ধোঁয়াশা

রীনা গুলশান

গত দুদিন টরন্টোতে টানা তুষারপাত হয়েছে! তুষারের পাহাড় জমেছে চারপাশ! তবু ওটা মাড়িয়েই অফিস যেতে হয়েছে! আজ রবিবার ছুটি! গতকালও ছুটি ছিল! কিন্তু ওর ছুটি ছিলো না! রেগুলার অফিস পাচঁদিন বাদেও, শনিবারে একটি রেস্টুরেন্টে মাসে চারদিন জব করে! যদিও অফিসের বেতন দিয়ে ওর নিজের ভালই চলে যায়! তবু বাড়তি টাকাটা ওর লাগে! হটাৎ পাওয়া এই একাকি জীবনে মুনা জেনে গেছে টাকার মাহাত্ম! গত তিনটা বছরের প্রতিটি ক্ষণ ওকে ঘিরে ছিল সব ধরনের যন্ত্রনার দৌরাত্ম!

আজকের এই ছুটির দিনটি মুনা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে চায়! যদিও সপ্তাহের বেশ কিছু রান্না ওকে করতে হবে! সেটা বিকালের দিকে ঝটপট কিছু একটা করে ফেললেই হবে! এই সুন্দর সকালটা ওর একান্ত নিজের! কিছুক্ষণ আগে মা/ ভায়ের সাথে সাপ্তাহিক রুটিন কথা বলে ফেলেছে! যদিও আজ কারো সাথে একদম কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না! কিন্তু মা, ভাইয়া সকালেই মিস কল দিয়ে রেখেছে! ভাইয়া অবশ্য একটা এসএমএস-ও পাঠিয়ে তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা দিয়েছে! যদিও এই দিনটি সে একদমই উপভোগ করে না! তবু মা, ভাইয়ার সাথে অনেক্ষণ কথা বলতে হয়েছে!

মায়ের সাথে তার খুব বেশিক্ষণ কথা বলতে ভাল লাগে না! কারণ মুনা জানে, কথা বলতে বলতে কিছুক্ষণ পরই মা তার ভাগ্য নিয়ে কপাল চাপড়াবে আর নিজেকেই দোষারোপ করবে! মুনা এখন সেসব আর শুনতে চায় না!

মুনা এখন এগিয়ে যেতে চায়! সামনে আরো সামনে! যেখানে আর পেছনের সেই অভিশপ্ত বিবমিষা তাকে স্পর্শ করবে না!

বাংলা নাটক একটা চালিয়ে দিল! মিশো আর মেহজাবিনের নাটক! এই মেয়েটিকে তার খুব ভাল লাগে! কিন্তু নাটকটা দুঃখের! ধুর! এই দুঃখের গীত সে আর শুনতে চায় না! হাসতে চায় মুনা! গলা ছেড়ে হাসতে চায়!

বুকের ভেতরের সব অপমান, যন্ত্রনা, কষ্ট, নির্জলা হাসি দিয়ে সব উড়িয়ে দিতে চায়!

সেদিনও তো তার জন্মদিন ছিল। বাইরে খুব তুষারের বর্ষন ছিল। আর ঐ দূর্যোগের রাতে মুনা এক কাপড়েই বের হয়ে এসেছিল! ক্ষিধা এবং শারিরীক অত্যাচার এবং অপমানের পাহাড় সাথে নিয়ে! চোখে এতটুকু কান্না ছিল না। ঐ রাতেই কোনমতে সাবওয়ে ধরে তার এক মাত্র প্রিয় সুহৃদ বন্ধু প্রিয়ার বাড়ীতে! অনেক রাত তখন! ওটাই শেষ ট্রেন ছিল! সে টিকিট কেটেও অনেক্ষণ স্টেশনে বসে ছিল! যাবে কি যাবে না প্রিয়ার বাড়ীতে, অত কষ্টের মধ্যেও দ্বিধা তাকে পেয়ে বসে ছিল! যদিও প্রিয়া তার জীবনের আদ্যপান্ত যা কিছু ঘটে চলেছিল তার সবই জানতো! তবু! এই তবুটাই গত আটটি বছর তাকে কুরে কুরে খেয়েছে! প্রতিটি মুহূর্তে মনে হতো এবারে সব ঠিক হয়ে যাবে! শিহাব আর তার গায়ে হাত তুলবে না! অকথ্য গালি দিবে না! ড্রাগ থেকে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু না, দিনের পর দিন সেটা বেড়েই চলছিল।

