শুচিতা

নজরুল ইসলাম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

(কানাডার দৈনন্দিন বাস্তবতার দিকে লক্ষ্য রেখে কাল্পনিক এই উপন্যাস ‘শুচিতা’। লিখেছেন কানাডা প্রবাসী নজরুল ইসলাম। )

বিকেলে প্রতিবেশী অধরা ও তার স্বামী সুশীল রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু খাবার নিয়ে এসে দরজা নক করতেই সুলতা গিয়ে দরজা খুলে বলে, আদাব, আপনারা কেমন আছেন?

ভালো। তোমার বাবা-মা কি আছেন?

সুশীল বলে, আদাব। দিদি, আমরা কাজ থেকে এসেছি, বেশিক্ষণ বসব না। আরতি বলে, বসেন, কী বলেন বসবেন না?

কমল ভেতর থেকে এসে বলে, আপনাদের কথাই ভাবছিলাম। এই দেখেন আপনারা এসে গেলেন। সুশীল বলে, আপনি স্মরণ করলে না এসে কি পারি?

আমি আজ কয়েক দিন থেকে ভাবছিলাম একটু এসে দেখে যাই।

আপনাদের ব্যবসা কেমন চলছে?

কোনো রকম চালিয়ে যাচ্ছি।

সুমিত কেমন আছে?

আর বলবেন না, ও কয়েক দিন হলো আর একবার ছোটখাটো একটা স্ট্রোক করেছে। ওকে ভালোভাবে দেখান কী জন্য ওর এ অবস্থা হচ্ছে?

সবই ভগবানের লীলাখেলা, কী বলব ভাই।

সুমিত ভেতর থেকে আস্তে আস্তে এসে প্রণাম জানিয়ে পাশে সোফায় বসেছে। সুশীল বলে, ডাক্তার তোমাকে কী বলে?

আংকেল, আমার অনেক ধরনের সমস্যা। আমি সম্পূর্ণ অসুস্থ হয়ে পড়েছি।

অধরা বলে, শুচিতা কী আর এল না?

আরতি বলে, আর ওর কথা বলবেন না।

দেখেন আমার ছেলেটা কী রকম অসুস্থ?

হ্যাঁ, তাই তো দেখছি। অন্তত বাচ্চা নিয়ে কাছে থাকলে মন একটু ভালো থাকত। সুলতা বলে, আমি গতকাল দেখতে গিয়েছিলাম, কী সুন্দর চটপটে এবং বুদ্ধিমান ছেলে। ওর সঙ্গে দুই ঘণ্টা থেকে আমার প্রাণ জুড়িয়ে গেছে। সারাক্ষণ বলে, এটা খাও, ওটা খাও। না খেলে মুখে উঠিয়ে দিয়ে বলে, খাও। আমাকে কত আদর করল। শেষে আমাকে গাড়ি করে দিয়ে গেল। কমল বলে, আমাদের দুর্দিন, সুমিত অসুস্থ থাকে। তা ছাড়া শুচিতার সঙ্গে আমাদের বনিবনা হচ্ছে না। সুমিতের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছে সে এ অবস্থায় সুখী না। তা ছাড়া সে অনেক অসুস্থ। সুমিত আস্তে করে বেডরুমের দিকে চলে গেল।

অধরা বলে, শুনেছি শুচিতার সঙ্গে প্রদীপের ভাব রয়েছে, ওটা কী ঠিক?

আরতি বলে, ওই ছেলের সঙ্গে ওর আগে থেকেই সম্পর্ক ছিল। মাঝখান দিয়ে এখানে আমার ছেলেকে সরল পেয়ে জড়িয়ে অশান্তির সৃষ্টি করেছে।

সুশীল বলে, চলো, অধরা। আমাদের একটু তাড়া আছে। আচ্ছা দাদা, আমরা যাই, পরে দেখা হবে।

সুশীল গাড়িতে এসে বলে, ওদের মাথা ঠিক নেই। সুমিত যেভাবে অসুস্থ রয়েছে, শুচিতার সঙ্গে ওদের মিলেমিশে চলাই শ্রেয়। তা না করে ওরা কেবল দোষ খুঁজে বের করছে।

অধরা বলে, সুশীল, তুমি তো ওদের দুকথা বুঝিয়ে বলতে পারতে। কে গায়ে পরে কাকে পরামর্শ দিয়ে ঝামেলা করে। আরতি হয়তো তখন আমাদের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি করবে। কিছু না বলে আমরা বরং নিরপেক্ষ থাকি, সেই ভালো।

আমাদের কাজ হলো লোকজনের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা এবং সময় পার করা। এখানে লোকজনের সঙ্গে মিলেমিশে চলা এত সহজ না। এসব লোক যারা দেশ থেকে এসেছে, তাদের কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ ডাক্তার, কেউ অন্য পেশার লোক এবং সবাই দিনরাত কষ্ট করে পড়াশোনা এবং পাশাপাশি কাজ করে জীবন নির্বাহ করে। এই যে বড় বড় বাড়িঘর দেখো, এগুলো অনেক পরিশ্রমের বিনিময়ে করা। এ দেশে অকর্মণ্য লোকের কোনো স্থান নেই। কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ নমঃশূদ্র, কেউ ধোপা, মুচি, নাপিত এসব নিয়ে আমাদের দেশে অকর্মণ্য লোকজন বাড়াবাড়ি করে।

এ দেশে এসব নিয়ে কথা বলার সময় কোথায়? এসব নিয়ে যারা দিনরাত চিন্তা করে, তাদের এ দেশে থাকার প্রয়োজন নেই। যেমন ধরো আমি দেশে কলেজে প্রফেসরি করতাম, এখানে আমি কী কাজ করব। আমি ব্যবসা করে একজন প্রফেসরের চেয়ে অনেক ভালো আছি।

সুমিতের অবস্থা কী তুমি দেখেছ?

অধরা বলে, ও অনেক শুকিয়ে গেছে। দেখলে মনে হয় বেশি দিন বাঁচবে না।

বাঁচলেও অনেক দিন লাগবে তাকে ঠিক হয়ে দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজ করতে। কমলের মেয়ে এবং ছোট ছেলে যদি ইমিগ্রেশন কাগজ হয়, পড়াশোনা শেষ করে কাজ করলে সংসারের অবস্থা ভালো হবে, সেও ভবিষ্যতের ব্যাপার। ওদের এখনই রোজগারি মানুষের দরকার, সুমিতের স্ত্রী শুচিতা কাজ করে, তাও বনিবনা নেই।

সুশীল এবং অধরা তাদের শুভ ম্যারেজ ডে উপলক্ষে কয়েকটি পরিবারকে একত্র করে খাবারদাবারের ব্যবস্থা করেছে। এ উপলক্ষে কমল ও তার পরিবারকেও নিমন্ত্রণ করেছে। সুমিত স্বাস্থ্যগত কারণে আসতে পারেনি। তবে পরিবারের বাকি সবাই এসেছে। মহিলারা একত্রে নানা গল্প, যেমন কে কী শাড়ি পরেছে, কে কী গয়না পরেছে- এ নিয়ে গল্প। কেউ বলে, বউদি, আপনার এই গয়না তো খুবই সুন্দর! আর বলবেন না, এই গয়না আমার স্বামী আমার ম্যারেজ ডেতে দিয়েছে। কেউ বলে, আমার এই শাড়ি এবং গলার সোনার চেইন সেবারে দিল্লি গিয়েছিলাম, সেখান থেকে কিনেছি। বাহ্ খুব সুন্দর তো এবং খুব মানিয়েছে! আর একজন বলে, আমরা সেবার বোম্বে বেড়াতে গিয়ে মেয়ের বিয়ের গয়না শাড়ি ও আনুষঙ্গিক জিনিস এনেছি। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার মেয়ে পছন্দ করেছে আমরা কী বিয়েতে অমত করতে পারি?

