শুচিতা

(কানাডার দৈনন্দিন বাস্তবতার দিকে লক্ষ্য রেখে কাল্পনিক এই উপন্যাস ‘শুচিতা’। লিখেছেন কানাডা প্রবাসী নজরুল ইসলাম। )

নজরুল ইসলাম

সন্ধ্যার দিকে মজিদ ও তার স্ত্রী রাবেয়া মিসেসাগা গো ট্রেন স্টেশন থেকে বের হয়ে আস্তে আস্তে ওয়াকার ঠেলে ঠেলে বাস স্টপের দিকে রওনা দিল। স্টেশন থেকে তাদের বাসা ১০-১২ কিলোমিটার দূরে, বাসে ভিড়ের মধ্যে বড়জোর এক ঘণ্টা লাগতে পারে। সারা দিনে ওয়াকার ঠেলে ঠেলে উভয়ই ক্লান্ত শরীর নিয়ে এগোচ্ছে। সকাল ৬টা বাজে ঘর থেকে বের হয়েছে দুজনে। বাস, ট্রেন করে তিন ঘণ্টা লেগেছে টরন্টো ইউনিভার্সিটি ডেন্টাল ডিপার্টমেন্টে পৌঁছাতে। মজিদ ও স্ত্রী রাবেয়া বেগমের দাঁতের সমস্যা, যা ডেন্টিস্ট দেখানো শেষ হয়েছে দুপুর সাড়ে ১২টায়। ডেন্টিস্ট শেষ করে রাবেয়া বলে, সব সময় টরন্টো আসা হয় না, বাসায় বাংলাদেশি মাছ, তরকারি ও মসলা নেই। মজিদ বলে চলো, কেনাকাটা করে যাই। বাস ও সাবওয়ে করে ভিক্টোরিয়া পার্ক ও ডেনফোর্থ এরিয়া গিয়ে ‘ঘরোয়া’ খাবার দোকান দেখে মজিদ বলে, ‘চলো ভেতরে গিয়ে কিছু খেয়ে নিই।’ রাবেয়া বলে, আমরা ঘর থেকে কিছু খাবার নিয়ে এসেছি। মজিদ বলে, আজ ঘরের খাবার রেখে দাও, এখানে গিয়ে দেখি কী আছে?

ছোট্ট রেস্টুরেন্ট, আট-দশজন বসার ব্যবস্থা, এই মুহুর্তে বসার মতো জায়গা নেই। তাই দুজনে হাঁটতে হাঁটতে সরকার ও মারহাবা গ্রোসারি দোকানে গিয়ে কেনাকাটা করে পাশে ‘কান্ট্রি স্টাইলে’ বসে নিজেদের খাওয়া ও দুই কাপ চা নিয়ে খেয়ে ওয়াশরুম সেরে পুনরায় বাসার দিকে রওনা হলো। মজিদ বলে, ওয়াকার নিয়ে ঠেলাঠেলি আর ভালো লাগে না। স্ত্রী রাবেয়া মজিদের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তোমাকে কে ড্রাইভ দেবে?’

মজিদ দীর্ঘ নিশাস ছেড়ে বলে, তা তো জানি। দুজনে ভিক্টোরিয়া পার্ক সাবওয়ে থেকে ইউনিয়ন স্টেশনে এসে গো ট্রেনে মিসেসগা গিয়ে বাইরে এল। ওরা বাস স্টপে না গিয়ে ভুল করে গাড়ি পার্কিং লটে ঢুকে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে, বুঝতে পারছেন না কোথায় গেলে বাস পাওয়া যাবে। সন্ধ্যা হয় হয়, ক্লান্ত শরীর, ওয়াকার ঠেলে ঠেলে আর এগোনের মতো শরীরে এনার্জি নেই।

