জীবনের বহু রং
সাইদুল হোসেন
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
চলমান সমাজের কিছু খন্ডচিত্র
অকটোবর ১, ২০২৪
(এক)
god is not Great
আমরা মুসলিমরা সদাসর্বদা বলে থাকি : আল্লাহু আকবার, God is Great. এটা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
ক’দিন আগে নিকটস্থ পাবলিক লাইব্রেরীতে গিয়েছিলাম। দেখলাম প্রচুর বই ON SALE. Price one dollar each! বড়ছোট, নূতন-পুরাতন সবই এক ডলার।
চোখে পড়লো আনকোরা নূতন একটা বই, নাম god is not Great, লেখক Christopher Hitchens. মূল্য ৩২.৯৯ ডলার। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩০৭। টরন্টো থেকে ২০০৭ সনে প্রকাশিত।
Subject matter: How Religion Poisons Everything. Religion is man-made. মূল্য এক ডলার মাত্র!
পাতা উল্টিয়ে দেখলাম যে লেখক একজন self-declared Atheist (নিরীশ্বরবাদী/নাস্তিক)। বইটিতে ইহুদি, খৃষ্টান এবং ইসলাম ধর্ম নিয়ে বিস্তারিত বিরূপ সমালোচনা রয়েছে।
(দুই)
LITTLE PRAYERS
আমাদের বাসস্থান কমিউনিটি বিল্ডিংয়ের Garbage Corner থেকে একদিন কারো ফেলে দেয়া ছোটছোট বাচ্চাদের একটা prayer book তুলে আনলাম। পাতায় পাতায় attractive clour illustrations-এ ভরা, বিভিন্ন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী ছোটছোট প্রার্থনা। ইসলাম ধর্মের একটা বিখ্যাত প্রার্থনাও আছে বইটাতে। মাত্র ২৬ পৃষ্ঠা। বিষ্মিত হলাম দেখে যে ১৯৮০ সনে প্রকাশিত বইটি এই ৪৪ বছর পরও সম্পূর্ণ অক্ষত আছে, কোথাও একটা কালির আঁচড় মাত্রও নেই কোন পাতায়! বইটি পেয়ে আমি দারুণ খুশী! বারবার পড়ছি। বইটার নাম LITTLE PRAYERS. Printed in the USA. আন্তরিক ধন্যবাদ সেই পরিবারকে যারা বইটাকে এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখেছে।
(তিন)
দু’জন বাংলাদেশীর কথা
গিয়েছিলাম এক বিয়ের রিসেপশান পার্টিতে যোগ দিতে বাসা থেকে বহু দূরে টরন্টোতে একটা রেস্টুরান্টে। বরের বাবা ট্যাক্সি নিয়ে এসে সমাদর করে নিয়ে গেলেন আমরা স্বামীস্ত্রী দু’জনকে। বিরাট আয়োজন। লোকজন বহু কিন্তু নগণ্য দু’চারজন ছাড়া বাকি সবাই অপরিচিত যদিও সবাই বাংলাদেশী। স্ত্রী পরিচিত কিছু মহিলাকে পেয়ে তাদের নিয়ে গল্পে মজে গেলেন। আমি একা হলের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটুকুতে আমার Walker-এর সীটে বসে চারদিকের ছুটাছুটি, ব্যস্ততা, পানাহারের দৃশ্য দেখতে লাগলাম।
(কাহিনী এক)
এমন সময় নিমন্ত্রিতদের মাঝখান থেকে ৬০-৬৫ বছর বয়সের এক ভদ্রলোক উঠে এসে “আস্সালামু আলাইকুম” বলে আমার পাশের খালি চেয়ারটি দখল করে বসলেন। তাঁর নামটা বললেন। তারপর বললেন, “একাকী বসে আছেন দেখে একটু গল্প করতে এলাম। আপনি ক্যানাডাতে আছেন কতদিন হলো?” বললাম, ৩৪ বছর।
বললেন, “অনেকদিন হয়ে গেল! আমি এসেছি অল্পদিন হলো। এখনো বাংলাদেশের সংগে যোগাযোগ আছে। আমি একজন ডাক্তার, দেশে প্র্যাকটিস ছিলো সব ছেড়ে চলে আসতে হলো। তবে প্র্যাকটিস একেবারে ছাড়িনি। টেলিফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে দৈনিক ১৫-২০ জন পেশেন্টের সংগে কথা বলি, তাদের প্রেসক্রিপশন দিই। সবই করি বিনা মূল্যে, free of charge. এই একটু সমাজসেবা করছি বলতে পারেন”, বলে একটু হাসলেন তিনি।
তাঁর কথা শুনে আমি খুবই খুশী হলাম। অনেক অনেক ধন্যবাদ দিলাম তাঁর উদারতার জন্য।
তারপর আরো দু’চার কথা বলার পর তিনি বললেন, “আনন্দ পেলাম আপনার সংগে পরিচিত হয়ে। এবার যাই। আস্সালামু আলাইকুম”, বলে তিনি তাঁর জায়গায় ফিরে গেলেন।
(কাহিনী দুই)
বাসায় ফেরার সময় আমাদের host হলের বাইরে এসে বয়স্ক এক ভদ্রলোকের সংগে আমাদের স্বামীস্ত্রীকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, “ইনি আমার বহুদিনের ফ্রেন্ড, আপনাদের মিসিসাগা সিটিতেই নিজ বাড়িতে থাকেন। উনিই আপনাদের বাসায় পৌঁছে দেবেন।”
ভদ্রলোক তাঁর গাড়ির দরজা খুলে দিলেন, আমরা দু’জন পেছনের সীটে বসলাম। তিনি গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছেন এমনি সময়ে আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনার স্ত্রী আসেননি এই পার্টিতে?”
