যে দিন ওরা পার্টি দিতে যাবে, আমিতো বেশ কিছু কথাও বলেছিলাম ফাবিয়ানকে-
: তাই-ই আমি জানি নাতো?
: হ্যাঁ বলেছিলাম, অনেকেই আসল হীরা ফেলে কাঁচ কুড়িয়ে ন্যায়। কিন্তু তখন তারা বুঝতে পারে না, যখন বুঝতে পারে তখন দেরি হয়ে যায়। আর এখন আবারো, আবারো- আর একটা ভুল করতে যাচ্ছে। ডোরিনের কাছে যাচ্ছে।
: কিন্তু বস! ডোরিন ফাবির ছেলেবেলার প্রেম! তাকে ওর অবশ্যই একটা চান্স দেওয়া উচিত।
: হু! ছোটবেলার প্রেম না আর কিছু! অত যদি প্রেম তাহলে আজ প্রায় ৫ বছর নিঃশব্দে কি করে আছে ঐ মেয়ে, বল?
: সে তো ফাবির উপর রাগ করে!
: আচ্ছা। কৈ তুমিতো পারছো না এত কিছুর পরও ফাবির কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে। বার বার ওর জীবনের সমস্ত বিপদে বিপথে তুমি ছুটে যাচ্ছো। দু’হাতে ওকে তুমি ভালোবাসা বিলিয়ে চলেছো! আর ঐ গাধাটা দেখেও দেখছে না, বুঝেও বুঝছে না।
: ওতো আমাকে বন্ধুর মতো দেখে। বলতে বলতে আবারো নাওমী সুলেভান কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। বুক ভাঙ্গা কান্না। মনে হচ্ছে ওর হৃদয় চিরা রক্তগুলো ওর চোখ দিয়ে বয়ে চলেছে। হঠাৎ নাওমী দাঁড়িয়ে পড়লো-
: বস, আমি এখন তাহলে যাই। ফাবিয়ানকে ডেকেছেন, হয়তো বা এক্ষুনি এসে পড়বে!
: কিন্তু তোমাকেও আমি ডেকে পাঠিয়েছিলাম যে, যখন তুমি ওকে এয়ারপোর্টে ড্রপ করতে যাবে, তখন হৃদয়ের কথাটা এবারে বলেই ফেলো!
: নাহ্ বস, তা হয় না। ওর মন ছুটেছে ডোরিনের কাছে বেশ কিছু কাল ধরে। সিসিলিয়া ব্যাপারটি ত্বরান্বিত করেছে মাত্র। আসলে ব্যাপারটা হতোই।
চোরাবালির মত, ফাবিয়ানের হৃদয়ের মধ্যে ক্রমাগত ধ্বস নামছিলো। এ এক দিক দিয়ে ভালোই হলো, ওর ভেতরে ডোরিনের জন্য এক ধরনের অপরাধ বোধ আছে। সেটাও কাটা দরকার।
: যা ভালো বোঝ তোমরা, এইসব আজকালকার ছেলেমেয়েরা আবার বেশি বোঝে।
দরজার ওপাশে ফাবিয়ান একেবারে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নড়তেও পারছে না। মনে হচ্ছে ওর পায়ের পাতায় কে যেন বড় একটা পেরেক মেরে আটকে রেখেছে! সরে যাওয়া দরকার। সম্ভবত যে কোন মুহূর্তে নাওমী বের হয়ে আসবে বসের ঘর থেকে। তাহলে খুবই লজ্জার হবে। যদি নাওমী বুঝতে পারে যে ওদের আলাপন ফাবিয়ান শুনে ফেলেছে, তবে তার থেকে বিড়ম্বনার আর কিছু হবে না। ফাবিয়ান ঝটিতে নিজেকে হেঁচড়ে সরিয়ে নিল নৈ:শব্দে। বারের দিকে ছুটলো। যদিও জানে ওখানে কেউ নেই। তবু ওর কিছুক্ষণ একাকী থাকা দরকার। দৌড়ে বারের একটা উঁচু টুলের উপর বসে পড়ে। উত্তেজনায়, আবেগে, লজ্জায় একটা অসম্ভব জগাখিচুড়ি অনুভূতিতে ফাবিয়ান বহুক্ষণ আচ্ছন্ন হয়ে রইলো। কতক্ষণ নিজেই জানে না। তারপর বেশ অনেকটা সময় অতিক্রম করে খুব দ্বিধার সঙ্গে ফাবিয়ান এ্যান্থনির রুমে ‘নক’ করলো-
: চলে আসো।
: সুপ্রভাত বস।
: সুপ্রভাত। কেমন আছো হে?
