‘শুচিতা’
(কানাডার দৈনন্দিন বাস্তবতার দিকে লক্ষ্য রেখে কাল্পনিক এই উপন্যাস ‘শুচিতা’। লিখেছেন কানাডা প্রবাসী নজরুল ইসলাম। )
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
উইকেন্ডে শুচিতা সুমিত ও তার বাবা-মাকে ডেকে বলে, আমি কাজ থেকে এসে ঘর পরিষ্কার, রান্না করা, ছেলের ডায়াপার পরিবর্তন করা, ওকে গোসল করানো আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি এ ব্যাপারে তোমাদের সহযোগিতা চাই। সুমিত অনেক অসন্তুষ্ট হয়ে বলে, তুমি ঘর থেকে চলে যাওয়ার উছিলা খোঁজ করছ। তুমি দেখো আমি অসুস্থ, কীভাবে ছেলের যত্ন নেব। তা ছাড়া আমার মা-বাবাও অসুস্থ, কে ওর যত্ন নেবে?
শুচিতা বলে, সুমিত, তুমি আমার ছেলের ব্যাপারে সঠিকভাবে গুরুত্ব দিচ্ছ না। বাচ্চা ছেলে সারা দিন অযত্নে থাকে, তোমরা এতগুলো লোক ঘরে থেকে ওকে দেখো না। ওকে আমি কোত্থেকে নিয়ে এসেছি?
দেখো শুচিতা, তুমি অযথা তর্ক করো। এক কথা দুই কোথায় ঝগড়া অতিমাত্রায় বেড়ে যায়, সুমিত রেগে ওকে মারতে যায় এবং কমল এগিয়ে এসে মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাধা দিয়ে বলে, তোমরা চুপ করো। শুচিতা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলে, সুমিত, তুমি আমাকে মারতে এসেছ?
সুমিত বলে, ওরা যতটুকু পারে করবে এবং তোমাকে কাজ করতে হবে। তুমি বরং বাড়তি ছুটি নিয়ে ঘরে থাকো।
সে সব গুছিয়ে ছেলেকে নিয়ে বাবা-মার কাছে চলে আসে এবং টেলিফোন করে বলে, আমি তোমাদের সঙ্গে থাকব না। তুমি যদি আমাকে নিয়ে থাকতে চাও, তাহলে আলাদা বাসা নেবে এবং সংসারের যত খরচ দুজনে শেয়ার করবে। আমি ওদের সঙ্গে আর এক দিনও থাকতে পারব না।
সুমিত বলে, এটাই কি তোমার শেষ কথা?
হ্যাঁ, এটাই আমার শেষ কথা। তুমি চিন্তা করে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে জানাবে।
পরদিন শুচিতা অফিসে গিয়ে তার বান্ধবী মনিকাকে সব খুলে বলে। মনিকা বলে, সুমিতের কী বুদ্ধি লোপ পেয়েছে?
তার তো তোমাকে সমর্থন দেওয়া উচিত, এ অবস্থা হলে তুমি ওদের সঙ্গে কীভাবে থাকবে?