তিনি বললেন, “না। সে তার boyfriend-এর সংগে থাকে। সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমি একাই থাকি।”
জানতে চাইলাম, “আপনাদের সন্তানেরা?”
“আমাদের দুই ছেলে, দু’জনই ইঞ্জিনিয়ার। চাকরি করে। ওরা ওদের মত জীবন কাটাচ্ছে। ভালোই আছে ওরা”, জানালেন তিনি।
আর প্রশ্ন করাটা সমীচীন মনে হলো না। তাই সারাটা পথ চুপচাপ রইলাম। বাসায় পৌঁছে তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম।
(চার)
“I’ll call you BABA. OK, BABA?”
ক্যানাডানিবাসী বাংলাদেশী এক মুসলিম পরিবারের মেয়েটি বিয়ে করেছে এক খৃষ্টান ছেলেকে। ওর নাম Mike. ওদের দুই সন্তান- বড়টি ছেলে, বয়স ১৪ বছর; ছোটটি মেয়ে, বয়স ১২ বছর। ছোট মেয়েটির নানা এই গল্পটা আমাদের শুনালেন।
তার নাতনি তাকে ডাকে “বাবা”, নানা অথবা নানাভাই নয়। “কি কারণ?” জানতে চাইলাম আমি।
কারণটা হলো নাতনির অবুঝ জেদ। ওর একটাই যুক্তি ‘‘My mum calls him Baba, so I must call him Baba.” মা যেহেতু তাকে বাবা ডাকে আমিও তাকে বাবা ডাকবো। ওর শেষ কথা।
যতই বোঝানো হচ্ছে যে ওর বাবা হচ্ছে Mike, ওর বড় ভাই Mikeকে বাবা (Dad) ডাকে, তারও তাই ডাকতে হবে। সে সেটা বুঝতে নারাজ। সে তার নানার হাতে হাত এবং চোখে চোখ রেখে confirmation-এর প্রত্যাশায় তাকে প্রশ্ন করে, “I’ll call you Baba. OK, Baba?”
অবুঝ সন্তান। কি আর করা যায়? তাই তিনি তার আদরের নাতনির আবদারকে মূল্য দিতে গিয়ে এই BABA সম্বোধনটাই মেনে নিয়েছেন। তবুও বাচ্চাটা খুশী থাকুক, পরিবারে শান্তি বিরাজ করুক।
(পাঁচ)
Fazal Karim, Jr.
Christian HERALD.
A monthly magazine that serves the Christian community across the Southern Ontario region. Being published from Brampton, Ontario, since 1994.
ম্যাগাজিনটার জুলাই ২০২৪ সংখ্যায় দেখলাম যে এটার পাবলিশার/এডিটর-ইন-চীফ হচ্ছেন :
Fazal Karim, Jr.
ফযল করিম তো স্পষ্টতঃই একটা মুসলিম নাম কিন্তু ম্যাগাজিনটা খৃষ্টানদের!
