কানাডায় স্বপ্ন পূরণ করতে এসে দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিন কাটে অনেকের
খুরশিদ আলম
কানাডাকে অনেক সময় বলা হয়ে থাকে ‘Land of opportunity’। শুধু তাই নয়, অভিবাসীদের বসবাসের জন্য সেরা দেশ হিসাবেও বিবেচনা করা হয় কানাডাকে। কারণ, বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বে অভিবাসীদের প্রতি সবচেয়ে বেশী ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে কানাডিয়ানদের। নতুন অভিবাসীদেরকে তাঁরা বোঝা মনে না করে একটা শক্তি হিসাবে বিবেচনা করেন। অভিবাসীদের মধ্য থেকে এদেশে এমপি, মন্ত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হচ্ছেন এমন নজীরও আছে। বাংলাদেশেরই একজন অধ্যাপক ডক্টর অমিত চাকমা এখানকার স্বনামধন্য ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর পদে পর পর দুইবার নিয়োগ পেয়েছিলেন। এমনকি প্রেসিডেন্টও ছিলেন তিনি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের।
বর্তমানে কানাডায় পেশাজীবীদের মধ্যে অনেক নতুন অভিবাসী আছেন যাঁরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন, গবেষক হিসাবে কাজ করছেন। ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার ইত্যাদি পেশায়ও রয়েছেন অনেক অভিবাসী।
গত জানুয়ারীতে সিটিভি নিউজে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত চার বছরে কানাডায় নতুন অভিবাসীদের আয় সাধারণ জনগণের আয়ের তুলনায় যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। তাঁদের মাঝারি পর্যায়ের আয়ের পরিমাণ ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে সব শ্রেণীর কানাডিয়ান করদাতাদের চেয়ে ৫৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এর আগে সব শ্রেণীর বাসিন্দার তুলনায় অভিবাসীদের মাঝারি মানের আয় ২০০৬ সালের ৪৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৩ সালে প্রায় ৮৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল।
কিন্তু আয়ের এই উন্নতী সব অভিবাসীর ক্ষেত্রেই ঘটেনি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখা গেছে কানাডায় আসা উচ্চ শিক্ষিত অভিবাসীদের বড় একটা অংশ পেশাভিত্তিক কাজের বাইরে রয়ে গেছেন। জীবন ধারণের জন্য তাঁরা এমন সব কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন যার জন্য তাঁরা অতিমাত্রায় ওভার কোয়ালিফাইড। উদাহরণ হিসাবে রেস্টুরেন্ট এর জব, পিজ্জা ডেলিভারী, টেক্সী বা উবার চালনা, সিকিউরিটি জব, ফ্যাক্টরী জব ইত্যাদির কথা বলা যায়। এই কাজগুলোর জন্য কোন কলেজ বা ইউনিভার্সিটি ডিগ্রিধারী লোকের প্রয়োজন নেই। ডক্টরেট ডিগ্রিধারীর তো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কানাডায় এসে উচ্চ শিক্ষিত অভিবাসীদের একটা অংশ বাধ্য হয়ে স্বল্প আয়ের এসব কাজই করছেন নিজ নিজ পেশায় কাজ না পেয়ে।
ফলে এদের মধ্যে হতাশায় নিমজ্জিত হওয়ার সংখ্যাও কম নয়। হতাশা থেকে বিষণ্নতা এবং এক পর্যায়ে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়া – এই যেন তাঁদের নিয়তি। অথচ কত স্বপ্ন নিয়েই না তাঁরা একদিন এ দেশে এসেছিলেন।
মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়া এই অভিবাসীরা যখন কানাডায় এসেছিলেন তখন কিন্তু তাঁদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বেশ ভাল অবস্থায়ই ছিল। এ কথার প্রমাণ মিলে বিভিন্ন সমীক্ষায়ও।
