কানাডার বৃহৎ গ্রোসারীর মালিকেরা লাগামহীন মুনাফা করে যাচ্ছেন আর এক-চতুর্থাংশ মানুষই প্রয়োজনের চেয়ে কম খাবার খাচ্ছেন

সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম কানাডায়ও!

খুরশিদ আলম

করোনা মহামারী আর রাশিয়া – ইউক্রেনের যুদ্ধের দোহাই দিয়ে কানাডার সুবিশাল গ্রোসারী স্টোরগুলোর মালিকেরা খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে গত প্রায় চার বছর ধরেই কানাডার ক্রেতাসাধারণ ঐ গ্রোসারীগুলো থেকে বর্ধিত মূল্যে খাবার ক্রয় করছেন বাধ্য হয়ে। অথবা খাবার কম কিনছেন কিংবা বর্ধিত মূল্যের খাবার একেবারেই কিনছেন না। সুবিশাল এই গ্রোসারীগুলোর মধ্যে আছে Loblaw, Metro, Empire, Walmart এবং Costco. 

মহামারী আর যুদ্ধের কারণে একটি দেশে মূল্যস্ফীতি বা অর্থনীতি খারাপের দিকে গেলে সকলেরই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা। কিন্তু আশ্চর্যভাবে আমরা লক্ষ্য করছি, সাধারণ মানুষ যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কানাডার সুবিশাল গ্রোসারীর মালিকেরা প্রতিকূল এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে লাগামহীন মুনাফা করে যাচ্ছেন! এটি কি করে সম্ভব? আর সরকারই বা কি করছে এই মুনাফাখোরদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য?

কানাডায় মূল্যস্ফীতি বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য পরিস্থিতির কোন উন্নতি না দেখে এ কথা সহজেই মনে করা যেতে পারে যে, সরকার বস্তুত কিছুই করেনি সুবিশাল গ্রোসারী মালিকদের মুনাফালোভকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। আর এর মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ ক্রেতাদেরকে যাদের আয় সীমিত বা ক্রয়ক্ষমতা সীমিত। নিয়ন্ত্রণহীন অর্থনৈতিক চাপের মুখে পড়ে সাধারণ মানুষের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। কানাডার প্রায় অর্ধেক অধিবাসীই এই দলে পড়েন। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় এমনটিই দেখা গেছে। কানাডায় আর্থিক পরিকল্পনা বিষয়ক গবেষণা কোম্পানি ‘FP Canada’ ২০২৩ সালে কানাডার আর্থিক চাপ সূচক বিষয়ে এক সমীক্ষা করেছে। কানাডার বৃহত্তম বাজার গবেষণা এবং বিশ্লেষণ কোম্পানী Leger এর অনলাইন প্যানেল ব্যবহার করে সম্প্রতি ২,০০৪ জন কানাডিয়ানের মধ্যে একটি জরিপ চালানো হয়। জরিপে অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে ছিলেন বিভিন্ন জাতিগত ও সাংস্কৃতিক পটভূমির লোকজন যাতে করে জরিপের ফলাফলে সকলের অবস্থার প্রতিফলন নিশ্চিত করা যায়।

জরিপে দেখা যায়, ৪০ শতাংশ কানাডিয়ানের জন্য অর্থই মানসিক চাপের প্রধান কারণ এখন। এবং দেখা গেছে প্রায় অর্ধেক (৪৮ শতাংশ) কানাডিয়ান আর্থিক চাপের কারণে ঠিকমত ঘুমাতে পারছেন না। এর ফলে প্রতি তিনজনে একজন (৩৬ শতাংশ) কানাডিয়ান উদ্বেগ অথবা বিষণ্নতার মত মানসিক সমস্যার মুখে পড়ছেন।

গত প্রায় চার বছর ধরেই কানাডার ক্রেতাসাধারণ গ্রোসারী থেকে বর্ধিত মূল্যে খাবার ক্রয় করছেন বাধ্য হয়ে। অথবা খাবার কম কিনছেন কিংবা বর্ধিত মূল্যের খাবার একেবারেই কিনছেন না।! ছবি : প্রবাসী কণ্ঠ