: ভালোই।
: তা সব কিছু গুছিয়ে ফেলেছো?
: মোটামুটি, ফাবিয়ান কেমন জানি তোতলাতে থাকে কুণ্ঠার সাথে।
: তো, এবারে তাহলে ডোরিনের কাছে চললে?
: না, মানে- আমি তো নানীকে দেখতে যাচ্ছি।
: ওকে, ওকে- বুঝেছি, নানীতো বাহানা। আসলেতো ডোরিন, ছেলেবেলার ভালোবাসা তা কি ভোলা যায়? বলতে বলতে এ্যান্থনি হা… হা… হা… করে হাসতে থাকে। এরপর ড্রয়ার থেকে একটা বাদামী রঙের খাম বের করে ফাবিয়ানের হাতে দেয়।
: এটা কি বস?
: খুলেই দ্যাখোনা।
ফাবিয়ান দ্রুত হাতে খামের মুখ খুললো, দেখে একশত ডলারের ৫ খানা চকচকে নোট। ও খুব আশ্চর্য হয়ে এ্যান্থনির মুখের দিকে তাকালো। ৫০০ ডলার? কি ব্যাপারে। গতকালই তো চেক দিয়ে দিয়েছে। আবার কিসের টাকা?
এ্যান্থনীর দিকে তাকিয়ে দেখলো মিটিমিটি হাসছে।
: এটা আমার তরফ থেকে তোমার নানীর জন্য। একদিন বেশ একটা সুন্দর ডিনার করিয়ে দিও, আমার তরফ থেকে। বুঝলে বোকারাম?
ফাবিয়ান কোন জবাব দিতে পারে না। বড় অকারণে তার চোখের পাতা ভিজে আসে। জীবনে কোনো দিন বাবার আদর কাকে বলে সে জানে না। তাই সামান্য কোন আদরেই ওর হৃদয়ের ভেতরটা খুব দ্রুত দ্রবিভূত হয়ে যায়। ফাবিয়ান কোন কথা বলে না। শুধু উঠে দাঁড়িয়ে এ্যান্থনিকে খুব জোরে জড়িয়ে ধরলো। হাতের উপর চুম্বন করলো। তারপর চোখের কান্না লুকানোর জন্য খুব দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো।
বাইরে বেরিয়ে পাশ দিয়ে একটা স্ট্রীটকার চলে গেল। ফাবিয়ান সেটাতে উঠবার চেষ্টাই করলো না। ওর হাটতে খুব ভালো লাগছে। আজ শীতের প্রকোপ খুবই কম। হালকা ঠান্ডার একটা ঝিরঝিরে বাতাস। বুক ভরে সেই অপূর্ব ঠান্ডা বাতাস ও নাক দিয়ে গাল দিয়ে টেনে নিল। ধীরে ধীরে হাটছে। আজ কোন তাড়া নাই। বুকের ভেতরে কোন নাম না জানা অনুভূতির তান্ডব চলছে। মাথার ভেতরে একই সাথে সেতারের সাতটি তার বেজে চলেছে। একদিকে দেশে যাবার উত্তেজনা। আর আজকের হঠাৎ শোনা নাওমীর কথাগুলো ওকে অদ্ভুত একটা উত্তেজনায় ভরিয়ে দিয়েছে। হাটতে হাটতে ব্যাথার্স