শিহাব তার আট বছরের বিবাহিত স্বামী! এটা তার সম্পূর্ণ এ্যারেঞ্জড্ ম্যারেজ ছিল। মুনার বড় চাচা এই প্রস্তাব এনেছিল। চাচার ছোটবেলার বন্ধুর ছেলে! যদিও সেই বন্ধু তিরিশ বছর ধরে জার্মানীতে আছে! মাহতাব কাজী। খুব নাকি বনেদি ঘর! শিক্ষিত! এক বিকালে বড় চাচা, সস্ত্রীক মাহাতাব সাহেব কে নিয়ে তাদের বাড়ী এলেন! প্রচুর খাবার, মিষ্টি সাথে নিয়ে এলো! তখন মুনার বাবা বেঁচে! ১৭ বছরের মুনা তখন কলেজের প্রথম বর্ষে! অসাধারণ রূপবতী মুনার সেই অষ্টম শ্রেণীর থেকে বিবাহের পয়গম আসা শুরু হয়েছে! মা / বাবা ও জানতো তাদের মেয়ে অসম্ভব রূপবতী। তাই এই প্রস্তাব আসাকে তারা স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিল! কিন্তু আজকের এই প্রস্তাবের বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা! অতি সুপাত্র! ফ্রাঙ্কফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে গ্রাজুয়েট। ওখানে নিজেদের বিশাল বাড়ী, গাড়ী। পাত্র সুদর্শন। আর কি চাই। মা অলরেডী গদগদ হয়ে খাবার দাবারের জন্য ছুটোছুটি শুরু করেছে! কিন্তু  মুনার বাবা আনোয়ার হোসেন সমানে কিন্তু কিন্তু করছে! তার ইচ্ছা তার অতি আদরের একমাত্র কন্যা অন্তত পক্ষে বি,এ টা পাশ করুক! তার দুই ছেলেই দাড়িয়ে গেছে! বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার! আমেরিকায় থাকে! ছোট ছেলে ফাইনান্সে মাষ্টার্স করে এক প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরী করছে! ধরতে গেলে তাদের মেয়েটা একেবারে বুড়ো বয়সের! বড় ছেলের সাথে মুনার ২১ বছরের পার্থক্য! দুই ভাইয়েরও তাই মুনা, জানের টুকরা ।

মুনার বাবা, ভাইকে আড়ালে ডেকে কিছু সময় চাইলো! বড় চাচা নাজমুল হোসেন বেশ মনক্ষুন্ন হলেন!

: কেন আমাকে তোমাদের বিশ্বাস হয় না ?

– না ভাইজান, সেটা না, মেয়েটা খুব ছোট। বড়ই আদরের। বিয়ের জন্য তেমন ওর প্রস্তুতিও নাই। আর একটু ম্যাচুরিটিতে বিয়ে হলে ভাল হতো!

– শোন, তোর মেয়ে যে ধরনের সুন্দরী, ওকে এমনিতেই ঘরে বেশীদিন রাখতে পারবি না! হয় কারো সাথে ভেগে যাবে , বা  কেউ ওকে না পেয়ে উঠিয়ে নিয়ে যাবে অথবা এসিড মেরে দিবে! বাংলাদেশের কোন বিশ্বাস নাই। আর এই পাত্র জানা শোনা ঘরের!

– কিন্তু ভাইজান তোমার তো এদের সাথে বহুদিন যোগাযোগ নাই!

– আরে এরা খুবই সম্ভ্রান্ত ঘর! এরা যে আমাদের প্রস্তাব দিয়েছে এটাই কপাল!

মুনার মা, প্রথম থেকেই খুব রাজী ছিল! এখন একদম নেচে উঠলো!

ব্যাস, শিহাবের বাবা/ মা পরদিনই ছেলেকে নিয়ে হাজির! ইনিয়ে বিনিয়ে তাদের পরিবারকে মোহাবিষ্ট করে ফেললো! মুনাকে তারাতো আগেই দেখেছিল! এবারে শিহাবের সাথেও আলাপ করিয়ে দিল!

