‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না’

জসিম মল্লিক

একদিন বরিশাল ছেড়ে চলে আসলাম ঢাকায়। মহসিন হলে থাকি। হলে রুম পাওয়ার আগে নানা জায়গায় থাকতে হয়েছে। রুমটা ছিল জাসদের ক্যাডারদের। ওখানে টিকতে পারলাম না। এমন সময় আমার বন্ধু খায়রুজ্জামান কামাল আমাকে নিয়ে গেলো তার ৬৩২ নম্বর রুমে। সে তখন এরশাদের দৈনিক জনতার বিশ্বদ্যিালয় রিপোর্টার। বেশ দাপট। আমি কঠিন সময় পার করছি। পকেট হাহাকার করছে। বিচিত্রার আশপাশ দিয়ে ঘুরি। ভিতরে ঢোকার সাহস পাই না। ১৯৮৪ সালে বিচিত্রায় কাজ করার সুযোগ পেলাম। প্রদায়ক হিসাবে। বিচিত্রা দৈনিকবাংলা ট্রাষ্টের পত্রিকা ছিল। দৈনিকবাংলায় তখন ছায়ামঞ্চ নামে একটি বিভাগ ছিল। সেখানে চলচ্চিত্রের খবর ছাপা হতো। পাতাটি দেখতেন রেজোয়ান সিদ্দিকী। চলচ্চিত্রের প্রতি আমার উৎসাহ এবং সচিত্র বাংলাদেশে কাজ করেছি শুনে আমাকে কাজ দিলেন প্রতি সপ্তাহে সিনেমা দেখে তার রিভিউ লেখা এবং এফডিসিতে গিয়ে খবরা খবর সংগ্রহ করা। আমি বরিশালে থাকতেই মাঝ মাঝে চিত্রালীতে আপনাদের পাতায় সিনেমা নিয়ে লিখতাম। প্রায়ই বিচিত্রার মাহমুদা চৌধুরীর চলচ্চিত্র সমালোচনা থেকে কপি করতাম। একবার একজন পাঠকের কাছে ধরাও পড়ে গেলাম। সে আমার এই কপি করার কথা লিখল চিত্রালীতে। সেই থেকে অন্যের লেখা আর কপি কিরিনি। রেজোয়ান সিদ্দিকী আমার চাকরি পাওয়ার জন্য অনেক হেল্প করেছেন তখনকার দিনে। তার অনেক স্নেহ ভালবাসা পেয়েছি।

শৈশবে প্রায়ই কাঠি দিয়ে সাইকেলের রিং চালাতাম। প্রতীকী ছবি : পেইন্টিরেস্ট

একবার এফডিসিতে গেলাম। গিয়ে দেখি নায়ক উজ্জলের একটা মারদাঙ্গা ছবির সুটিং চলছে। উজ্জল তখন মোটামুটি মেগাস্টার। আমি সাংবাদিক। আমার আবার ভয় কি! ঢুকে পরলাম সেটের ভিতর। সুটিং বন্ধ! উজ্জল খেপে গিয়ে আমাকে সেট থেকে বেড় করে দিলেন এবং দৈনিক বাংলায় আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন। আর একবার গেলাম এফডিসির পিআরও গুলরুখ আপার কাছে। তিনি হচ্ছেন সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের বোন। গিয়েই সরাসরি বললাম, এফডিসিতে কী কী দূর্নীতি হয় বলেন। তিনি হেসে বললেন, আমি পিআরও। আমি কী আপনাকে বলবো যে এখানে দূর্নীতি হয়! অনেক পরে প্রেসক্লাবে যখনই তার সাথে দেখা হতো এই ঘটনা নিয়ে হাসাহাসি করতেন! চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা খতম। শুরু হলো সিনেমা দেখা। প্রতি সপ্তাহে একটা করে সিনেমা দেখি। তখন থেকেই বাংলা সিনেমার অধপতন শুরু হয়েছে। একসময় ক্লান্ত হয়ে ইস্তফা দিলাম ছবি রিভিউ লেখার।