সুমিত এ নিয়ে তার মা-বাবার সঙ্গে আলাপ করেছে। তারা বলে, আমরা এমন কিছুই করছি না যে জন্য তোমার সঙ্গে শুচিতার বিবাদ হতে পারে। আমাদের পুরা ঘর অসুস্থ। এই সুযোগ নিয়ে শুচিতা সংসারে অশান্তির সৃষ্টি করতেছে। আমরা তোমার ছোট্ট বাচ্চাকে অনেক ভালোবাসি। যতটুকু পারি তার দেখাশোনা করি। শুচিতা আমাদের পছন্দ করে না, তাই সে আমাদের এড়িয়ে চলে। সুমিত বলে, শুচিতাকে পাওয়া যায় না দিনের বেলা, সে অনেক ব্যস্ত থাকে অফিসের কাজ নিয়ে। একমাত্র উইকেন্ডে আমি গিয়ে দেখতে পারি যদি তাকে বোঝানো যায়। আরতি বলে, এতটা তোষামোদ করার দরকার নেই। যদি না আসে, তোমার ছেলে ধ্রুবকে দিয়ে দেবে, আমরা ওকে নিয়ে নেব।
কমল বলে, দেখো আমাদেরও অনেক দোষত্রুটি আছে; যা থেকে বের হয়ে আসা দরকার। শুধু শুধু শুচিতাকে দোষ চাপিয়ে দিলে ঠিক হবে না। আমরা এতগুলো লোক খাওয়াদাওয়া করি, দুটি পয়সাও আমাদের রোজগার নেই। অপর দিকে অ্যাকসিডেন্ট করে ঘরে বসে আছি। এতগুলো লোক একজনের মাথার ওপর, কেউ পছন্দ করবে না। শুচিতার মা-বাবার খোঁজখবর আমরা কোনো দিন নিই না। আমাদের সঙ্গে ওদের কোনো দিন মিল হওয়ার নয়। ওরা নিম্ন শ্রেণির লোক, আমাদের সঙ্গে চলাফেরা বা কথাবার্তায় মিল হতে পারে না। সুমিতের তাকে পছন্দ করার আগে এসব চিন্তা করতে হতো, পারিবারিকভাবে আমাদের সঙ্গে তাদের মিল হবে কি না। আরতি বলে, আমরা শুচিতার কাছে কি নতজানু করতে যাব?
সুমিত ও কমলের সব সময় মাথাব্যথা থাকে এবং পেইন কিলার নিতে হয়। ডাক্তার বলেছে যে এই মাথাব্যথা অনেক দিন থাকবে এবং আস্তে আস্তে সেরে যাবে। তবে সুমিত কাজ করতে পারবে এবং ডাক্তার ফিটনেস লেটার দিলেও সুমিত কাজ করার মতো মনোবৃত্তি হারিয়ে ফেলেছে। সুমিত অনেক দিন থেকে শুচিতাকে টেলিফোন করে; কিন্তু শুচিতা তার টেলিফোনের কোনো জবাব দেয় না।
কিছু দিন হয় শুচিতার কাজিন প্রদীপ ইমিগ্রেশন নিয়ে ইন্ডিয়া থেকে এসেছে, সে আপাতত শুচিতাদের বাসায় এসে উঠেছে। প্রদীপ এখন পর্যন্ত অটোয়ার রাস্তাঘাট চেনেনি। মাঝেমধ্যে সে শুচিতার কাছ থেকে কাজের জন্য পরামর্শ নিয়ে নিজেকে তৈরি করে। প্রদীপ এখানে আসার পর তার আংকেল ও আন্টি তাকে শুচিতার দাম্পত্যজীবনের কলহ নিয়ে আলাপ করে। প্রদীপ অত্যন্ত চতুর ছেলে এবং কোনো মন্তব্য করে না শুচিতার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে। সে সময় পেলেই শুচিতার ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ওকে অনেক ধরনের খেলনা এনে দিয়েছে। প্রদীপকে দেখামাত্র ছেলে দৌড়ে আসে এবং এটা-সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রাতে এই ছেলে ঘুম থেকে এসে দরজা খুলে প্রদীপের বিছানায় গিয়ে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকে। শুচিতা ওকে নিতে গেলে কান্না করে এবং আসতে চায় না।
এক উইকেন্ডে প্রদীপ কিছু কেনাকাটার জন্য শপিং মলে শুচিতার সঙ্গে গেলে হঠাৎ সুমিতের সঙ্গে দেখা। সুমিত শুচিতাকে অন্য এক অপরিচিতের সঙ্গে দেখে সন্দেহ করে। বলে, এই লোক কে?