এবং কুইন্সের মধ্যে দিয়ে কিং এর দিকে এগিয়ে গেল। এখন মাত্র আড়াইটা বাজে। ৫টার দিকে এয়ারপোর্টে রওনা দেবে। হাতে অনেকটা সময়। ঘরে যেতে ইচ্ছা করছে না। পেটের মধ্যে ক্ষুধার চিনচিনে অনুভূতি। হু! খাওয়া দরকার। সামনেই ‘সাবওয়ে’ দেখলো। ওখান থেকে ১২ ইঞ্চির একটা টোনার সাব নিল আর তার প্রিয় পানীয় ‘এ্যারিজোনা কোল্ডটি’র একটা টিন নিল। তারপর আর কিছুটা হেটে লেকের পাড়ে যেয়ে বেঞ্চের উপর বসলো। লেকের পানিটা আজ বেশ ঘোলাটে স্থির। প্রচুর সাদা হাঁস পাখি পানির উপর দিয়ে বেড়াচ্ছে। ওদের কোন চিন্তা নাই। ঘুরে ফিরে বেড়ায়। ইচ্ছা হলে পানিতে ঠোকর মারে। ইচ্ছা হলো তো ডানা মেললো আকাশে। স্বাধীন। কোন পিছুটান নাই।
পিছুটান? ফাবিয়ানের কি সেটা আছে? একমাত্র জীবনে একটিই তো তার পিছুটান ছিল নন্না। দু হাত মেলে দিয়ে যে তাকে ক্রমাগত ডাকে। শয়নে, স্বপনে, জাগরণে- সমগ্র চেতনায়। হৃদয়ের সমস্ত তন্ত্রীতে যাকে ও অনুভব করে। সেই নানীকে ছেড়েও তো দিব্যি এত দূর দেশে চলে এলো। এতদিন ধরে পড়ে রইলো। কিভাবে? বুড়ো মানুষ যে তাকে আঁচলের সমস্ত উষ্ণতা দিয়ে বড় করেছে। তার কথা একটি বারও ভাবলো না। কেমন করে একাকী তাকে ছাড়া নানীর দিনগুলো কাটছে? তাহলে সত্যিই কি তার কোনই পিছুটান নাই। ডোরিন? তার আজন্মের বন্ধু। তার খেলার সাথী। তার সমগ্র যন্ত্রণার সহমর্মী। তাকেই বা কিভাবে ও ভুলে রইলো, এই এতটা সময়। সব কিছুই কি সে শুধুই তার মায়ের উপর তীব্র অভিমানে? আর মনে না হওয়া তার বাবার উপর অসম্ভব ক্রোধে তাকে এমন করে দিয়েছে? তবে কি কোন ভালোবাসা তাকে পিছু টানে না?
তাহলে আজ কেন তার এই অসম্ভব দম বন্ধ একটা অনুভূতি হচ্ছে? নাওমীর গুমরে কান্না কেন তাকে পিছু ছাড়ছে না? কেন মনে হচ্ছে কোথায়, কোনখানে যেন খুব বড় মাপের একটা ভুল হয়েছে? নাকি এসবই অনুভূতি হচ্ছে অসম্ভব কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে? নাওমীর জন্য তার কি কখনো অন্যরকম কোন চোখ ছিল? অন্য কোন ভালোবাসা?