আর একজন বলে, আরে না বউদি, আজকাল ছেলেমেয়েরা পছন্দ করে বিয়ে করে, মা-বাবাকে ও ব্যাপারে চিন্তা করতে হয় না। আমাদের দেশগুলোতে ও আজকাল ওয়েস্টার্ন কালচার ঢুকেছে। কার আগে কে মন্তব্য করবে, এ নিয়ে যেন প্রতিযোগিতা হচ্ছে।

এক মহিলা আরতিকে বলে, আপনার ছেলের বউকে সেদিন শপিং মলে দেখেছি আপনার নাতিকে নিয়ে কী যেন কেনাকাটা করছে। সুমিতকে দেখলাম না, অন্য একটা কাউকে যেন ওর সঙ্গে দেখলাম। আর একজন বলে হয়তো ওদের কোনো আত্মীয়কে নিয়ে গিয়েছে।

অধরা বলে, ছেলেটা দেখতে কেমন?

ফর্সা লম্বামতো বয়স ৩৫-৩৬ হতে পারে। আরতি বলে, এই ছেলে ওদের আত্মীয়, দেশ থেকে ইমিগ্রেশন নিয়ে এসে ঝামেলা লাগিয়েছে। আরতি বলে, আর বলবেন না, সবই আমার কপাল। সুলতা বলে, মা, তুমি চুপ করো। কমল চোখ রাঙিয়ে বলে, চুপ করো। কিন্তু আরতির দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, সে শাড়ির অচল দিয়ে চোখ মুছে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।

রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আসতে একটু দেরি হয়েছে। কমলের মতো আরও কয়েকজন নিরামিষভোজী, সবজি ছিল তাই দিয়ে খেয়ে নিয়েছে। আরতি, সুলতা মাছ-মাংস সবই খেলো। সুলতা বলে, আমরা আংকেলের দোকানের সব খাবারই পছন্দ করি।

বাসায় ছেলেমেয়েদের হইচই, মহিলাদের শাড়ি আর গয়নার গল্প, পুরুষদের পলিটিকস, এ যেন এক অপূর্ব দৃশ্য, কে কার চেয়ে বেশি কথা বলবে, এ নিয়ে প্রতিযোগিতা। মহিলা ও ছেলেমেয়েদের এক দিক এবং পুরুষদের অন্য দিকে গল্পের আড্ডা। খাওয়ার পর মিষ্টান্ন এবং পরিশেষে পান ও পানীয়র ব্যবস্থা, সবাই খেয়ে রাত ১২টার পর যার যার ঘরে ফিরছে। অধরার স্বামী সুশীল ওদের ড্রাইভ দিয়ে বাসায় নামিয়ে দিতে গিয়ে বলে, দাদা, আপনারা আসাতে অনেক ভালো লাগল।

ঘরে এসে আরতি মুখ খুলছে এবং বলে, শুনলে শুচিতা সম্পর্কে কিছু?

সুমিত বেডরুম থেকে এসে বলল, কী শুনলে?

আরতি বলে, ওখানে কিছু কিছু লোক এসেছে যারা শুচিতাকে প্রদীপের সঙ্গে বাইরে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছে। সুলতা বলে, মা, এটা তুমি বাড়িয়ে বলছ। কেউ বলেনি যে শুচিতা প্রদীপের সঙ্গে বাইরে ঘোরাঘুরি করে। প্রদীপ ওদের আত্মীয়, তা ছাড়া ওরা কি প্রদীপকে চেনে?

তুই আমার সঙ্গে তর্ক করিস না, সবাই প্রদীপকে চেনে এবং এ সম্পর্কে সবকিছু জানে। সুলতা বলে, ধ্রুবকে নিয়ে শুচিতা বাজারে গেছে, হয়তো কারও সঙ্গে দেখা হয়েছে। এটাকে এত বড় করে দেখার কী আছে?

সুমিত বলে, তুই এসব বুঝবি না, মা যা বলছে, তাই ঠিক। শুচিতার চলাফেরা ঠিক না, সে আমাদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে চায় না। আমি এত অসুস্থ, সে একবার ধ্রুবকে নিয়ে এসে দেখা করে যাওয়া মনে করে না। দাদা, শুচিতা কাজ করে বাসায় গিয়ে ধ্রুবকে সামলায়। তা ছাড়া নিজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত।

সে কিসের পড়াশোনা করে?

শুচিতা কাজের পর ইভিনিং পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্স করে অটোয়া ইউনিভার্সিটি থেকে।

তুই শুচিতার পক্ষে দালালি করিস। ঠিক আছে দাদা, আমি এ নিয়ে তোমাদের সঙ্গে কোনো রকম কথা বলব না। তোমাদের যা ভালো মনে হয় তাই করো?

আমি আর কী করব, আমি অসুস্থ, আমার কী করার ক্ষমতা আছে। আমার অ্যাকসিডেন্টের পর একবার ব্রেন অপারেশন, একবার ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে। আমি আমার নিজের অবস্থা বুঝি, তোরা আমার কী বুঝবি?

দাদা, আমরা জানি তুমি অনেক অসুস্থ, তুমি আমাদের এ দেশে এনেছ, এটা অনেক ভালো কাজ করেছ, আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। সুমিত বলে, এটা আমার দায়িত্ব। মা-বাবা, ভাইবোনকে সবাই ভালো অবস্থায় দেখতে চায়। আমি কী পুরা দায়িত্ব পালন করতে পারলাম?

দাদা, তুমি অসুস্থ হয়ে পড়েছ, এর বেশি কী করবে?

তোমার এই দুর্দিনে আমরা তোমার পাশে রয়েছি এবং সব সময় দেখাশোনা করি। আশীর্বাদ করি, যাতে তুমি ভালো হও।

পরদিন সকালে সুমিত আজিজকে টেলিফোন করে বলে, তুমি কেমন আছ?

আজিজ টেলিফোন উঠিয়ে বলে, সুমিত, আমি অফিসে কাজে ব্যস্ত। জরুরি কিছু না থাকলে আমি বিকেলে কাজের পর তোমাকে টেলিফোন করব। সুমিত বলে, ঠিক আছে।

দুপুরে লাঞ্চ টাইমে আজিজ শুচিতাকে বলে, সুমিত টেলিফোন করেছিল এবং জানি না কী বলতে চায়। আমি বলেছি, বিকেলে কল দেব। তাই সে টেলিফোন রেখে দিয়েছে।

শুচিতা বলে, এখন কথা বলে দেখতে পারো সে কী বলতে চায়। মনিকা বলে, যাও ৫ মিনিট টেলিফোন করে শুনে নাও সুমিত কী বলতে চায়। আজিজ টেলিফোন করে এসে বলে, সুমিত বলে, শুচিতা কেমন আছে?

আমি বলেছি, ভালো আছে, শুচিতা তুমি কী ওর সঙ্গে কথা বলতে চাও?

না, এখন কথা বলব না এই বলে টেলিফোন রেখে দিয়েছে।

মনিকা বলে, শুচিতা, তোমার ও সুমিতের সঙ্গে মান-অভিমান চলছে, এই বলে হাসে। শুচিতা বলে, এতে মান-অভিমানের কী আছে। আমি টেলিফোন করলে ও টেলিফোন রেখে দেয়, এদিকে তোমাদের টেলিফোন করে খোঁজ নেয়, বোঝাতে চায় যে আমি টেলিফোন করি না।

আজিজ বলে, ও অনেক অসুস্থ, সারা দিন বাসায় বসে কী করবে। কথা বলার কোনো লোক পায় না। তুমি বরং ধ্রুবকে নিয়ে বাসায় গিয়ে ওঠো এবং দেখো সে বা তার লোকজন কী বলে। না, আমি ওখানে গেলে অযথা ঝগড়া হয়। মনিকা বলে, আজকাল তো সুমিতের ভাইবোন সবাই বড় হয়েছে এবং ওরা ন্যায়-অন্যায় বুঝবে।