শুচিতা বলে, এ আমার কাজিন প্রদীপ, ইন্ডিয়া থেকে ইমিগ্রেশন নিয়ে সদ্য এসেছে। প্রদীপ শুচিতার স্বামীকে দেখে হাত মেলাতে চাইলে সুমিত হাত না মিলিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়। সুমিত বলে, শুচিতা, তুমি মলে কী জন্য এসেছ?
শুচিতা জবাব না দিয়ে এড়িয়ে প্রদীপকে নিয়ে দোকানে গিয়ে কিছু কেনাকাটা করে বাসায় ফিরে না গিয়ে কোনো এক রেস্টুরেন্টে প্রদীপকে নিয়ে খেতে বসে। প্রদীপ বলে, শুচিতা, আমি ভুল করেছি।
শুচিতা বলে, যেমন?
প্রদীপ বলে, আমি জানতাম না তোমার স্বামীর সঙ্গে দেখা হবে। শুচিতা বলে, কে কী ভাবল এতে আমার কিছু-যায় আসে না।
পর্ব: ৪
শুচিতা কাজের শেষে মা-বাবার বাসায় গিয়ে ছেলে ধ্রুবকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সুমিত মাঝে মাঝে এসে ধ্রুবকে দেখে যায়।
ছোট বাচ্চা যার কাছে আদর পায় তার কাছেই যায়, সুমিত বাবা হলেও সব সময় আসে না, সে জন্য বাচ্চা তার কাছে যেতে চায় না। সুমিত শুচিতার বাসায় এলে জোর করে ওকে কোলে নিলে ও কেঁদে কোল থেকে নেমে যায়। সুমিত এর জন্য শুচিতা ও তার বাবা-মাকে দোষারোপ করে, সে বলে যে এই ছোট বাচ্চা নিয়েও ওরা আমার সঙ্গে কৌশলে খেলা করে। বাসায় গিয়ে সে আরতি ও কমলকে বলে, ধ্রুব আমার কাছে আসতে চায় না। ওরা বলে, তুমি বাবা আজ হোক, কাল হোক ধ্রুব তোমার কাছে আসবে। আরতি বলে, শুচিতা ও ওর বাবা-মা এই ছোট বাচ্চাকে কৌশলে তোমার কাছে থেকে সরিয়ে নিচ্ছে। এগুলো ওদের হীনম্মন্য কৌশল, যা তুমি বুঝতে পারবে না। সুমিত আরও বলে, প্রদীপকে দেখামাত্র ধ্রুব দৌড়ে গিয়ে কোলে ওঠে। আরতি বলে, শুনেছি এই ছেলের সঙ্গে শুচিতার আগেও সম্পর্ক ছিল, এখন বাসায় এসে বসেছে, দেখো কোন দিকের পানি কোন দিকে গড়ায়।
সুমিত এ নিয়ে শুচিতাকে বলে, এর জন্য প্রদীপও দায়ী। প্রদীপ না থাকলে এই বাচ্চা আমার কাছে অবশ্য আসত। শুচিতা বলে, তুমি এই বাচ্চা নিয়ে অযথা প্রদীপকে কেন দোষারোপ করছ?
সুমিত বলে, আমার এবং তোমার মধ্যে যে সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে, তা একমাত্র প্রদীপের জন্য। শুচিতা বলে, প্রদীপ কানাডা আসার আগেও তোমার সঙ্গে আমার কি মধুর সম্পর্ক ছিল?
না থাকলেও ততটা খারাপ সম্পর্ক ছিল না। আভা বলে, ছোট বাচ্চা যার কাছে আদর পায় তার কাছেই যায়।
শুচিতা বলে, তোমরা অযথা কেন আমি ও আমার মা-বাবার খুঁত খুঁজে বের করছ?
আমি তোমাদের বাসায় থাকাকালে তুমি এবং তোমার লোকেরা আমাকে গয়না চুরি করেছি বলে দোষারোপ করেছ, কেন করছ?