অবশেষে কথা হলো, সামনের শুক্রবারেই নিকাহ হবে। আর মুনার এইস এস সি ফাইনাল পরীক্ষার পর অনুষ্ঠান করে তুলে নিয়ে যাবে! তবে নিকাহ নামার পর পরই শিহাবরা মুনাকে জার্মানে নেবার জন্য প্রসেসিং শুরু করে দিবে!

শুক্রবার বাদ জুম্মা ১৭ বছর বয়সে মুনার বিয়ে হয়ে গেল! কথা হলো পরের বছর রেজিস্ট্রি হবে, কারণ তখন মুনার ১৮ পূর্ণ হবে! নিকাহর পর শিহাব পনেরো দিনের মত ছিল! ওকে এক মিনিট চোখের আঁড়াল করছিল না! হয়তো এটা মোহ, ভালবাসা? কি জানি? তবু কেন জানি মুনার দম বন্ধ ভাব লাগছিল! প্রতিটি ব্যাপারেই শিহাব তার নিজস্ব মতামতটাই জোরালো ভাবে এস্ট্যাবলিশ করতে চাইছিলো! মুনা নিজেকে প্রবোদ দিচ্ছিল এই বলে যে, হয়ত তার কোন পূর্ব রাগ ছিল না, সেই কারণেই তার বেশী বেশী মনে হচ্ছিল! এরপর ওরা চলে গেল!

তখন মুনার পড়াশুনার খুবই চাপ। সে বরাবরই খুব ভাল ছাত্রী! পড়াশুনার ব্যাপারে অসম্ভব সিরিয়াস! কিন্তু শিহাব জার্মান যাবার পর থেকে একাধারে ফোন করা শুরু করলো। সকাল বিকাল রাতের ভূ ভাগ! কি অবস্থা! প্রথম প্রথম মা/ বাবা মুখ টিপে হাসতো! তাদের ল্যান্ড ফোনে কথা হতো! আর ল্যান্ড ফোনটা ড্রয়িং রুমে থাকতো। ক্রমশ সে হাপিয়ে উঠছিল! তখন সে মাকে ঈশারা করতো শিহাব কে বলতে যে, সে ঘুমিয়ে আছে বা বাসায় নাই! তখন আবার নানা প্রশ্ন বানে মা কে অতিষ্ট করে দিত!

ক্রমশ, পরীক্ষা এগিয়ে আসছিল, আর শিহাবের ফোনও বেড়ে যাচ্ছিল! একদিনতো মুনা বলেই ফেললো –

– তুমি অফিসে কখন যাও ? সারাক্ষণ তো আমার সাথে কথা বল?

–  কেন তুমি বিরক্ত হও আমার ফোনে?

– না, মানে আমারতো আর কিছুদিন পর পরীক্ষা, এখনতো একটু বিজি… সে আমতা আমতা করে বলে ।

– ও আচ্ছা! ঠিক আছে তাহলে আর করবো না, বলেই ফোনটা ঠাস কর রেখে  দিল!

মুনার একটু খারাপ লেগেছিল! আবার মনে মনে হাফ ছেড়ে বেঁচেছিল!

যাইহোক পরীক্ষা ভাল ভাবেই হয়ে গেল! যদিও এস এস সির মত ভাল রেজল্ট হলো না! ওরা পরীক্ষার তিন মাসের মধ্যেই এসে উঠিয়ে নেবার ডেট দিল! মজার ব্যপার এবারে এসে অন্যরকম কথা বার্তা! শিহাবের বাবা মা বললো অনুষ্ঠান যা করার আপনারাই করেন। আমরা জার্মানে যেয়ে বড় করে বৌভাত করবো।