ওহ্! অজান্তে কত বড় একটা ভুল সে করে ফেলেছে। চিন্তা করলেই ফাবিয়ানের মরে যেতে ইচ্ছা করছে। নাওমী সুলেভান! তার কানাডিয়ান জীবনের একমাত্র পরিত্রাতা। সুহৃদ, বন্ধুজন। কানাডায় আসবার পরে যখন সে গভীর গাড্ডায় পড়েছিল, তখন সে কাউকেই পায়নি সেই দুঃসময়ে! তখন এই নাওমীই তার সেই চরম অসহায় অবস্থায়, ওর নরম মমতাময় সোনালী হাত খানা বাড়িয়ে দিয়েছিল।
সেই যেদিন ওরা তিনজন টগবগে নবীন তরুণ সব ছেড়ে দেশ ছেড়ে স্বজন ছেড়ে এসেছিল একটি নতুন দেশে অজানার উদ্দেশ্যে। এই দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান ছাড়া আর কিছুই জানতো না। শুধু হৃদয়ের ভেতরে ছিল স্বপ্নের দৃঢ় প্রত্যয়। আর কিছুই ছিলো না। দুরু দুরু বুকে যখন ‘পিয়ারসন্স’ এয়ারপোর্টে অবতরণ করেছিল, তখন ওদের হৃদয়ে একই সঙ্গে আনন্দ এবং ভয় একই সাথে মিশেছিলো। তবে ওদের জন্য বেশ একটা বড় সড় বিস্ময়ও অপেক্ষা করছিলো। এয়ারপোর্টে ওদের নিতে এসেছিলো রবার্টের (গার্লফ্রেন্ড) অর্থাৎ গেরী (ছেলে বন্ধু)। তারা তো দুজন দুজনাকে পেয়ে একেবারে ভালোবাসায় ব্যাকুল কপোত কপোতীর মত জড়িয়ে একেবারে দিশেহারা অবস্থা। অবশেষে হতবিহ্বল ফাবিয়ান এবং রায়ানকে গেরী আর রবার্ট বাসায় নিয়ে এলো। বাসা দেখে তো ওদের চক্ষু চড়কগাছ। মনে হলো, বাসা তো নয়, মুরগির খোপ। ছোট্ট একটা বেড রুম তারপর লিভিং রুম নামে এক চিলতে জায়গা। সেখানেই ড্রয়িং, কিচেন এবং ডাইনিং। তাইতো আবার ভিক্টোরিয়ান আমলের বাংলো প্যাটার্নের বাড়ির অন্ধকার স্যাতস্যাতে বেজমেন্ট। তারই ভাড়া নাকি ৭৫০ ডলার। গেরী কোমর দুলিয়ে, হাত নেড়ে অতি মেয়েলী গলায় বললো-
: এটা ডাউনটাউন তো, তাই বাড়িগুলো সবই প্রায় পুরানো মডেলের, প্রায় ২০০-৩০০ বছর আগের। অথচ ভাড়া অনেক বেশি।
: তা এখানে থাকার দরকার কি? রায়ান বললো।
গেরী তার কোমর পর্যন্ত কোকড়ানো চুলে হাত বুলিয়ে বললো-
: কি করবো বল? আমার কাজের জায়গা এখান থেকে ৩/৪ ব্লক দূরে। হাঁটা পথ।
: কোথায় কাজ করো তুমি?
: এই ‘ঈটন সেন্টারে’। খুব বড় শপিং মল। বেসিক্যালি এটা টুরিস্ট মল।
: আচ্ছা! দারুন! কালই বেড়াতে যাবো।
তো, সেই রাতে ঐ লিভিং রুমের এক চিলতে পরিসরে একটা ফ্যুটন ছিল (সোফা কাম বেড), তাতেই ওদের ঘুমুতে দিল। নিজেরা দুজন বেড রুমে যেয়ে দরজা বন্ধ করলো। ডিনারেও দিল শুধু একটু পাস্তা সেদ্ধ ও পাস্তা সস।
পর দিন সকালেই ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে গেরী ফাবিয়ান আর রায়ানের দিকে তাকিয়ে বললো-
: দ্যাখো আমি কিন্তু সোজা কথার মানুষ, তোমরা কিন্তু কিছু মনে করো না। আমার এখানে তোমরা ৭ দিনের বেশি থাকতে পারবে না।
ওরা খুবই অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। এমনকি রবার্টও ওদের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো। সকালের নাস্তা খেয়েই ফাবিয়ান আর রায়ান বেরিয়ে পড়লো, ওদের দুজনকে বললো একটু দেখে আসি আশপাশে। তো সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওরা বাইরে বাইরে ঘুরলো। ঘুরতে ঘুরতেই কিং এন্ড ডাফরিনের ওখানে খুব বড় একটা বাড়ির সামনে দেখলো ‘ঃড়-ষবঃ’ লেখা আছে। ওরা কলিং বেল টিপতেই একজন খুব বয়স্কা মহিলা দরজার খুলে বললো-
: কাকে চাই?