(ছয়)
বাবা-মার প্রতি সহানুভূতিশীল সন্তান
ক্যানাডায় উচ্চশিক্ষা নিতে বাবা-মার খরচে বাংলাদেশ থেকে আগত ২৩ বছর বয়সের একটি ছেলের সংগে পরিচয় হলো একদিন। সে ওয়াটারলু ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করছে। গ্র্যাজুয়েশনের আরো তিন বছর বাকি। খুব সিরিয়াস স্টুডেন্ট বলে মনে হলো।
কথা প্রসংগে জানালো যে সে ওর বাবা-মায়ের উপর বোঝা হতে চায় না। তাঁরা খুব ধনীলোক নন।
তাই সে খুঁজেপেতে এমন একজন employerকে বের করেছে যে তাকে পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে একটা regular part time job দিয়ে আগামী বছরগুলোতে আর্থিকভাবে সাহায্য করবে। দেশে মা-বাবাকে জানিয়ে দিয়েছে যে সে না চাইলে যেন ওকে ডলার পাঠানোর জন্য তাঁরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না হন।
খুবই বিবেক-বিবেচনাসম্পন্ন সন্তান নিঃসন্দেহে।
আল্লাহ তার উপর রহমত করুন।
(সাত)
Freeloader Sons!
টরন্টো শহরনিবাসী এক বাংলাদেশী পরিবার। তাদের দুই সন্তান। দু’জনেরই বয়স ৩০ বছরের উর্ধে।
লেখাপড়া নামকাওয়াস্তে কিছু করেছে বটে কিন্তু দু’জনই বেকার। কোন কাজকর্ম করে না, কোন চেষ্টাও নেই। ঘরে বসে নির্বিকারভাবে বাবার রোজগার এবং মায়ের হাতের রান্না উপভোগ করে যাচ্ছে। বিবেক ওদের মরে গেছে।
Freeloaders
অথচ ওদের পরিবার তেমন সচ্ছল নয়। মা ঘরবাড়ি দেখাশোনা করেন। নো ইনকাম।
বাবার রিটায়ারমেন্টের বয়স হয়ে গেছে। বসত বাড়িটা যদিও নিজেদের, কিন্তু অন্যান্য খরচের বোঝাটা বেশ ভারী। রিটায়ারমেন্টে গেলে নিয়মিত মাসিক আয়টাও বন্ধ হয়ে যাবে।
কিন্তু ছেলেরা উদাসীন। কবে ওদের মনুষ্যত্ব ও বিবেকটা জেগে উঠবে?
(আট)
দুর্ভাগ্যের কবলে
আমার পরিচিত একজন এই খবরটা দিলেন।
নিতান্তই দুঃখজনক ঘটনা।
তিনি জানালেন যে তাঁরই এক বন্ধু সম্প্রতি স্ত্রীহারা হয়েছেন অতি আকষ্মিকভাবে।
সেই ভদ্রলোকের শাশুড়ির গুরুতর অসুখের খবর পেয়ে মায়ের সেবা-শুশ্রুষা করতে তার স্ত্রী তড়িঘড়ি টরন্টোর সংসার পেছনে ফেলে ঢাকায় ছুটে গেলেন। মোটেই কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয়, এমনটা তো অহরহই ঘটছে বিভিন্ন পরিবারে এদেশে।
কিন্তু বেদনাটা হলো এই জায়গায় যে ঢাকা পৌঁছার সাতদিন পর সেই মহিলা হার্টফেইল করে নিজেই মারা গেলেন তার অসুস্থ মায়ের চোখের সামনে।
ভদ্রলোক পড়লেন মহাবিপদে। তার বয়স ৬০ বছর। কোন সন্তানাদি নেই। ভাড়া করা এপার্টমেন্ট। ছোটখাটো একটা ব্যবসা করতেন। ভালোই চলছিলো। কিন্তু একাকী জীবন কাটানো এখানে অসম্ভব। তাই এখানের সবকিছু গুটিয়ে স্থায়ীভাবে ক্যানাডা ছেড়ে বাংলাদেশেই ফিরে গেছেন।
(নয়)
সাম্প্রতিক খবর।
একমাত্র সন্তান এক ছেলে। লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করছে। হঠাৎ একদিন সংগে এক মেয়েকে নিয়ে এসে বাসায় হাজির। “মা, এই মেয়েটাকে আমি বিয়ে করেছি। বাংলাদেশী মেয়ে, আমার ওয়াইফ, তোমার নূতন বৌমা”, ছেলে তার বক্তব্য শেষ করলো।
ঘটনাটার আকষ্মিকতায় মা ঘাবড়ে গেল। “বলে কি মোর পোলায়? বলা নেই, কওয়া নেই, পুত্রবধু সামনে হাজির!”
