এবার মক্কায় হজের সময় যে কারণে এতো মানুষ মারা গেছে

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : সৌদি আরবের মক্কায় এবার পবিত্র হজ পালন করতে গিয়ে এক হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর এদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষের মৃত্যু হয়েছে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের কারণে। হজের সময় এবার সৌদিতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।

বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়, হজে গিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৬৫৮ জন মিসরের নাগরিক। ইন্দোনেশিয়া বলেছে, তাদের দেশের ২০০–এর বেশি নাগরিক মারা গেছেন। ভারত বলেছে, তাদের ৯৮ নাগরিকের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে।

প্রতি বছর সৌদি আরবে হজ পালন করতে যান লাখ লাখ মুসলমান। বয়স এবং অতিমাত্রার তাপের কারণে কিছু লোক মারাও যান এই সময়।

তবে এবছরটা বাড়তি শোকাবহ হয়ে উঠেছে বহু মুসল্লির মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে।

সৌদি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে চলতি বছর প্রায় ১৮ লাখ ৩০ হাজারের মতো ব্যক্তি হজ করতে এসেছিলেন যার মধ্যে ১৬ লাখই এসেছিলেন বিদেশ থেকে।

উচ্চ তাপমাত্রা ছাড়াও আরো যে কয়টি কারণে এই বছরের এত বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার সেগুলো  খতিয়ে দেখেছে বিবিসি:

পবিত্র কাবা শরিফ তাওয়াফের সময় সূর্যের তাপ থেকে বাঁচতে ছাতা ব্যবহার করছেন হাজিরা। ১৯ জুনছবি: এএফপি

চরম তাপে উত্তপ্ত পরিস্থিতি

এবার সৌদি আরবে তাপমাত্রা ছায়ার মধ্যেই ৫১.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত গিয়েছে। এই পরিস্থিতিকেই একটা বড় কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় উচ্চতাপ ও পানিশূন্যতা এড়াতে সতর্কতা জারি করলেও অনেক হাজি তীব্র গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা এবং হিটস্ট্রোকের শিকার হয়েছেন।

এমন তাপের সাথে অভ্যস্ত না থাকা, কঠিন ধরণের শারীরিক কাজকর্ম, বিস্তীর্ণ খোলা জায়গা এবং হাজিদের অনেকে বয়স্ক বা অসুস্থ থাকায় হাজিদের জন্য ঝুঁকি থাকেই। অন্যদিকে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন যে বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে সামনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

ক্লাইমেট অ্যানালিটিক্সের কার্ল-ফ্রেডরিচ শ্লেউসনার রয়টার্স নিউজ এজেন্সিকে বিশ্বের তাপমাত্রার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তার গবেষণা অনুযায়ী শিল্প বিপ্লবের আগের সময়ের তুলনায় বিশ্বের তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি বাড়লে হজের সময় হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি পাঁচ গুণ বেড়ে যেতে পারে।

অব্যবস্থাপনা

অব্যবস্থাপনার কারণে গরমের চরম পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছিল।

অনেকে অভিযোগ করে বলছেন থাকার জায়গা বা সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থাপনার দিক দিয়ে ভালো ছিল না, ফলে তাঁবুগুলোতে অতিরিক্ত ভিড় এবং পরিচ্ছন্নতা সংক্রান্ত সুবিধার ঘাটতি ছিল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, মক্কার তাপে আমাদের তাঁবুগুলিতে কোনও এয়ার কন্ডিশনার ছিল না। যে কুলারগুলি বসানো হয়েছিল তাতে বেশিরভাগ সময় পানি ছিল না।”

কিছু হাজি অভিযোগ করেছেন যে কিছু তাঁবুতে শীতলীকরণ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত ছিল না।

“এই তাঁবুগুলি এতটা শ্বাসরুদ্ধকর ছিল যে আমরা ঘেমে ভিজে যাচ্ছিলাম এবং এটি একটি ভয়ানক অভিজ্ঞতা ছিল।”

পরিবহন সমস্যা

এবারের ভয়াবহ গরমের মধ্যে হজ করতে আসা লোকেরা প্রায়শই দীর্ঘ পথ হাঁটতে বাধ্য হয়েছেন। এজন্য অনেকে বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা আটকে দেয়া এবং খারাপ পরিবহন ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছেন।

একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাকিস্তানি হাজি বলেন, “আমাদের সাত কিলোমিটার দীর্ঘ পথে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল যেখানে কোনও পানি এবং ছায়া ছিল না। পুলিশ ব্যারিকেড বসিয়ে আমাদের অপ্রয়োজনীয়ভাবে দীর্ঘ দূরত্ব হাঁটতে বাধ্য করেছে।”

তিনি আরো বলেন, “ক্যাম্পে মানুষকে মুরগি বা খামারের পশুর মতো রাখা হয়েছিল, দুই বিছানার মাঝে দিয়ে যাওয়ার মতো জায়গা ছিল না, এবং কয়েকটি টয়লেট শত শত মানুষের জন্য যথেষ্ট ছিল না।”

বিলম্বিত চিকিৎসা সহায়তা

এবার হজ করতে আসা অনেক লোকই পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা পাননি বলে জানা গেছে। অনেকে বলছেন যারা তীব্র গরমে ক্লান্তি বা অন্যান্য স্বাস্থ্যসমস্যায় ভুগেছেন তাদের জন্য অ্যাম্বুলেন্স বা প্রাথমিক চিকিৎসা সহজে পাওয়ার উপায় ছিল না।

হজে আসা একজন অভিযোগ করে বলেন, শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে তার এক সহযাত্রীর অক্সিজেন প্রয়োজন ছিল, তখন তাদের মরিয়া অনুরোধ সত্ত্বেও অ্যাম্বুলেন্স আসতে ২৫ মিনিটেরও বেশি সময় লেগেছিল।

“অবশেষে, একটি অ্যাম্বুলেন্স এসেছিল এবং ডাক্তার তাকে দুই সেকেন্ডও দেখেননি এবং ‘তার কিছু হয়নি’ বলে চলে গেলেন,” তিনি যোগ করেন।

বয়োজ্যেষ্ঠ, রুগ্ন বা অসুস্থ তীর্থযাত্রী

উল্লেখ যে, অনেক ব্যক্তি জীবনের শেষের দিকে হজ করতে যান। এদের অনেকে আশা করেন যে মৃত্যু হলে যেন সেখানেই হয়। কারণ তাদের বিশ্বাস হজ পালনের সময় মারা যাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়। হজে প্রতি বছর মৃত্যুর এটি আরেকটি কারণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *