শ্রদ্ধাঞ্জলি : আমার স্মৃতিতে জনাব নুরুল ইসলাম
বাংলাদেশী কমিউনিটি হারালো তার এক যোগ্য অভিভাবক!
ফায়জুল হক, ccp
১৯৯৭ সালের আগষ্ট মাসে সরাসরি ট্রেনে নিউইয়র্ক থেকে টরন্টোতে ল্যান্ড করি। নিউইয়র্কের তুলনায় টরন্টোতে জন মানব নাই বললেই চলে। আমাদের কম্যুনিটির অবস্থাও বেশ বেহাল তখন। বলা যায় সবাই সবাইকে চিনতো। কানাডার অর্থনৈতিক দুরাবস্থা তখন চরমে। মুখে না বললেও সবার ভিতরে তখন ইয়া নফসি ইয়া নফসি। মাঝে মধ্যে কম্যুনিটির ছোট খাটো আয়োজন দেখা যেত। তখন ব্লোর ষ্ট্রিটে একমাত্র বাংলা গ্রোসারী ছিল “বেংগল গ্রোসারী”; তার বেইসম্যান্টে ভিডিওর দোকান। ১৯৯৮ সালে সেই বেইসম্যান্টেই আমার প্রথম দেখা জনাব নুরুল ইসামের সাথে। বাংলাদেশের কৃষির বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যতে তার উন্নয়ন সংক্রান্ত একটি সেমিনারের বিরাট পোস্টার লাগানো ছিল সেখানে। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পোস্টারটি পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম-অর্থনৈতিক এই চরম দুর্দিনেও আমার কমিউনিটির একটি সেমিনার হচ্ছে খোদ টরন্টো সিটি হলে তা তো খুব সহজ কাজ নয়। কে বা কারা এমন নিবেদিত প্রাণ, কাদের এমন উদ্যম-উচ্ছাস? প্রশ্ন গুলো যখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে-তখনই পেছন থেকে একটি আওয়াজ আসলো “আপনি খুব মনোযোগ দিয়ে পোষ্টার পড়ছেন – আপনার বিশেষ দাওয়াত থাকলো অনুষ্ঠানে”। আহবায়ক -নুরুল ইসলাম যে উনিই তা বুঝতে অসুবিধা হল না। অনুষ্ঠানে আমি গিয়েছিলাম। উনার সাংগঠনিক ক্ষমতার কারিশমা এই প্রথম দেখে অভিভূত হই ।
সেই ১৯৯৮ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বাংগালী কমিউনিটির জন্য উনার নিঃস্বার্থ, নিরলস আর দূর্বার কর্ম তৎপরতার স্বাক্ষী পুরো কমিউনিটিই রয়েছে। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত, বিভিন্ন সাবজেক্ট এ উনার পান্ডিত্য ছিল অপরিসীম। ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সর্বক্ষেত্রেই ছিল সহজ বিচরন। যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখান থেকেই সোনার ফসল তোলে ঘরে ফিরেছেন। টরন্টোর বাংগালী কমিউনিটির প্রায় সকল সংগঠনেই ডাক পরতো জনাব নুরুল ইসলামের আর সেখানে বিচক্ষণতার ছাপ রেখে অনুষ্ঠানের মধ্যমনি হয়ে ঘরে ফিরতেন তিনি। উনার ধর্মীয় বিশ্বাসের শিকড় ছিল অনেক গভীরে প্রোথিত ; অন্যদিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় তিনি ছিলেন বলীয়ান। সেই প্রমান আমরা পাই বাংগালীর অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাতিঘর কবি নজরুলকে নিয়ে তার বিশাল কর্মযজ্ঞ। এই টরন্টোতেই তার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল “নজরুল ফাউন্ডেশন”- বিশ্বের বিভিন্ন কোণায় বাস করা নজরুল