যাহোক সব সামাল দিলো মা তার নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা অনুসারে। ছেলে তার বৌকে নিয়ে নিজের বেডরুমে থাকে, খাওয়াদাওয়া করে বাইরে থেকে আনিয়ে অথবা বাইরে গিয়ে দু’জনে মিলে। মাকে কোন কষ্ট দেয় না।
মা একদিন ছেলেকে বললো, “আমাদের তো কিচেন রয়েছে। আমি ও বৌমা মিলে রান্নাটা করলে তো খরচও বাঁচে এবং তোমাদের তিনবেলা বাইরেও দৌড়াতে হয় না।”
জবাবে ছেলে বললো, “আমার ওয়াইফ রান্না করতে জানে না, রান্না করার ঝামেলাতে সে যেতেও চায় না। আমরা আমাদের মত থাকি, তুমি তোমাকে নিয়ে থাকো। এটাই উত্তম।”
ছেলের সিদ্ধান্ত শুনে মা চুপ হয়ে গেল। প্রতিবাদ করার ভাষা গেল তার হারিয়ে।
(সুদূর অতীতের মজাদার একটি কাহিনী)
ভাগ্যলিপি
“ভোজনং যত্রতত্র, শয়নং হট্টমন্দিরে”
অকটোবর ৭, ২০২৪
সুদূর অতীতে (১৯৪৭-৪৮ সাল) যখন ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া শহরে হাইস্কুলে ক্লাস নাইন অথবা টেন-এ পড়ি, তখন আমাদের বাংলার পন্ডিতমশাই এই গল্পটি ক্লাসে একদিন উপস্থিত ছাত্রদের শুনিয়েছিলেন। প্রসংগটা ছিল মানুষের ভাগ্যলিপি। গল্পটা আমার মনে এতোটাই গেঁথে গিয়েছিলো যে আজ এই ৭৭ বছর পরও তার বর্ণনাটা স্পষ্ট মনে আছে। গল্পটার ভিত্তিটা ছিলো প্রাচীন একটা সংস্কৃত শ্লোক :
“ভোজনং যত্রতত্র, শয়নং হট্টমন্দিরে,
মরণং গোমতী তীরে,
অতঃপরম্ কিম্ ভবিষ্যতিঃ”
গল্পটা ছিল এরকম।
কথিত আছে যে স্রষ্টা/ভগবান মানুষের ভাগ্য মানুষের কপালের হাড়টাতে লিখে দেন।
প্রাচীন কালে ভারতের কোন এক গ্রামে একজন হিন্দু ব্রাক্ষ্মণ পন্ডিত বাস করতেন যিনি মরা মানুষের কপালের হাড়ে লিখিত কথাগুলো পড়তে পারতেন। তিনি একদিন তাদের অঞ্চলের শ্মশানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে চিতার আগুনে পোড়া মানুষের কপালের একটা হাড় দেখতে পান। কৌতূহলী হয়ে তিনি সেই হাড়টা কুড়িয়ে নিয়ে চোখের সামনে তুলে ধরেন। এবং অতিশয় আশ্চর্যান্বিত হলেন দেখে যে সেটাতে উপরোক্ত শ্লোকটা লেখা রয়েছে যার অর্থ-
এই লোকটা এমনি হতভাগা হবে যে খাদ্যের অভাবে সে যেখানে যা পাবে তাই কুড়িয়ে খাবে; ঘরবাড়ি থাকবে না, গ্রামের হাটবাজারের দোকানের সামনের খালি জায়গাতে ঘুমিয়ে রাত কাটাবে; মৃত্যু হবে তার গোমতী নদীর তীরে [জনগণের বিশ্বাসানুসারে, গোমতী নদীর তীরে মৃত ব্যক্তি কখনো স্বর্গে যেতে পারবে না।] এর পর যে কি ঘটবে তা একমাত্র ভবিষ্যৎই বলতে পারে!