পর্ব: ৮

ললিতকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল থেকে যে আশ্রমে পাঠানো হয়েছে, সেখানে আরও অনেকেই রয়েছে এবং সবাই মানসিক রোগী। রোগের তারতম্য অনুযায়ী কারও অবস্থা ভালো এবং কারও অবস্থা খারাপ। ললিতের মতো অনেকেই বেড পরিষ্কার করে না, বিছানার চাদর পাল্টায় না, বেডে ছারপোকা, ঘরে তেলাপোকা এবং ইঁদুর, দুই সপ্তাহেও একবার গোসল করে না, গা থেকে দুর্গন্ধ, বাইরে থেকে ময়লা এটা-সেটা কুড়িয়ে নিয়ে আসে। পাশের বেডে শন নামে এক রোগী যার অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভালো, ললিতের সঙ্গে প্রতিদিন পয়-পরিষ্কার নিয়ে ঝগড়া হয়। ললিত রাতে ঘন ঘন লাইট জ্বালায়, হাঁটাহাঁটি করে। শন ঘুমাতে পারে না। এ নিয়ে প্রতিদিন শন অফিসে অভিযোগ করে আর কথা-কাটাকাটি তো হয়ই। শন বলে, তুমি এই রুমে থাকলে আমি থাকব না। ললিত বলে, তোমার ভালো না লাগলে অন্যত্র চলে যাও। ললিত অসুস্থতার জন্য কিছুই বোঝে না এবং শন যা কিছু বলে, সে কেয়ার করে না, ললিতের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। একদিন দুজন কথা-কাটাকাটি করতে গিয়ে একপর্যায়ে হাতাহাতি ও হইচই শুরু করে। এ নিয়ে শন পুলিশ কল দিলে, পুলিশ এসে ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে আলাপ করে ওকে অন্য রুমে সরিয়ে দিতে চাইলে, কেউ নিতে রাজি হয় না। মোট ১০ জন এই আশ্রমে থাকে এবং সবাই বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে হাসপাতাল থেকে এখানে এসেছে।

কেউ সাদা, কেউ আফ্রিকান, কেউ ভারতীয় এই ১০ জন বিভিন্ন রংবেরঙের লোককে একসঙ্গে হাসপাতাল থেকে আশ্রমে পাঠানো হয়েছে। তাদের খাওয়ার ধরন ভিন্ন। যেমন কেউ হাতে, কেউ চামচ বা কাঁটাচামচ ব্যবহার করে। ভাষা এবং আচার-আচরণও সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের নিয়মিত ওষুধ দেওয়া হয়। কিন্তু ললিতের মতো অনেকেই নিয়মিত ওষুধ না নিয়ে ফাঁকি দিয়ে বলে ওষুধ খেয়েছি।

ললিত দিনে ঘরে থাকে না, একবার হাঁটতে গিয়ে পড়ে গিয়েছে এবং আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে তার চিকিৎসার পর দুই মাস প্রিয়ব্রতের বাসায় পাঠায়। প্রিয়ব্রত ও অদিতির অনুপস্থিতে ওকে দেখাশোনার জন্য বাসায় নার্স পাঠানো হয়। নার্স তাকে গোসল, খাওয়া, ওষুধ এবং নিয়মিত ব্যায়াম করানো থেকে দুই মাসের মধ্যে কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠে। সুস্থ হলে তাকে পুনরায় আশ্রমে পাঠায়।

ললিত ডাইনিং টেবিল থেকে খাবার নিজের বেডে এনে রেখেছে এবং শন তাকে বাধা দিয়ে বলে, তুমি বেডরুম পুরা গার্বেজ দিয়ে ভর্তি করে ফেলেছ। সে মানসিক রোগী, পয়-পরিষ্কার বলতে কিছুই বোঝে না। ম্যানেজমেন্টের লোক এসে বলে, তুমি ডাইনিং টেবিলে খাবে এবং বেডরুম সকাল-বিকেল পরিষ্কার করবে। ললিত দিনের পর দিন অসুস্থ থাকে। ললিত বুঝতে পারে না তার কৃতকর্মে অন্যেরা অস্বস্তিবোধ করে। সে পাল্টা তর্ক করে বলে, আমি কী করি?

শন বলে, তুমি যেভাবে রুম নোংরা করে রাখো, এখানে আমরা থাকতে পারব না। কেউ ঘুমাতে পারে না স্বস্তিভাবে। ওরা ৯ জন দরখাস্ত দিয়ে বলে, ললিতকে এখান থেকে বিদায় করতে হবে, নতুবা আমরা এখানে কেউ থাকব না। ম্যানেজমেন্ট অফিসের লোক বলে, আমরা দেখেশুনে ওকে অন্যত্র পাঠাব এবং তোমরা সে পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করো।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ললিত কোথায় গিয়েছে কেউ বলতে পারে না। সকালে নাশতা, দুপুরে লাঞ্চ এবং রাতের খাবার ডাইনিং টেবিলে পড়ে রয়েছে। ম্যানেজমেন্ট অফিস থেকে প্রিয়ব্রতকে টেলিফোন করে জানানো হয়েছে যে ললিতকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

নিমি, প্রিয়ব্রত ও অদিতি অস্থির হয়ে সারা শহরে আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ করে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এই ঠান্ডার দেশে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অবশেষে দুদিন পর ওকে এক পার্কে নোংরা কাপড় পরা অবস্থায় ঘোরাঘুরি করতে দেখে পুলিশ হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে। ডাক্তার ভালোভাবে টেস্ট করে দুদিন রেখে আশ্রমে পাঠিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো ও অন্যদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারে না। তা ছাড়া অপরিষ্কার থাকে এবং বাইরে যা কিছু দেখে তা-ই বাসায় নিয়ে আসে। সে রাতে ঘুমায় না, বেড থেকে উঠে এ রুম-সে রুম ঘোরাঘুরি করে। ডাক্তার বলে যে এটা তার ব্রেইনের সমস্যার জন্য হয়েছে এবং তাকে হাই পাওয়ারফুল ওষুধ দিয়ে ঘুমিয়ে রাখা হচ্ছে।

নিমি ও প্রিয়ব্রত ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করে বলে, বাবাকে এ অবস্থায় ঘরে ফিরিয়ে আনা কোনোক্রমেই সম্ভব না। নিজেরা কাজ করে, ওকে কে ২৪ ঘণ্টা দেখাশোনা করবে?

অদিতি বলে, বাবা ওখানেই ভালো থাকবে এবং ডাক্তারের কেয়ারে থাকলে ওরা প্রয়োজনে হাসপাতালে আনা-নেওয়া করতে পারবে। আমরা এ অবস্থায় বাবাকে ঘরে রেখে ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করাতে পারব না।

প্রিয়ব্রত বলে, বাবাকে আশ্রমে রাখাও সমস্যা, পয়-পরিষ্কার থাকে না, বাইরে থেকে নোংরা আবর্জনা নিয়ে আসে। এ নিয়ে অন্যান্য রোগীর সঙ্গে প্রতিনিয়ত ঝগড়া হচ্ছে।

অদিতি বলে, বাবাকে কোথায় রাখবে?

আশ্রমেই রাখতে হবে, এ ছাড়া কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছি না। তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যেন আবার বের হয়ে না যায়।

নিমি বলে, বাবাকে নিয়ে এই অশান্তি কত দিন সহ্য করতে পারব?

অদিতি বলে, বাবাকে একসময় দেশে পাঠিয়ে দিতে হবে। ওখানে ভালো ট্রিটমেন্ট আছে এবং দেশের বাড়িতে লোকজন আছে, যারা সর্বক্ষণ দেখাশোনা করতে পারবে। মাসে মাসে কিছু ডলার পাঠিয়ে দিলে সবাই দেখাশোনা করবে।

কী বলো বউদি, দেশে বাবার কে আছে?

মা মারা গেছেন, ভাইবোন আমরা এখানে থাকি, কে দায়িত্ব নিয়ে বাবাকে দেখাশোনা করবে?

বাবা আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছেন, আমরা নিষ্ঠুর হতে পারি না।

প্রতিদিন এখানে একটা না একটা কিছু হচ্ছে। কত দিন এভাবে পেছনে পেছনে কে দৌড়াবে?

বউদি, আমি দাদার সঙ্গে আলাপ করব।

অদিতি বলে, আমি তোমার দাদাকে বলেছি, সেও এ ব্যাপারে চিন্তা করছে।

নিমি সারা রাত ঘুমাতে পারছে না। পরদিন কাজে গিয়ে তার সহকর্মী নাহিদকে বলে, শুনছ অদিতি বাবা সম্পর্কে কী বলে?

নাহিদ বলে, কী বলে?

অদিতি বলে, বাবা রোজ রোজ আশ্রম থেকে বের হয়ে যায়, এখানে-সেখানে রাস্তা থেকে পুলিশ ধরে ফেরত আনে। এতে আমাদের ইজ্জতের হানি হচ্ছে। বাবাকে ইন্ডিয়া পাঠিয়ে দিতে বলে। নাহিদ বলে, দেশে তোমাদের কে আছে দেখাশোনা করার জন্য?