‘FP Canada’র প্রেসিডেন্ট এবং সিইও তাসিয়া ব্যাটস্টোন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, ‘কানাডিয়ানরা তাদের আর্থিক অবস্থার সঙ্গে অব্যাহতভাবে সংগ্রাম করছেন এবং আর্থিক চাপের প্রভাব কেবল আর্থিক কল্যাণের উপরেই নয় বরং মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও পড়তে পারে।’

সাম্প্রতিককালে কানাডিয়ানদের আর্থিক চাপের পেছনে বড় কিছু উপাদানের ভূমিকা রয়েছে। সেই উপদানগুলো হলো ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি এবং পেট্রোল ও ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি।

অন্য এক খবরে বলা হয়, মূল্যস্ফীতির কারণে কানাডায় প্রায় এক-চতুর্থাংশ লোক খাবার কম খাচ্ছেন। গত বছর পরিচালিত এক সমীক্ষায় এই তথ্য উঠে এসেছিল। ঐ সমীক্ষায় বলা হয়, পাস্তা, রুটি এবং মাংশের মত নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় কানাডার ক্রমবর্ধমান সংখ্যক মানুষ কষ্টেসৃষ্টে চলছেন। ফুড ব্যাংকস কানাডার এই সমীক্ষায় আভাস পাওয়া যায়, দেশজুড়ে ক্ষুধা ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। আর মূল্যস্ফীতির কারণে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্বল্পআয়ের কানাডিয়ানরা। দি কানাডিয়ান প্রেস এর এক খবরে এই কথা বলা হয়।

মেইনস্ট্রিট রিসার্চ নামের এক সংগঠনের পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, কানাডিয়ানদের মধ্যে প্রায় এক-চতুর্থাংশই প্রয়োজনের চেয়ে কম খাবার খাচ্ছেন। কারণ খাবার কেনার মত যথেষ্ট অর্থ নেই তাদের কাছে। আর বছরে যারা ৫০ হাজার ডলারের কম উপার্জন করেন এমন কানাডিয়ানদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ।

পাশাপাশি ফুড ব্যাংকগুলোও তাদের সামর্থ হারিয়েছে। ক্রিসটিন বিয়ার্ডস্লি বলেন, ফুড ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগই এরই মধ্যে তাদের সামর্থের সীমা পেরিয়ে এসেছে। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘কানাডার বেশিরভাগ অঞ্চলের ফুড ব্যাংকগুলোতে প্রথমবারের মত আসা কানাডীয়দের জোয়ার দেখা যাচ্ছে-  কিছু অঞ্চলে এধরণের মানুষের সংখ্যা ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।’

মূল্যষ্ফীতির কারণে সৃষ্ট কষ্টের সংবাদ আরো আছে। ইতিপূর্বে সিবিসি নিউজের এক খবরে বলা হয়, ২০২১ সালে কানাডার প্রায় ৫.৮ মিলিয়ন মানুষ কোনও না কোনও ধরণের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হন। সেই সময় প্রকাশিত টরন্টো ইউনিভার্সিটির গবেষকদের এক নতুন সমীক্ষা থেকে এই তথ্য জানা যায়। ঐ পরিসংখ্যানে ১.৪ মিলিয়ন শিশুও অন্তর্ভুক্ত ছিল। ‘কানাডায় পরিবারগুলোর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা’ শিরোনামের ওই সমীক্ষায় বলা হয়, দেশের ১০টি প্রদেশের সব কয়টি মিলিয়ে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়া পরিবারের সংখ্যা ১৫.৯ শতাংশে। সমীক্ষায় পুরো মহামারিকাল ও তার পরবর্তী বর্তমান রেকর্ড পরিমাণ মূল্যস্ফীতির সময় পর্যন্ত দেশের প্রদেশগুলিতে খাদ্য নিরাপত্তহীনতার হার পর্যবেক্ষণ করা হয়। আর গবেষকরা দেখেছেন, গত তিন বছরে সমস্যার খুব একটা উত্তরণ ঘটেনি। টরন্টো ইউনিভার্সিটির টেমার্টি ফ্যাকাল্টি অব মেডিসিনের পুষ্টিবিজ্ঞানের প্রফেসর ভ্যালেরি তারাসুক বলেন, ‘কানাডায় স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার কোনও স্পষ্ট উন্নতি আমরা দেখতে পাইনি।’

সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, খাদ্য নিরাপত্তহীনতার ক্ষেত্রে প্রদেশগুলোর মধ্যে বড় ধরণের ব্যবধান রয়েছে; কুইবেকে ১৩.১ শতাংশ পরিবার এবং আলবার্টায় ২০.৩ শতাংশ পরিবারের মধ্যে নানা মাত্রায় খাদ্য নিরাপত্তহীনতা বিদ্যমান। আর সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তহীনতা ও গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তহীনতা এই উভয় বিষয় বিবেচনায় নিলে টরন্টোর অবস্থান হয় মাঝামাঝিতে।

অন্টারিওতে ২০২১ সালে প্রতি ছয়টির মধ্যে একটি বা ১৬.১ শতাংশ পরিবারের খাদ্য প্রাপ্তি ছিল অনিরাপদ, যা সংখ্যায় ২.৩ মিলিয়ন মানুষের সমান। একইভাবে এই প্রদেশের ৪.৬ শতাংশ বা দুই লাখ ৫৯ হাজার পরিবার মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তহীনতার মুখে পড়ে। এর অর্থ হলো, পরিবারের সদস্যরা কিছু বেলায় না খেয়ে থেকেছেন, খাওয়ার পরিমাণ কমিয়েছেন অথবা টাকার অভাবে দিনের পর দিন কিছু কিছু খাবার না খেয়েই কাটিয়েছেন। গবেষকরা আরো বলেন, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার উচ্চ হার অব্যাহত রয়েছে এবং মানুষের স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর প্রভাবের দিক থেকে এটি “গভীর উদ্বেগের” বিষয়। তারা মনে করেন, মানুষের আয় যদি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ হয় তাহলে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা আরও মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।

এদিকে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য পরিস্থিতির কোন উন্নতী না হওয়ায় ফেডারেল সরকার সম্প্রতি কিছুটা নড়েচড়ে বসেছেন বলে মনে হয় আপাতদৃষ্টিতে। সরকার প্রধান জাস্টিন ট্রুডো কানাডার বৃহৎ গ্রোসারীর প্রধান নির্বাহীদের অটোয়াতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন খাদ্যদ্রব্যের মূল্য কিভাবে স্থিতিশীল করা যায় তার একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়ে আসার জন্য। তিনি হুমকীও দিয়েছিলেন এই বলে যে, মধ্য ও নিম্ন-বিত্ত কানাডিয়ানদের জন্য ‘প্রকৃত উপশম’ হিসাবে কাজ করে এমন একটি পরিকল্পনা নিয়ে আসতে ব্যর্থ হলে সরকার একশনে যাবে। প্রয়োজনে টেক্স আরোপের হুমকীও দেন তিনি গ্রোসারীর মালিকদের উপর।

সম্প্রতি লন্ডন অন্টারিওতে এক সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে জাস্টিন ট্রুডো আরো বলেন, ‘এটার কোন মানে হয় না যে কানাডার মত একটি দেশে সাধারণ মানুষ প্রতিদিন প্রয়োজনীয় খাবার যোগার করতে গিয়ে কঠিন লড়াই করে যাচ্ছে, ফুড ব্যাংকে লম্বা লাইন তৈরী হচ্ছে, আর অন্যদিকে গ্রোসারীগুলো রেকর্ড মুনাফা করে যাচ্ছে।’