এমন দুর্ভাগার ভাগ্যে ভবিষ্যতে আরো অপমানজনক এমন আর কি ঘটবে পারে সেটা দেখার উদ্দেশ্যে সেই পোড়া হাড়টাকে ব্রাক্ষ্মণ তার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তার গোয়ালঘরের খড়ের চালের ভেতর এক জায়গায় গুঁজে রাখলেন। এবং প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে সেটাকে বের করে দেখতে লাগলেন সেই লেখাটার কোন পরিবর্তন হয়েছে কি না। ব্যাপারটা ব্রাক্ষ্মণীর অজানা রইলো না।
এদিকে হয়েছে কি, তার স্ত্রী ব্রাক্ষ্মণের এই চালচলনে সন্দিহান্বিতা হয়ে ব্রাক্ষ্মণের অনুপস্থিতিতে একদিন সেই হাড়টা খুঁজে বের করে ভাবতে লাগলো :
ও, এই কথা! বাম্ণে জাদুর আশ্রয় নিয়েছে আমার মৃত্যুর জন্য যাতে সে নূতন একটা স্ত্রী ঘরে আনতে পারে? আমার আকর্ষণ ফুরিয়েছে? দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা।
যেই ভাবা, সেই কাজ! হাতের ঝাড়ুটা দিয়ে সেই হাড়টাকে সে বেদম পিটাতে লাগলো এবং তৎসংগে সেটা পায়ের তলায় ফেলে মাড়াতে মাড়াতে ভেংগে টুকরা টুকরা করে ফেলতে লাগলো।
ঠিক এমনিক্ষণে ব্রাক্ষ্মণ তার বাড়িতে ফিরে এলেন এবং দেখলেন যে তার স্ত্রী পাগলের মত বকবক করছেন এবং কিছু একটাকে পদদলিত ও ঝাড়ুপেটা করছেন।
অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি ব্রাক্ষ্মণীকে দু’হাত দিয়ে জাপটে ধরলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, “পাগলের মত এসব কি করছ?”
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ব্রাক্ষ্মণী বললেন, “আমাকে জাদু করে মেরে তোমার নূতন বাম্ণী ঘরে আনার রাস্তাটা বন্ধ করছি। আমি এতোই অস্পৃশ্য হয়ে গেছি তোমার কাছে যে তুমি আমার মৃত্যুর জন্য মড়ার হাড় দিয়ে জাদু পর্যন্ত করতে পারলে? এই আমার কপালে ছিল? হায় ভগবান!”
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ব্রাক্ষ্মণ তার স্ত্রীকে বললেন, “শান্ত হও। জাদু, নূতন বাম্ণী, তোমাকে ঘৃণা- না, ওসব কিছুই না। সব তোমার কল্পনা। তুমি তোমার জায়গাতেই আছ। আমার কথা শুনো”।
তারপর তিনি সেই কপালের হাড়ের উপরে লিখনের ইতিহাসটা সবিস্তারে বর্ণনা করলেন এবং বললেন যে “অতঃপরম্ কিম্ ভবিষ্যতিঃ” কথাটার বাস্তব রূপটা দেখলাম। বুঝলাম যে অতঃপর লোকটার কপালে লেখা ছিল ঝাড়ুপেটা এবং পদদলিত হওয়া। এরই নাম ভাগ্যলিপি।
চলমান সমাজের কিছু খন্ডচিত্র
(দ্বিতীয় পর্ব)
(এক)
বাংগাল্কা কালা জাদু
অকটোবর ১৫, ২০২৪
জীবিকার সন্ধানে মানুষ কত না পন্থা অবলম্বণ করে থাকে!
সেগুলোর মাঝে নদীতে জাল ফেলে/পেতে মাছ ধরাটা হচ্ছে একটা অতি পরিচিত দৃশ্য আবহমান কাল ধরে পৃথিবীর সর্ব দেশে। কিন্তু গতকাল YouTube-এ কয়েকটা Video দেখে আমার জ্ঞানের পরিধিটার একটু বিস্তৃতি ঘটলো।
দেশটা হলো বাংলাদেশ।
স্থান রাজধানী ঢাকার বুড়িগংগা নদী।
দেখলাম, কিছু লোক তাদের নৌকায় দাঁড়িয়ে নদীতে জাল ফেলার পরিবর্তে দীর্ঘ মোটা একটা দড়িতে বেঁধে দু’পাউন্ড ওজনের একটা চুম্বকখন্ড (magnet) নদীর তলা পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে এবং তারপর তাদের নৌকাটাকে বেয়ে বেয়ে সেই দড়িতে বাঁধা চুম্বকখন্ডটাকে নদীর তলদেশের নরম কাদার উপর দিয়ে বেশ কিছু দূর টেনে নিয়ে এক জায়গায় থেমে দড়িটাকে টেনে টেনে সেই চুম্বকখন্ডটাকে নৌকায় উঠাচ্ছে। কি লাভ হলো তাতে?
সেটাই এক মজার দৃশ্য।
দেখলাম, সেই চুম্বকখন্ডটাতে আটকে আছে লোহাজাতীয় কিছু দ্রব্য যার মধ্যে আছে নগদ টাকা ও পয়সা (coins) এবং চাবিসহ অথবা চাবিছাড়া ছোটছোট সব তালা (locks).