রহস্যময়তা হচ্ছে মানুষের চরিত্রের প্রধাণ গুণ। রহস্যময়তার এই ঘেরাটোপ তাকে এক বিশেষ মাত্রা দিয়েছে। মানুষ যে পশুর চেয়ে আলাদা তা তার সৃষ্টিশীল কার্যক্রমেই প্রমাণিত হয়। মানুষ কত কী দিয়েছে এই পৃথিবীকে, কত কী আবিষ্কার করেছে। কিন্তু তার নিয়ত পরিবর্তনশীল মনের রহস্য কেউ উদঘাটন করতে পারেনি। আমরা যদি লক্ষ্য করি দেখতে পাবো আমাদের চারপাশের মানুষগুলোই কেমন দিনে দিনে বদলে যায়। আমাদের সন্তান, ভাই, বন্ধু, বাবা, মা সবাই বদলায়। কখনও এই পরিবর্তন স্বাভাবিক মনে হয় কখনও মনে হয় আশ্চর্য্যরে!

আমার শরীরে এখনও লেগে আছে শৈশবের সোঁদামাটির গন্ধ। আমি কখনও ভুলতে পারি না ছোটবেলার সেইসব নির্দোষ দিনগুলোর কথা। শৈশব ও কৈশোরের সেই দুরন্তপনার কথা। খেলার সাথীদের কথা। স্কুল থেকে ঘরে ফিরেই ঘুড়ি নিয়ে ছুটে যেতাম মাঠে। দৌড়াতাম কেটে যাওয়া ঘুড়ির পিছনে। খালে বিলে ঝাপাঝাপি করতাম। পানিতে থাকতে থাকতে গায়ের চামরা সাদা হয়ে যেতো। ফুটবল খেলতে গিয়ে মারামারি লেগে যেতো বন্ধুদের সাথে। আবার একটু পরই মিলমিশ করে নিতাম। কিছুতেই আঙুলের মাথায় মারবেল নিয়ে অন্য মারবেল ঠুকতে পারতাম না। বাড়ির পাশেই ছিল সি এন্ড বি রোড। সেখানে বিকেল হলেই প্রায়ই কাঠি দিয়ে সাইকেলের রিং চালাতাম। লাল কাপড়ে মোড়া মাটির হাড়িতে কুলফি মালাই নিয়ে এলে দৌড়ে যেতাম রাস্তায়। অথবা ঘটিগরম। চা-না-চু-ররর..। প্রায় সময় পয়সা থাকতো না বলে খেতে পারতাম না। মায়ের কাছে পয়সা চাইলে মা প্রায়ই দিতে পারতো না। দিতে না পারলে মা অনেক কষ্ট পেতেন মনে মনে। আমার বাবা ছিল না বলে সব আবদার ছিল মায়ের কাছে। কত কী করতাম। ভরা বর্ষার দিনে মামা বাড়িতে নৌকা নিয়ে মামাত ভাইদের সাথে চলে যেতাম দূরে দূরে কোথায়। কোনো মাঝি হয়ত খোলা গলায় গান ধরত..মন পাখী তুই আর কতকাল থাকবি খাঁচাতে.. ও তুই উড়াল দিয়ে যারে পাখী বেলা থাকিতে..। টেন্ডু পাতার বিড়ি টানতাম ফুক ফুক করে। তারপর খুক খুক করে কাশতাম। সেইসব ভাইদের সাথে কতকাল দেখাই হয় না। অথচ কত স্মৃতি জমে আছে। মামাতো ভাইবোনদের সাথে কত মধুর স্মৃতি আছে। তারপর প্রায় ৪২ বছর পর ২০২২ সালে স্মৃতির ঢাপরকাঠি গিয়েছিলাম। ভাবা যায়! অনেক স্থানই চিনতে পারছিলাম। নতুন জেনারেশন অবাক হচ্ছিল আমি এখনও এতোকিছু মনে রেখেছি দেখে!