উল্লেখ্য যে, কানাডার বৃহৎ গ্রোসারীর মালিকদের বিরুদ্ধে আগেও অভিযোগ উঠেছিল যে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির সুযোগে তারা মুনাফা লুটে নিচ্ছে। তবে Loblaw, Metro এবং Empire এর কর্তৃপক্ষ তখন পার্লামেন্ট কমিটির সামনে সেই অভিযোগ অস্বীকার করেন। 

গত ১৮ সেপ্টেম্বর অটোয়ায় অনুষ্ঠিত মিটিং-এ তারা একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন। তারা নাকি মূল্যষ্ফীতির সুযোগে লাভ করছেন না।

প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর আহ্বানে কানাডার বৃহৎ গ্রোসারীর প্রধান নির্বাহীরা গত ১৮ সেপ্টেম্বর অটোয়ায় ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী ও অর্থ মন্ত্রী Chrystia Freeland এবং শিল্প মন্ত্রী François-Philippe Champagne’র সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে শিল্প মন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া-ফিলিপ সাংবাদিকদের বলেন, কানাডার পাঁচটি বৃহত্তম গ্রোসারি চেইনের প্রধানরা খাদ্যের মূল্য স্থিতিশীল করতে ফেডারেল সরকারের সাথে ‘কাজ করতে সম্মত হয়েছেন’।

ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড ও ফ্রাঁসোয়া-ফিলিপ Loblaw, Sobeys, Metro, Costco এবং Walmart এর প্রধানদের সঙ্গে দুই ঘন্টার এক বৈঠকে বসেছিলেন। ফ্রিল্যান্ড অবশ্য বৈঠকে বেশিক্ষণ ছিলেন না। বৈঠক শুরুর পর কয়েক মিনিট পরেই উনি চলে যান।

ফ্রাঁসোয়া-ফিলিপ সাংবাদিকদের আরো বলেন আমি আমাদের আলোচনার গঠনমূলক প্রকৃতির প্রশংসা করি। শেষ কথা হলো, গ্রোসারীর মালিকরা কানাডায় খাদ্যের মূল্য স্থিতিশীল করতে সরকারের সথে কাজ করতে সম্মত হয়েছেন। এ জন্য তারা একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করবেন আগামী থ্যাংসগিভিং ডে এর আগে।

উল্লেখ্য যে, বাজার দর নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো দিন কয়েক আগে ‘কম্পিটিশন এ্যাক্ট’ এ কিছু সংশোধন আনার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। এই সংশোধনীগুলো বাস্তবায়িত হলে গ্রোসারীগুলোকে তথ্য প্রদানে বাধ্য করা যাবে। এছাড়াও কোম্পানীগুলোর মধ্যে একীভূতকরণ সীমিত করা হবে যাতে সেবা বা পন্যমূল্যের প্রতিযোগিতা বিলুপ্ত না হয় এবং বৃহৎ গ্রোসারীগুলো যাতে ক্ষুদ্র প্রতিযোগিদের অনাহারে না রাখতে পারে তারও ব্যবস্থা করা হবে।

এদিকে ফেডারেল ‘নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি’র (এনডিপি) প্রধান নেতা জাগমিত সিং বৃহৎ গ্রোসারীর প্রধান নির্বাহীদেরকে ‘লোভী’ আখ্যায়িত করে বলেছেন তাঁরা মূল্যস্ফীতির দোহাই দিয়ে পন্যসামগ্রীর মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা এমন একটি আইনের প্রস্তাব করছি যা কানাডায় অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতাকে শক্তিশালী করবে, যা পন্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি এবং উদ্দেশ্যমুলক মূল্য নির্ধারণকে ঠেকাবে। একই সাথে এই আইন কোম্পানী একীভূতিকরণ প্রক্রিয়ার অবসান ঘটাবে যাতে করে ব্যবসায় মনোপলি বা একচেটিয়া কতৃত্ব করতে না পারে কেউ।

জাগমিত সিং আরো বলেন, বৃহৎ গ্রোসারীর মালিকদেরকে পন্যের মূল্য স্থিতিশীল করতে বলা ‘হাস্যকর’ বিষয়। তাঁদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে, আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। 