যেহেতু কথাছিল সব যৌথ ভাবে করবে, তাই ঐ ভাবেই মুনার বাবা তৈরী ছিল! এদিকে মুনার বড় ভাই কিছু টাকা পাঠাতো মাসে মাসে! সম্প্রতি সে একটি গায়েনিজ মেয়েকে বিয়ে করেছে! তার বড়ভাই ১০/১২ বছর ধরে আমেরিকার কলারাডোতে থাকে। সে হঠাৎ করে টাকা দেওয়া বন্ধ করেছে! তাই সব মিলিয়ে ওর বাবা খুবই বিব্রতকর পরিস্হিতিতে পড়লো! তবু প্রায় ১৫০ জনের মত মানুষ কে নিয়ে অনুষ্ঠান হলো! গায়ে হলুদ ও হলো! বিয়েতে ওরা এমনকি কোন গহনাও দিল না। বললো ওখানে যেয়ে দিবে! মেয়ে পক্ষরা সবাই গোটা অনুষ্ঠানে বিরক্ত এবং মনক্ষুন্ন হয়ে রইল! তবু বিয়ের সব কাজ ঠিক ঠাক ভাবেই সম্পন্ন হলো! যদিও ওর বাবার ১০ লক্ষ টাকার মত দেনা হলো! মাহতাব কাজী তার বৌ নিয়ে জার্মান চলে গেল! কিন্তু শিহাব আরো মাসখানেক রয়ে গেল! তার আবার বায়নাক্কার শেষ নাই। এটা খায় না, ওটা খাবো ইত্যাকার ঝামেলায় মুনার মা লাইলি বেগম তটোস্হ হয়ে রইল। অবশেষে বিয়ের কাগজ এবং সব রকমের কাগজ পত্রের কপি নিয়ে শিহাব গাত্রত্থান করলো!

কি জানি কেন, প্রথম থেকেই ভালবাসার যে বেহাগ বাজার কথা, বার বার সে সুরের লহরী কেটে যাচ্ছিল। যদিও তার জীবনের প্রথম পুরূষ, প্রথম প্রেম, প্রথম স্পর্শ সবই শিহাব। তবু, কেন যে…!

“ সেই সব পথে বহু পতাকার সার কিন্তু প্রাণচিহ্ন নেই।

  দুরারোগ্য অসুখের শ্বাসকষ্টে বিদীর্ণ বাতাস

  এবং পাথরও খুব,বড় বড়  ডাকাতের  মতন পাথর ।

  যেতে যেতে রক্তপাত হয়।

  যেতে যেতে সর্বাঙ্গের উদ্যমেও অভিলাষে, বাসনায় ,

  বাহুতে, বল্কলে

  নীল মরচে পড়ে।” (পূর্ণেন্দু পত্রী)

অবশেষে একদিন জার্মানী যাবার দিন এলো। মুনা তার দিন পনেরো আগের থেকেই কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। আসবার আগে ছোট ভাই আফতাব ওকে একটা সেল ফোন উপহার দিল। হেসে হেসে বললো, এখনতো তোর বিয়ে হয়ে গেছে, এবারে সেল ফোন রাখতে পারিস!

মাও এক গাদা সালোয়ার কামিজ বানিয়ে দিল! শশুর শাশুড়ী, শিহাব, শিহাবের ভাই এর জন্য দামী দামী কাপড় দিয়ে দিল। এয়ার পোর্টে নিজে কেঁদে, সবাই কে কাঁদিয়ে, ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ার পোর্টে এলো। সেখানে সবাই অপেক্ষমান। এমনকি শিহাবের ভাইকেও প্রথম দেখলো। সেলিম নাকি পড়াশুনায় খুব ব্যস্ত ছিল। তার বাংলাদেশে যেতেও নাকি ভাল লাগে না! কদিন বেশ হৈচৈ এর মধ্যে কাটলো! দিন পনেরো পর ঐ বাড়ীর-ই বেজমেন্টের পার্টিরুমে একটা বৌভাত মত হলো। তাকে কোন গহনা দিল না।

কিন্তু সেটা তার মোটেই বিস্ময়ের ছিল না! যতটা না প্রথম এই বাড়ীতে পা দিয়ে হয়েছিল। বিয়ের সময় এরা বলেছিল, তাদের নিজেদের বিশাল বাড়ী (ম্যানশন), গাড়ী ইত্যাদি! অথচ ঢুকেই দেখলো ১৬ তলার এক বিশাল এপার্টমেন্ট বিল্ডিং, যার ১১ তলায় মাত্র ২ কামরার একটা এপার্টমেন্টে তারা থাকে। পরে জেনেছিল, সেই এপার্টমেন্টও সরকারী! আসবার সাথে সাথেই, একটার পর ধাক্কায় মুনা ভাষা হারিয়ে ফেলেছিল! বুঝলো তাদের সাথে বিরাট একটা প্রতারণা হয়েছে। তবে জানা আরো অনেক বাকি ছিল।