কোনো কিছু হারানো গেলে যেকোনো লোক নিকটের লোকদের সন্দহ করতে পারে, তা ছাড়া আমার মা-বাবা তোমাকে চোর বলেনি। তুমি নিজেও বলছ, শুচিতা, মনে করে দেখো তো তুমি কি কোথাও ভুলে রেখেছ?
আমি তোমার স্ত্রী, আমাকে তুমি সন্দেহ করছ কেন?
আমি তোমাকে সন্দেহ করিনি।
আমি প্রেগন্যান্ট, অসুস্থ শরীর নিয়ে প্রতিদিন কাজ করেছি এবং তোমরা বাসায় এতগুলো লোক, বাসার কিচেন, ডাইনিং টেবিল থেকে আরম্ভ করে সব কাজ আমার জন্য কেন ফেলে রেখেছ?
আমি এবং আমার লোকেরাও অসুস্থ ছিল, তা ছাড়া সবাই কাজ করছে যে যা পেরেছে। আমাকে তোমরা পছন্দ করো না, কিন্তু আমার বাবা-মা কী করেছে?
আমি কী তোমার বাবা-মাকে কিছু বলি?
না বললেও ভালো ব্যবহার করো না।
প্রদীপ বাইরে থেকে ঘরে ঢুকতেই ধ্রুব দৌড়ে এসে আংকেল আংকেল বলে কোলে ওঠে। শুচিতা বলে, কী দেখলে তুমি?
যে আদর করে ছোট বাচ্চা তার কাছেই যায়। প্রদীপ বলে, তোমার আব্বুর কাছে যাও, এই বলে সুমিতের দিকে নিয়ে যেতেই ধ্রুব চিৎকার করে বলে, না, আমি যাব না। শুচিতা ওকে কোলে নিয়ে বলে, সুমিত, তুমি কী দেখলে, ধ্রুব তোমার কাছে যায় না?
তুমি বাসায় চলে এসো তাহলে ধ্রুব আমাদের কাছে আসবে। আমরা বাসার সবই ওকে মিস করছি।
আমি আবারও বলছি, তুমি যদি আমাকে নিয়ে বাস করতে পারো আলাদাভাবে, তাহলে আমি যাব। আমি এত লোকের মধ্যে থাকতে পারব না। পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার না, আমি আলাদা তোমাকে নিয়ে থাকতে চাই।
তোমার কী চাকরি হয়েছে?
না, আমি চেষ্টা করছি; তবে এখনো কিছুই হয়নি।
তোমার তো চাকরি আছে, আমাকে খাওয়াতে পারবে না?
শুচিতা বলে, সংসার খরচের পয়সা দুজনকে সমানভাবে ভাগ করে দিতে হবে, তুমি ঘরে থাকবে, আমি কাজ করব এবং ঘরের কাজও করব, এটা সম্ভব না।
এটাই কী তোমার শেষ কথা?
হ্যাঁ, এটাই আমার শেষ কথা।
সুমিতের বাবা-মা ব্রাহ্মণ বংশ, হিন্দুধর্ম মতে ব্রাহ্মণ সবচেয়ে উঁচু বংশের লোক এরা পূজা পার্বণে ধর্মীয় কাজ নিয়ে দেশে ভালোভাবে থেকেছে। তাদের ধারণা অন্য সব হিন্দু লোক ওদের শ্রদ্ধা, প্রণাম
ও খাওয়া পরা জোগাবে। কিন্তু এখানকার জীবন সম্পূর্ণ আলাদা, হয় কাজ করো নতুবা সরকারের অনুদান নিয়ে কোনো রকমে বেঁচে থাকো।
আরতি শুচিতাকে পছন্দ করে না, বড় বংশ এবং নিচু বংশ–এর মধ্যে রয়েছে একটা টানাপোড়েন। ওরা মনে করে শুচিতা, ওর বাবা-মা অশুচি এবং তাদের সঙ্গে ওঠাবসা এবং তার হাতের রান্না খাওয়াও ঠিক না। ওরা নিত্য গঙ্গার পবিত্র জল ঘরের জলের সঙ্গে মিশিয়ে সারা বাসায় ছিটিয়ে দিয়ে পবিত্র রাখে। গ্রোসারি দোকান থেকে এই পবিত্র জল সব সময় এনে রাখে, শুচিতা রান্না করা শেষ করলে একটু জল ছিটিয়ে দিয়ে আরতি ভগবানের নামে মন্ত্র পড়ে ঘর পবিত্র করে।
শুচিতা আধুনিক যুগের মহিলা, সে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে, সব সময় কমল ও আরতির সঙ্গে মন্দিরে যাওয়ার সময় হয় না বা পছন্দ করে না। কমল ও আরতি বলে, শুচিতাদের পূর্বপুরুষ নিম্ন শ্রেণির হিন্দু যারা মুচি (অস্পৃশ্য হিন্দু) জুতা মেরামতের কাজ করত। শুচিতা বলে, আমার দাদা রেলওয়েতে কাজ করত, কিন্তু কেউ কী বলেছে আমরা অস্পৃশ্য হিন্দু?