: না, মানে এখানে কি ঘর ভাড়া আছে?
: আছে কিনা দেখছো না? চোখের মাথা খেয়েছো? বুড়ি ঝন ঝন করে ওঠে।
: আমরা কি একটু ঘরটা দেখতে পারি?
: তা পারো।
বুড়ি ওদের বেজমেন্টে নিয়ে গেল। বেশ বড় পরিসর। তবে ৩টা কামরা। দুটোতেই ভাড়া আছে। একটা খালি আছে। বাথরুম, কিচেন শেয়ার করতে হবে। একটিই বাথরুম। ভাড়া $ ৩০০ ডলার। দুজনে থাকলে এক রুমে $ ৪০০ ডলার। ওদের অবাক প্রশ্ন, এরকম কেন?
: কেন না শুনি? আমার পানির বিল, ইলেক্ট্রিক বিল একজনের জন্য বেশি আসবে না?
এতক্ষণে ওরা হৃদয়ঙ্গম করলো। বুড়ি আবার বললো-
: কাপড়, পেইড ওয়াশিং মেশিন থেকে ধুয়ে আনতে হবে।
: সেটা আবার কোথায়?
: ঐ তো সামনেই দেখতে পাচ্ছো, রাস্তার ওপারে। ম্যাকডোনাল্ডের পাশে। বলেই বুড়ি আবার খিচিয়ে উঠলো-
: তা কাজ টাজ করা হয় নাকি? নাকি বেকার হয়ে ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঘুরে বেড়ানো হচ্ছে। তারপর ৩/৪ মাস মাগনা থেকে এক রাতে ভোকাট্রা হয়ে যাবে। দেখলাম তো কম নয়। চুলগুলো পেকে গেল এইসব বদমায়েশদের সাথে থাকতে থাকতে। বুড়ি বকবক করেই চললো। ওরা বুঝলো বুড়ির খুবই তীক্ত অভিজ্ঞতা এইসব ভাড়াটেদের নিয়ে। ফাবিয়ান তাড়াতাড়ি বললো-
: না, না ম্যাম- আমরা ওরকম ছেলে নই। বলেই ফাবিয়ান পকেট থেকে $ ৪০০ ডলার বের করে বুড়ির হাতে দিল। বুড়ি খুবই অবাক হয়ে ডলারগুলোর গুনলো। তারপর ওদের বললো-
: চলো ওপরে আমার ঘরে।
উপরে এনে বুড়ি ওদের খুব আদর করে বসালো। তারপর বললো-
: আমার নাম এলিজাবেথ রবিনসন। দু’বছর হলো স্বামী মারা গেছে। দুটো ছেলে আছে। কিন্তু বছরে একমাত্র ক্রিসমাসের রাতে ছাড়া আসে না। মাঝে মধ্যে ছোট ছেলেটা এক/দুই বার ফোন করে। বড়টা তাও করে না। অথচ এই টরন্টোতেই থাকে- বলতে বলতে এলিজাবেথের কণ্ঠ ধরে এলো।
: তোমরা কিছু মনে করো না বাবা। একা বুড়ো মানুষ তো সবাই আমাকে ঠকিয়ে যায়। তারপর বুড়ি একটু একটু করে ওদের সমস্ত বৃত্তান্ত নিল। সব শুনে এলিজাবেথ বললো-
: আমি নিজে এক দুঃখী। আমার কাছেই সব দুঃখী মানুষগুলো আসে কেন? যাক, চিন্তা করো না, তোমরা দরকার হলে আজই চলে এসো। দেখলেই তো, ফ্রি ফারনিসড্ রুম। অতএব কোন অসুবিধা হবে না। খাওয়াটাই যা তোমাদের অসুবিধা হতে পারে। যা হোক করে চালিয়ে নাও। এত দূর থেকে এত স্বপ্ন নিয়ে এসেছো, সৃষ্টিকর্তা তোমাদের মঙ্গল করবেন। আমি রান্নারও কিছু জিনিসপত্র দেবো তোমাদের।