শিহাবের একটি ভাল গুন ছিল, সে মিথ্যা কথা বলতো না। যেহেতু এদেশে বড় হয়েছে। তার সাথে কথায় কথায় জানতে পারলো, তার কোনই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নাই! অনলি গ্রেড টুয়েলভ পাশ। সে জাস্ট নরমাল একটা জব করে। সপ্তাহে তিন দিন বা চার দিন জব করে। তারা প্রথম থেকেই সরকারী ফ্যাসেলিটি নানা ভাবে নিয়ে চলেছে ।

মুনা কাওকে বলতে পারছে না! সইতেও পারছে না! দেশে বাবা/মা/ভায়ের সাথে কথা বললে তার পাশে সবাই এসে বসে থাকে। দেখতে দেখতে ৬ মাস চলে গেল। এর মধ্যে এটাও বুঝেছে, শিহাব ড্রাগ এডিকটেড। তাই তার বাবা / মা বাংলাদেশের থেকে সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করিয়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু ড্রাগ এডিকশন কি এসবে যায় ? সে ৬ মাস রিহাব সেন্টারেও ছিল। এর মধ্যে সামান্য কথা কাটাকাটিকে কেন্দ্র করে শিহাব তার গায়ে হাতও তুলেছে। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই তার মনে হলো তার ১০ বছর বয়স বেড়ে গেছে! জীবনে তার আরো অনেক কিছু দেখতে হবে, সেটা সে বুঝে গেছে।

তবু তার ভেতরে একটাই ভাল হয়েছে, তার শশুর তাকে ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্সে ভর্তী করে দিয়েছে আর প্রিয়ার মত একটা বন্ধু পেয়েছে। তার থেকে ৬/৭ বছরের বড়, তবু বন্ধুত্ব তো বয়সের ব্যবধান মানে না। প্রিয়ার ২ টা বাচ্চা। ৪ বছরের একটা ছেলে আর ৭ মাসের একটা মেয়ে। বড়টাকে স্কুলে দিয়ে ছোটটাকে কোলে নিয়ে, সেও ল্যাঙুয়েজ ক্লাসে আসে। এখানকার ডে-কেয়ারে বাচ্চা রেখে প্রিয়া ক্লাস করে। এখানেই তাদের দুজনের নিবিড় বন্ধুত্ব হয়ে গেল।

বাড়ীতে যতক্ষণ থাকে, তার শাশুড়ী তাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়। এমনকি বাংলাদেশের স্টাইলে তাকে দিয়ে ঘর মুছায়। স্কুলে গেলে ওর শাশুড়ীর গায়ে আগুন ধরে যায়। তবু সে দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করে যাচ্ছে। প্রিয়া তাকে সমানে সাহস যুগিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে স্কুলের চলাকালিন সময়ে, তার মা/বাবা-কে একে একে সব বলেছে। মুনার বাবা/ মা সাথে সাথে বলেছে, জার্মানিতে থাকার দরকার নাই। দেশে ফিরে যেতে ।

কিন্তু এই বয়সে সে এটুকু বুঝেছে, এটা কোন সমাধান নয়। তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। তার বিয়ের দু বছরের মাথায় হটাৎ খবর এলো, তার বাবার হার্ট এটাক হয়ে এক ঘন্টার মধ্যেই মারা গেছে। কারণ সে যখন থেকে শুনেছিল যে, শিহাব রা সব মিথ্যা বলেছে ; আনোয়ার সাহেব সারাক্ষণ কপাল চাপড়িয়ে কাঁদতো আর বলতো আমার সোনার প্রতিমাকে জলে ভাসিয়ে দিয়েছি। খবরটা পেয়ে মুনাকে এবারে শিহাবই সাথে সাথে টিকিট কেটে পাঠিয়ে দিল। যদিও দেশে গিয়ে বাবাকে দেখতে পেল না। শুধু ভাইয়ার বিপর্যস্ত মূর্তি দেখলো আর মায়ের অবিরাম কান্না দেখলো। এক মাস ছিল! যদিও মা, ভাইয়া বারবার বলছিল, ওখানে আর ফিরে না যেতে! কিন্ত মুনা শুনলো না।

