২০২৪ সালে কানাডায় রিফিউজি ক্লেইম করেছেন প্রায় ২০ হাজারেরও বেশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক, ১২ মে, ২০২৫ : ২০২৪ সালে ২০ হাজার ২শত ৪৫ জন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী কানাডায় রিফিউজি ক্লেইম করেছেন যা রেকর্ড সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। ধারণা করা হচ্ছে চলতি বছর এই সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে। খবর গ্লোবাল নিউজের।
প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি তার পূর্বসূরি জাস্টিন ট্রুডোর মতো কানাডিয়ান অভিবাসনকে “টেকসই স্তরে” ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকার তাদের জারি করা স্টাডি পারমিটের সংখ্যাও কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তারপরও কানাডায় রিফিউজি ক্লেইম এর সংখ্যা বাড়ছে।
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে গ্লোবাল নিউজ তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল যে, ঐ বছর পহেলা জানুয়ারী থেকে শুরু করে ৩১ আগস্টের মধ্যে (৮ মাসে) কানাডায় মোট ১ লাখ ৮ হাজার ৩৫ জন ব্যক্তি রিফুউজি ক্লেইম করেছিলেন যার মধ্যে ১২ হাজার ৯ শ ১৫ জন ক্লেমেন্ট ছিলেন স্টাডি পারমিটে এবং ১ হাজার ৩ শ ১০ জন স্টাডি পারমিট এক্সটেনশনে। পরবর্তী ৪ মাসে রিফিউজি ক্লেমই করা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ হাজারের উপরে।
গ্লোবাল নিউজের খবরে ঐ সময় বলা হয়েছিল ২০১৮ সালে কানাডায় ১ হাজার ৫ শ ১৫ জন শিক্ষার্থী রিফুউজি ক্লেইম করেছিলেন। তার সাথে তুলনা করলে ২০২৪ সালের প্রথম ৮ মাসে রিফুউজি ক্লেইমের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল ৬০০ শতাংশে।
নতুন প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসেই সাড়ে ৫ হাজার আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী রিফিউজি ক্লেইম করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২২ শতাংশ বেশি।

অভিবাসন আইনজীবীরা বলছেন যে, পার্মানেন্ট রেসিডেন্সীর জন্য পূর্বের সুগোগুলো ফেডারেল সরকার কর্তৃক সীমাবদ্ধ করার কারণে রিজিউজি ক্লেইমের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে।
টরন্টো-ভিত্তিক অভিবাসন ও শরণার্থী আইনজীবী চ্যান্টাল ডেসলজেস বলেন, “সরকার আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়মিত কোর্সের মাধ্যমে পার্মানেন্ট রেসিডেন্সীর জন্য আবেদন করার অনেক দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।”
ফলস্বরূপ, এটি মানুষকে অন্যান্য পথে পার্মানেন্ট রেসিডেন্সী পাওয়া যায় কি না সেদিকে ঠেলে দিচ্ছে।”
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মার্ক কার্নি গত ২রা মে তার প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন ২০২৭ সালের শেষ নাগাদ কানাডার মোট জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশেরও কম অস্থায়ী কর্মী এবং আন্তর্জাতিক ছাত্রদের সংখ্যা সাত শতাংশ থেকে কমিয়ে আনবেন। তার মতে এটি আবাসন, সরকারি অবকাঠামো এবং সামাজিক পরিষেবার উপর চাপ কমাতে সাহায্য করবে।
উল্লেখ্য যে, ২০২৪ সালে কানাডায় অনুমোদিত স্টাডি পারমিটের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে রেকর্ড পরিমানে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় ২০২৩ সালে রেকর্ড সর্বোচ্চ ৬৮১,৩৯০টি অনুমোদনের পর, ২০২৪ সালে অনুমোদন কমে ৫১৮,১২৫টিতে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের আগমন নিয়ন্ত্রণের জন্য কানাডিয়ান সরকারের প্রচেষ্টার ফলে এই হ্রাস ঘটেছে। আবাসন সংকট, সরকারী সম্পদের উপর অতিরিক্ত চাপ এবং শিক্ষার্থীদের উপর আর্থিক চাপ সৃষ্টিকারী ক্রমবর্ধমান টিউশন ফি নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে এই হ্রাস এসেছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের কানাডায় প্রবেশের ক্ষেত্রে আরো লাগাম টানতে যাচ্ছে দেশটির সরকার। রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়, কানাডা ২০২৫ সালেও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কমিয়ে আনতে চায়। আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা সহ অন্যান্য সমস্যার কারণে দেশটির সরকার এ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।