পার্কিং লটে অসংখ্য গাড়ি রেখে লোকজন টরন্টো ও অন্যান্য শহরে ট্রেনে যাতায়াত করে। ট্রেনে দ্রুত গন্তব্য স্থলে পৌঁছা যায়, তাই এখানে পার্কিং করে যাত্রীরা দূরের শহরে অফিস করে ফিরে এসে গাড়ি নিয়ে বাড়ি চলে যায়। মজিদ ও তার স্ত্রী দু-একজনকে কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যস্ত জীবন, কারও দাঁড়িয়ে শোনার সময় নেই। অতিরিক্ত ঠান্ডা, স্নোর মধ্যে সবাই কাজ থেকে ফিরে বাসায় যাওয়া নিয়ে ব্যস্ত। মজিদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে দুই শহরে থাকে এবং সময়-সময় এসে খোঁজ নেয়; তবে মা-বাবাকে সার্ভিস দেওয়ার মতো সময় কোথায়?

মজিদ ও রাবেয়া চুপ করে দাঁড়িয়ে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে; যদি কোনো সুহৃদ ব্যক্তি একটু সাহায্য করে এবং তাদের বাস স্টপ দেখিয়ে দেয়।

অবশেষে মনে মনে বাসের চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে দিয়ে ভাবছে গো স্টেশনে গিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে বাসায় যাওয়াই উত্তম। মজিদ তার স্ত্রীকে বলে, ‘চলো, এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে গো স্টেশনে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে যাই।’ তারা আস্তে আস্তে ওয়াকার ঠেলে ঠেলে গো স্টেশনের দিকে ফিরে যাচ্ছে। এমন সময় ৩০-৩২ বছরের এক মেয়ে তাদের দিকে এগিয়ে এসে বলে, আমি কি তোমাদের কোনো সাহায্য করতে পারি?

মজিদ বলে, ‘আমরা বাস স্টপ খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি কি আমাকে বলতে পারো এখানে নিকটতম বাস স্টপ কোথায়?’

মেয়েটি একটু চুপ থেকে বলে, তোমরা কোথায় যাবে?

মজিদ পকেট থেকে কলম বের করে তাকে কাগজে অ্যাড্রেস লিখে দেখাল। মেয়েটি বলে, আমি ওদিকেই যাচ্ছি। আমি কি তোমাদের নিয়ে যেতে পারি?

মজিদ ও রাবেয়া বেগম বলে, ‘তুমি এত কষ্ট করবে?’ মেয়েটি বলে, কষ্ট কিসের?

এই অ্যাড্রেস আমি বাসায় যাওয়ার পথে। তোমরা কিছু মনে না করলে আমি তোমাদের পৌঁছে দিতে পারি। মজিদ অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তুমি সারা দিনের কাজের শেষে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরছ, আমাদের তোমার সাহায্য আসা করা ঠিক হবে কি?

সে বলে, কোনো অসুবিধা হবে না। এসো আমার গাড়ির নিকট। সে গাড়ির পেছনে ওয়াকার ঢুকিয়ে ওদের দুজনকে ভেতরে বসিয়ে গাড়ি চালাতে শুরু করে। মজিদ বলে, তুমি এত বড় উপকার করলে, তোমার নাম ও দেশের বাড়ি কোথায় জানতে কি পারি?

মেয়েটি হাসতে হাসতে বলে, আমার নাম শুচিতা। আমি কানাডিয়ান, আমার বাবা-মা ভারতীয়। মজিদ বলে, আমরা বাংলাদেশি। শুচিতা বলে, আমার দাদা ও বাবার বাংলাদেশে জন্ম। শুচিতা হাসতে হাসতে বলে তাহলে আমি তোমাদের নিয়ে এসে একটা ভালো কাজ করেছি। মজিদ বলে, তুমি কি বাংলাদেশে কখনো গিয়েছ?

হ্যাঁ, আমি মা-বাবার সঙ্গে একবার বাংলাদেশে গিয়েছি। ওখানে তোমার কে কে আছেন?

ওখানে আমার দাদার দিকের আত্মীয়স্বজন আছে; যাদের সঙ্গে আমার বাবার যোগাযোগ রয়েছে।

তুমি কি জানো বাংলাদেশে কোথায় তোমার দাদার বাড়ি?

