কানাডায় মানুষের আয়ুস্কাল কমেছে টানা তৃতীয় বছরেও

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : কানাডায় টানা তৃতীয় বছরের মত মানুষের আয়ুস্কাল কমেছে। বিশেষজ্ঞরা এই প্রবণতাকে বলছেন ঐতিহাসিক, যা আমাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উদ্বেগজনক অবনতি নির্দেশ করে। খবর কেটি ডেঞ্জারফিল্ড   গ্লোবাল নিউজ।

স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা গত নভেম্বর মাসে তার রিপোর্ট ডেথ ২০২২ প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, কানাডায় মানুষের আয়ু ২০২১ সালের ৮১.৬ বছর থেকে ২০২২ সালে ৮১.৩ বছরে নেমে গেছে। তথ্যে দেখা যায়, এই অবনতি পুরুষের চেয়ে নারীদের ক্ষেত্রে আরও বেশি জোরালো।

অটোয়া হাসপাতাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ডা. ডাউ ম্যানুয়েল গ্লোবাল নিউজকে বলেন, “এমন ঘটনা এই প্রথম ঘটলো। আমাদের এমন পতন খুব কমই ঘটেছে, আমরা একটি মন্দা কাটিয়েছি, কিন্তু কখনই এমন ছিল না, টানা তিন বছর এমনটা ঘটেনি। এটি সত্যিই বড় ঘটনা।”

“কানাডীয় হিসাবে আমাদের স্বাস্থ্য কেমন যাচ্ছে এটি তারই পরিমাপ। আর এর অর্থ হলো, আমরা খুবই বাজে অবস্থার মধ্যে আছি।”

২০২২ সালে কানাডায় ৩৩৪,৬২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা ২০২১ সালের চেয়ে ৭.৩ শতাংশ বেশি।

স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার একজন বিশ্লেষক প্যাট্রিস ডিওন-এর মতে, পর পর তিন বছর ধরে কানাডায় আয়ুস্কালের হার কমার একটি প্রধান কারণ কোভিড-১৯ মহামারিজনিত।

অবশ্য, তার বিশ^াস এর সঙ্গে অন্যান্য কারণও সক্রিয় ছিল।

কানাডায় টানা তৃতীয় বছরের মত মানুষের আয়ুস্কাল কমেছে। বিশেষজ্ঞরা এই প্রবণতাকে বলছেন ঐতিহাসিক, যা আমাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উদ্বেগজনক অবনতি নির্দেশ করে। ছবি : গেটিইমেজ

ডিওন ব্যাখ্যা দেন যে, ২০২২ সালে প্রবীণদের মৃত্যু বেড়েছে, যা ছিল প্রধানত কোভিড-১৯-এর সাথে সংশ্লিষ্ট। তবে গত কয়েক বছরে অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের মৃত্যুর হারও বেড়েছে, যা তার বিশ্বাস কানাডার ওপিয়ড ক্রাইসিসের (ওষুধের বিষাক্ত প্রতিক্রিয়াজনিত সঙ্কট) সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। ওপিয়ড হলো এক ধরনের ওষুধ যার মধ্যে অবৈধ মাদক হেরোইন, ফিনাইলের মত সিন্থেটিক ওপিয়ড এবং প্রেসক্রিপশনের মাধ্যমে পাওয়া যায় এমন বৈধ বেদনানাশক রয়েছে।

স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা জানায়, তরুণ বয়সীদের গ্রুপে মৃত্যুর হার বৃদ্ধি অংশত সেইসব মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে যেগুলি কোনও করোনার (নির্দিষ্ট কারণে মৃত্যুর বিষয়ে তদন্তকারী) বা মেডিক্যাল পরীক্ষকের পরীক্ষাধীন রয়েছে।

ডিওন বলেন, “এসব মৃত্যুর ঘটনা কোনও করোনার অথবা মেডিক্যাল পরীক্ষকের পরীক্ষার আওতায় রয়েছে, তাই আমরা এখনও জানি না। ঘটনা উদ্ঘাটনের জন্য আমাদের আরও সময় দরকার।” তিনি বলেন, “তবে, অতীতের ঘটনা থেকে আমরা যা জানি তা হলো, এসব মৃত্যুর অনেকগুলোই হত্যা, আত্মহত্যা অথবা দুর্ঘটনা বা অনিচ্ছাকৃত জখমের ঘটনা হিসাবে শ্রেণীকরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে দুর্ঘটনাক্রমে অতিরিক্ত মাদক গ্রহণের ঘটনাও অন্তর্ভুক্ত।”

সারা দেশে মানুষের আয়ুস্কালে পার্থক্য আছে। উদাহরণস্বরূপ, স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নিউ ফাউন্ডল্যান্ড ও ল্যাব্রাডর, নোভা স্কশিয়া, নিউ ব্রুন্সউইক, কুইবেক, অন্টারিও এবং ম্যানিটোবায় মানুষের আয়ু কমেছে। কিন্তু সাসকাচুয়ান, আলবার্টা ও ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় যেখানে ২০২০ এর চেয়ে ২০২১ সালে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অবনতি দেখা গিয়েছিল, সেখানে ২০২১ সালের চেয়ে ২০২২ সালে আয়ুস্কাল মূলত অপরিবর্তিত রয়েছে।

ডিওন বলেন, “ওপিয়ড সঙ্কট বিস্তৃত হচ্ছে, এর প্রভাব অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল ওয়েস্টার্ন প্রভিন্সে। বি.সি এবং আলবার্টায় ২০২১ সালে আয়ুস্কাল কমে যায়। কিন্তু এখন আমরা দেখছি আটলান্টিক প্রদেশে, অন্টারিও এবং কুইবেক প্রদেশেও। সুতরাং এটি কি (ওপিয়ড ক্রাইসিস) পূবদিকে এগুচ্ছে? আমরা জানি না… অনেক প্রশ্ন আছে এবং সেগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।”