২০২৫ সালে ৪ লাখ ৩৭ হাজার শিক্ষার্থীকে কানাডায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে যা ২০২৪ সালের সংখ্যার চেয়ে ১০ শতাংশ কম। গত ২৪ জানুয়ারি দেশটির অভিবাসন মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে এতথ্য জানিয়েছে।
এর আগে, ২০২৩ সালে সাড়ে ৬ লাখের বেশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীকে কানাডায় পড়াশোনার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ বিশ্বের উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর শিক্ষার্থী ও অভিবাসনপ্রত্যাশীদের কাছে শীর্ষ পছন্দের দেশ কানাডা।
কানাডার সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশটিতে সক্রিয় ভিসাধারী আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১০ লাখে পৌঁছেছিল। ১০ বছর আগে, ২০১২ সালে এই সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার।
উল্লেখ্য যে, কানাডায় ২০০১ সাল থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিস্ময়করভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর এই শিক্ষার্থীদের অনেকে লেখাপড়া শেষে এদেশে থেকে গেছে এবং তাদের অস্থায়ী চাকরি এবং স্থায়ী আবাসন অব্যাহত রেখেছে। এই ছাত্ররা কানাডার অর্থনীতির সুযোগ নেয়া এবং উন্নত জীবনযাত্রা ভোগ করার বিনিময়ে এদেশের শ্রম বাজারকে জোরদার করতে সহায়তা করেছে।
আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় উৎস হলো চীন। প্রতি ১০ জন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩ জনই চীনের। এর পরেই রয়েছে ভারতের অবস্থান, প্রতি চারজনে একজন।
উল্লেখ্য যে, গত বছর, কানাডার কেন্দ্রীয় সরকার বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য যোগ্য কর্মঘণ্টা সীমিত করেছে এবং তাদের স্বামী/স্ত্রীর জন্য উপলব্ধ ওয়ার্ক পারমিটের নিয়ম কঠোর করেছে।
তবে টরন্টো-ভিত্তিক অভিবাসন এবং শরণার্থী আইনজীবী চ্যান্টাল ডেসলজেস গ্লোবাল নিউজকে বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতির কিছু ক্ষেত্র আছে যারা সত্যিই আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছে।’
কানাডায় এমন অনেক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী আছে যারা এই সিস্টেমের মধ্য দিয়ে গেছে, এমন একটি ডিপ্লোমা অর্জন করেছে যার আসলে কোনও মূল্য নেই,” তিনি বলেন। “এখন তারা হয় ওয়ার্ক পারমিটের জন্য যোগ্য নয় অথবা এমনকি যদি তারা কিছু সময়ের জন্য কাজ করে থাকে, তবুও তারা কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পেতে সক্ষম হবে না।”
২০২৪ সালে কানাডায় যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি মাত্রায় রিফিউজি ক্লেইম করেছেন তার মধ্যে কয়েকটি হলো – Conestoga College, Seneca College of Applied Arts and Technology, Université du Québec à Chicoutimi, Niagara College Canada, Collège Ellis – Trois-Rivières campus.
গ্লোবাল নিউজ এর পক্ষ থেকে এই বিষয়ে মন্তব্যের জন্য কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে Université du Québec à Chicoutimi’র কর্তৃপক্ষ জানায়, পরিস্থিতি উদ্বেগজনক, কিন্তু এটি এমন একটি পরিস্থিতি যার উপর তাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। “বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য কী তা আমরা জানতে পারি না। আমরা তাদের একাডেমিক রেকর্ডের ভিত্তিতে তাদের নির্বাচন করি।” ফরাসি ভাষায় এক বিবৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয়টি এ কথা বলেছে।
নায়াগ্রা কলেজ বলেছে যে “শরণার্থী কর্মসূচির অধীনে কানাডার লক্ষ্য” সমর্থন করার জন্য তারা ফেডারেল সরকারের সাথে কাজ করার জন্য উন্মুক্ত, তবে কলেজটি এ কথাও বলছে যে কোন শিক্ষার্থী রিফিউজি ক্লেইম করলে ইমিগ্রেশন মন্ত্রণালয় সেটা সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অবহিত করে না।