আমার দাদা ও দাদি রেলওয়ের কোয়ার্টারে থাকত। আমি কোনো দিন শুনিনি যে আমার পূর্বপুরুষ শিডিউল কাস্ট হিন্দু। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি এসব গুল্প বানিয়েছে আমাকে হেয় করার জন্য। তা ছাড়া ইন্ডিয়া থেকে এই কাস্ট সিস্টেম উঠিয়ে দিয়েছে।
শুচিতা প্রদীপকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কী কখনো শুনেছ যে আমাদের পূর্বপুরুষ মুচি (চামড়ার কাজ করত)?
প্রদীপ বলে, আমি তা শুনিনি, তা ছাড়া এই সিস্টেম ইন্ডিয়া থেকে উঠিয়ে দিয়েছে, মানুষ কাজ করে রুটি রোজগার করবে, এতে সমস্যা কোথায়?
প্রদীপ বলে, হিন্দুধর্মে শ্রেণি বলতে একসময় ছিল, মেথর, মুচি যে পুকুরে গোসল করত, সেই পুকুরের জল অশুচি বলে ধরে নেওয়া হতো। সরকার আইন করে এসব প্রথা উঠিয়ে দিলেও এটা সমাজ থেকে চিরতরে মুছে ফেলতে যুগের পর যুগ সময় লাগবে। শুচিতা বলে, আরতি এবং কমল আমাকে হেয় করার জন্য এসব বানিয়েছে।
সুমিত বলে, আমার মা-বাবা কি মিথ্যা কথা বলে?
কিন্তু এটার প্রমাণ কী?
সুমিত বলে, আমার মা-বাবা খোঁজখবর নিয়ে জেনেছে যে তোমরা নিম্ন শ্রেণির হিন্দু।
শুচিতা বলে, যদি তাই মনে করো যে আমরা নিম্ন শ্রেণির হিন্দু, তাহলে তোমার সঙ্গে আমার আর এ নিয়ে কোনো কথা বলাই ঠিক হবে না। আমার গায়ে হাত দিলে তুমি অশুচি এবং গোসল করতে হবে।
প্রদীপ বলে, ধরো শুচিতা তোমার পূর্বপুরুষ কেউ চামড়ার কাজ করত?
তা হলে কী তুমি অশুচি হয়ে যাবে?
সুমিত এ কথার জবাব না দিয়ে চলে যায়।
শুচিতা বলে, আমার শাশুড়ি আরতি গোঁড়া হিন্দু, সে এসব নিয়ে কয়েকবার আমার সঙ্গে তর্ক করেছে।
শুচিতার বাবা প্রিতম বলে, আমার দাদার ছোট ভাই হরিপদ মুচির কাজ করত, আমার দাদা কৃষিকাজ করত। আমার বাবা রেলওয়েতে চাকরি করতো, আমরা কখনো ওই কাজ করিনি। আভা বলে, আমার মা-বাবা কৃষিকাজ করত, তারা তো আমাকে বিয়ে দিতে আপত্তি করেনি। এটা তো বহু যুগ আগের কাহিনি, এরা মূলত আমাদের পছন্দ করে না, এ-সম্পর্ক কীভাবে টিকে থাকবে?