এলিজাবেথের কথা শুনতে শুনতে ফাবিয়ানের মনে হলো তার নানী কথা বলছে। আহারে তার নানীও তো আজ এই রকম একা। মেয়ে থাকতেও নাই। যাকে নিজের ছেলের থেকেও বেশি আদরে মানুষ করেছে, সেও তো তাকে ছেড়ে চলে এসেছে। ফাবিয়ান দারুন একটা অনুশোচনায় দগ্ধ হলো। তার দু চোখে জল এসে গেল।
এলিজাবেথ ঠিকই ফাবিয়ানের এই ভাবান্তর লক্ষ্য করলো। তাড়াতাড়ি এসে ফাবিয়ানের চুলের মধ্যে স্নেহের হাত বুলিয়ে দিল-
: কি ব্যাপার তোমার নানীর কথা মনে পড়ছে বুঝি? এখন মন খারাপ করে আর কিইবা করবে? তারচে বরং কাগজপত্র হয়ে গেলে তোমার নানীকে তোমার কাছে আনিয়ে নিও।
: নানী, সে কখনো তার ঘর, বাড়ি ছেড়ে আসবে না!
: আসবে রে বেটা আসবে? তুমি যে তার কতখানী, সে তুমি কি করে বুঝবে? আমি একটু বুঝতে পারছি! নাতি পোতা হলো দাদী-নানীদের কাছে আসল টাকার থেকে সুদের টাকার মত আনন্দের!
এসব বলতে বলতে এলিজাবেথ ওদের সামনে প্লেট ভরে তার হাতে বানানো ব্রাউনি দিল। খুব সুন্দর ব্রাউনিটা। মধ্যে কাজু বাদাম ভরা। খুব নরম। ওরা দুজন তো ঘর খুঁজতে খুঁজতে এমনিতেই প্রচন্ড ক্ষুধার্ত ছিল। মোটামুটি নিমেষের মধ্যে প্লেট সাফ করে দিল। এলিজাবেথ আবার গ্লাশ ভরে অরেঞ্জ জুস দিল।
: তোমরা, তোমাদের যে বন্ধুর বাড়ি উঠেছো, তাদেরকে বলে আজই চলে আসো। আর তোমরা আসতে আসতে আমি ঘরটা পরিস্কার করে রাখবো।
: না, না এলিবাবেথ, তোমার পরিস্কার করবার কোনই দরকার নাই। আমরা এসেই পরিস্কার করবো। ভ্যাকুম করবো। আর খাবারের জন্য চিন্তা করবে না। আমরা যখন কাটিনজিরাতে এপার্টমেন্টে ছিলাম, তখনতো রেঁধেই খাওয়া লাগতো।
: ফাবিয়ান রান্নায় এক্সপার্ট। ওর মিটবল উইথ পাস্তা যে না খেয়েছে, সে জানবেই না ও কত বড় প্রতিভাধর বাবুর্চি!
: তাই নাকি? এলিজাবেথ খুউব হৈ চৈ করে ওঠে। বেশতো একদিন খাওয়া যাবে?
: অবশ্যই, অবশ্যই- ফাবিয়ান নম্র স্বর বলে।
এরপর ওরা গেরির বাসায় যেয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বিদায় নিল। রবার্টের মুখে কিঞ্চিত অপরাধী ভাব। বার বার বলছে-
: এত শীঘ্র বাসা কোথায় পেলি?
: এই তো পেয়ে গেলাম- ফাবিয়ান বললো।
: আরে খুঁজলে কি না মেলে? পয়সা থাকলে বাঘের দুধও মেলে- রায়ান বললো বেশ জুলুনীর স্বরে। রায়ান কানাডাতে আসার পর থেকেই রবার্টের উপর কেন জানি খুব চটে ছিল। আজ তার ঝাল ঝাড়লো। রবার্টও যে তা বোঝেনি, তা নয়। তবে তার কিইই বা করার ছিল? ভালোবাসা বলে কথা?