মা মারা গেছেন, আমরা ভাইবোন এখানে থাকি। তোমার বাবা সারা জীবন তোমাদের জন্য কষ্ট করেছেন। শেষ বয়সে অসুস্থ অবস্থায় দেশে পাঠানোর পরামর্শ দিচ্ছে?

অদিতি এসব আমাকে এবং দাদাকেও বলতেছে।

তোমার দাদা কথা না শুনলে বাসায় অশান্তি হবে। তার অবস্থা এক দিকে অসুস্থ বাবা, আর একদিকে স্ত্রী, দুই দিক সামলানো অনেক কষ্টকর। তাই তো দেখছি।

নাহিদ বলে, তোমার বিয়ের কী হলো?

মানস কিছু সময় নিচ্ছে এবং ওর হাতে দেশে যাওয়ার মতো ডলার নেই। দুজনের যাওয়া-আসার খরচ এবং বিয়ের খরচ আছে, যে জন্য দেরি করতেছে।

ও কী তোমার বাবার অবস্থা জানে?

হ্যাঁ, জানে।

ও বলে, ওটা বাবার অসুস্থতা এবং আমাদের বিয়ে হলে বাবাকে আমাদের সঙ্গে রাখবে। তুমি ওকে বুঝিয়ে বলে ছোট করে এখানে বিয়ে করে নাও এবং পরে দুজনে দেশে গিয়ে অনুষ্ঠান করো। ঠিক আছে, দেখি ওকে বলে।

পরের সাপ্তাহিক ছুটিতে মানস ও নিমি বাইরে ঘুরতে গিয়ে সারা দিন কাটায় এবং এরই একপর্যায়ে নিমি মানসকে বলে, আমরা ছোটখাটো করে বিয়ের পর্ব এখানে সেরে নিতে পারি কি না?

মানস বলে, কীভাবে করতে চাও বুঝিয়ে বলো। নিমি বলে, আমরা দুইপক্ষের কয়েকজনকে নিয়ে ছোটখাটো করে বিয়ে পর্ব সেরে নেব। পরে একসময় টাকাপয়সা হলে দেশে গিয়ে বড় করে অনুষ্ঠান করব।

মানস বলে, এটা এভাবে সম্ভব না, আমার লোকজন ইন্ডিয়ায় আছে; ওরা আমার মা-বাবা এবং আপনজন। ওদের বাদ দিয়ে নিজে নিজে বিয়ে করতে গেলে আমার মা-বাবা অনেক দুঃখ পাবে। নিমি বলে, আমার নিজের লোকজনও তো এখানে আছে, তুমি এবং আমি কী সবাইকে একত্র করিয়ে অনুষ্ঠান করতে পারি?

মানস বলে, দেখো আমার কাছে টাকাপয়সা নেই যে এই মুহূর্তে দেশে গিয়ে বিয়ে করতে পারি। তাহলে এভাবে কত দিন ঝুলে থাকব?

মানস হেসে বলে, এই ধরো পাঁচ বছর। নিমি বলে, আমি সিরিয়াসলি কথা বলছি, তুমি এটা হালকাভাবে কেন নিচ্ছ?

পকেটে ডলার না থাকলে কী করব?

তোমার পকেটে কখনো ডলার জমবে না, আর তাহলে বিয়েও হবে না, এটাই কী তুমি বোঝাতে চাচ্ছ?

না, তা হবে কেন?

দেখো আমার বাড়িতে অনেক সমস্যা, অভাবী সংসার, বাবা জমি বিক্রি করে এবং লোকজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে আমাকে পাঠিয়েছেন। পাওনাদার লোন পরিশোধ করার জন্য তাগাদা দিচ্ছে। আমি এই মুহূর্তে একটু ঝামেলায় আছি। দেশে গেলে পাওনাদারের মুখামুখি হতে হবে, সে জন্য আমি দেশে যাওয়া দেরি করতেছি।

আচ্ছা এখন যাও, দেখি চিন্তা করে কীভাবে কী করা যায়। নিমি চোখের পানি ফেলে বলে, তুমি গত তিন বছর আমাকে ঘোরাচ্ছ আর বলে যাচ্ছ যে বিয়ে করবে। এদিকে আমার দাদা ও বউদি অন্যত্র ছেলে দেখেছে এবং আমাকে চাপ দিচ্ছে রাজি হতে।

আমি কত দিন ওদের না করব?

মানস কোনো কথার জবাব না দিয়ে বলে, আমার একটু তাড়া আছে, আমি যাই।

আজ আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। অনেক রাত, ঘুম আসছে না। নিমি বিছানা থেকে বের হয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকাচ্ছে। সে অনেক দিন কানাডায় এত সুন্দর চাঁদ দেখেনি। অনেক সময় নিয়ে সে বাইরে চাঁদের সোনালি আলোর দিকে তাকিয়ে কত-কী ভাবছে। তার মনে নেই পেছনে অদিতি কখন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অদিতি হালকাভাবে গায়ে হাত রেখেছে। সে হকচকিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখে অদিতি পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অদিতিকে দেখে নিমি বলে, দেখো কী সুন্দর পূর্ণিমার চাঁদ। অদিতি বলে, ছোটকালে আমি শহর থেকে গ্রামে বাবার বাড়ি গেলে চাঁদের জোৎস্না ভরা রাতে বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে হেঁটে গল্পে বিভোর হতাম। কী অপূর্ব লাগত বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে এবং সোনালি রঙের চাঁদ ও তার আলোর মধ্যে বেড়াতে।

অনেক রাত হয়েছে, তোমার ঘুম আসে না?

আজ কেন যেন ঘুম আসে না। অদিতি বলে, আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।

কী বলবে?

মানসের সঙ্গে তোমার কী কোনো কথা হয়েছে?

বউদি, ওর আর্থিক সমস্যা যে জন্য দেরি করছে।

নরেশ বাবু কলেজে শিক্ষকতা করে, তার সঙ্গে তোমার বিয়ের প্রস্তাব আছে। তোমার মনে নেই নরেশ নিলয়ের জন্মদিনে আমাদের বাসায় এসেছিলো। হ্যাঁ, মনে আছে। ওর সঙ্গে তোমার বিয়ের কথা বলছি।

বউদি, ওর সঙ্গে আমার বিয়ে দেবে?

নরেশ দাদা বয়সে আমার চেয়ে অন্তত ১৫ বছরের বড়। ও দাদার চেয়েও ১০ বছরের বড়। আমার সঙ্গে ওনার কোনো দিনও মনের মিল হবে না। উনি একজন প্রফেসর মানুষ, ওই লেভেলের কোনো শিক্ষিতা মহিলা দেখে বিয়ে করলে ভালো মিল হবে।

নিমি, তুমি কী জানো, দিলীপ কুমারের সঙ্গে সায়েরা বানুর বয়সের পার্থক্য কমপক্ষে ২১-২২ বছর ছিল। বউদি, তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না। দিলীপ কুমার, সায়েরা বানু সিনেমা জগতের নায়ক-নায়িকা, ওদের মধ্যে সিনেমা জগতে অনেক দিনের ভালোবাসা ছিল এবং হুট করে বিয়ে করেনি। আমার সঙ্গে নরেশ দাদার কোনো মিল নেই। উনি একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি, যাকে আমি নিজ থেকে শ্রদ্ধা করি। তা ছাড়া মানসের সঙ্গে আমার এখনো সম্পর্ক রয়েছে।

তোমাদের এই সম্পর্ক কত দিন এভাবে চলবে?