শুচিতা বলে, আমার শাশুড়ি আরতি উঁচু বংশ আর নিচু বংশ নিয়ে সব সময় একটা বাহাদুরির ভাব নিয়ে চলে। সে এই ঝামেলার সৃষ্টি করছে, তা ছাড়া বাবা, তুমি শিপে খালাসির কাজ করতে এবং কলে কারখানায় কাজ করো, এ নিয়েও আমাকে অনেক কথা শোনায়। আমার শাশুড়ির দুনিয়া সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান নেই।
বাবা, এরা এ খবর কীভাবে জেনেছে?
তোমাদের বিয়ের পর আরতি আমার বংশপরিচয় জানতে চেয়েছে। আমি মিথ্যা কথা বলিনি।
শুচিতা বলে, সুমিত, আমাদের বিয়েকে কেন্দ্র করে তার মা-বাবা এবং ভাইবোনদের দেশ থেকে এনে স্থায়ীভাবে থাকার সুবিধা দিয়েছে এবং এরা এখানে এসে আমাদের দাম্পত্যজীবনে বিঘ্ন ঘটিয়েছে। ওরা এ দেশে না এলে আমি এবং সুমিতের মধ্যে কোনো সমস্যা হতো না।
প্রিতম বলে, এরা মূলত স্বার্থপর লোক, যেই স্বার্থ শেষ হয়েছে, সেই ফিরে দাঁড়িয়েছে। আভা বলে, আমি তোকে আগেই বলেছি, তুই ভেবেচিনতে সিদ্ধান্ত নিবি। কিন্তু তুই আমাদের কোনো কথা শুনিসনি। এখন যা হওয়ার হয়ে গেছে, শক্ত হয়ে সবকিছু সিদ্ধান্ত নিবি।
মা, আমি ওকে দেখেছি, কিন্তু ওদের লোকজনকে দেখিনি। আমি কীভাবে বুঝব যে ওর মা আরতি এত কুটিল মানুষ?
সুমিত বিয়ে করেছে, ওদের লোকজন আনার জন্য। আমি অনেকবার শুনেছি আরতি লোকজনকে বলতে, সুমিত কী দেখে বিয়ে করেছে?
ও কী চায় আমি বুঝতে পারছি না।
প্রদীপ মনে মনে বলে, এই ঝামেলার মধ্যে না থাকাই ভালো। সে একটা শর্টকোর্স করে চাকরির ব্যবস্থা করে নিয়েছে এবং একদিন আংকেল ও আন্টিকে বলে, আমি আপনাদের কাছ থেকে অনেক সাপোর্ট পেয়েছি, এখন আলাদা থাকতে চাই। প্রিতম বলে, তুমি এখানেই থাকবে, কেন আলাদা থাকতে চাও?
সে বলে, আংকেল, আমি কাজের জায়গার কাছাকাছি থাকলে একটু সুবিধা হয়, তা ছাড়া আর একটু পড়াশোনাও করতে চাই।
প্রিতম বলে, প্রদীপ, তুমি চলে গেলে আমরা একাকী হয়ে যাব।
আংকেল, আমি জানি আপনারা আমাকে অনেক ভালোবাসেন, সে জন্য আমি অনেক কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমার সুবিধা আর অসুবিধার দিকেও দেখতে হবে।
ঠিক আছে, তুমি কবে যাবে?