আমি যতটুকু জানি, ওদের বাড়ি ফরিদপুর। আমার বাবা-মা বাঙালি ও বাংলা বলতে পারে, তবে আমি ভালো বাংলা বলতে পারি না। মজিদ বলে, আমরা তোমাকে পেয়ে অনেক খুশি হয়েছি। এ কথা-সে কথা বলতে বলতে সে তাদের বাসার কাছে এসে বলে, এটাই কি তোমাদের বিল্ডিং?

মজিদ বলে তুমি তো খুব তাড়াতাড়ি চলে এলে। তুমি গাড়ি পার্কিং করে আমাদের বাসা দেখে যাও, এতে তুমি তোমার মা-বাবাকে নিয়ে আবার আসতে পারবে। শুচিতা তাদের কথায় রাজি হয়ে তাদের সঙ্গে ওপরে উঠে বাসায় যায়। মজিদ ও রাবেয়া বেগম বলে, তুমি তো এখন আমাদের নাতিন। না খেয়ে কোথায় যাবে? বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এসো, আমাদের যা উপস্থিত আছে খেয়ে যাও।

শুচিতা বলে, দাদি, আজ না, অন্য একদিন মা-বাবাকে নিয়ে এসে খেয়ে যাব।

মজিদ ও রাবেয়া বেগম বলে, তোমাকে আজ আমাদের সঙ্গে খেয়ে যেতে হবে। তুমি আমাদের যে উপকার করলে তা অসীম। তুমি সাহায্য না করলে আমরা কখন বাসায় আসতাম এবং আমরা দুজনই অসুস্থ রোগী, কী হতো বলা যায় না।

খাবার সবই তৈরি বলতে বলতে রাবেয়া বেগম খাবার মাইক্রোওয়েভে গরম করে টেবিলে দিল।

শুচিতা বাসায় টেলিফোন করে বলে, মা, আমার একটু দেরি হবে, তোমরা আমার জন্য চিন্তা করবে না।

তার মা বলে, তুমি কোথায় এবং কতক্ষণ লাগবে আসতে?’ শুচিতা বলে, আমি পাশেই সিনিয়র হোমে একটা পরিবারকে দেখতে এসেছি। আমি বাসায় এসে সবকিছু তোমাকে বলব।

তার মা বলে, আচ্ছা ঠিক আছে। শুচিতা বলে, তোমরা কত দিন এ দেশে আছ?

মজিদ বলে, আমরা প্রায় ৪০ বছর এ দেশে এসেছি। তোমার কয় ছেলেমেয়ে?

আমাদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। তারা সবাই আলাদা থাকে। আমরা আলাদা থাকতে ভালোবাসি এবং ছেলেমেয়েদের বিরক্ত করতে চাই না। রাতের খাবার পর শুচিতা মজিদ ও রাবেয়াকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিতে গিয়ে মনে মনে বলে, আমি আজ একটা ভালো কাজ করেছি এবং দুজন অসহায় মানুষকে যেভাবে সাহায্য করলাম তা অনেক দিন মনে থাকবে। মজিদ ও রাবেয়া গাড়ি পর্যন্ত শুচিতাকে বিদায় দিতে গিয়ে বলে, তুমি মা-বাবাকে নিয়ে আবার আসবে।’

শুচিতা বাসায় গিয়ে মা-বাবাকে এই ঘটনা বলায় ওরা অনেক খুশি হয়ে বলে, আমরা একদিন ওদের দেখতে যাব।

শুচিতা স্ট্যাটিসটিকস কানাডা, অটোয়া সরকারি চাকরি পেয়েছে এবং যাওয়ার জন্য তৈরি। মা-বাবা তাকে টরন্টো ছেড়ে যাওয়ার জন্য নিষেধ করে যাচ্ছে। তারা মেয়েকে একা ছেড়ে দিতে চাচ্ছে না। শুচিতা বলে, এটা সরকারি চাকরি, আমি কেন যাব না বাবা?