যেমন ইতিপূর্বে কানাডার ইনস্টিটিউট অব ওয়ার্ক এন্ড হেল্থ এর এক রিপোর্টে বলা হয়, কানাডায় আসার কিছুদিন পর থেকেই পেশাজীবী অভিবাসীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে। আর এর কারণ নিজ নিজ পেশায় চাকরী না পাওয়া এবং তাঁদের কোয়ালিফিকেশনের তুলনায় অনেক নিম্নআয়ের চাকরী করতে বাধ্য হওয়া। ইনস্টিটিউট অব ওয়ার্ক এন্ড হেল্থ এর গবেষণা সহকারী সিনথিয়া চেন বলেন, আমরা জানি এবং দেখেছি যে কানাডায় আসার পর অনেক ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার পিজ্জা ডেলিভারী অথবা ক্যাব চালাতে বাধ্য হন। অথবা ফ্যাক্টরীতে দিনমজুরের কাজ করেন।
সিনথিয়া এবং তাঁর গবেষণা সহকর্মীরা স্যাটিসটিকস কানাডার অধীনে পরিচালিত Longitudinal Survey of Immigrants to Canada (LSIC) জরীপ রিপোর্টের ডাটা ও তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছেন। ঐ জরীপ রিপোর্টে এমনসব অভিবাসীদেরকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছিল যাঁরা কানাডায় আসার আগে দেশে চাকরী করেছেন এবং কানাডায় আসার সময় ভাল স্বাস্থ্যে অধিকারী ছিলেন। কানাডায় আসার পর পরবর্তী চার বছরে তাঁদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে তিনবার (ওয়েভ ১, ওয়েভ ২ এবং ওয়েভ ৩)। এক বছর পর পর নেয়া হয়েছিল ঐ সাক্ষাৎকারগুলো। প্রতিবার সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে জানতে চাওয়া হয়েছিল তাঁদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য এক বছরে কোন পর্যায়ে নেমেছে। সাক্ষাৎকারে বিভিন্ন প্রশ্নের মধ্যে বিশেষ যে প্রশ্নটি করা হয়েছিল তা হলো- বিগত এক বছরে তাঁরা কোন ক্রমাগত বিষন্নতা, মনমরা ভাব বা একাকিত্বে ভুগেছিলেন কি না। জরীপে মোট ২,৬৮৫ জন পেশাজীবী অভিবাসীকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছিল। জরীপে দেখা গেছে একাডেমিক লেভেল এর বিচারে এই অভিবাসীদের মধ্যে শতকরা ৫২জন ছিলেন ওভারকোয়ালিফাইড এবং শতকরা ৪৪ ভাগ ওভারকোয়ালিফাইড ছিলেন তাঁদের চাকরীর অভিজ্ঞতার বিচারে। আর এই বিরূপ পরিস্থিতির কারণে তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে সেই চার বছরের মধ্যে। তবে শারীরিক স্বাস্থ্য ঠিক ছিল।
সিনথিয়া তাঁর গবেষণা পত্রে আরো বলেন, কানাডার ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাঁদের পলিসি অনুসারে বিদেশ থেকে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন ও ভাল স্বাস্থ্যের অধিকারী পেশাজীবী লোকদের নিয়ে আসেন অভিবাসী হিসেবে। কিন্তু কানাডায় আসার পর তাঁদের অধিকাংশেরই স্ব স্ব দেশের অভিজ্ঞতা ও সার্টিফিকেটের যথাযথ মূল্যায়ন হয়না বলে পেশাভিত্তিক চাকরীর বাজারে প্রবেশের সুযোগ থেকে তাঁরা বঞ্চিত হন।
এরকম মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে অনেক বাংলাদেশীর মধ্যেও। এদের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। মানসিক চাপ, দুঃশ্চিন্তা, হতাশা, বিষণ্ন্নতা ইত্যাদি অনেক সমস্যা নিয়েই বাংলাদেশীরা এখানে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হন। প্রধান কারণ ঐ একটাই। নিজ পেশায় চাকরী না পাওয়া। নিজ পেশায় চাকরী না পেয়ে যখন অন্য কোন সাধারণ পেশায় চাকরী করতে যান তখন সেখান থেকে পর্যাপ্ত অর্থ আসে না। ফলে সংসারও চলে না ঠিকমত। এর পর অনেকেরই আবার রয়েছে দেশের আত্মীয়-পরিজনের প্রতি দায়। প্রতি মাসে না হোক, দুই তিন মাস পর পরই দেশে অর্থ পাঠাতে হয়। এসব মিলিয়ে তাঁরা কি করবেন তা ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। আর তার অবস্বম্ভাবী পরিনতি হলো মানসিক সমস্যা। টরন্টো প্রবাসী বাংলাদেশী ডাক্তার আবু আরিফের মতে বাংলাদেশী অভিবাসীদের মধ্যে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ লোক মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।