বউদি, আমি ওকে ভলোবাসি ও নেহাত সরল মানুষ। ও আমাকে অনেক শ্রদ্ধা করে। আমি একটু সময় নিয়ে ওকে বিয়ে করব।

ঠিক আছে, এখন ঘুমাতে যাও পরে কথা বলব।

নিমি সারারাত ঘুমাতে পারছে না। কী যেন একটা টেনশনে রাত কাটাচ্ছে। রাতের শেষের দিকে মাকে স্বপ্নে দেখে একটা সাদা শাড়ি পরা তার মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। হাস্যোজ্জ্বল চেহারা, কী যেন কী বলছে। নিমি মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছে, কিন্তু মা দূরে সরে যাচ্ছে। নিমির চোখ দিয়ে জ্বল গড়িয়ে পড়ছে। মা যেন কী বলছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। নিমি মা মা বলে চিৎকার করে জড়িয়ে ধরেছে। কিন্তু মা চলে যাচ্ছে। তার চিৎকার শুনে অদিতি ডাকে, নিমি নিমি! সে তখনো কাঁদছে, চোখ খুলে দেখে অদিতি পাশে দাঁড়িয়ে বলে, তুমি কাজে যাবে না। ও মা, তুমি তো কাঁদছ, কী স্বপ্নে দেখলে?

নিমি বলে, আমি এতক্ষণ মাকে দেখছি। প্রিয়ব্রত রুম থেকে এসে বলে কী দেখছ?

নিমি কান্নার জন্য কথা বলতে পারছে না। অনেকক্ষণ পর বলে, আমি মাকে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম এবং কী যেন আমাকে বলতেছিল, বুঝতে পারিনি। মাকে দেখছ, ভালো দেখছ, ওঠো নাশতা করো। তোমার মন ভালো নেই, আজ কাজে যাওয়ার দরকার নেই, বাবাকে আশ্রমে গিয়ে দেখে এসো। নিমি তখনো কাঁদছে?

অদিতি বলে, ওমা কী মেয়ে গো! ও তো স্বপ্ন।

নিমি বলে, বউদি, আমি মাকে এভাবে কখনো দেখিনি। মা কেন আমার কাছে এল এবং কী বলতে চেয়েছিল কিছুই বুঝতে পারিনি। মা দুনিয়া থেকে আমাদের ছোট রেখে বিদায় নিয়েছেন, বাবা মায়ের আদর দিয়ে মানুষ করেছেন। আজ বাবা অসুস্থ এবং আমরা আপন হয়েও পর, বাবাকে একা আশ্রমে ফেলে রাখছি।

অদিতি বলে, কী করবে, এ দেশে কাজ না করলে দুবেলা খাবার মেলে না। এটাই এখানকার বাস্তবতা। তা ছাড়া বাবা অসুস্থ, আমরা কাছে থাকলেও কী করতে পারি?

নিমি ঘুম থেকে উঠে কাজের জায়গায় কল দিয়ে আজকের জন্য ছুটি নিয়েছে। আমি কাজে যাব না, ছুটি নিয়েছি এবং বাবাকে দেখতে যাব। প্রিয়ব্রত বলে, ঠিক আছে, তুমি থাকো এবং বাবাকে দেখে এসো।

প্রিয়ব্রত ও অদিতি নিলয়কে ডে কেয়ারে দিয়ে যার যে কাজে চলে গেছে। নিমি সকালের নাশতা ও কিছু রান্না করে বাবা ললিতের জন্য সকাল সকাল আশ্রমে যায়। ললিত নিমিকে দেখে হেসে বলে, তুমি আজ কাজে যাওনি?

না, বাবা, আমি আজ কাজে যাইনি।

নিমি বাবাকে ডাইনিং টেবিলে খাবার দিয়ে বলে, বাবা, তুমি আস্তে আস্তে খেয়ে নাও এবং আমি তোমার বেড গুছিয়ে দেব। ললিতের বেডশিট, বালিশের কভার এবং শার্ট-প্যান্ট ওয়াশিং মেশিনে দিয়ে এসে রুম পরিষ্কার করে অন্য কাপড় ও বেডশিট লাগিয়ে ম্যানেজমেন্ট অফিসে গিয়ে জিজ্ঞেস করে ললিতের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আছে কি না?

অফিস ম্যানেজার মি. পিটার বলে যে ললিত বেডরুম পরিষ্কার করে না এবং নিয়মিত ওষুধ খায় না। তা ছাড়া সে না বলে বাইরে চলে যায় এবং আমরা অনেক সময় খোঁজাখুঁজি করেও পাই না। অনেক সময় টেবিলে খাবার পড়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সে বাসায় থাকলেও খেতে চায় না।

নিমি বেডরুম পরিষ্কার করে, লন্ড্রি থেকে কাপড় এনে গুছিয়ে বলে, বাবা, তুমি চলো আমরা একটু ঘুরে আসি। নিমি ললিতকে নিয়ে নিকটতম শপিং মলে গিয়ে বাবার জন্য প্যান্ট, শার্ট, গেঞ্জি, সাবান, সেভিং রেজার, আফটার শেভ ও এটা-সেটা কেনাকাটা করে টিমহর্টন বসে দুইটা পিক্যান ডেনিস ও দুই কাপ কফি নিয়ে খাচ্ছে।

নিমি মানসকে টেলিফোন করে বলে, তুমি কী আসতে পারবে?

মানস বলে, জরুরি কিছু?

না, বাবাকে নিয়ে টিমহর্টনে বসে কপি খাচ্ছি, তুমি এলে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি। ঠিক আছে, আমি আসছি। মানস দুই ঘণ্টার ছুটি নিয়ে এসে ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। নিমি মানসকে বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে, বাবা, এই মানসের সঙ্গে আমার বিয়ে হবে, তুমি আমাদের জন্য আশীর্বাদ করো। ললিত মানসকে দেখে খুশি হয়ে বলে, আমি তোমাদের জন্য অবশ্যই আশীর্বাদ করি, তোমরা সুখী হও।

নিমি বাবাকে আশ্রমে নিয়ে রেখে বলে, বাবা, তুমি সব সময় ডাক্তারের পরামর্শমতো চলবে। বাবাকে ধরে আদর করে বলে, বাবা, আমি কাল রাতে মাকে স্বপ্নে দেখে অনেক কেঁদেছি এবং সে জন্য আজ কাজে না গিয়ে তোমাকে দেখতে এসেছি। চোখের পানি মুছতে মুছতে নিমি বলে, বাবা, আমি আবার তোমাকে দেখতে আসব এবং আমি বিয়ে করলে তোমাকে বাসায় নিয়ে যাব। তুমি ভালো হয়ে বাকি জীবন আমার কাছে থাকবে। ললিত হেসে হেসে বলে, ভালো থেকো।

পরদিন কাজে যাওয়ার পর নিমি নাহিদকে বলে, কাল বাবাকে দেখতে গিয়েছিলাম। নাহিদ বলে, তোমার বাবা কেমন আছেন?

এক রকমই। মানসকে ডেকে বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। বাবা খুশি হয়েছে এবং আশীর্বাদ করেছে। নাহিদ বলে, ভালো কাজ করেছ।

নাহিদ বলে, গতকাল এই নতুন বাচ্চা ডে কেয়ারে এসেছে। নিমি বলে, দেখে মনে হয় আগে দেখেছি। জিজ্ঞেস করে তোমার কী নাম?

সে বলে ধ্রুব। আমার কাছে মনে হয় এ হয়তোবা শুচিতার ছেলে। কিন্তু সে নিশ্চিত হতে পারেনি। তা ছাড়া শুচিতা কেন বাচ্চা ডে কেয়ারে দেবে?

বিকেলে শুচিতা এলে নিমি বলে, এ তোমার ছেলে বলে আমি মনে করছিলাম। কিন্তু নিশ্চিত হতে পারিনি। ওকে কেন ডে কেয়ারে এনেছ?

শুচিতা বলে, মা-বাবা ইন্ডিয়া বেড়াতে গিয়েছেন। সে জন্য কাজে যাওয়ার আগে ওকে ডে কেয়ারে রেখে যাই।

আংকেল এবং আন্টি কত দিনের জন্য ইন্ডিয়া গিয়েছেন?

মনে হয় দুই-তিন মাস থাকবে। ওরা কলকাতা নিজেদের বাড়িতে কিছুদিন থাকবে এবং দার্জিলিং, দিল্লি ও দেশের বিভিন্ন্য স্থানে নিজেদের লোকজনকে দেখতে যাবে। আমি শুনেছি বাংলাদেশে বাবার আদি বাড়িতেও যাবে। তবে শরীর ভালো থাকলে ঘুরবে, নতুবা চলে আসবে। তুমি একা বাসায় থাকো?