এই চাকরিতে সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি। বাবা-মা বলে, তুমি আমাদের ছেড়ে গেলে আমরা একা হয়ে যাব। তুমি বরং সার্ভিস অন্টারিও বা অন্য কোনো সরকারি চাকরি দেখো, যার অফিস টরন্টো রয়েছে। শুচিতা বলে, বাবা, চাকরি চাইলেই তো আর পাওয়া যায় না। সে কোনোভাবেই ওদের বোঝাতে পারছে না। শেষে সে কাজ থেকে মজিদ দাদাকে টেলিফোন করে বিস্তারিত সবকিছু বলে এবং দাদা বলে, তুমি তোমার মা-বাবাকে নিয়ে এসো আমরা বুঝিয়ে দেব। এক বিকেলে শুচিতা তার মা-বাবাকে নিয়ে মজিদের সিনিয়র হোমে এসে এ কথা-সে কথা বলে রাতের খাবার শেষ করে শুচিতার চাকরিসংক্রান্ত আলোচনায় বসে।

শুচিতা মা-বাবার একমাত্র মেয়ে, তার দাদা শ্যামল দত্ত খ্রিষ্টান ও দাদি আভা দত্ত হিন্দুধর্মের বিশ্বাসী ছিলেন। তার দাদার আদি বাসস্থান ফরিদপুর, অবিভক্ত ভারত; যা পরে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ নামে পরিচিতি লাভ করে ১৯৪৭ ও ১৯৭১ সালে। ১৯৪৭ দেশ ভাগ হওয়ার পর ওর দাদা-দাদি ছেলেমেয়েদের নিয়ে কলকাতা, মানে ভারতে চলে যান। তাদের আত্মীয়স্বজন ভারত ও বাংলাদেশে রয়েছে। তার দাদা শ্যামল দত্ত ইন্ডিয়ান রেলওয়েতে চাকরি করতেন। দাদি আভা দত্ত গৃহিণী ছিলেন। দাদা শ্যামল দত্ত ভারতে স্থায়ীভাবে চলে যাওয়ার দুই বছরের মধ্যে কলকাতা মুসলিম-হিন্দু দাঙ্গায় মারা যান, যদিও দাদা একজন খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী ছিলেন। দাদা কাজ থেকে আসার পথে দাঙ্গায় পড়ে অকালমৃত্যু হয়। দাদা একজন সাদাসিধে মানুষ ছিলেন। উনি কারও সঙ্গে কোনো কথা-কাটাকাটি করতে পছন্দ করতেন না। দাদা মারা গেলে বাবা অল্প বয়সে সংসারের দায়িত্ব নেন। তার প্রথম চাকরি কলকাতা পোর্টে ক্লার্ক এবং অভাবী সংসার চালাতে না পারলে বেশি বেতন আশা করে বিদেশি শিপে যোগদান করেন। তা ছাড়া বিভিন্ন দেশ দেখার নেশা তার ছিল। প্রতিবছর একবার ছুটিতে গেলে এক থেকে দুই মাস করে দেশে থাকতেন। সংসারে তারা দুই ভাই ও দুই বোন ছিলেন। ফরিদপুরের জমি ও বাড়ি অন্যদের কাছে বিক্রি করে দাদা কলকাতা চলে যান। দাদা মারা গেলে দাদি সামান্য বিধবা ভাতা পেতেন, তা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চালাতে হিমশিম খেতেন, দাদি ১৯৮১ সালে মারা যান।

শুচিতা বলে, আমরা ভারতে বেড়াতে গেলে এখানে-সেখানে ঘোরাঘুরি করতেই

ছুটি শেষ হয়ে যায়, ফরিদপুর, বাংলাদেশ একবার গিয়েছি। ওখানকার আত্মীয়স্বজন আমাদের যেভাবে আতিথেয়তা করেছেন তা ভোলার নয়। ওরা আমাদের অনেক কাপড় ও গয়না দিয়েছেন এবং বারবার বলেছেন আবার বেড়াতে যেতে। কিন্তু আমাদের পণে যাওয়া সম্ভব হয় না।

শুচিতার বাবা প্রিতম দত্ত বলে, তোমরা কত দিন এ দেশে এসেছ?