অবশ্য Retail Council of Canada পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, অটোয়ায় গত ১৮ সেপ্টেম্বর যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে তা ছিল গঠনমূলক এবং তথ্যপূর্ণ। এই কাউন্সিল কানাডার বৃহৎ গ্রোসারীগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে। এই কাউন্সিলের একজন মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমাদের সদস্যরা খাদ্য শিল্প, মুদ্রাস্ফীতি এবং ক্রয়ক্ষমতার বিষয়ে সরল বিশ্বাসের সংলাপে অংশ নিতে সর্বদা প্রস্তুত।’

এখন কথা হলো, সংলাপে অংশ নিলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? এই অতিধনী ব্যবসায়ীরা মুখে বলছে ‘সরল বিশ্বাস’ এর কথা। কিন্তু কতটুকু ‘সরল’ তাদের অন্তর?

কানাডার একটি পার্লামেন্টারী কমিটি গত মার্চ মাসে বলেছিল যে কানাডার কম্পিটিশন ব্যুরো যদি দেখে যে গ্রোসারীর মালিকেরা খাদ্য মূল্যস্ফীতি থেকে অত্যধিক মুনাফা করছে তবে সরকারের উচিত হবে এদের উপর অতিরক্তি ট্যাক্স আরোপ করা।

আর কম্পিটিশন ব্যুরো গত জুন মাসে তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে বলেছে যে, কানাডায় গ্রোসারী ব্যবসায় যথেষ্ট প্রতিযোগিতা নেই। তিনটি বৃহৎ দেশীয় কোম্পানীর আধিপত্য রয়েছে এই খাতে। এই অধিপত্য বা প্রতিযোগিতাহীন পরিস্থিতি বদলানোর জন্য বাজারে নতুন প্রতিযোগিদের আগমন ঘটনো প্রয়োজন যাতে করে গ্রোসারী ব্যবসায় মূল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে।

কয়েক মাস তদন্ত করে কানাডার কম্পিটিশন ব্যুরো এই উপসংহারে পৌঁছেছে যে, এখানকার গ্রোসারী ব্যবসা প্রধানত তিনটি দেশীয় কোম্পানী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এগুলো হলো Loblaw, Metro এবং Sobeys. পাশাপাশি বিদেশী দুটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠানও আছে যারা এই প্র্যাক্টিসের সঙ্গে জড়িত। এরা হলো Walmart এবং Costco.

এরা যে মহামারী আর যুদ্ধের দোহাই দিয়ে আকাশচুম্বী মুনাফাই করছে তা নয়, নিজেদের কর্মীদের বেতনের বেলায়ও কার্পন্য করছে। কয়েক সপ্তাহ আগে মেট্রো গ্রোসারীর কর্মীরা ধর্মঘটে গিয়েছিলেন বেতন বৃদ্ধির দাবীতে। প্রায় পাঁচ সপ্তাহ স্থায়ী ছিল ঐ ধর্মঘট। এই সময়ে মেট্রোর স্টোরগুলো বন্ধ ছিল।

আবার কানাডায় বৃহৎ কোম্পানীর মালিকরা সিন্ডিকেট তৈরী করে প্রচুর মুনাফা লুটে নিয়েছে এমন প্রমাণও আছে। গত ২১ জুন দি কানাডিয়ান প্রেস এর এক খবরে বলা হয়, রুটি প্রস্তুতকারী বৃহৎ প্রতিষ্ঠান Canada Bread Co কে সিন্ডিকেট তৈরী করে মূল্য স্ফীতি ঘটানোর কারণে ৫০ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করা হয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই তারা কারসাজির মাধ্যমে রুটির মূল্য বাড়িয়ে বাজারে বিক্রি করে আসছিল। কম্পিটিশন ব্যুরো অফ কানাডা জানায়, অবৈধ প্রাইজ ফিক্সিং এর দায়ে দেশের আদালতে এটি ছিল এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ পরিমাণের জরিমানা।