ধ্রুব এবং আমি দুজনে বাসায় এটা-সেটা নিয়ে ব্যস্ত থাকি। মাঝেমধ্যে প্রদীপও এসে যোগ দিয়ে খেয়েদেয়ে গল্প গুজব করে চলে যায়।

প্রদীপের কাজ কি হয়েছে?

হ্যাঁ, ও আলাদা বাসা নিয়ে থাকে।

সুমিতের কী অবস্থা?

সুমিতের শরীর ভালো যাচ্ছে না, সে কয়েক দিন থেকে হাসপাতালে ভর্তি আছে। ওকে দেখলে কেউ চিনবে না এত শরীর খারাপ হয়েছে। অসুস্থতার জন্য মেজাজ সব সময় খিটখিটে থাকে। আমি গতকাল ধ্রুবকে নিয়ে সুমিতকে দেখতে গিয়েছি হাসপাতালে। বাসা থেকে এটা-সেটা তৈরি করে নিয়েছি।

দুঃখ লাগে, এই অল্প বয়সে ওর এত এত সমস্যা হয়ে গেল?

ওর অ্যাকসিডেন্টে অনেক সমস্যা হয়েছে। ব্রেন অপারেশন, তা ছাড়া হার্ট অ্যাটাক এবং ওপেন হার্ট সার্জারি। এতগুলো সমস্যা কাটিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে বেশ সময় লাগবে। তা ছাড়া সে স্মোক করত, ওটা থেকে বের হতে পারছে না এবং কারও কথাও শোনে না।

নিমি বলে, অনেক কথা তোমার সম্পর্কে শোনা যাচ্ছে, তুমি প্রদীপকে আজও ছাড়তে পারছ না। তুমি দুই নৌকায় পা দিয়ে রেখেছ, ওটা কী সত্যি?

মানুষ কত কিছু বলে, তাদের বলতে দাও, আকাশে চাঁদ উঠলে সবাই দেখবে। আমি যদি এমন কিছু করি, তাহলে সবাই জানবে।

ওটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, আমাদের কিছুই বলার নেই। ঠিক আছে এখন যাই, ধ্রুব সম্পর্কে কোনো অভিযোগ আছে কী?

না, ও আপন মনে কাজ করে এবং কাউকে বিরক্ত করে না।

বিকেলে প্রদীপ কাজ থেকে বের হয়ে কেন্টাকি থেকে ফ্রাইড চিকেন, ফ্রাইজ এবং কোল্ড ড্রিংক নিয়ে বাসায় এসে দেখে শুচিতা কেবলই ধ্রুবকে নিয়ে এসেছে। ধ্রুব দেখে তো চিৎকার, আংকেল এসেছে, তা ছাড়া ওর পছন্দের খাবার, সে তো কাপড় না পাল্টিয়েই খাবারে হাত ঢুকিয়েছে। শুচিতা রাগ করে বলে, কাপড় ছাড়ো এবং হাত-মুখ না ধুয়ে খাবে না। প্রদীপ বলে, ঠিক আছে আমি ওকে সামলাই, তুমি তৈরি হয়ে খেতে এসো। শুচিতা বলে, তুমি রোজ রোজ এসব কেন আনো?

তুমি সারা দিন কাজ করো, কখন কী করবে, তাই একটু নিয়ে আসলাম। শুচিতা বলে, বেশ ভালো করেছ, আমার কিছু রান্না করতে হলো না। তুমি বসো, আমি আসতেছি। প্রদীপ ধ্রুবকে কাপড় পাল্টিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে টেবিলে বসিয়ে বলে, তুমি খাওয়া শুরু করো। শুচিতা সারা দিনের অফিসের কাপড় ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে এসে বলে, বাসায় কিছু রান্না আছে, গরম করে নিই। সে ফ্রিজ থেকে কালকের পুরোনো খাবার বের করে মাইক্রোওয়েভে গরম করে টেবিলে দিয়ে বলে, চলো, খেয়ে নিই।

প্রদীপ ও শুচিতা দুজনে ডিনার শেষ করে দুই কাপ কপি নিয়ে টেলিভিশনের সামনে আরাম করে বসে ২৩ চ্যানেলে আজকের আবহাওয়া দেখে বলে, আজ ঝড় হতে পারে। বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। প্রদীপ বলে, রাতের খাওয়া হলো, এখন চলি বাসায়। দেরি হলে মারিয়া আমার জন্য চিন্তা করতে পারে।

শুচিতা হাসতে হাসতে বলে, মারিয়ার সঙ্গে কী তোমার প্রেমের সম্পর্ক?

হ্যাঁ, তাই বলে হা হা করে হাসে।

শুচিতা বলে, তোমার এত কষ্ট করে আসার দরকার ছিল না।

প্রদীপ বলে, যে যাকে ভালোবাসে তার জন্য এর চেয়েও বেশি করতে পারে, আমি আর কী করলাম।

শুচিতা বলে, রিয়েলি!

প্রদীপ হেসে হেসে বলে রিয়েলি। যাক একটু রসালাপ করলাম, এ সামান্য খাবার এনেছি ধ্রুবর জন্য। ঠিক আছে, ভালো থেকো।

প্রদীপকে বিদায় দিয়ে শুচিতা টেলিভিশন বন্ধ করে মা ও বাবাকে কলকাতা টেলিফোন করে। আভা টেলিফোন উঠিয়ে বলে, কেমন আছিস, শুচিতা?

আমরা ভালো আছি। তোমরা কেমন আছ?

আমরা জার্নি সিক ও রেস্টে আছি। তোর বাবার সঙ্গে কথা বলবি?

দাও। বাবা, তুমি কেমন আছ?

আমরা একটু জার্নি সিক ও রেস্টে আছি। থাকো রেস্টে, বেশি ছোটাছুটি করবে না। আচ্ছা ঠিক আছে।

পরদিন কাজ থেকে শুচিতা বের হয়ে হাসপাতালে কিছু খাবার নিয়ে সুমিতকে দেখতে যায়। সুমিতের সঙ্গে কথা বলার পর সে ওর ডাক্তার শর্মার সঙ্গে আলাপ করে জানে, সুমিতের শরীরের কী অবস্থা। শর্মা বলে, সুমিতের ব্রেন অপারেশন হলেও কিছু সেল কাজ করছে না। তা ছাড়া দুবার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ফলে ওর নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিয়েছে এবং ওকে আপাতত হাসপাতাল থেকে রিলিজ করা যাবে না। রিলিজ করলে ও ২৪ ঘণ্টা মেডিকেল কেয়ারে থাকতে হবে। শুচিতা ধ্রুবকে পিকআপ করতে যাবে, সে জন্য বেশিক্ষণ না বসে বলে, আমি সময় নিয়ে আবার আসব।

হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পথে অধরা ও সুশীলের সঙ্গে ওর দেখা। শুচিতা প্রণাম জানিয়ে বলে, আপনারা কেমন আছেন?

ওরা বলে ভালো। সুমিতের কী অবস্থা?

আন্টি, ডাক্তার শর্মা বলল, ওর নানা ধরনের জটিলতা রয়েছে। আমি ধ্রুবকে ডে কেয়ার থেকে পিকআপ করতে যাব, সে জন্য বেশিক্ষণ বসতে পারলাম না। ঠিক আছে তুমি যাও, পরে কথা হবে। শুচিতা ট্যাক্সি নিয়ে ডে কেয়ারে গিয়ে ধ্রুবুকে নিয়ে বের হতেই নিমিকে বলে, আমি হাসপাতালে গিয়ে সুমিতকে দেখে এসেছি, ওর শরীরের অবস্থা ভালো নেই এবং ডাক্তার খুব একটা ভরসা দেয় না।

পর্ব: ৯

পরদিন ললিত আশ্রম থেকে সকাল সকাল বের হয়ে কোথায় চলে গেছে, কেউ বলতে পারছে না। প্রিয়ব্রত ডাক্তারের সঙ্গে এবং তার আশ্রমে আলাপ করেছে। ওরা জানিয়েছে যে যেখানেই যাক হয়তো বিকেলের দিকে চলে আসবে। আর যদি না আসে, পুলিশ রিপোর্ট করবে এবং পুলিশ তাকে খুঁজে বের করবে। এ নিয়ে প্রিয়ব্রত নিমিকে বলছে যে বাবাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। বাবা মাঝেমধ্যে বের হয়ে কোথায় চলে যায় এবং আবার একসময় ফিরে আসে। তথাপি ওরা এখানে-সেখানে এবং আত্মীয়স্বজন যে যেখানে আছে বলেছে খোঁজ নেওয়ার জন্য।