অবশ্য, কানাডায় যতদিন ধরেই অভিবাসীরা বসবাস করুন না কেন, নবাগতদের তীব্র উৎকণ্ঠা ও মনখারাপ অবস্থার কোনও উন্নতি হয় নাÑ বরং তার আরও অবনতি ঘটে। ডালহৌসি ইউনিভার্সিটির সমাজতত্ত্ব বিষয়ে পিএইচডি গবেষক ইকবাল চৌধুরীর গবেষণায় এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। আটলান্টিক কানাডার উপাত্তের আলোকে পরিচালিত চৌধুরীর গবেষণা অবশ্য Canadian immigration paradox তত্ত্ব সমর্থন করে।
ওই প্যারাডক্স হলো: কানাডায় আসা অভিবাসীরা প্রায়শ তাঁদের কানাডিয়ান প্রতিপক্ষের চেয়ে স্বাস্থ্যবান হলেও, নবাগতদের স্বাস্থ্য গড় কানাডিয়ানদের চেয়ে বেশি দ্রুত খারাপ হতে থাকে।
ইকবাল চৌধুরীর গবেষণায় প্রাথমিকভাবে দেখা যায়, নয় বছরের কম সময় আগে কানাডায় আসা অভিবাসীদের মানসিক স্বাস্থ্য এদেশে দীর্ঘ সময় ধরে বসবাসকারীদের চেয়ে ভালো। কিন্তু পরে, নবাগতদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা সময়ের সাথে সাথে গড় কানাডিয়ানদের চেয়ে দ্রুত খারাপ হতে থাকে।
“গবেষণায় উঠে এসেছে যে, অভিবাসীরা যখন কানাডায় আসেন তখন তাঁরা মানসিকভাবে স্বাস্থ্যবান থাকেন এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর (চৌধুরী বলেন ১০ বছর পর) তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হতে শুরু করে।”
জনসংখ্যাগত নির্দিষ্ট গ্রুপ, যেমন নারী, অশে^তাঙ্গ, একক ব্যক্তিবিশেষ, স্বল্পশিক্ষিত এবং নিম্নআয়ের ব্যক্তিরা এসব ব্যাধির কারণে উচ্চমাত্রায় নাজুকতার মুখে পড়েন।
ইকবাল চৌধুরীর মতে, অনেক অভিবাসী কানাডায় আসার পর তাঁর প্রত্যাশার সঙ্গে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সম্মুখিন হন এবং যে চাকরির জন্য নিজেকে যোগ্য মনে করেন সেরকম চাকরি না পাওয়ায় তাঁরা উদ্বিগ্ন থাকেন যা মানসিক রোগের সৃষ্টি করতে পারে।
তিনি বলেন, “এটি চিন্তার বিষয়। অভিবাসীরা যখন কানাডায় আসেন তখন তাঁরা অভিবাসন পরবর্তী বিভিন্ন ধরণের চাপের মধ্যে পড়েন, যার মধ্যে রয়েছে চাকরিতে স্থির হওয়া এবং অন্য নানা পরিবেশগত চাপ। এটা যখন অব্যাহতভাবে চলতে থাকে তখন মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হতে শুরু করে।”
বাংলাদেশী ইকবাল চৌধুরী ম্যানিটোবা ইউনিভার্সিটিতে তাঁর দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেয়ার জন্য ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে কানাডায় আসেন। যেহেতু তিনি নিজের দেশে অভিবাসন সম্পর্কিত বিষয়ে জড়িত ছিলেন সেজন্যেই একজন অভিবাসী হিসাবে তাঁর অভিজ্ঞতা এই কমিউনিটির লোকেদের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে তাঁকে আগ্রহী করে তোলে।
ইকবাল চৌধুরী বলেন, “আমি কানাডায় এসে ওইরকম অনুভব করতে শুরু করি, তখন মনে করেছি দেশে ফিরে যাবো। আমি নিঃসঙ্গ বোধ করতাম এবং তা ক্রমশ আরও গভীর হতে থাকে।”
তিনি স্মরণ করেন, চাপ যখন সীমা ছাড়িয়ে যেত তখন তার প্রফেসারদের সমর্থন তাঁকে অভিবাসীদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ নিয়ে গবেষণা করার প্রেরণা যুগিয়েছে।