একটু যখন বড় হয়েছি যখন বারো তেরো বছর বয়স তখনই মেয়েদের দেখলে কেমন লাগতো। সাইকেল চালিয়ে চলে যেতাম বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কলোনীতে। সেখানে ডাক্তারদের অনেক সুন্দরী মেয়েরা ছিল। মনে আছে মায়া নামে এক রুপসী ডাক্তার কন্যার প্রেমে পড়েছিল পুরো শহরের যুবকরা! মা আমাকে একটা ফনিক্স চাইনীজ বাইসাইকেল কিনে দিয়েছিলো। সেটাই দাবড়ে বেড়াতাম। লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খেতাম। সিনামায় যেতাম স্কুল পালিয়ে। চুলের স্টাইল করতাম রাজ্জাকের মতো। কবরী ছিল আমার প্রিয় নায়িকা। চিত্রালী পত্রিকা থেকে কবরীর ব্লাক এন্ড হোয়াইট ছবি কেটে বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখতাম। সেইসব বিশেষ ভঙ্গিমার ছবি দেখে ওই বয়সেই বড়ই কাতর হয়ে পরতাম।

বিদেশে থাকলেও চেষ্টা থাকে প্রতি বছর একবার করে দেশে যাই। ২০১০ সালে মা মারা যাওয়ার এ দুই বছর আগে থেকেই বাড়িতে গেলে হোটেলে থাকা শুরু করি আমি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এ নিয়ে কারো মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম না। মা একটু হা হুতাশ করলেন বটে তবে সেটা তেমন জোড়ালো না। মা’র অবশ্য তেমন কিছু করার নেই। ছেলের সংসারে থাকলে মায়েদের তেমন দাম থাকে না। বাড়ির ছেলে বাড়িতে না থেকে কেনো হোটেলে থাকলো এ নিয়ে কেউ বিশেষ মাথা ঘামাল না। হয়ত ভেবে থাকতে পারে বিদেশ থেকে এসেছে তাই..। এমনকি আমি যে খেলাম না পর্যন্ত সে বিষয়টাও কেউ খেয়াল করলো না। তার মানে এই নয় যে এজন্য আমি খুব মন খারাপ করেছি বা সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। সব কিছুই আমি মেনে নিলাম। শুধু ভাবি মানুষ কত বদলে যায়!

জীবনে অনেক কিছুই আমাদের মেনে নিতে হয়। সভ্য সমাজের এটাই রীতি। অনেক বঞ্চনা, অবহেলা আর হঠকারিতার মুখোমুখী হতে হয় প্রতিনিয়ত। জীবনের অনিবার্যতাকে সবসময় খন্ডন করা যায়না। প্রতিরোধ করা যায়না সব দুষ্কর্মকে। এসব মেনে নিয়েই এই আমাদের বেঁচে থাকা। আগের লেখায় বলেছি মানুষের চরিত্রের প্রধাণ গুন হচ্ছে তার রহস্যময়তা। এই রহস্যময়তার ঘেরাটোপ ছিন্ন করে কারো মনের প্রকৃত সন্ধান পাওয়া সত্যি দুঃসাধ্য একটি কাজ। কিন্তু তবুও আমাদের অবচেতন মন সবসময় রহস্যময়তার কারণ অনুসন্ধান করে ফেরে। যতক্ষণ না এর কারণটা খুঁজে পাওয়া যায় ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ সম্পর্কে একটা অস্পষ্টতা থেকেই যায়। এ এক কঠিন খেলা। আমার কাছে পুরুষের চেয়ে নারীর রহস্যময়তা বেশী আকর্ষণীয় মনে হয়। রহস্যময়তা সবার মধ্যে থাকলেও নারীর রহস্যময়তা অধিক আকর্ষণীয়। সত্যি বলতে গেলে পুরুষের মধ্যে কতগুলো মৌলিক গুনাবলী ছাড়া বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট নেই। তাদের মন সহজেই পড়ে নেয়া যায়। কিন্তু নারীর মনের প্রগাঢ় রহস্যময়তা এক বিস্ময়কর উপাদান হিসাবে প্রতিভাত হয়।