কিন্তু এক সপ্তাহ চলে গেছে, বাবার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশও খুঁজে বেড়াচ্ছে, কিন্তু তার দেখা পাচ্ছে না। ইতিপূর্বে ললিত এত দীর্ঘ সময় নিখোঁজ থাকেনি এবং এ নিয়ে পরিবারের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। নিমি, প্রিয়ব্রত পুলিশকে জিজ্ঞেস করে জেনেছে ওরা শহরের আনাচকানাচে নজর রাখছে। যদি নজরে পড়ে ওকে আশ্রমে নিয়ে আসবে এবং খবর দেবে।

বাসায় প্রতিনিয়ত ওকে নিয়ে অন্যদের সঙ্গে অসন্তুষ্ট এবং কথা-কাটাকাটি হচ্ছে, তাই সে কাউকে কিছু না বলে বাসস্টেশনে গিয়ে টিকিট কেটে মন্ট্রিয়েলে চলে গিয়েছে। সে বাসস্টেশনে নেমে আপন মনে ঘোরাঘুরি করে একসময় খিদায় ক্লান্ত হয়ে এক ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে গেলে মালিক ওকে ভেতরে ডেকে খাবার দিলে খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে পার্কে গিয়ে বেঞ্চে বসে থাকে। ঠান্ডার সময় পার্কে লোকজনের যাতায়াত থাকে না, চারদিকে বরফ আর বরফ। গাছে কোনো পাতা নেই, দেখলে মনে হয় সব গাছ মরে দাঁড়িয়ে আছে।

মাইনাস টেম্পারেচার বাইরের আবহাওয়া। ললিতের ভালো কাপড়ও গায়ে নেই। তাকে পুলিশ এ অবস্থায় দেখে উঠিয়ে নিয়ে হোমলেস লোকদের সঙ্গে আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা করে। সেখানে খাবার ও থাকার ব্যবস্থা পেয়ে সে খুবই খুশি। কারণ সকালে গরম গরম সুপ, বার্গার, ফ্রাইজ, কপি এবং দুপুরে ও রাতে গরম খাবার পেয়ে সে আর আশ্রম থেকে বের হতে চায় না।

এদিকে তাকে ছেলেমেয়েরা খুঁজে না পেয়ে পুলিশ রিপোর্ট করেছে। এক শহর থেকে অন্য শহর স্থান পরিবর্তনের ফলে পুলিশও তাকে আর সময়মতো খুঁজে বের করতে পারছে না।

কানাডায় প্রতিটি মিউনিসিপালিটি হোমলেসদের জন্য খাবার, গরম কাপড় ও থাকার ব্যবস্থা থাকে এবং বিভিন্ন আতিথেয়তা সংগঠন যেমন চার্চ, মসজিদ, মন্দির ও ব্যক্তিগত সাহায্যে সারা বছর খাবার ও কাপড় এবং হাতখরচের টাকা দেওয়া হয়। এ ছাড়া সরকারি অনুদান তো অবশ্যই রয়েছে। এ দেশে ৯১১ কল দিলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ও অ্যাম্বুলেন্স এসে রোগীদের অবস্থা বুঝে চিকিৎসা শুরু করে। যে পর্যন্ত না রোগী হাসপাতালে নেওয়া হয়।

এ দেশে যারা গৃহহীন, এরা গরিব না, অধিকাংশই মানসিক রোগী। এদের ছেলেমেয়েরা অনেকে বড় বড় চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য করে। মেয়েদের এ দেশে গৃহহীন হিসেবে কম দেখা যায়। হোমলেস লোকদের রাস্তা, শপিং মলে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। এ দেশের সরকার মানসিক রোগীদের চিকিৎসার জন্য অনেক পয়সা খরচ করে। তাদের স্থায়ীভাবে আশ্রয়, চিকিৎসা ও নার্সিং দিয়ে থাকে।

একদিন পুলিশ খবর দিয়ে জানায় যে ললিত মন্ট্রিয়েলে এক আশ্রয়কেন্দ্রে আছে। খবর পেয়ে প্রিয়ব্রত ও নিমি মন্ট্রিয়েলে গিয়ে বাবার খবর নিয়ে বলে, চলো, তোমাকে অটোয়া নিয়ে যাব। ললিত বলে, আমি ওই আশ্রয়কেন্দ্রে আর যাব না, ওখানে যেসব লোকজন আছে ওদের সঙ্গে থাকা সম্ভব না। ওরা আমাকে সব সময় বিভিন্নভাবে মানসিক অত্যাচার করে। প্রিয়ব্রত ও নিমি ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে বাবার অসুস্থতার রেকর্ড নিয়ে আলোচনা করে। ম্যানেজমেন্ট অফিস বলে, উনি বয়স্ক, যদি না যেতে চায়, তোমরা কিছুই করতে পারবে না। ও বরং এখানে থাকুক, আমরা ওর চিকিৎসা করাব এবং কোনো ব্যাপারে তোমাদের দরকার হলে যোগাযোগ করব। অগত্যা ওরা তাকে কাপড় ও দরকারি এটা-সেটা দিয়ে অটোয়া চলে আসে।

নিমি ও প্রিয়ব্রত অটোয়া ফিরে এসে অদিতির সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে বলে, বাবাকে ফিরে আনা সম্ভব হচ্ছে না। এটার মূল কারণ এখানে আশ্রমে অন্যদের সঙ্গে বাবার বনিবনা হতো না। ওখানে লোকজন খোলামেলা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব রেখে চলাফেরা করে। খাওয়ার সময় ওরা সবাই হাসিখুশি আলাপ-আলোচনা করে খায়। কপি ব্রেকে সবাই একসঙ্গে গিয়ে একে অপরের সঙ্গে আলাপ করে। আশ্রমে ভারতীয় বসু নামে একজন রোগী রয়েছে, তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা সর্বদা খোঁজখবর নিয়ে থাকে। আমরা তাদের সঙ্গে আলাপ করে আমাদের টেলিফোন নম্বর দিয়ে এসেছি, কোনো অসুবিধা হলে ওরা খোঁজ খবর দেবে এবং সব সময় দেখাশোনা করবে। তা ছাড়া কিচেনে দুজন ভারতীয় বাবুর্চি আছে ওরা বাবাকে পছন্দ করে এবং বলেছে ওরা খোঁজখবর নেবে এবং প্রয়োজনে আমাদের সঙ্গে আলাপ করবে। অদিতি বলে, ঠিক আছে বাবা যদি মন্ট্রিয়লে ভালো থাকে, থাকতে দাও।

নিমি পরদিন কাজে গিয়ে নাহিদকে বলে, উইকেন্ডে বাবাকে দেখে এসেছি।

নাহিদ বলে, কেমন দেখলে?

বাবা আশ্রমে আছে এবং ভালো আছে। বাবা মন্ট্রিয়েল ছেড়ে অটোয়া আসতে চায় না। ওখানে আমাদের ভারতীয় আরও কিছু লোক আছে, তিনি তাদের পছন্দ করেন এবং বলেন, আমি এখানে ভালো আছি। বাবা যদি স্থায়ীভাবে মন্ট্রিয়েলে থাকে আমি কাজ নিয়ে হয়তো একসময় চলে যাব, বাবার কাছে থাকলে দেখাশোনার জন্য ভালো হবে।

এখানকার ডাক্তার কী বলে?

ডাক্তার বলে মন্ট্রিয়েলেও ভালো চিকিৎসা আছে। তিনি নিজের থেকে চিকিৎসা নিলে তো ভালো। নতুবা তোমাদের তার পেছনে লেগে থাকতে হবে। এ জাতীয় রোগী পেছন থেকে বারবার না বললে ডাক্তারের কাছে যায় না বা রীতিমতো ওষুধ নেয় না।

উইকেন্ডে নিমি মানসের সঙ্গে ঘুরতে বের হয়েছে। ওরা পার্লামেন্ট হিল এলাকা ঘোরাঘুরি করে একসময় এক ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে খেতে বসেছে।

মানস জানতে চায় বাবা ললিতের কী অবস্থা?