ফিরে এলো সেই অপ্রত্যাশিত জীবনে।

এবারে ফিরে আসার পর থেকেই দেখছিল, শিহাবের অস্বাভাবিক পরিবর্তন। কথা খুব কম বলছে। রাতের গভীরে মুনা তার যত নিকটবর্তী হতে চায়, সে ততই যেন দূরে সরে যায়। আবার মুনা ঘুমিয়ে গেলে, শিহাব উঠে সারারাত কার সাথে যেন চ্যাটিং করে। মাঝে মাঝে গলা চেপে খুক খুক করে হাসে। মুনার ঘুম ভেঙ্গে যায়, তবু ঘুমের ভান করে বাকী রাত জেগে থাকে। ভাবে সে কি অপরাধ করেছে ? এর মধ্যে তাদের তৃতীয় এবং যথাক্রমে চতুর্থ এনিভার্সারীও চলে গেল চুপিসারে! ৫ম বছরে মুনা নিজের থেকে, শিহাবকে বললো, আমাদের এখন বেবী নেওয়া দরকার। সে তার জবাবে অত্যন্ত কদর্য ভাবে বললো ঃ দরকার মনে হলে অন্য কোথা থেকে ক্যারি করো। মুনা সারারাত প্রচন্ড অপমানে নীল হয়ে রইল।

এমনকি তার শশুরকেও এক দুপুরে যখন শাশুড়ী ছিল না, শিহাব ছিল না, তখন শিহাবের মারাত্মক পরিবর্তনের কথা বললো! শশুর চুপচাপ শুনে বললো ঃ তুমি একটা চাকরী নাও মা! তোমার ভাল লাগবে!

প্রিয়ার হাসবেন্ডই তাকে ঐ রেস্টুরেন্টের চাকরীটা করিয়ে দিয়েছিল! ওখানকার ম্যানেজার তার বন্ধু ছিল। মজার ব্যাপার সে চাকরী পাবার পর শিহাব অতি খুশী হয়ে গেল! কারণ ওকে মাত্র কিছু টাকা হাত খরচার জন্য যেটা দেওয়া লাগতো, সেটাও আর দেওয়া লাগলো না! ২ বছরের লারনিং কোর্স শেষ হবার পর, প্রিয়া বুদ্ধি দিল পার্ট টাইম কোন একটা কোর্সে কলেজে ভর্তি হতে। শশুরের সাথে পরামর্শ করে কলেজে একাউন্টিং এর ২ বছরের কোর্সে ভর্তি হলো। কলেজ, চাকরী, বাড়ী এসে নিত্যকার কাজ, এসবেই বিজি হয়ে রইল।

শিহাব তার সাথে ভাল করে কথা বলাই ভুলে গেল! বাচ্চা নেবার ব্যপারে ঐ নোংরা কথাটা শোনার পর থেকে মুনার ভেতরের রোমান্স গুলো কেমন জানি শুকিয়ে যাচ্ছিলো। তবু স্বামীকে কাছে টানার ব্যর্থ চেষ্টা সে অবিরত করে যাচ্ছিল। তার যে সব খাবার প্রিয়, সেগুলো বানিয়ে সামনে ধরতো, শিহাব নির্বিকার খেয়ে নিত। একটা ধন্যবাদও বলতো না। তার লাল প্রিয় রং। বাসায় থাকলে লাল শাড়ী, বড় করে লাল টিপ পরে শিহবের সামনে ঘোরাঘুরি করতো। উল্টো সে বলতো-

– কোথাও যাচ্ছো নাকি ?

– চলনা আজ কোথা থেকে ঘুরে আসি ।

– না, আমার সময় নাই, তোমার ইচ্ছা হলে ঘুরে আসো।

– বারে, তুমি ছাড়া কার সাথে ঘুরবো?

– কেন, কলেজে যাও, চাকরী করছো, একটা ব্যাটা ছেলে ধরতে পারছো না ?