ইকবাল চৌধুরী আরো বলেন, অভিবাসীরা স্বভাবতই আশা করেন যে কানাডায় এসে তাঁরা নিজ নিজ পেশায় কাজ পেয়ে যাবেন। কিন্তু কানাডায় আসার পর অনেকেই দেখেন যে পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রায়শই এ দেশে মূল্যায়ন হয় না। এটি আসলে পেশাজীবী আভিবাসীদের আকাঙ্খাকে প্রভাবিত করে এবং তাঁদের আত্মসম্মানকে প্রভাবিত করে। শুধু তাই নয়, এই পরিস্থিতি কানাডায় তাঁদের নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের সাথে সামাজিক নেটওয়ার্ক তৈরীতে বাধা দেয়। কারণ যখন তাঁরা নিজ পেশার কাজ পান না তখন সেটি অন্যদের কাছে বলাটা লজ্জাজনক বলে মনে করেন। আর এ লজ্জা ঢেকে রাখার জন্য অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা কমিয়ে দেন বা তাঁদেরকে এড়িয়ে চলেন।
ইকবাল চৌধুরী বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কানাডা যদি অভিবাসীদের একটি ফলপ্রসূ ভবিষ্যত প্রজন্ম গড়ে তুলতে চায়, তবে অভিবাসীদের সমস্যাগুলো ভাল করে বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে এবং তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের উপর জোর দিতে হবে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কানাডায় যখন কেউ অভিবাসী হয়ে আসেন তখন তাঁকে একসাথে অনেকগুলো সেটেলমেন্ট ইস্যু নিয়ে কাজ করতে হয়। এর মধ্যে আছে হাউজিং, নিজ পেশায় চাকরী খোঁজা, নতুন দেশের নতুন পরিবেশ ও আইন সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়ার চেষ্টা করা, নিজ দেশ থেকে নিয়ে আসা সংস্কার ও সংস্কৃতির সঙ্গে কানাডার সংস্কার আর সংস্কৃতির বিরোধ থাকলে তার সমন্বয় ঘটানো বা এড়িয়ে চলতে শেখা, ছেলে-মেয়েদের স্কুল-কলেজের লেখাপড়ার দিকে নজর দেয়া, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক গড়ে তোলা এ সবকিছু মিলিয়ে একটা প্রচন্ড চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় নতুন আসা অভিবাসীদেরকে। আর এই পরিস্থিতি অনেক সময়ই প্রচন্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। তার সঙ্গে যোগ হয় আরো ওজনদার চাপ- যদি নিজ পেশায় কোন অভিবাসী চাকরী না পান। আর এই মানসিক চাপই ক্রমান্বয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায় এবং চিকিৎসকের স্মরনাপন্ন না হলে একপর্যায়ে তা রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কর্মক্ষেত্রে আভিবাসীরা বেতন বৈষম্যেরও শিকার হন যা তাঁদের মানসিক যন্ত্রণা বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে। দেখা গেছে কানাডায় শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় বিভিন্ন সংখ্যালঘু অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসীরা বেশি শিক্ষিত। কিন্তু শিক্ষা শেষে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় একই পরিমাণ বেতন ও সুবিধাসম্পন্ন চাকরি খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা তাঁদের ক্ষেত্রে কম। ইতিপূর্বে প্রকাশিত স্ট্যাটিসটিকস কানাডার এক সমীক্ষায় এ কথা বলা হয়।
বিশেষ করে, স্নাতক হওয়ার দুই বছর পর, অশ্বেতাঙ্গ স্নাতকরা অভিবাসীরা তাঁদের শ্বেতাঙ্গ সমকক্ষদের তুলনায় কর্মক্ষেত্রে কম উপার্জন এবং ইউনিয়নে কম অন্তর্ভুক্তি এবং পেনশন পরিকল্পনার সুবিধা কম পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। সাধারণভাবে, দৃশ্যমান সংখ্যালঘু অভিবাসী মহিলারা যেখানে বছরে আয় করেন ৪৫,৭০০ ডলার সেখানে শ্বেতাঙ্গ মহিলাদের আয় বছরে ৪৭,৮০০ ডলার। শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের আয় যেখানে বছরে ৫৪,১০০ ডলার, সেই তুলনায় দৃশ্যমান সংখ্যালঘু অভিবাসী পুরুষদের আয় বছরে ৫১,৬০০ ডলার।
মাহামারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর অভিবাসীদের উপর আরো নুতন যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে তা হলো আবাসন ও খাদ্যদ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। নতুন বা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আসা অভিবাসীদের আয় এমনিতেই সীমিত। বিশেষ করে যাঁরা নিজ নিজ পেশায় চাকরী করার সুযোগ পান না। তার উপর এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। এ সমস্ত কারণে দেখা গেছে, কানাডায় আসা অভিবাসীরা অন্য কোথাও সুযোগ-সুবিধা পাবার জন্য ক্রমবর্ধমান হারে দেশটি ছেড়ে যাচ্ছেন।
ইন্সটিটিউট ফর কানাডিয়ান সিটিজেনশিপ এবং কনফারেন্স বোর্ড অব কানাডার পরিচালিত সমীক্ষা অনুযায়ী, অভিবাসীদের কানাডা ছেড়ে যাওয়ার জোয়ার সৃষ্টি হয় ২০১৭ ও ২০১৯ সালে। ওই দুই সময়ে ঐতিহাসিক গড়ের চেয়ে ৩১ শতাংশ বেশি অভিবাসী কানাডা ছাড়েন।
কনফারেন্স বোর্ড অব কানাডার আগের সমীক্ষার উল্লেখ করে নতুন সমীক্ষায় বলা হয়, “কানাডার ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি অভিবাসনের ওপর নির্ভরশীল।” আগের সমীক্ষায় বলা হয়, অভিবাসনের ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ায়, শ্রমিক ও অবসর গ্রহণকারীর অনুপাত উন্নত করে এবং মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেয়া শ্রমিক ঘাটতি সহজ করে। নবাগতরা কানাডার মানবিক লক্ষ্য অর্জনেও সহায়ক।
স্ট্যাটক্যান এর এক রিপোর্টে বলা হয় পারমানেন্ট রেসিডেন্ট হিসাবে কানাডায় আসার ২০ বছরের মধ্যে দেশটি ছেড়ে যাচ্ছেন ১৫ শতাংশেরও বেশি অভিবাসী। তাঁরা হয় স্বদেশে ফিরছেন অথবা অন্য কোনও দেশে অভিবাসী হয়ে যাচ্ছেন। নতুন এক সমীক্ষায় এই তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। স্ট্যাটক্যান এর সূত্র উল্লেখ করে গত ২ ফেব্রুয়ারি সিটিভি নিউজ এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে যে, ১৯৮২ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে আসা অভিবাসীদের ৫.১ শতাংশ এদেশে আসার পাঁচ বছরের মধ্যে অন্য কোথাও অভিবাসন নিয়েছে।
সমীক্ষা অনুযায়ী, কিছু অভিবাসী হয়তো কোনও এক পর্যায়ে কানাডা ছেড়ে যাবার পরিকল্পনা করে থাকতে পারে, তবে এই অভিবাসনের সঙ্গে কানাডার শ্রমবাজার অথবা সমাজে একাত্ম হবার ক্ষেত্রে অনেক অভিবাসী যে সঙ্কটে পড়েন তারও সম্পৃক্ততা থাকতে পারে।”
সমীক্ষায় আরও যোগ করা হয় যে, বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তা ক্যাটাগরিতে আসা অভিবাসীদেরও কানাডা ত্যাগের সম্ভাবনা সেবাদানকারী এবং উদ্বাস্তু হিসাবে আসা অভিবাসীদের চেয়ে বেশি।
বিনিয়োগকারী ক্যাটাগরিতে আসা অভিবাসীদের ৪০ শতাংশের বেশি এবং উদ্যোক্তা ক্যাটাগরিতে আসা অভিবাসীদের ৩০ শতাংশ এদেশে আসার ২০ বছরের মধ্যে দেশত্যাগ করেছে। স্ট্যাটক্যান ব্যাখ্যা করে এভাবে: “এই ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত হন ধনাঢ্য অভিবাসীরা যাঁদের অত্যন্ত ভ্রমণশীল থাকার প্রবণতা রয়েছে Ñ এমনকি এরা এদেশে আসার পরও Ñ ভবিষ্যতে কানাডা ছেড়ে যাবার ইচ্ছা পোষণ করে।”