কানাডার বৃহৎ গ্রোসারীর মালিকেরা কিভাবে ক্রেতাদের কাছ থেকে অধিক মুনাফা আদায় করে তার আরেকটি নমুনা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। চলতি সেপ্টেম্বর মাসের ৯ তারিখে সিটিভি নিউজ একটি খবর প্রকাশ করে যেখানে দেখা যায়- বেশ কয়েকটি পণ্য Dollarama -তে যে দামে বিক্রি করা হচ্ছে, Loblaws এ সেই একই কোম্পানীর পণ্য কয়েকগুণ বেশী দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এমন নয় যে, পণ্যগুলো ভিন্ন কোম্পানীর তৈরী বা উন্নত মানের। এর একটি উদাহরণ হলো Italpasta spaghetti. ৪৫০ গ্রামের এই পণ্যটি Dollarama-তে বিক্রি হচ্ছে এক ডলারে। আর Loblaws এ বিক্রি হচ্ছে ৪.৪৯ ডলারে! অর্থাৎ চারগুনেরও বেশী দামে! রুটিও বিক্রি হচ্ছে অনেক বেশী দামে। Dollarama-তে ৬৭৫ গ্রামের সাদা Wonder Bread বিক্রি হচ্ছে ২.৫০ ডলারে আর ঠিক একই রুটি Loblaws এ বিক্রি হচ্ছে ৩.৯৯ ডলারে।

আসলে সার্বিক বিবেচনায় এখন এ কথা বলা যায় যে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে এবং একই সঙ্গে অসম মূল্য পরিস্থিতির কারণে কানাডার সাধারণ আয়ের মানুষ ভাল নেই। দেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ এখন জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে পারছে না। মূল্যস্ফীতি অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকায় প্রতি ১০ জনে সাত জনই বলেছেন, তারা অর্থকড়ির ব্যাপারে চাপে আছেন। এঙ্গুস রেইডের রিপোর্টে বলা হয়, দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকায় কানাডিয়ানদের পারিবারিক বাজেট সব দিক থেকেই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে।

এঙ্গুস রেইডের সমীক্ষায় আরো দেখা গেছে, ৫৩ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তারা জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। জরুরী ব্যয়ের প্রসঙ্গে ৫১ শতাংশ উত্তরদাতা বলেন, হঠাৎ কোনও কারণে ১০০০ ডলারের বাড়তি ব্যয়ের প্রয়োজন দেখা দিলে তারা সেটা বহন করতে পারবেন না। এর মধ্যে ১৪ শতংশ উত্তরদাতা রয়েছেন যারা বলেন, কোনওরকম জরুরী প্রয়োজন পূরণেরই সামর্থ তাদের নেই।

যেসব পরিবারে শিশু রয়েছে তারা বিশেষভাবে আর্থিক চাপ বোধ করেন। এরা পরিবারের খরচ ও সঞ্চয়ের পরিমাণে কাটছাঁট করেন। প্রায় ৪০ শতাংশ বাবা-মা বলেন, শিশুর পরিচর্যার ব্যয় নিয়ে তারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন।

আসলে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন কানাডার সাধারণ আয়ের সব মানুষই। আর যাদের আয় আরো সীমিত তাঁদের অবস্থা আরো খারাপ। এই পরিস্থিতি থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্ত করতে না পারলে তা গোটা কানাডার জন্যই অমঙ্গলজনক হবে। এখন এই অতি ধনি এবং জাগমিত সিং এর ভাষায় লোভী গ্রোসারী মালিকদের কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। জনগণ এখন অপেক্ষায় আছেন ফেডারেল সরকার এই লোভী গ্রোসারী ব্যবসায়ীদের কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তা দেখার জন্য এবং একই সাথে আশায় বুক বেধে আছেন বাজার দর স্বাভাবিক হয়ে আসবে তা দেখার জন্য।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কণ্ঠ