– এসব কি বলছো তুমি – মুনা চিৎকার করে কেঁদে ওয়াশরুমে গিয়ে বুক ভাসালো ।

মুনা এখন কি করবে? প্রায় ৫ বছর হতে চলেছে তাদের বিয়ের! সেতো শিহাবকেই পাগলের মত ভালবাসে। তার বাচ্চার মা হতে চাইছে। কিন্তু সেতো পণ করেছে তার কাছে আসবে না, তাকে ভালবাসবে না।

এর মধ্যে একদিন কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে শিহাব বলেই দিল –

– তোমাকে ভালবাসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

– কেন আমি কি করেছি, কি দোষ আমার?

– না, তোমার কোন দোষ নাই। আমি অন্য একটা মেয়েকে ভালবাসতাম, সে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, তখন রাগ করে তোমাকে বিয়ে করি! কিন্তু জেনীফার আবার আমার কাছে ফিরো এসেছে। আমি ওকে ভুলতে পারছি না!

-এখানে আমার কি দোষ? আমাকে কেন এর মধ্যে টেনে আনলে ? আমার তো সব কিছু তুমি …, মুনা আর কথা বলতে পারছিলো না ; অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো!

সারারাত কেঁদে কেঁদে এক সময় মেঝের উপরই ঘুমিয়ে পড়লো। তবু শিহাব তাকে বিছানায় তুলে নেই নি। তার কান্নাও থামাতে আসেনি। এরপরও বেশ কিছুদিন চুপচাপ কাটলো। কিন্তু মুনার ব্রেন এক রকম কাজ করছিলো না। সে এখন কি করবে? কার কাছে যাবে? একটা শেষ চেষ্টা করবে না? এসবই তার মাথায় অবিরাম তোলপাড় করছিল।

সেদিন তার জন্মদিন ছিল। সকাল থেকে মা, ভাইয়া উইশ করেছে। দেবর টাও উইশ করলো। আর কেও করেনি। রোজকার ঘরের কাজ করে জবে গেল। কলেজ বন্ধ ছিলো কয়েকদিনের। জবেই লান্চ টাইমে প্রিয়াকে ফোন দিল, কারণ তাকে অনেকবার কল করেছিল। লান্চটাইমে সে কলারআইডি চেক করে, তারপর কল ব্যাক করে। প্রিয়া তাকে জন্মদিনের শুভকামনা জানালো। মুনা বেশী কথা বললো না। কারো সাথেই কথা বলতে পারছিল না।

৫ টার মধ্যে বাসায় ফিরে আসলো। দেখলো শিহাব ঘরে শুয়ে শুয়েই ঐ মেয়ের সাথে চ্যাট করছে। এখন আর আড়ালটাও রাখছে না।

তবু মুনার বেহায়া মন, তাকে পাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে। রান্না ঘরে গিয়ে ঈলিশ পোলাও করলো। ঘরে চাপলি কাবাব বানিয়ে ফ্রোজেন করে রেখেছিল, তার থেকে অনেক গুলো ফ্রাই করলো। সবাইকে খেতে ডাকলো। তখন বাইরে তুমূল তুষারের বর্ষণ শুরু হয়েছে। সবাই টেবিলে এসে খাওয়া শুরু করেছে। শিহাব আসছে না। তখন মুনা নিজেই আবার ডাকতে গেল ঃ  এই খেতে চলো, দেখো তোমার প্রিয় ঈলিশ পোলাও করেছি।

– না, আমি খাবো না। আমি বিকালে হেভি খেয়েছি। আমার ক্ষিধা নাই ।

– আমি এত কষ্ট করে রান্না করলাম।

– আমি তোকে বলেছি ?

– তুই তোকারি করছো কেন? আজ আমার জন্মদিন, তাই সবাইকে ভাল খাওয়াতে ইচ্ছা করলো!

– জন্ম দিন তো আমি কি করবো, তোকে কোলে নিয়ে নাচবো?

মুনা আর সহ্য করতে পারলো না । সে দৌড়ে গিয়ে শিহবের বুকের কাছে সার্ট চেপে ধরে চিৎকার করলো-

– অবশ্যই আমাকে  নিয়ে নাচবে, আমি তোমার বউ।

তবে রে ….আমার সাথে জোর দেখাতে এসেছিস – বলেই মুনাকে একটা জোর ধাক্কা দিল, মুনা সারাদিন না খাওয়া, ঘুরে গিয়ে বেড সাইড টেবিলের কর্ণারে গিয়ে পড়লো।