এর বিপরীতে, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা অথবা জ্যামাইকায় জন্ম নেয়া অভিবাসীদের কানাডা ত্যাগের সম্ভাবনা কম। সমীক্ষায় দেখা গেছে, কানাডায় আসার ২০ বছর পর ওইসব দেশে জন্মগ্রহণকারী অভিবাসীদের ১০ শতাংশেরও কম সংখ্যক কানাডা ছেড়ে গেছেন।
এছাড়াও, অপেক্ষাকৃত বয়োবৃদ্ধ অভিবাসীদের কানাডা ত্যাগের সম্ভাবনা সর্বোচ্চ। ৬৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সে এদেশে আসা অভিবাসীদের মধ্যে ১০.৭ শতাংশ পারমানেন্ট রেসিডেন্সি পাবার পাঁচ বছরের মধ্যে কানাডা ছেড়েছেন।
এই সংখ্যা ২৫ শতাংশেরও বেশি হয়ে যায় এদেশে আসার ২০ বছরের মাথায়। অন্যদিকে ১৮ ও ২৪ এর মধ্যে যাঁদের বয়স সেইসব অভিবাসীর মাত্র ১৫ শতাংশের কিছু বেশি সংখ্যক এদেশে আসার ২০ বছরের মধ্যে কানাডা ছাড়েন।
মূলত কানাডায় যে স্বপ্ন নিয়ে অভিবাসীরা আসেন তা যখন পূরণ হয়না বা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না এবং আর্থিক চাপসহ আরো কিছু বৈরী পরিস্থিতি যখন তাঁদেরকে কঠিন এক বাস্তবতার মুখমুখি করে তুলে তখন তার অবসম্ভাবী পরিনতি হয়ে উঠে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও হতাশা। এবং এক পর্যায়ে মানসিক রোগ।
হতে পারে অভিবাসীদের বসবাসের জন্য কানাডা অন্যতম সেরা একটি দেশ, তাঁদের প্রতি সিংহভাগ কানাডিয়ানের রয়েছে ইতিবাচক মনোভাব, বিশ্ব মানের চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে দেশটিতে এবং আরো রয়েছে শক্তিশালী অর্থনীতি, স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ। কিন্তু এর কোনটাই কোন অর্থ বহন করে না একজন উচ্চ শিক্ষিত ও দক্ষ অভিবাসীর কাছে যখন তিনি তাঁর নিজ পেশায় চাকরী না পান দেশটিতে। প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকা সত্বেও ইচ্ছার বিরুদ্ধে দিনের পর দিন অপছন্দের এবং নিম্ন আয়ের কোন কাজ করতে হলে স্বাভাবিকভাবেই একজন ব্যক্তির জীবনে তার পরিনতি হয় নেতিবাচক।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, কানাডা উচ্চশিক্ষিত এই অভিবাসীদের জন্য যথেষ্ট কিছু করছে না। সম্প্রতি এই অভিমত প্রকাশ করেছে স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা। এই সংস্থার গবেষকরা বলেন, পছন্দের পেশা ফিরে পাবার চেষ্টায় অনেক অভিবাসীই বাধার মুখে পড়ছেন। তাঁরা আরো বলেন, উচ্চ শিক্ষিত অভিবাসীদের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহের কারণে কানাডা জি-৭ এর সদস্য দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থান ধরে রাখতে পারছে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রিধারী ওই অভিবাসীদের কারণেই কানাডার কর্মক্ষম জনশক্তির হার জি-৭-ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ (৫৭.৫ শতাংশ)। কিন্তু তারপরও সংস্থাটি বলছে, কানাডা তার “মেধাবি জনশক্তি থেকে সর্বোচ্চ সুফল তুলছে না।” মেধাবী অভিবাসীরা এদেশে আসার পর বাইরের দেশে নেয়া তাঁদের প্রশিক্ষণ ও যোগ্যতার স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হচ্ছে কানাডা।
বলাই বাহুল্য, এই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে কানাডা ছেড়ে চলে যাবেন আরো অনেক দক্ষ অভিবাসী যাঁরা একদিন অনেক স্বপ্ন নিয়ে এ দেশে এসেছিলেন। আর এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কানাডার অর্থনীতি যা কারো কাম্য হতে পারে না।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