প্রত্যেক  নারীই আকর্ষণীয়। একেক জনের আকর্ষণ একেকভাবে বিকশিত হয়। নারীর হৃদয়ের স্পন্দন বুঝতে হলে চাই তাদের প্রতি ভালবাসা এবং তার অবস্থানকে মূল্য দেয়া। ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনোদিন কোনো নারীকে অশ্রদ্ধা বা অবহেলা দেখাইনি। এমনকি বেশ্যাদের প্রতিও আমার সহমর্মিতা আছে। একজন নারী শুধু তার শরীরটুকুতেই শেষ নয়, এর বাইরেও সে আরো অনেক কিছু। একথা বেশীরভাগ নারী-পুরুষ ভালো করে উপলব্ধি করেনা। বেশীরভাগ পুরুষের ধারনা নারী  ব্যক্তিগত সম্পদ। আবার অনেক নারীর ধারণা পুরুষরা তাদের সাথে শুধু প্রেমের খেলা খেলতে চায়। কারো কারো ধারণা পুরুষের মনোরঞ্জন করাই নারীর একমাত্র কাজ। অনেকে নারী পুরুষ সম্পর্কটাকেই জটিল মনে করে। একথা ঠিক যে নারী পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। কাউকে বাদ দিয়েই কেউ পূর্ণ নয়। নারীকে মহিয়ান করেছে পুরুষেরাই, তার গুনকীর্তন করে রচনা করেছে অসংখ্য মাহাকাব্য। আজও তা থেমে নেই। প্রকৃতিই নারীকে অপার সৌন্দর্য দিয়ে তৈরী করেছে। নারীর পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছে কত রাজা মহারাজা। নারীর রূপের মধ্যেই সব শেষ একথা যারা মনে করে তারা আসলে নারীকে জানেনা। এর বাইরেও নারী অনেক কিছু। এই অনেক কিছুই নারীকে বিশিষ্ট করেছে, স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে। নারীকে কখনও আমার দুর্বল বা কম বুদ্ধিমান মনে হয় না। তারা অনেক দিক থেকেই পুরুষের চেয়ে এগিয়ে। নারীর প্রধান যে বৈশিষ্ট্য তার রহস্যময়তা সেটা পুরুষের মধ্যে নেই।

বরিশাল বিএমন কলেজে যখন পড়ি একদিন ক্লাসের একটি মেয়ে আমার হাতে একটা কাগজ গুজে দিয়ে বলল, ঘরে গিয়ে পড়ো। আমি সেদিন কিভাবে যে ঘরে পৌঁছে ছিলাম জানি না। কখন পড়ব সেই চিঠি! কি আছে সেই চিঠিতে!! সেটা ছিল সাধারণ কয়েক লাইনের একটা চিরকুট। কিন্তু তার আবেদন ছিল অসাধারণ। আমি সেদিনই সেই মেয়ের প্রতি এমন আকৃষ্ট হলাম! ‘প্রেম’ শব্দটা নিয়ে আমার মধ্যে প্রবল একটা দ্বন্দ্ব আছে। আমি যখন নিজেকে এই প্রশ্ন করি তখন আমার মধ্যে একটা দ্বিধার দেয়াল এসে আড়াল করে দাঁড়ায়। তবে সেই মেয়ের জন্য আমার যে একটা প্রচন্ড হৃদকম্প তৈরী হয়েছিল সেটা ছিল একটা ভূমিকম্পের মতো ঘটনা! একেই কী বলে প্রেম! আমি আসলে প্রেমের সংজ্ঞা ভালো জানি না। না হলে কতজনইতো আমাদের বলে ’ভালবাসি’ কিন্তু কেনো হারিয়ে যায় ভালবাসা। সেই মেয়ের কথা আগে বলেছি।