নিমি বলে, বাবা এখানে আসতে চায় না, ওখানে ভালো আছে। মানস বলে, ওখানে বাবাকে কে দেখাশোনা করবে?

নিমি বলে, আমাদের দেশীয় কিছু লোক আছে ওদের বলে এসেছি খোঁজখবর নিতে। নিমি বলে, বাবা বয়স্ক লোক, এ দেশে বয়স্ক লোকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো চিকিৎসা দেওয়া যায় না। সে জন্য বাবাকে মন্ট্রিয়েল থেকে এখানে আনা যাচ্ছে না।

বাবা ললিত মন্ট্রিয়েলে আর এক অঘটন ঘটিয়েছে, হাঁটতে গিয়ে পা ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। নিমি বলে, বাবার এত এত কষ্ট দেখলে ভালো লাগে না। হাসপাতালে ললিতের ভগ্ন পা জোড়া লাগিয়েছে। চার দিন হাসপাতালে রাখার পর তাকে আশ্রমে পাঠানো হয়েছে। বাবা পায়ের ব্যথায় চিৎকার করছে, কিছুই সহ্য করতে পারছে না। ডাক্তার উচ্চ ক্ষমতাশালী ব্যথা কমার ওষুধ দিয়েছে। কিন্তু তাতেও ব্যথা কমছে না। নিমি সঙ্গে সঙ্গে ছুটি নিয়ে মন্ট্রিয়েল গিয়ে একটা ছোট বাসা নিয়ে বাবার কাছে থেকে বাবাকে সেবা দিচ্ছে এবং সঙ্গে হাসপাতালের নার্সও সময়-সময় এসে এক্সারসাইজ করানো দেখিয়েছে। হাসপাতাল ও হেলথ ক্লিনিকে আনা-নেওয়ার জন্য হুইল ট্রান্স দেওয়া হয়েছে। নিমি না থাকলে ললিতের অসুবিধা হতো হাসপাতাল ও হেলথ ক্লিনিকে আনা-নেওয়ার জন্য।

এক মাসের অধিক সময় পার হয়েছে, এখনো সপ্তাহে তিন দিন নার্স আশ্রমে আসে এবং আস্তে আস্তে পা নাড়াচাড়া ও ওয়াকার দিয়ে চলাফেরা করাচ্ছে। বাবার আর শান্তি নেই, একটার পর একটা অঘটন চলছে। সারা দিন বিছানায় শুয়ে ব্যথায় কাতরাইতে থাকে। প্রিয়ব্রত ও অদিতি এসে দেখে অটোয়া চলে গেছে। কিন্তু কেউ না কেউ পাশে থাকা দরকার। আমি থেকে গেলাম এবং কাজের জায়গা থেকে ছুটির দরখাস্ত দিয়েছি। নাহিদকে বললাম আমার ছুটি করিয়ে দিও। নাহিদ বলে, আমি দেখব।

নাহিদ ও শুচিতা ধ্রুবকে নিয়ে মন্ট্রিয়েল গিয়ে নিমি ও ললিতকে দেখে এটা-সেটা দিয়ে কয়েক ঘণ্টা থেকে শুচিতার এক বান্ধবীর বাসায় রাত কাটিয়ে পরদিন ঘুরে অটোয়া চলে আসে। নাহিদ বলে কেউ না কেউ বাবার কাছে কিছুদিন থাকা দরকার। নিমি বলে, বাবা আমাকে দেখলে অনেক খুশি হয়।

নিমির এখানে ভালো লাগে, ছুটি বাড়িয়ে নিয়ে মন্ট্রিয়েলে ডে কেয়ারগুলোতে দরখাস্ত দিয়েছে। বেশ কয়েক জায়গায় দরখাস্ত দেওয়ার পর এক জায়গায় কাজ পেয়েছে। কাজের ব্যবস্থা হওয়ায় সে অটোয়া থেকে স্থায়ীভাবে চলে এসেছে।

নিমি মানসকে বলে, আমি আর তোমার পেছনে সময় নষ্ট করব না। তোমার মন মানসিকতার পরিবর্তন না হলে আমি অযথা তোমার পেছনে দৌড়াব না। তোমাকে আমি তিন বছর সময় দিয়েছি, তুমি যেসব কারণ দেখাচ্ছ, তা অযৌক্তিক। নাহিদ, অদিতি এবং আরও অনেকে বলেছে নিমি, তুমি খোঁজ নিয়ে দেখো মানসের কারও সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে, তা না হলে ও এত দেরি করবে কেন?

মানসকে এ-সম্পর্কে কিছু বললে চুপটি করে থাকে যেন বোকা লোক। বান্ধবীরা বলে খোঁজ নিয়ে দেখো পেছনে কেউ আছে যে জন্য তোমাকে আগ্রহ দেখায় না।

নিমি বলে, তুমি একেক বার একেক রকম বলো যার কোনো যৌক্তিকতা আমি খুঁজে পাই না। মানস হেসে বলে একটু ধৈর্য ধরো, এখনই হুট করে কোনো কিছু সিদ্ধান্ত নেবে না। আমি দেখি কী করতে পারি।

শুচিতা শুনে বলে, তোমার কেস সম্পূর্ণ আমার কার্বন কপি। আমি সুমিতের ফাঁদে পড়ে যেভাবে আজ পর্যন্ত ভুগতেছি। মনে হয় তুমিও সেদিকে পা বাড়াচ্ছ। তুমি বুঝে-শুনে পা বাড়াবে। নতুবা শেষে আমার মতো ভুগে মরবে। আমি মা-বাবার কথা শুনিনি, নিজে একরোখা সিদ্ধান্ত নিয়ে বিয়ে করেছি, আজ আমি বুঝি কী ভুল করেছি। কেউ আমার কথা শোনে না, অনেকে আমাকে বলে যে আমি প্রদীপকে ভালোবাসি, সে জন্য এত সব অসুবিধা হচ্ছে।

পড়াশোনা জীবনে আমি সুমিতকে ভালোবেসেছি এবং সে সরলতার সুযোগে ভুল করে বিয়ে করেছি।

আমি কী পেয়েছি?

সুমিত তার মা-বাবা ও ভাইবোনকে দেশ থেকে এনে সমস্যা করেছে। ওদের কোনো বাস্তব জ্ঞান নেই। ওর পরিবার এখানে এসে কলহ সৃষ্টি করেছে। আমাকে ছোট ঘরের মেয়ে এবং চোর পর্য্যন্ত বানিয়ে হেনস্তা করতে দ্বিধা করেনি। আমি কেঁদেছি, সুমিত আমাকে কোনো রকম সান্ত্বনার কথা ও শোনায়নি; বাসার সবাই আমাকে চাকরানীর মতো ব্যবহার করেছে।

নিমি বলে, আমি তোমার দুঃখ দেখেছি এবং আমার জীবনে এসব হতে দেব না। আমি মানসকে বলেছি চলো আমরা ছোটখাটো করে বিয়ে করে ঘর সংসার শুরু করি। কিন্তু ওর প্ল্যান অনেক বড়, দেশে যাবে মা-বাবা ও আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে আনন্দ করে বিয়ে করবে?

নাহিদ বলে, ওর এক পক্ষের লোকজন আনন্দ করবে, তোমার লোকজন গত দুই যুগেরও বেশি সময় কানাডা থাকে।

তোমার কেউ কী ইন্ডিয়া অনুষ্ঠান করতে যাবে?

বাবা অসুস্থ, এক ভাই সে-ও দেশে যেতে চায় না। আমাদের দেশে আপনজন বলতে কেউ নেই।

নাহিদ বলে, তাহলে কিসের আনন্দ হবে?

ওকে বুঝিয়ে দুজনে এখানে ছোটখাটো করে বিয়ে করে নাও। পরে একসময় দেশে গিয়ে লোকদের নিয়ে খাবার দিয়ে একটু আনন্দ করবে। ঠিক আছে দেখি।

নিমি একদিন টেলিফোন উঠিয়ে বলে, মানস, তুমি একবার মন্ট্রিয়েল এসো, আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই। কী কথা বলবে টেলেফোনে বলো, আমি শুনব। টেলেফোনে এত কথা বলা যাবে না। তুমি এখানে এসো আমি কিছু কথা বলব। ঠিক আছে আমি আসব। (চলবে)