আমি আগামী মাসে চলে যাব। আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার যেভাবে ভালো হয়।
আজ প্রদীপ কাজ থেকে বের হয়ে তার নিজের নেওয়া বাসা দেখতে গিয়ে বাড়িওয়ালী মারিয়াকে বলে, আমি আগামী সপ্তাহে কিছু ফার্নিচার এবং জরুরি এটা-সেটা কিনে ঘর আস্তে আস্তে সাজাব। বাড়িওয়ালী বলে, এটা তোমার বাসা, তুমি যেভাবে ভালো মনে করো সাজাবে। প্রদীপ বাসায় আসতে এক ঘণ্টা দেরি হলো এবং বাসায় ঢুকতেই ধ্রুব দৌড়ে এসে আংকেল আংকেল বলে কোলে গিয়ে উঠেছে। প্রিতম বলে, তুমি চলে গেলে ধ্রুবকে কে সামলাবে?
শুচিতা বলে, প্রদীপ কোথায় যাবে?
প্রিতম বলে, প্রদীপ তার কাজের জায়গার কাছাকাছি থাকার ব্যবস্থা করেছে।
আভা কিছুই বলছে না, চুপ করে প্রদীপের দিকে চেয়ে আছে। শুচিতা বলে, প্রদীপ, তুমি একা একা কীভাবে নিজেকে সামলাবে?
প্রদীপ বলে, চেষ্টা করে দেখি, যদি অসুবিধা হয় আংকেল-আন্টি তো আছেই। যেকোনো সময় আসা যাবে।
ঠিক আছে তুমি যা ভালো মনে করো। ধ্রুব তোমাকে না পেলে অনেক যন্ত্রণা করবে, তাই না ধ্রুব?
ধ্রুব ওর কোল থেকে নিচে নামিয়ে দিলে প্রদীপকে ডাইনিং টেবিলে টেনে নিয়ে বলে খাও খাও।
শুচিতা সন্ধ্যার দিকে প্রদীপকে বলে, তুমি আমার অবস্থা অনুধাবন করে চলে যেতে চাও?
না শুচিতা, তুমি আমাকে ভুল বুঝেছ, আমি কাজের একটু কাছাকাছি যেতে চাই। তোমার অফিস তো আমার অফিস থেকেও কাছে। তুমি আমাকে এড়িয়ে চলছ তাই না?
না শুচিতা, আমি তোমাকে এড়িয়ে চলব কেন?
আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সুমিতের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি করে নেব। যেখানে জাত-বংশ নিয়ে কথা হচ্ছে, সেখানে কীভাবে একত্রে থাকা যায়?
প্রদীপ বলে, শুচিতা, এটা তোমার নিজস্ব ব্যাপার, আমি এর মধ্যে কোনো রকম জড়াতে চাই না।
আমি জানি তুমি বলবে এটা তোমার ব্যাপার না। প্রদীপ হেসে বলে, আমি এর বেশি কী বলতে পারি?
হ্যাঁ, ঠিকই বলছ, তুমি এই অবস্থায় কী বলতে পারো?
তা ছাড়া সুমিত এবং ওদের মা-বাবা তোমাদের নিম্ন শ্রেণির লোক বলে এতে আমি নিজেও তার মধ্যে জড়িয়ে পড়ি। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার, আমাদের পূর্বপুরুষ কেউ যদি মুচির কাজ করে তাতে অসুবিধা কোথায়?
কেউ তো চুরি করে না, কাজ তো কাজই, হয় বড় কাজ, না হয় ছোট কাজ, বেঁচে থাকার জন্য যেকোনো ধরনের কাজ করলে পয়সা আসে, এতে মান-ইজ্জতের কী আছে?