আমার আসলে কোন কিছু হওয়ার কথা ছিলনা। ছোটবেলায় স্কুলে যখন ’এইম ইন লাইফ’ রচনা লিখতে দিত তখন আমি বিরাট সমস্যায় পড়ে যেতাম। অনেকেই লিখত ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনয়ার হবে, পাইলট হবে। কিন্তু আমি কোনদিন এসব লিখিনি। কারণ তখনও আমি জানতাম না আমি কি হব, কি হতে চাই। আমার জীবনের লক্ষ্যটা ঠিক ছিলনা। আজও না। এখন বিদেশে এসে কিছুটা হলেও সান্তনা পাওয়া যাচ্ছে যে তখন জীবনের লক্ষ্য ঠিক ছিল না বলে ভালই হয়েছে। যদি কিছু হয়ে যেতাম ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার তাহলে বিদেশ এসে সেটা যদি ধরে রাখা সম্ভব না হতো! কতজনইতো তা পারে নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন মাছের ব্যবসায়ী, ডাক্তার হয়েছেন কমিউনিটি ওয়ার্কার, ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন ট্যাক্সি চালক বা সাংবাদিক হয়েছেন সিকিউরিটি অফিসার! জীবনের প্রয়োজনে, বাঁচার তাগিদে মানুষ তার পেশার পরিবর্তন করতেই পারে। বড় বড় স্বপ্নের সওদাগরদের এই স্বপ্নভঙ্গের জন্য আমার খারাপ লাগে। আরো খারাপ লাগে আমার মায়ের জন্য। আমার মাও চেয়েছিলেন কিছু একটা হই আমি। কিন্তু মায়ের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। আমি কিছু হতে পারিনি। লেখার শেষে ’প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক’ কথাটা  দেখতে খারাপ লাগেনা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে নেশার জন্যই এসব করা। নেশার জন্য মানুষ কি না করে। তবে লেখালেখির একটা ভাল দিকও আছে। আমরা যারা একত্রে  স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম সেই সব হারানো বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ ঘটে যায়! ওরা বিস্মিত হয়ে জানতে চায় আমি কি সেই! এছাড়াও নানাভাবে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়। চমৎকার চমৎকার সব মেয়েদের অনুভূতিগুলো শেয়ার করা যায় যারা আমার লেখা পড়তে পছন্দ করে।

আমার সুবিধা হচ্ছে আমি সহজেই মুগ্ধ হই। বিস্ময়বোধটা আমার পিছু  ছাড়েনি। মানুষের কিছু কিছু গুনাবলী সত্যি মুগ্ধ হওয়ার মতো। লিখেছেন তিনি আজকাল সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে পারেন না। এমনকি আমাকেও পুরোপুরি আস্থায় আনতে পারছেন না। সেটা আমি বুঝি। আমার ধারণা মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানোটা অতি দুঃখে ঘটে। নানা কার্যকারণে মানুষ একে অন্যের প্রতি আস্থা হারায়। তারপর মানুষ একদিন একাকী হয়ে যায়। সেই চমৎকার মানুষটির জীবনও একাকীত্বের। এক একটি স্বপ্ন বুকে ধারণ করে মানুষ বেঁেচ থাকে। তারও একটি স্বপ্ন আছে। মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাসের ভীতটা তৈরী হয় খুব ধীর গতিতে। কোনভাবেই একজন মানুষ অন্যের উপর পুরোপুরি আস্থা অর্জন করতে পারে না। একধরণের রহস্যময়তার ঘেরাটোপে নিজেকে বন্দি করে রাখে। নিজেকে মেলে ধরতে পারে না। আস্থাহীনতায় ভোগে। বঞ্ছিত করে নিজেকে। অবশ্য এরকম হওয়ার পিছনে অনেক কার্যকারণও থাকে। তারপর একদিন সে নিঃস্ব হয়ে যায়। এটাই মানুষের নিয়তি। সে কিছুতেই নিজেকে নিজের মতো গড়তে পারে না। নিজের চাওয়াটাকে বাস্তব করতে পারে না। নিজের মতো করে আনন্দ উপভোগ করতে পারেনা। অনেক সীমাবদ্ধতা তাকে কুড়ে কুড়ে খায়। আসলে অন্যকে বিশ্বাস করার মতো উদারতা অল্প মানুষের মধ্যেই দেখা যায়।