Ellis College এর মহাপরিচালক স্টিফেন ডেলিসল বলেছেন ফেডারেল সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে যদি তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কেউ রিফিউজি ক্লেইম করেন তাহলে সেটা যেন তাদেরকে সাথে সাথে অবহিত করা হয়। কিন্তু তাদের অনুরোধের “কোনও সাড়া” দেয়নি ফেডারেল সরকার।
উল্লেখ্য যে, কানাডায় আশ্রয়প্রার্থী ব্যক্তিদের অবশ্যই প্রমাণ করতে হয় যে তাদেরকে জন্মভূমিতে ফেরত পাঠানো হলে তারা নিপীড়নের মুখোমুখি হতে পারেন।
কানাডার ইমিগ্রেশন অ্যান্ড রিফিউজি বোর্ড ২৮১,০০০-এরও বেশি রিফিউজি ক্লেমেন্টদের ফাইল নিয়ে কাজ করছে এবং মামলার শুনানির জন্য ক্লেমেন্টদেরকে ইতিমধ্যেই দীর্ঘ অপেক্ষার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
অভিবাসন ও শরণার্থী আইনজীবী চ্যান্টাল ডেসলজেস গ্লোবাল নিউজকে বলেন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা রিফিউজি ক্লেইম করছেন তাদের মধ্যে বৈধ আবেদনকারীও আছেন। ধরা যাক কেউ, সম্ভবত ছয় বছর আগে, ইউক্রেন থেকে আন্তর্জাতিক ছাত্র হিসেবে কানাডায় এসেছিলেন। কিন্তু এখনতো ইউক্রেনের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
অর্থাৎ শুধুমাত্র একজন আন্তর্জাতিক ছাত্র হিসেবে কানাডায় এসেছিলেন বলেই রিফিউজি ক্লেমেন্ট বা শরনার্থী স্টেটাস পাওয়ার জন্য তার আবেদনের দাবি ভুয়া এ কথা ঠিক নয়।
উল্লেখ্য যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ইতিপূর্বে বলেছিলেন, সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা ব্যক্তিদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য কানাডার একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে আমাদেরকে এটি নিশ্চিত করতে হবে যে এই সিষ্টেমের কোন অপব্যবহার যাতে না হয়।
জাস্টিন ট্রুডো আরো বলেছিলেন, আমাদেরকে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে হবে কাদের সবচেয়ে বেশী সাহায্যের প্রয়োজন, কে একজন
সত্যিকারের আশ্রয়প্রার্থী। সিস্টেম এবিউজ করে কেউ শর্টকাটে পার্মানেন্ট রিসিডেন্সী বা সিটিজেনশীপ পাওয়ার জন্য রিফিউজি ক্লেইম করলে সেটা গ্রহণযোগ্য নয়।
সাবেক ইমিগ্রেশন মন্ত্রী মার্ক মিলারও গ্লোবাল নিউজের সাংবাদিক মার্সিডিস স্টিফেনসনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ক্রমবর্ধমান সংখ্যক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা স্টুডেন্ট ভিসায় কানাডায় প্রবেশের পর এ দেশে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য আশ্রয় দাবি করছে। এই প্রবণতাকে মন্ত্রী ‘উৎকণ্ঠাজন’ বলে অভিহিত করেছিলেন। মন্ত্রী আরো বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ স্টুডেন্ট ভিসার প্রোগ্রামটিকে ‘কানাডায় ব্যাকডোর এন্ট্রি’ হিসাবে ব্যবহার করছেন। প্রায়শই এটি করা হচ্ছে তাদের টিউশন ফি কমানোর জন্য। এই পরিস্থিতিতে কানাডার বিশ^বিদ্যালয় ও কালেজগুলোকে অবশ্যই তাদের স্ক্রিনিং এবং মনিটরিং প্র্যাকটিসকে উন্নত করতে হবে যাতে কেউ এই সিস্টেমের অপব্যবহার না করতে পারে।
তিনি জানিয়েছিলেন মন্ত্রনালয় এই সমস্যাটি নিয়ে স্টাডি করছে এবং স্টুডেন্ট ভিসা প্রোগ্রামটিতে আরো সংস্কারের বিষয়টি অন্বেষণ করা হচ্ছে।
সাবেক ইমিগ্রেশন মন্ত্রী মার্ক মিলার আরো বলেছিলেন তাত্বিকভাবে, এই শিক্ষার্থীরা কানাডায় আসেন আর্থিক সক্ষমতা নিয়ে যাতে তারা তাদের টিউশন ফি ও থাকা খাওয়ার খরচ চালাতে পারেন। তাদের টিউশন ফি কানাডিয়ান শিক্ষার্থীদের তুলনায় চারগুণ বেশী। আর দেখা গেছে আন্তর্জাতিক এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা রিফুউজি ক্লেইম করেন তারা তাদের প্রথম শিক্ষা বর্ষেই এই কাজটি করেন। এবং প্রায়শই এমন সব কারণ দেখিয়ে রিফুউজি ক্লেইম করেন যার তেমন কোন বৈধতা থাকে না। ক্লেইম করার অন্যতম একটা কারণ, তাদের টিউশন ফি কমিয়ে কানাডিয়ান শিক্ষার্থীদের সমমানের করা।
ইমিগ্রেশন, রিফিউজি এ্যান্ড সিটিজেনশীপ কানাডা’র একজন মুখপাত্র গ্লোবাল নিউজকে বলেন, কানাডার আইন অনুসারে কেউ এখানে রিফিউজি ক্লেইম করলে তার কেইস হিয়ারিং এর সুযোগ রয়েছে। এটি তার অধিকার। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, কেউ ক্লেইম করলেই কানাডায় থাকার গ্যারান্টি পেয়ে যাবেন।