এখানে স্কুল, কলেজ এবং ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা প্রয়োজনে একজনের গাড়ি, বাড়ি পরিষ্কার করে পয়সা নিয়ে যায়, তাতে মান-ইজ্জতের কিছুই যায়-আসে না।
কানাডার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ব্রায়ান মালরোনি ছাত্রজীবনে যে রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন, এখনো অতীব গর্বের সঙ্গে বলে, আমি এই রেস্টুরেন্টে কাজ করেছি এবং মাঝেমধ্যে খেতে যায়।
এ নিয়ে মহাত্মা গান্ধী ভারতে জায়গায় জায়গায় মিছিল সভা সমিতি করে বর্ণ প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য সারা ভারতের হিন্দুদের একত্র হতে বলেছিলেন। যদিও ভারত সরকার এই প্রথা উচ্ছেদ করেছে, কিন্তু লোকজনের মধ্যে এখনো নিম্নবর্ণ হিন্দুদের অবজ্ঞার চোখে দেখে, যেমন শুচিতার শ্বশুর-শাশুড়ি তোমাদের পরিবারকে নিম্নমানের লোক হিসেবে দেখে।
পরবর্তী মাসের প্রথম দিকে প্রদীপ নতুন বাসায় গিয়ে উঠেছে। ধ্রুব আংকেল আংকেল বলে রোজ চিৎকার করে। রাতে ঘুম থেকে উঠে প্রদীপের রুমে গিয়ে বলে, আংকেল নেই, আংকেল নেই, আমি এখানে ঘুমাব।
শুচিতার বাবা প্রিতম প্রদীপকে খুবই পছন্দ করে এবং সে বলে, শুচিতা, তোমার ভুলের জন্য এই সমস্যা এত দূর গড়িয়েছে।
শুচিতা বলে, আব্বু, আমি কীভাবে বুঝব সুমিত তার মা-বাবাকে এনে এখানে এই সমস্যার সৃষ্টি করবে। আমি তো ওকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছি, সুমিত প্ল্যান করে তার মা-বাবা এবং ভাইবোনকে এনে এখানে এই ঝামেলার সৃষ্টি করবে তা তো আমি জানিনি। সুমিতের বাবা কমল দেশে পূজা পার্বণের কাজ করত। মানুষ এই দুনিয়াতে পরিশ্রম করে কীভাবে দাঁড়ায়, এরা মানুষের শ্রমের সঠিক মর্যাদা দিতে শেখেনি।
সাপ্তাহিক ছুটিতে শুচিতা ধ্রুবকে নিয়ে প্রদীপের বাসায় সারপ্রাইজ দিয়ে বলে, তোমাকে দেখতে এলাম। ধ্রুব দৌড়ে গিয়ে প্রদীপের কোলে ওঠে। শুচিতা ঘরটা এদিক-সেদিক দেখে বলে, বেশ সুন্দর করে সাজিয়েছ। কিচেনে গিয়ে দেখে প্রদীপ রান্না বসিয়েছে। সে জিজ্ঞেস করে কী রান্না করো?
চাল, ডাল, টমেটো, সবজি, কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজ মসলা একত্রে দিয়ে রান্না বসিয়েছি, তুমি খেয়ে যেয়ো। আমরা মা-ছেলে খেলে তুমি কী খাবে?
অনেক রান্না করছি, তোমরা মা-ছেলে খেলেও অনেক থাকবে। শুচিতা বাইরে খাওয়ার অর্ডার দিয়ে বলে, ১০ মিনিটের মধ্যে খাবার এসে যাবে। কয়েক মিনিটের মধ্যে ডেলিভারি দরজায় নক করে। শুচিতা ডেলিভারি নিয়ে বলে, প্রদীপ, ডাইনিং টেবিলে খেতে এসো। প্রদীপ বলে, তুমি আমার বাসায় এসে বাইরে থেকে খাবার এনে খেয়ে যাবে?
তাতে কী?
আমি কী রান্না করলাম, ওটাও খেয়ে দেখো। শুচিতা টেস্ট করে বলে, বেশ তো মজাই হয়েছে। আর একদিন এসে তোমার হাতের রান্না খেয়ে যাব, অনেক সময় বসে থেকে বলে, এখন যাই। প্রদীপ বলে, আমি কী তোমাদের একটু এগিয়ে দিয়ে আসব?
না, দরকার নেই। ধ্রুব হাত উঠিয়ে বলে, বাই বাই। (চলবে)