শৈশবের কথা মনে পরলে কেমন মন খারাপ হয়ে যায়। তখন থেকেই আমার মধ্যে একটা শূন্যতা তৈরী হয়ে ছিল। সেই শূন্যতাটা আজও আছে। আমি এখনও কোলাহল থেকে দুরে থাকতেই পছন্দ করি। আমি আসলে একসঙ্গে অনেক কিছু নিতে পারি না। আমার জগৎটা ছিল বরাবারই খুব ক্ষুদ্র। এখনও। একা একা ঘুরে বেড়াতাম বনে জঙ্গলে। গাছেদের সাথে কথা হতো। কথা বলতাম পাখীদের সাথে। মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়াতাম। বরশি দিয়ে মাছ ধরতাম নিভৃতে। জোনাকী আর প্রজাপতির পিছু নিতাম। আমাদের বাড়ির পিছনে ছিল বিশাল জঙ্গল। তার মধ্যে একা একা ঘুরে বেড়াতাম আর রাজ্যের সব ফল কুড়াতাম। ছুটতাম কেটে যাওয়া ঘুড়ির পিছনে। মারবেল নিয়ে খেলতাম। সাইকেলের রিং নিয়ে রাস্তায় দৌড়াতাম। বিয়ারিংয়ের গাড়ি বানিয়ে চালাতাম। সিগারেটের কাগজ দিয়ে চাড়া খেলেছি। বাই সাইকেল চালাতে গিয়ে হাত পা ছড়ে গেছে কত। আমার বাবা মারা গিয়েছেন আমার দুই বছর বয়সে। মাই আমার সব ছিল। কিন্তু আমি বহু দিন ধরে মায়ের কাছ থেকে দূরে দূরে থেকেছি। বড় হয়ে জেনেছি মায়ের এ অহিংস ধারণাটা ঠিক না। শিখদের একটি প্রবাদ আছে ’কেউ যদি তোমাকে অন্যায়ভাবে এক গালে একটি চড় মারে তুমি তার অন্য গালে চারটি চড় মেরো’। এখনও অন্যভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হই। কিন্তু পাল্টা আঘাত আর দেওয়া হয় না। মায়ের জন্যই পারি না। অনেক কিছুই আমার হতে ইচ্ছে করতো। আর যেকোন সুন্দর মেয়ে দেখলেই আমি খুব উদাস হয়ে যেতাম। পৃথিবীর তাবৎ সুন্দর মেয়েগুলো আমার কেনো হবে না এটা মনে হোত একসময়। এসব ভাবলে কেমন সব গন্ডগোল হয়ে যায়। হায়রে জীবনের কতগুলো সময় পার হয়ে এলাম। কিছুইতো করা হলো না, পাওয়া হলো না! এখনও জীবনের লক্ষই যে ঠিক হয়নি! এইম ইন লাইফ!!

স্মৃতি ছাড়া মানুষের আর কিইবা আছে! ছোটবেলায় মার সাথে যেতাম ঢাপরকাঠি নামক এক অজগ্রামে। মামা বাড়ি। ভরা বর্ষার দিনে মাঠ ঘাট পানিতে টৈ টুম্বুর হয়ে যেতো। ঘোলা পানিতে মাঠ ঘাটকে মনে হতো সাগর। বড় বড় ঢেউ উঠতো। সন্ধ্যা নদীর পানির এমন স্রোত ছিল যে দেখলে বুক কেঁপে উঠতো। আমার যখন বাড়ির জন্য খুব মন খারাপ হতো তখন নদীর তীরে এসে বসে থাকতাম। দুপুরের দিকে একটা লঞ্চ ভোঁ দেয়ে এসে ঘাটে ভিরতো। বরিশাল-পটুয়াখালীর মধ্যে যাতায়াত করতো এই লঞ্চ। কিছু নারী পুরূষ লঞ্চ হতে নামতো আর কিছু উঠতো। তারপর কোথায় উধাও হয়ে যেতো নদীর বাঁকে। অনেকক্ষণ ধরে লঞ্চের ইঞ্জিনের গুম গুম শব্দ কান পেতে শুনতাম। শব্দটা মিলিয়ে গেলে একধরণের হাহাকার বুকের মধ্যে বেজে উঠতো। ওই লঞ্চটার আসা যাওয়ার মধ্যেই বাড়ির সাথে একটা গোপন যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। মা আমাকে একা একা যেতে দেবে না জানি; আবার বাড়িতে রেখে এসেছি খেলার সাথীদের। তাদের জন্য মন খারাপ হয়। কিন্তু ছোটদের কথা কেউ বুঝতে চায় না। বড়রা কখনো ছোটদের মন বোঝে না।