মৃত্যুর প্রধান কারণ :

কানাডায় মৃত্যুর প্রাথমিক কারণ হিসাবে রয়ে গেছে ক্যান্সার ও হৃদরোগ। স্ট্যাটক্যানের তথ্যমতে, ২০২২ সালে মোট মৃত্যুর ৪১.৮ শতাংশ ঘটে ওই দুটি রোগে। এটি তার আগের বছরের চেয়ে সামান্য বেশি। ওই বছর ক্যান্সার ও হৃদরোগে মারা যান মোট মৃত্যুর ৪৪.৩ শতাংশ।

ডা. ডাউ ম্যানুয়েল বলেন, “ক্যান্সার ও হৃদরোগের বিরুদ্ধে আমাদের অর্জন দেখা যাচ্ছে বেশ ধীর। গত ৫০, ৬০ বছরে এটি কমেছে বটে, কিন্তু এখন যেন মালভূমির রূপ নিয়েছে। আর আমাদের উদ্বেগের বিষয় হলো যে, এখন অনেক প্রতিকূলতা আছে এবং তা ঊর্ধ্বগামী। স্থ’ূলতা বাড়ছে, ডায়াবেটিস বাড়ছে এবং রক্তচাপও বাড়ছে।”

মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ ছিল কোভিড-১৯

২০২২ সালে মৃত্যুর অন্যান্য প্রধান কারণের মধ্যে রয়েছে: দুর্ঘটনা (অনিচ্ছাকৃত জখম), মস্তিষ্কের রোগ (স্ট্রোক), পুরনো নিম্ন শ^াসযন্ত্রের রোগ, ডায়াবেটিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও নিউমোনিয়া, আলঝেইমার্স ডিজিজ এবং পুরনো লিভারের রোগ ও সিরোসিস।

২০২২ সালে মৃত্যুর ১০টি প্রধান কারণে মারা গেছে ২২৭,০০০ জনের বেশি মানুষ, যা শতকরা হিসাবে মোট মৃত্যুর ৬৮.২ শতাংশ।

কোভিড-১৯ এ মৃত্যু বেড়েছে :

স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার তথ্যে দেখা যাচ্ছে, কোভিড-১৯ এ মৃত্যুর ঘটনা ২০২১ সালের

১৪,৪৬৬ জন থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ১৯,৭১৬ জনে দাঁড়ায়, যা এই মহামারি শুরুর পর সর্বোচ্চ।

কেন্দ্রীয় এই সংস্থা জানায়, এই বৃদ্ধি হতে পারে অংশত উচ্চমাত্রার সংক্রামক নতুন ভ্যারিয়েন্টের সংস্পর্শে আসা এবং পর্যায়ক্রমে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার কারণে  যেমন, বিধিনিষেধ ও মাস্ক পরার বাধকতা হ্রাস করা)।

করোনা ভাইরাসের ওমিক্রন নামক ভ্যারিয়েন্ট ২০২১ সালের শেষের দিকে বিশে^ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, লাখো কানাডীয়কে সংক্রমিত করে এবং মহামারির গতিপথ পাল্টে দেয়। এটি আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর চেয়ে বেশি সংক্রামক এবং টিকা ও সংক্রমণজনিত কারণে অর্জিত প্রতিরোধ ক্ষমতা উভয়কেই পাশ কাটাতে অধিকতর সক্ষম ছিল। ওমিক্রনে আক্রান্তের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় রোগীদের হাসপাতালে ভর্তির হার ও মৃত্যু বৃদ্ধি পায়।

ডিওন বলেন, “ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের একটি প্রভাব ছিল। একই সাথে প্রতিরোধমূলক ফ্যাক্টরগুলোরও যা দেশকে পাল্টে দেয়।”

৬৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সের কানাডীয়দের মধ্যে কোভিড-১৯ এ মৃত্যুর অনুপাত ২০২২ সালে ৯১.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, যা মহামারির শুরুর দিকের পর্যায়ে পৌঁছে। তথ্যে দেখা যায়, এই বৃদ্ধি বহুলাংশে ভোগ করেন ৮০ বছর বা তারও বেশি বয়সের প্রবীণরা, যাদের মৃত্যুর হার ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ৭৮.২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।

এর বিপরীতে, ২০২২ সালে ৬৫ বছরের কম বয়সী লোকেদের মধ্যে কোভিড-১৯ সংশ্লিষ্ট মৃত্যু ৮.৬ শতাংশ হ্রাস পায়।

২০২২ সালে কোভিড-১৯ এ মৃত্যুর হার শুধু প্রেইরি অঞ্চল ছাড়া কানাডার আর সবখানেই বেড়ে যায়। সবচেয়ে বেশি বেড়েছিল আটলান্টিক কানাডায়। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার সন্ধানে দেখা যায়, সেখানে কোভিড-১৯ এ মৃত্যুর হার ছিল ২০২১ সালের চেয়ে সাত গুণেরও বেশি।

তিনি বলেন, “কোভিডের কারণে ২০২২ সাল ছিল খুব মন্দ, এটি ছিল আমাদের সবচেয়ে খারাপ বছর। সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা এবং বয়োবৃদ্ধ মানুষ যারা সংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন তারা নিছক সংখ্যা।” “এটি মন্দ ছিল। এটি আমাদের আয়ু কমিয়ে দিয়েছে। পরিসংখ্যান মিথ্যা বলে না।”