মজিদ বলে, আমরা প্রায় ৪০ বছর এ দেশে আছি। তোমার কয় ছেলেমেয়ে এবং ওরা কি কাছাকাছি থাকে?

না, ওরা কাছাকাছি থাকে না। আমাদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। তারা সবাই আলাদা থাকে। সিনিয়র হোমে সব ধরনের সুবিধা রয়েছে। সপ্তাহে একবার ডাক্তার এসে রোগী দেখে যায়। পাশেই শপিং প্লাজা এবং যখন যা দরকার নিয়ে আসতে পারি। এখানে থাকতে থাকতে আমাদের অনেক বন্ধু হয়েছে এবং আমরা একাকিত্ব মনে করি না। ছেলেমেয়ে-নাতি-নাতনিরা এসে খোঁজ খবর নিয়ে যায় এবং বড় ধরনের গ্রোসারি কিনে ফ্রিজে ভর্তি করে রেখে যায়। আমাদের কোনো কিছুরই অভাব হয় না। প্রিতম দত্ত বলে, দেশে কি যাওয়া হয়?

মজিদ বলে, বাংলাদেশে অনেক দিন পরপর একবার গিয়ে আত্মীয়স্বজনদের দেখে আসি।

মজিদ বলে, তোমরা কবে এবং কীভাবে এ দেশে এলে?

প্রিতম দত্ত বলে, আমি এ দেশে ১৯৮৪ সালে এসেছি। আমি বিদেশি শিপে কাজ করতাম এবং হ্যালিফ্যাক্স, কানাডা শিপ এলে আমরা কয়েকজন শিপ থেকে নেমে পড়ি ও রাজনৈতিক আশ্রয় নিই। কথা প্রসঙ্গে সে বলে, শিপে অন্য শ্রমিকদের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল না। অনেকে কাজ না করে তাদের কাজ আমার ওপর চাপিয়ে দিত। এ নিয়ে ওপরস্থ লোকদের কাছে অভিযোগ করেও কোনো কাজ হতো না। এর জের ধরে অন্যরা আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করত। প্রিতম দত্ত বলে, এসব করুণ কাহিনি। ইতালি শিপ নিয়ে গেলে কিছু লোক চোরাচালান মালামাল নিয়ে ধরা পড়লে আমাকেও ষড়যন্ত্র করে বিপদে ফেলে এবং দেশে পাঠিয়ে দেয়। কোর্টে মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে ফাঁসাতে চেষ্টা করলেও ভগবানের কৃপায় পারেনি। জজ আমাকে বেকসুর খালাস দেন। কেস থেকে খালাস পেলে আমি আর এ শিপে না এসে অন্য শিপে কাজ নিয়ে চলে যাই। আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, যে করেই হোক আমেরিকা, কানাডা অথবা অস্ট্রেলিয়ায় শিপ গেলে নেমে পড়ব। শিপ হ্যালিফ্যাক্স, নোভাস্কোশিয়া, কানাডা এলে অন্যদের সঙ্গে কানাডায় আশ্রয় নিই। কানাডায় কাগজ হওয়ার পর দেশে গিয়ে বিয়ে করে স্ত্রীকে নিয়ে আসি। জীবনের কিছু করুণ কাহিনি তোমাদের বললাম। মজিদ ও রাবেয়া শুনে বলে, সবার জীবনেই কিছু না কিছু দুঃখের কাহিনি থাকে।

প্রিতম বলে, আমাদের অতি আদরের একমাত্র মেয়ে শুচিতা। সে ছাড়া আমাদের দেখাশোনা করার আর কেউ নেই। শুচিতা ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা করে কোনো একটা প্রতিষ্ঠানে সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করে। সে কিছু দিন হয় তার লাইনে সরকারি কাজ পেয়েছে; তবে পোস্টিং অটোয়ায়। এ নিয়ে আমাদের সঙ্গে মতের গরমিল; আমরা বাবা-মা তাকে দূরে পাঠাতে চাই না। সে তোমাকে দাদা বলে ডাকে এবং কাউন্সেলিং করার জন্য আমাদের এনেছে।