বিশষেজ্ঞ-গবেষক- পন্ডিতদেরকে একত্রে এনে বার বার করেছেন নজরু সম্মেলন। আমি তার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী, তার কল্যানেই নজরুলের রক্তের বংশধর খ্লিখিল কাজীর সাথে কথা বলা-ও কাজ করার সুযোগ পেয়েছি আমরা। সুনামগঞ্জ এসোসিয়েশন সহ কমিউনিটির বিভিন্ন সংগঠনকে Shape up করা সহ দিক নির্দেশনায় ছিল তার অকৃপন অবদান। কমিউনিটির তরুণ সম্প্রদায়কে মটিভেশনে তার জুড়ি আমার চোখে দেখিনি। এক ক্যারিসম্যাটিক চৌম্বকীয় শক্তি ছিল তার মাঝে যা খুব সহজেই মানুষকে প্রভাবিত করতো- তাই এক শক্তিশালী সংগঠক হিসাবে ছিলেন সবার কাছে পরিচিত। তার আরেকটি গুনের কথা অনেকেরই হয়তো জানা নেই -খুব ভাল কবিতা লিখতেন তিনি। তার কবিতা পড়ে আমি বার বার প্রকাশ করার জন্য উনাকে অনুরোধ করেছি।
২০১৯ সালে আমার “কানাডা -আমেরিকায় কমিউনিটি ভাবনা” বইটি প্রকাশিত হয়। মুলতঃ দীর্ঘ দিন থেকে প্রবাসে বসে লিখা গুলোকে বই আকারে প্রকাশ করে নিজের আত্মতৃপ্তি মিটানোই ছিল উদ্দেশ্য- প্রকাশনা অনুষ্ঠান করার কথা কস্মিনকালেও চিন্তায় আসে নাই। কিন্তু বাধ সাধলেন জনাব নুরুল ইসলাম। সাথে পেয়ে গেলেন পরম শ্রদ্ধেয় কবি আসাদ চৌধুরীকেও (প্রয়াত)। দু’জনেরই একই কথা “ কমিউনিটির ইতিহাস নির্ভর এমন গুরত্বপূর্ন একখানা দলিল লুকিয়ে রাখার নয় সুতরাং প্রকাশনা অনুষ্ঠান করতেই হবে। দিন রাত পরিশ্রম করে একটি সফল প্রকাশনা অনুষ্ঠানের মূল আর্কিটেক্ট জনাব নুরুল ইসলাম আমাকে করেছেন চির কৃতজ্ঞ।
প্রায় ১৫/১৬ বছর যাবত আমরা প্রতিবেশী হওয়াতে আমার পারিবারিক জীবনেও তার প্রভাব ছিল। বড় ভাইয়ের মতই আমার মেয়েদের বিয়ে দেওয়া-ভাল পাত্র খুজে বের করার প্রচেষ্টা উনার মধ্যে ছিল মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত। ২৮ জানুয়ারী আমার মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার ছিল তার প্রাণপন চেষ্টা। উনার মেয়েকেও বলে রেখেছিলেন কোন রকমে যেন অন্ততঃ ৫ মিনিটের জন্য হলেও তাকে হলে নেওয়া হয়। কিন্তু তা আর হয়ে উঠে নি। মৃত্যুর আগের দিন ভারী গলার আওয়াজ ভেসে আসলো “ আপনার মেয়ের বিয়ে খুব সুন্দর ভাবে হয়েছে শুনেছি – আপনার বেয়াইকে আমার সালাম দিবেন”। বলেই ফোন শেষ করলেন। আমার বেয়াই জনাব সাইফুল ইসলাম আমার সামনেই বসা ছিলেন- নুরুল ইসলাম সাহেবের সালাম পৌছে দিলাম। রাত্রে খবর আসলো কমিউনিটিকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে চলে গেছেন নুরুল ইসলাম সাহেব। পরদিন জানাজায় গিয়ে শেষ বারের মত দেখে আসলাম। কমিউনিটির সত্যিকারের এক অভিভাবক কে হারিয়ে সবাই বাকরুদ্ধ। আমি যেন হারালাম আমার এক বড় ভাইকে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে দু হাত তুলে দোয়া করি তিনি যেন এই ভাল মানুষটিকে বেহেশতের সর্বোচ্চ সম্মানীত স্থানে আশ্রয় দেন। আমিন।