মুনা চিৎকার করে। ও মাগো বলেই ফেইন্ট হয়ে গেল ।

অনেক্ষণ, কতক্ষণ মুনা অজ্ঞান হয়ে ছিলো জানে না। কানের কাছে অনেক শব্দের গুন্জন; সে চোখ মেলে চাইলো। দেখলো চারপাশে পুলিস এবং প্যারামেডিকেলের টিম ভর্তি। সে ধড়পড় করে উঠতে গেল, ওরা উঠতে দিল না। কপাল থেকে অনেক রক্ত ঝরেছে। চারপাশে এখনও রক্তের দাগ। পরে শুনলো পাশের ফ্লাটের যে বুড়ো দম্পতি থাকে তারাই পুলিশ কল করেছে। এবং ওরাই বলেছে, যে শিহাব ড্রাগ এডিক্টেড, প্রায় ওর গায়ে হাত তোলে। জ্ঞান ফিরে আসায় পুলিশ ওর কাছে ডিটেলস জানতে চাইল। মুনা আর লুকানোর প্রয়োজন দেখলো না। তাদের চিটিং করে বিয়ে করিয়ে আনা থেকে, জেনিফার পর্যন্ত সবই বললো। পুলিস শিহাব কে এরেস্ট করে নিয়ে গেল। মুনাকে সেলটারে নিতে চাইলো। সে সেলটারে যেতে রাজী হলো না। অনেক্ষণ পর রাত তখন ১১ টা বেজে গেছে ; মুনা অনেক কষ্টে উঠে একটা ব্যাগে মোটামুটি জরুরী কিছু কাপড় এবং জিনিশ পত্র নিয়ে বাড়ী থেকে বের হলো। যাবার সময় সেলিম কে বলে গেল। গত পাঁচ বছরে এই ছেলেটা তাকে অনেক মায়া করেছে। শশুরকে বলতে চেয়েছিল, কিন্তু সেও পুলিশের সাথে গিয়েছিল।

তারপর ঐ রাতে অনেক দ্বিধার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে প্রিয়ার বাড়ী গিয়েছিল। ওরা স্বামী/স্ত্রী ওর জন্য যা কিছু করেছে, ঐ গভীর সঙ্কটে, সেটা চিন্তারও অতীত। এই যে আজ ওর থাকার একটা ঠাঁই হয়েছে, এর জন্যও ওদের অনেক অবদান। অবশ্য পুলিশেরও সহায়তা ছিল। সে যেহেতু নিপীড়িত একাকি একজন মহিলা, তাই সরকার থেকেই ওকে এই এক বেড রুমের এপার্টমেন্ট দিয়েছে। আর এই গত তিন বছরে তার এই থাকার যুদ্ধ। কোর্টে যাওয়া আসা ডিভোর্সের জন্য। পড়াশুনা, জব, সব মিলিয়ে এক কঠিন সেই যুদ্ধ। তারপর একাকী অসম্ভব সুন্দরী এক কন্যার জন্য সুহৃদ এরও অভাব হয় না। ইতিমধ্যে ডিভোর্স হয়েছে। পড়াশুনাও শেষ হয়েছে। একটা কোম্পানিতে একাউন্টস সেকশনে জবও হয়েছে।

এই তিন বছর সে দেশে যায় নি। মায়ের অবিরাম কান্না, তার ভালো লাগে না। মাত্র ২৫ বছরেই একটা জীবন মুনা দেখে ফেলেছে। ওহ আজকের এই ছুটির দিনটাতে সে আবার সেই কাসুন্দি ঘাটছে? চিল মুনা চিল … নিজের সাথে কথা বললো সে …

“ কেউই বোঝে না, তবু আছে আরো আকাঙ্খিত সুস্নিগ্ধ জগৎ ;

   যখন মানুষ তাকে দুঃখ দেয়,

   দলবেঁধে যখন ঠোকরায় তাঁকে নষ্ট কিছু পাখি ,

   তখোন ঘাসের দিকে তাকাও-

দেখবে ঘাস নতমুখ,অধোবদনের কিছু ভাষাস্নেহ লেগে আছে তৃষ্ণার্ত তরুর ঠোঁটে

   ভোরবেলা শিশিরের মত। ( আবুল হাসান)

গল্পটি লিখেছেন কানাডা প্রবাসী রীনা গুলশান