মজিদ বলে, আজকাল মেয়েরা অনেক দূরে একা গিয়ে কাজ করে। আমার তিন নাতনি রয়েছে যারা মা-বাবার সঙ্গে থাকে না। একজন আমেরিকা, একজন অটোয়া ও একজন হ্যামিলটনে কাজ করে। শুচিতা মজিদকে দাদা বলে সম্বোধন করে। সে বলে, আমি দুই সপ্তাহ অন্তর টরন্টোয় তোমাদের দেখতে আসব। অনেক আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে শুচিতা অটোয়া যাবে এবং ভালো কাজ পেলে টরন্টো চলে আসবে।

শুচিতা বলে, দাদা, ভালো চাকরি সব সময় পাওয়া যায় না। আমি বুঝি মা-বাবা একা হয়ে যাবে এবং সে জন্য আমাকে যেতে দিতে চায় না। কিন্তু সুযোগ সব সময় আসে না।

মজিদ বলে, এটা তোমার মা-বাবা ও তোমার সিদ্ধান্ত, আমরা এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না। তবে আমার ছেলেমেয়ে কেউ আমাদের কাছাকাছি থাকে না। আজকাল টেলিফোন, ফেসবুকের যুগ, সবই মনে হয় নিকটে। মজিদ বলে, তোমরা কি বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখো?

শুচিতার বাবা প্রিতম বলে, ফরিদপুর বাংলাদেশে তাদের আত্মীয়স্বজন, ওদের সঙ্গে তাদের নাড়ির টান রয়েছে। ওরা যাওয়া-আসা না করলেও আমরা সব সময় টেলিফোন করে খোঁজখবর নিই।

পরের সপ্তাহে শুচিতা তার নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছে এবং টেলিফোন করে মজিদ ও তার স্ত্রীকে জানিয়েছে যে তার অফিসে কয়েকজন বাংলাদেশি বন্ধু পেয়েছে, যারা তাকে বাসা গোছানোর কাজে অনেক সাহায্য করেছে। শুনে মজিদ ও তার স্ত্রী অনেক খুশি।

শুচিতা সুন্দরী ফর্সা, লম্বা, ডান গালে তিলক-মিষ্টি করে হাসে, একনজর দেখলে যেকোনো লোকই আর একবার ফিরে দেখে। শুচিতা অতি বুদ্ধিমতী, তার চলাফেরা ও কথাবার্তার মধ্যে রয়েছে মার্জিত স্বভাব। ইউনিভার্সিটি জীবনের প্রথম বর্ষে তার বন্ধুবান্ধব সুমিত, আজিজ, মনিকা গ্রুপ করে পড়াশোনা করতো। শুচিতার স্বপ্ন ছিল ভালো রেজাল্ট করে এই প্রতিযোগিতার বাজারে কাজে যোগদান করা। ভোরে ঘর থেকে শুচিতা বের হতো, ক্লাস, লাইব্রেরি, ল্যাব শেষ করে অনেক রাত করে ঘরে ফিরতো। উইকেন্ড ও ছুটির দিনেও সে পড়াশোনা নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখতো। শুচিতার এ ব্যস্ততা দেখে প্রিতম ও আভা খুবই আনন্দিত ছিল। শুচিতা একমাত্র মেয়ে, ওদের যত কিছু ভাবনা শুচিতাকে ঘিরে। তার বড় হয়ে ওঠা, পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করবে; একদিন বিয়ে করে চলে যাবে স্বামীর সংসারে। মা-বাবার ভাবনা, বৃদ্ধ বয়সে নাতি-নাতনি নিয়ে সময় অতিবাহিত করা।