সেই নৌকাগুলোতে উপস্থিত Videographerদের “এমন করে চুম্বক টেনে আপনাদের কি লাভ হয়?” প্রশ্নটার জবাবে চুম্বকখন্ডের
মালিকেরা জানালো যে এটা একটা লাভজনক ব্যবসা। এমনটা করে তারা প্রতিদিন চুম্বকখন্ডে আটকে থাকা-
১) প্রচুর নগদ টাকা-পয়সা উদ্ধার করে যদ্বারা তাদের সংসার খরচ মিটানোর পরও কিছু পরিমাণ নগদ অর্থ তাদের হাতে জমা হয়;
২) উদ্ধারকৃত লৌহখন্ড এবং তালাচাবিগুলো বাজারে ওজন দরে বিক্রি করেও কিছু টাকা আয় করা যায়।
মূলধন হলো চুম্বকের টুকরাটা কেনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ। একজন মাঝি জানালো যে ওর চুম্বকখন্ডটা কিনতে সে চার হাজার টাকা খরচ
করেছে।
এবার শুনুন অন্য ধরনের বিষ্ময়কর একটা খবর। “এতো কাঁচা টাকা ও পয়সা এবং লোহার তালাচাবি নদীতে আসে কোথা থেকে এবং কেমন করে?”, একজন Videographer-এর প্রশ্ন।
নৌকার মাঝিদের উত্তর :
“এসব হচ্ছে জাদুর খেলা। বহু লোক (নারী ও পুরুষ) দেশের শহরে ও গ্রামে নানা কারণে তাদের শত্রুদের ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে অথবা প্রিয়জনের নেকনজরে পড়ার উদ্দেশ্যে স্থানীয় জাদুগরদের বাড়ি গিয়ে ওদের উপর জাদু করায়। জাদুর বাহন হচ্ছে কাঁচা টাকা ও পয়সা ও লোহার তালাচাবি। জাদুর মন্ত্র পাঠ করে জাদুগরেরা সেই সবে ফুঁ দিয়ে সেগুলোকে মন্ত্রপূতঃ করে। তারপর লোকজনদের নির্দেশ দেয় সেসবকে নিকটস্থ নদীতে ফেলে দিতে যাতে তাদের জাদুর প্রভাবটা উল্লিখিত ব্যক্তিদের উপর কার্যকর হয়। লোকেরা বিশ্বাস করে তাই করে। প্রতিদিনই এমনটা ঘটছে। জাদুর প্রভাবের উপর মানুষের প্রবল আস্থা/বিশ্বাস আমাদের দেশে। তাই নানা ধরনের গুনিনরা (জাদুগরেরা) প্রচুর অর্থ অর্জন করছে এই ব্যবসা করে।”
ইতিপূর্বে আমার ধারণা ছিল যে জাদুবিদ্যা (Black magic) অতীতের কিস্সা- কাহিনীর ব্যাপার, বর্তমান যুগে সেসব অচল। কিন্তু সদ্য দেখা ও শোনা বাংলাদেশী Videoগুলোর বক্তব্য অনুসারে দেখা যাচ্ছে যে আমার ধারণাটা সত্য নয়, ভুল।
এখানে এসে অতীতের কিছু অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ছে।
বহুযুগ আগের পাকিস্তানী আমলের কথা যখন বহু পশ্চিম পাকিস্তানী উর্দুওয়ালা ইস্ট পাকিস্তানে নানা কারণে বসবাস করতো। আমার বহু সহকর্মীও ছিল উর্দুওয়ালা। ওরা দৃঢ় বিশ্বাসের সংগে আমাকে বলতো “তোমাদের বাংগাল মুল্লুকে Black magic (কালা জাদু) শতশত বছর ধরে চলে আসছে সেকথা আমরা জানি। বড়ি খতরনাক চীজ হ্যায় ইয়ে কালা জাদু। হুশিয়ার রেহ্না হ্যায় হামলোগোঁকো (কালা জাদু অতি ভয়ংকর ব্যাপার, আমাদের সতর্ক থাকতে হয়।)”
আরো মনে পড়ছে যে নানা সূত্রে সাক্ষাৎপ্রাপ্ত কিছু ইন্ডিয়ানদের মুখেও “বাংগালমে কালা জাদু হ্যায়” কথাটা আমি শুনেছি অতীতে। (চলবে)
সাইদুল হোসেন
মিসিসাগা