যাই হোক, ওরা দুটিতে সন্ধ্যার মধ্যে চলে এলো। এসেই ব্যাগগুলো লিভিং স্পেসে রেখে চটপট ঘরটা ক্লিন করে ফেললো। ভ্যাকুম করলো। তারপর চটপট দুজনে ক্লোজেটে কাপড় গুছিয়ে ফেললো। রাত ১১টা বেজে গেল। এত রাতে আর কিইবা রান্না করবে? ওদের বাড়িটার গায়েই ‘ম্যাকডোনাল্ড’। দুটো লার্জ ম্যাক কিনে খেয়ে নিল। তারপর ঘুমুতে গেল। আগামীকাল ওদের জীবনের অন্য রকমের শুরু। সম্পূর্ণ নিজস্ব ধারার বাইরে। যে জীবন ফেলে এসেছে, হয়তোবা কোন দিক দিয়েই তার সাথে কোন মিল থাকবে না। ক্লান্ত, শ্রান্ত দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লো অচিরেই।
বেশ সকালেই পাশের ঘরে খুটখাট শব্দে ফাবিয়ানের ঘুম ভেঙ্গে গেল। রায়ানের ঘুম খুউব গাঢ়। এসব অল্প স্বল্প শব্দে রায়ানের ঘুম ভাঙ্গে না। আসলে ঘুমুতে যাবার আগে ফাবিয়ান বেশ অস্বস্তি নিয়ে ঘুমিয়েছে। কারণ আর কিছু না। বিছানার উপরে রাখা ‘কমফোর্টার’টা পুরানো। কত মানুষ ওটা শরীরে চড়িয়েছে, কে জানে? ওর সমস্ত অন্তরাত্মা ঘিন ঘিন করে উঠলো। তবু কিছু করার ছিল না। কারণ, সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ, তবু ভালোই ঠান্ডা পড়েছে। তারপর বেজমেন্টের এই ঘর। বেশ ঠান্ডা লাগছিল ওদের। তবুও ওর মনের সেই ঘিনঘিনে অস্বস্তির কথা রায়ানকে সে বলেনি।
তাই এত ভোরেই খুটখাট শব্দেই ফাবিয়ানের ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম ভেঙ্গে গেলে ফাবিয়ান আবার বিছানায় শুয়ে থাকতে পারে না। কেমন জানি গায়ে জ্বালা ধরে যায়। চট করে উঠে পড়লো। ঘরের মধ্যেই ৩/৪টা চক্কর লাগালো। কেমন জানি অজানিত নতুন অনুভূতিতে ও আচ্ছন্ন হয়ে গেল। নতুন দেশে এসে এটাই ওর প্রথম নিজের ঘর। হোক সে বেজমেন্ট অথবা অনেকগুলো মানুষের সাথে ভাগাভাগি করে থাকছে। তবুও তো নিজের ঘর। একটু পর রায়ানও উঠে পড়লো। এরপর ওরা সকালের ওয়াশরুম পর্ব শেষ করে দুজনে বসলো লিস্ট করতে। একদম কি না হলেই নয়। সেটাই লিস্ট করতে বসলো। প্রথমেই ওরা দুজনের আনা ডলার হিসাব করতে বসলো। দুজনাই আলোচনা করলো যে, যতদিন একটা কোন কাজ না জুটছে, খুবই হিসাব করে চলতে হবে। বাইরে খেলে হবে না। তাহলে অনেক ডলার বেরিয়ে যাবে। (চলবে)

লেখক রীনা গুলশান বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স। ইতিপূর্বে বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং মাসিকে তার কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, রম্য রচনা প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে কানাডার বিভিন্ন বাংলা পত্রিকাতেও। তিনি ‘প্রবাসী কণ্ঠ’ ম্যাগাজিন এর একজন নিয়মিত কলামিস্ট।