শীতের রাতে মেয়ে ঘরে ফিরতে কষ্ট হবে ভেবে প্রিতম ও আভা আস্তে আস্তে বরফ ঠেলে ইউনিভার্সিটি পার্কিং লটে গিয়ে অপেক্ষা করতো। চারদিকে সাদা তুলার মতো তুষার পড়ে বরফ হচ্ছে। মিউনিসিপ্যালিটির লোক রাস্তা প্রতিনিয়ত স্নো ব্লোয়ার দিয়ে পরিষ্কার করছে। মাইনাস ট্যাম্পারেচারে অতিদ্রুত বরফ হয়ে পথ পিচ্ছিল করে দেয়। লবণ না দিলে রাস্তায় হাঁটা ঝুঁকি হয়ে পড়ে। স্বাভাবিক জুতা পরে রাস্তায় বের হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বুট, উলেন কোট, মাথায় উলেন টুপি, মোটা উলেন মোজা, গলায় উলেন কাপড়, হাতে উলেন গ্লে­াভস পরে বের হতো প্রিতম ও আভা। গাড়িতে হিট দেওয়া থাকতো। এই ঠান্ডার মধ্যে মা-বাবা গাড়িতে হিট দিয়ে একমাত্র অতি আদরের মেয়ের জন্য অপেক্ষা করে বসে তাকিয়ে থাকতো, কখন মেয়ে আসবে আর ঘরে নিয়ে যাবে। এভাবেই টরন্টোর ব্যস্ত জীবন কেটে যায় প্রিতম, আভা ও শুচিতার। প্রিতম ও আভার স্বপ্ন মেয়ে বড় হয়েছে, দেখতে সুন্দর, ভালো ছেলে দেখে, আনন্দ ও হইচই করে বিয়ে দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব শেষ করবে। তবে হ্যাঁ, মেয়েকে দূরে যেতে দেবে না। সে একমাত্র মেয়ে, তাকে ছাড়া প্রিতম ও আভা কীভাবে বেঁচে থাকবে!

দেখতে দেখতে চার বছর শেষ হয়ে গেল। শুচিতা ইউনিভার্সিটি থেকে ভালো গ্রেড নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেছে। প্রিতম ও আভা বলে, তুমি স্কুল টিচিং জবের জন্য চেষ্টা করো, স্কুল জব সম্মানজনক, আমরা পছন্দ করি।

শুচিতা বলে, বাবা, আমি টিচিং জব পছন্দ করি না। আমি প্রাইভেট কাজ নিয়ে শুরু করব এবং পরে সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করব। মা-বাবা বলে, আমাদের মনের ইচ্ছা, তাই বললাম, তুমি যা ভালো মনে করো। শুচিতার বান্ধবী মনিকা সরকারি চাকরি নিয়ে অটোয়া চলে গেছে। ছয় মাসের মধ্যে তারই ক্লাসমেট আজিজকে বিয়ে করে সংসারি হয়েছে। আভা একদিন শুচিতাকে নীরবে ডেকে বলে, তোমার বাবা দুই বছরের মধ্যে অবসর নেবে। আমি ছোটখাটো কাজ করি, তুমি প্রাইভেট বা সরকারি কাজ করো, টরন্টো থাকতে চেষ্টা করবে। শুচিতা বলে, আমি টরন্টো থাকতে চেষ্টা করব; তবে আমাকে বাইরে পোস্টিং দিলে আমি যাব।

মনিকা চলে যাওয়ার চার-পাঁচ মাস পর শুচিতা সরকারি চাকরি পেয়ে অটোয়া যাইতে চাইলে, প্রিতম ও আভা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করে, তুমি অটোয়া চলে গেলে আমরা একা হয়ে যাব। তুমি বরং এখানে কোনো সরকারি চাকরি নিতে চেষ্টা করো। শুচিতা বলে, বাবা, চাকরি চাইলেই পাওয়া যায় না।

শুচিতা চাকরি নিয়ে অটোয়া মুভ করে। শুচিতা, মনিকা ও আজিজের অফিস এক বিল্ডিং, বাসা ১০ মিনিটের হাঁটাপথ। ওরা একই বিল্ডিংয়ে থাকে, পাশাপাশি অ্যাপার্টমেন্টে।