সন্ধ্যা নদীর সাথেও আমার অদ্ভুৎ এক সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। অন্যে যা করতো আমার অবচেতন মন তাই করতে চাইত। ছোটবেলায় স্কুল পালিয়ে খুব সিনেমা দেখতাম। কবরী ছিল আমার খুব প্রিয়। মনে মনে ভাবতাম আহারে কবরী এত সুন্দর কেনো! পরবর্তীকালে কবরীর ভুবনভোলানো হাসি নিয়ে অনেক লেখা লিখেছি। তখন কবরীকে নিয়ে আমার অনেক  স্বপ্ন ছিল। আসলে সুন্দর কিছু দেখলেই আমার মন কেমন করে। কত কি যে ভর করতো মনে। আমি বরাবর একটু ইন্ট্রোভার্ট। সহজে কারো সামনে যেতে বা কিছু বলতে  পারি না। নিজের জন্য পারি না কিছু চাইতে। এজন্যে আমার কিছু হয়নি। আমাকে বোঝে এ রকম একজন মানুষও আমি পাইনি। আমাকে বোঝা যেকোন মানুষের জন্য একটু কঠিন বটে।

আমি স্কুলে বার্ষিক খেলাধুলায় কোনদিন একটি পুরষ্কারও পাইনি। আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিল ভাল হা ডু ডু খেলোয়ার হবো। খেলেছিও। কিন্তু অন্যদের মতো পারিনি। হতে চেয়েছিলাম ফুটবল প্লে­য়ার এবং দৌড়বিদ। দৌড় প্রতিযোগিতায় আমি বরাবার শেষের দিকে থাকতাম। আমার স্পিড ছিল খুবই কম। আজও। সেজন্য সামনের দিকে এগোনো হলোনা। হাইজাম্প লংজাম্প খেলতে গিয়ে স্থায়ীভাবে ব্যাকপেইন হয়ে রইল। ছোটবেলায় মার সাথে মামা বাড়িতে গিয়ে থাকতাম বছরে দু’মাস। আমাদের প্রচুর ধান আসতো তখন গ্রাম থেকে। মা যেতেন তদারকি করতে। তখন একবার কৃষক হওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল। তখন স্বপ্ন দেখতাম বড় হয়ে গ্রামের ঘোমটা টানা কোন মেয়ের সাথে আমার বিয়ে হবে। আমি হব আদর্শ কৃষক। কৃষকের স্ত্রী সকালবেলা সানকিতে পান্তা ভাত নিয়ে আসবে আমর জন্য ক্ষেতে। আমি পান্তা ভাতের সাথে কাঁচামরিচ ডলে সেই ভাত খাব। সাথে থাকবে  ক্ষেতের টাটকা সবজী আর পুকুরের মাছ। শীতের সকালের সেই জমাট বাধা তরকারির স্বাদই আলাদা।

ধানের আটি মাথায় নিয়ে ঘরে ফিরবো বেলা বাড়ার সাথে সাথে। ধান মারাতে গরুর পিছনে ছুটেছি কত। রাতে সিদ্দ ধানের ভিতরে টং বানিয়ে ওম ওম বিছানা পেতে মাঘের শীতে ঘুমিয়েছি। নৌকা বাইয়েছি খালে বিলে। গ্রাম দেশে বড় বড় তাল গাছের খোল দিয়ে ডোঙ্গা তৈরী হতো। সেগুলো বাইয়েছি। প্রায়ই তাল রাখতে না পেরে উল্টে পড়ে যেতাম পানিতে। চিনে জোকে ধরতো। সাপ আর চিনে জোক আমি খুব ভয় পেতাম। এখন অবশ্য মানুষ নামক প্রানীটিকে এই দুটোর চেয়েও অধিক ভয় পাই। কোন কোন মানুষ দেখলে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। আবার কাউকে দেখলে আনন্দে মন ভরে যায়।

পুকুরে ডুবে ডুবে মাছ ধরেছি। কলার ভেলার উপর দাড়িয়ে ঝাকি জাল ছুড়েছি পানিতে। শীতের বিকেলে ধান উঠে যাওয়া জমিতে খেলেছি গ্রামের আমার ভাইবোনদের সাথে। কাঁচি দিয়ে নাড়া কেটেছি। মাঝে মাঝে লুকিয়ে পাতার বিড়ি টেনেছি। নাড়া জ্বালিয়ে আগুন পোহায়েছি। শীতের কুয়াশা ভরা সকালে বিড়ির ধোঁয়া সত্যি অসাধারণ।

শনিবার  হলে ছোটা মামার সাথে কলস কাঠির হাটে যেতাম। বিশাল বড় সে হাট। কত কি পাওয়া যেতো। মামা কত কি আমাকে কিনে দিত। প্লাস্টিকের খেলনা, লজেন্স। একটা খাবার খুবই সুস্বাদু ছিল মনে আছে, সেটা হলো মিষ্টি মুড়ি আর ঘোল। আহা কি সে স্বাদ! একবারের একটা ঘটনা কোনদিন ভুলবো না। ছোট মামার সাথে হাট থেকে ঘুরতে ঘুরতে বাড়িতে এসে পড়েছি। তখন রাত হয়ে গেছে। নৌকায় কলস কাঠির হাট থেকে যাওয়া আসা করতে ঘন্টা চারেক লাগে। বাড়িতে পৌঁছে মামা দেখলো আমার হাতের মুঠোয় একটা পিঁয়াজ বা আলু জাতীয় কিছু। আমি কোন দোকান থেকে নিয়ে এসেছি। মামা করলেন কি, আবার আমাকে নিয়ে গেলেন সেই রাতে কলস কাঠির হাটে। এবং যে দোকান থেকে আমি জিনিসটা এনেছি সেই দোকানে সেটা ফেরত দিয়ে এলেন। এই ঘটনাটা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। আহা সে এক অপূর্ব জীবন ছিল। সেই দিনগুলো আর ফিরবে না। এরকম হাজারো কান্ড করেছি এবং সেসব স্থায়ী করতে চেয়েছি জীবনে। কিন্তু কিছুই হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়েও  বন্ধুরা মিলে দিনভর টিএসসি আর লাইব্রেরী চত্বরে আড্ডা মেরে আর মেয়ে দেখেই সময় কাটাতাম। বিকেল হলে অনুরোধের আসরে দাড়িয়ে যেতাম রোকেয়া বা শামসুন্ন্হার হলের গেটে। বন্ধুদের কাছ থেকে ফাও ডাসের ফুসকা আর চটপটি খাওয়ার জন্য। কিছু স্যারদের সাথে একত্রে ধুমপান করতাম। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে পুলিশের পিটুনিও খেয়েছি। পুলিশের ছোড়া টিয়ার গ্যাস উল্টো ছুড়ে মারতাম পুলিশের দিকে।

একসময়  যখন দেখলাম কিছু বন্ধুরা বেশ নেশা টেশা করে তখন আমার ইচ্ছে হয়েছিল নেশাখোর হলে কেমন হয়! কিন্তু তেমন সফলতা নেই এ লাইনে। প্রতিবারই ব্যর্থ। নেশারুরা আমাকে তেমন পাত্তা দিলনা। তবে এ বিষয়ে মজার মজার সব ঘটনা আছে। আজকের নামকরা অনেক লেখক সাংবাদিক আমার পার্টনার ছিল।

চুরি করতে গিয়ে প্রতিবার ধরা পরেছি। আমাদের বাড়িটা ছিল বিশালাকৃতির। চারিদিকে ঘন জঙ্গল আর ঝোপঝাড় ভরা ছিল। রাতে আমরা সমবয়সীরা মিলে নারকেল আর খেজুরের রস চুিরর অভিযানে নামতাম। অন্যেরা পালাতে পারলেও আমি বেশ কয়েকবার ধরা খেয়েছি। এসবের পাশাপাশি ঘুড়ে বেড়ানোর একটা নেশা গড়ে উঠে আমার মধ্যে। ওই একটা জিনিস এখনও আমাকে ছেড়ে যায়নি। কারণ ঘোরাঘুরির মধ্যে একধরনের পলায়নপরতা আছে। নিজের র্ব্যথতাগুলোকে ঢাকার জন্য দূরে সরে থাকা। যখনই কোথাও গিয়েছি কেউ না কেউ জুটে যেতো সঙ্গি। না চাইলেও। একসময় লটারী খেলা শুরু করলাম। যদি লাইগ্যা যায়। লটারীর ভাগ্য যাচ্ছেতাই খারাপ আমার। কোনদিন কোন লটারীতে আমি কিছু পাইনি। বড় বড় অনেক যায়গায় ক্যাসিনোতে খেলার অভিজ্ঞতা আছে। জানি ভাগ্যের শিঁকে ছিঁড়বে না তবুও।

জসিম মল্লিক, লেখক ও সাংবাদিক

টরন্টো