এটা ডিসেম্বর মাস, সে রাতে শুচিতা আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখেনি। সকালে সামান্য তুষারপাত শুরু হয়েছে, সে হেঁটে অফিসে চলে গেছে। আজ মনিকা ও আজিজ কাজে আসেনি, হয়তো ছুটি নিয়েছে। দীর্ঘ সময় সে বাইরে খেয়াল করেনি। বিকেলে অফিস সেরে শুচিতা বিল্ডিংয়ের বাইরে এসে প্রচণ্ড বরফ দেখে ভয় পেয়ে যায়। ভাবে কীভাবে বাসায় পৌঁছাবে?

মনিকা ও আজিজ বাসা থেকে আজ কাজে আসেনি। ওরা অতিরিক্ত তুষারপাতের পূর্বাভাস পেয়ে হয়তো সিক লিভ নিয়েছে। সে ট্যাক্সি ডেকে বাসায় এসে কাপড় ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে মনিকাকে টেলিফোন করে বলে, তোমরা আজ কাজে যাওনি জানলে আমিও যেতাম না। আজ অফিস খুবই কম অ্যাটেনডেন্স ছিল। মনিকা জিজ্ঞেস করে, তুমি কী খাবে?

শুচিতা বলে, ফ্রিজে কালকের খাবার আছে, আমি হাত-মুখ ধুয়ে মাইক্রোওয়েভে গরম করে খেয়ে নেব। মনিকা বলে, তুমি হাত-মুখ ধুয়ে তৈরি থেকো, আমি গরম গরম খাবার নিয়ে আসছি। শুচিতা বলে, আমার পুরোনো খাবার আছে, তোমার আবার পরিশ্রম করার দরকার কী?

মনিকা চিকেন কারি ও বাসমতি চালের পোলাও, নান রুটি ও সালাদ নিয়ে দরজা নক করে, তুমি অনেক কষ্ট করে অফিস থেকে এসেছ। বসে বসে টেলিভিশন দেখো ও খাওয়া শেষ করে ঘুমাতে যাও। শুচিতা বলে, আমি এত সকাল সকাল ঘুমাতে যাই না।

শুচিতা বলে, তুমি কি খাওয়াদাওয়া করেছ?

না, এখন পর্যন্ত করিনি। শুচিতা বলে, আমি আজ অফিসে না গেলেও হতো। মনিকা বলে, ঠিক আছে, কেউ না কেউ অফিসে যাওয়া দরকার। কাজ বেশি করিনি, শুধু বসে বসে গল্প করেছি। বাসায় একা একা বসে ক্লান্ত হয়ে যেতাম। মনিকা বলে, আচ্ছা, আমি যাই, আজিজ খাওয়ার জন্য বসে আছে।

শুচিতাকে টরন্টোর বাসা থেকে তার মা কল করেছে। শুচিতা, তুই কেমন আছিস?

মা, ভালো।

তুই কি আজ কাজে গিয়েছিলি?

হ্যাঁ, আমি গিয়েছি মা। তোমরা কেমন আছ? বাবা কী করে?

আমরা ভালো আছি। তোর বাবা কী আর করবে, বসে বসে টেলিভিশন দেখে। এত স্নোর মধ্যে না গেলেও পারতে।

মা, যত অসুবিধাই হোক, কাজে তো অবশ্যই যেতে হয়। তা বুঝলাম। তুই বড় কর্তব্যপরায়ণ।

শুচিতা হা হা হা করে হাসে।

কী রান্না করেছিস?

না মা, আমি আজ রান্না করিনি। কালকের খাবার আছে, তা ছাড়া মনিকা গরম পোলাও, চিকেন কারি, নান রুটি, সালাদ দিয়ে গেছে।

ঠিক আছে খাও।

তোমরা কি খাওয়াদাওয়া করেছ?

আমরা তো সন্ধ্যা হলেই খেয়ে নিই। ঠিক আছে মা, ভালো থেকো। শুচিতা টেলিফোন রেখে দিয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে বসে। (চলবে)

নজরুল ইসলাম

টরন্টো